৮
গত দু-দিন নীলার বেশ ব্যস্ততা গেল। আজ কিছু একটা কিনে দিপু ভাইকে দেখতে যাবে। সকাল থেকে ভাবছে— কী দেয়া যায়? শেষতক কয়েকটা বিনোদন-ধর্মী ম্যাগাজিন কিনে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
‘মা— বিকেলের দিকে দিপু ভাইকে একটু দেখে আসি।’
‘আয়...’
‘এর মধ্যে তোমার আর ফোনে যোগাযোগ হয়নি?’
‘না রে, ফোন করা উচিত ছিল।’
‘চলো-না আমার সঙ্গে?’
‘তুই দেখে আয়, আমি পরে এক সময় যাব।’
সূর্যের গায়ে রঙ ধরেছে আমের মতো। টসটসে রসের ভারে আকাশের ডাল থেকে গড়িয়ে পড়বে যখন তখন। রাস্তায় রাস্তায় ছায়ারা— দৌড়ে পার হচ্ছে, লম্বা লম্বা পা ফেলে। নিজের ছায়া দেখে নীলার মনে হল— দেহকে একা ফেলে, বারবার মস্তকটি কোথায় যেন লুকোতে চাইছে।
নীলা ধীর পায়ে এগোতে থাকে। রোদের ঝাঁঝ নেই আর। গেট ভেজানো ছিল, ঢুকে গেল সহজে। দিপু বারান্দায়— ঘুম শেষ করে একা— চা এর অপেক্ষায়।
‘আরে নীলারাণি যে! কেমন আছো?’
‘ভাল— আপনি কোথায়?’
‘ওপরে, বারান্দায়, চলে এসো; দরজা খোলা আছে...বন্ধ কোরো না, মঙ্গল ভাই দোকানে গেছে।’
‘কেমন আছেন?’
একে অন্যকে দেখে খুশি হয়ে উঠল।
‘এই যে... মোড়াটা নিয়ে এসো।’ ইশারা করল দিপু।
‘তা ডাক্তার, আমি তো ডাক পাঠাইনি...’
‘কেন, খুশি হননি?’
‘আমি জানতাম আসবে।’
‘তাই তো চলে এলাম।’
‘বাঃ তুমি দেখছি মনের ডাক্তার হয়ে গেছ... হা হা হা।’
মঙ্গল চলে এসেছে। নীলাকে দেখে ঘাড় একদিকে কাত করে হাসল। নীলাও ঘাড় কাত করল সহাস্যে।
‘চা খাবে তো?’
আবারও ঘাড় কাত করল নীলা। এবার মঙ্গল বলল, ‘কী ব্যাপার নীলা, তুমি কি বোবাদের কলেজে ভর্তি হয়েছ?’ নীলা শিশুদের মতো ডানে-বামে মাথা ঘুরিয়ে হেসে ফেলল।
‘লিকার ছাড়া চা, নাকি সহ?’
‘লিকার ছাড়া চা মানে!’ নীলা চোখ পাকাল।
‘না-আ, সুন্দরীরা আবার কালো হয়ে যাবার ভয়ে চা খায় না তো, তাই...’
একসাথে সকলে হেসে ওঠে। মঙ্গল ভেতরে চলে যায়।
হাতের ম্যাগাজিনগুলো এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনার জন্য...’
নেড়েচেড়ে দিপু বলল, ‘দারুণ! তুমি-না নীলা, সত্যি সত্যিই মনের ডাক্তার... যদিও আমি এসব হালকা পত্রিকা পছন্দ করি না, কিন্তু ক-দিন ধরে এসবই পড়তে মন চাইছে।’
‘গতকাল থেকেই ভাবছি, আপনার জন্য কী আনা যায়, শেষ-মেষ এ-ই-ই নিয়ে এলাম।’
দিপু খুশি হয়েছে দেখে নীলা উচ্ছ্বসিত। উচ্ছ্বাস গোপন করতে না পারায়, লজ্জায় একটু রাঙা হল, আবার ভাবল, ‘... না হলে অহঙ্কারী ভাবত... নিজেকে নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করার এত চেষ্টা করেও পারি না...’ নীলার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।
‘তোমার পড়ালেখা কেমন চলছে?’
দিপুর প্রশ্নে হেসে ফেলল, ‘ভাল— আচ্ছা দিপু ভাই, মঙ্গল ভাই লোকটি আপনার কী হন? ভাবিকে নাম ধরে ডাকে দেখেছি।’
‘ও, আমার দোকানের ম্যানেজার; খুবই বিশ্বত— বাইরে মাল দেয়া বন্ধ করার পর, সব সে-ই চালায়। আর ইদানীং আমাকে দেখা-শোনা করছে। তোমার ভাবিদের বাড়ির পাশাপাশি বাড়ি। একই বংশের ওরা।
‘এবার বলুন আপনার শরীরের কী অবস্থা?’
‘এতক্ষণে তোমার জানতে ইচ্ছে হল?’
‘যদিও আপনাকে দেখতেই এসেছি, কিন্তু ইচ্ছে করেই কথাটা আপনাকে বলিনি। অসুখের কথাটা আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাইনি।’
‘ডাক্তার হয়ে উঠছ, ওরাও তাই বলে, আপনার কিচ্ছু হয়নি, অসুখের কথাটা ভুলিয়ে রাখতে চায়।’
‘উঁহু... কথায় কথায় ডাক্তার বলে, খোঁটা দেবেন না তো!’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে।’
দিপু একটা ম্যাগাজিন পেঁচিয়ে গোল করে পাইপ বানাল, তার ফুটোর মধ্য দিয়ে ডান চোখে তাকাল নীলার দিকে। মঙ্গল মুড়ি-ভাজা নিয়ে এল। পেটে সুড়সুড়ি-দেয়া একটা ঘ্রাণ।
‘এটা খেয়েছ কখনও?’
এক-মুঠ মুড়ি হাতে উঠিয়ে নীলার উদ্দেশে ঝাঁকিয়ে বলল দিপু। নীলা কিছু না ভেবে, যন্ত্র-চালিতের মতো হাত বাড়িয়ে, দিপুর হাত থেকে নিয়ে, লাল হয়ে ওঠে। দিপুও একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়।
‘খুব মজা তো! কীভাবে ভাজতে হয়?’
‘খুব সোজা— আমার ভারি পছন্দ। প্রথমে তেল গরম করে, ঘি হলে শ্বশুর বাড়ির মতো’
‘শ্বশুর বাড়িতে প্রায়ই হত বুঝি?’
হাসল দিপু, ‘একটু কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ কুচি দিয়ে, মচমচে হবার একটু আগেই মুড়ি ঢেলে নাড়তে থাকো। মুড়ি ও পেঁয়াজ মচমচে হলে, চিনি ছড়িয়ে নেড়েচেড়ে আঠালো হয়ে এলে, নামিয়ে ফেল, একটু জিরে দিতে পারো, আর গরমাগরম খাও।’
‘বুঝতে পারছি রান্না-ঘর আপনার আয়ত্তে।’
‘তা কিছুটা বলতে পারো।’ মুচকি হাসল।
‘আপনার রিপোর্টগুলো আনতে বলুন-না?’
‘চা আনলে বলছি।’
মুড়ি খাওয়ায় দু-মিনিট মুখ ব্যস্ত রেখে, অতঃপর নীলা বলল, ‘দিপু ভাই ভাবির নাম্বারটা একটু দেয়া যায়? কথা বলতে...’ দিপুর দিকে তাকাল, এক পলকে। দিপু ওর সেলফোনে নাম্বারটা বের করে, নীলার দিকে এগিয়ে দিয়ে, মুখ বরাবর চেয়ে থাকে মলিনভাবে। অবশ্য নীলা নাম্বারটিতে মন দেয়ায় তা দৃষ্টি এড়িয়ে যায়।
বেশ সময় নিয়ে কথা বলতে লাগল। মাঝে-মধ্যে কথা বলতে বলতে একটু দূরে চলে যাচ্ছিল। দিপু কথা বলার ধরন থেকে বোঝার চেষ্টা করে কিছুই পেল না। ইশারায় চা দেখিয়ে কথা সংক্ষেপ করে আসতে বলে। নীলা হাত নেড়ে জানাল— প্রায় শেষ।
একটু চিন্তিত দেখানোয় জিজ্ঞেস করল, ‘কথা হল?’
কাপ তুলতে নিয়ে বলল, ‘আচ্ছা ভাবি কি আর এখানে আসবে না?’
দিপুকে গম্ভীর লাগছিল এতক্ষণ— নীলার কথায় এবার মুখটা একেবারে শুকনো হয়ে এল— ‘কেন কী বলল?’
গলা কেমন ভাঙ্গা শোনাল। তাকিয়ে থাকল, নীলার মুখে স্থির হয়ে। যেন ভয়ানক কিছু একটা শুনবে।
চুপ করে থেকে চা-য়ে চুমুক দিল ‘বুঝতে পারছি না, আপনার অসুস্থতার কথা বলায়, উত্তরে বলল, “অসুখ ভাল হলে আসব,” কথার মধ্যে কেমন একটু ব্যঙ্গাত্মক ভাবও ছিল।’
দিপু একটা ম্যাগাজিন নিয়ে পাতা ওলটাতে লাগল। শেষে বলল, ‘হতেই পারে, হয়ত কোন কাজ আছে— আমি ততদিনে সুস্থ হয়ে যাব, তাই ভাবছে।’
‘কথা সেটা নয়, আপনার বিপদে আসবে না সুখের সময় আসবে...? আচ্ছা আপনাদের মধ্যে মনোমালিন্য কী নিয়ে, শেয়ার করেছেন কারও সঙ্গে?’
দিপু তাকাল অবাক হয়ে নীলার দিকে। নীলা সঙ্কুচিত হয়ে গেল। ভাবল— ‘প্রশ্নটা করা বোধ হয় ভাল হল না।’ চোখ নামিয়ে নিল, দু-পায়ের পাতা পরস্পর ঘসতে লাগল।
‘নাঃ এসব বলা যায় নাকি? সুমি শুরু থেকেই একটু বেশি উত্তাপহীন। আমি অফিস থেকে ফিরে দেখতাম— রান্না বা বই নিয়ে। ওর অফিস আমার আগেই ছুটি হয়ে যেত।’
নীলা খেয়াল করল— দিপুকে একটু বলাতেই সব কথা বলা শুরু করে দিয়েছে। যেন বলার জন্য মুখিয়েই ছিল। গভীর আগ্রহে নীলা দিপুর কথা শুনতে লাগল— বাম হাত কোলে শুইয়ে, ডান হাত তার ওপর খাড়া করে, তালুর মধ্যে চিবুক উঁচিয়ে ধরল।
‘টিভির সামনে এলেও খুব কমই থাকত। বলতে গেলে আমাদের মধ্যে, তেমন কোন কথাই হত না। কখনও-সখনও ঘুমতোও আলাদা রুমে।’ (কিছুদিন হল কখনও-সখনও নয়, আলাদা রুমেই সে থাকত।)
‘বলেন কী!’
‘তাই...’
‘ভাবি কী বই পড়ে বা কী করে সময় কাটায় জানতে চাইতেন না?’
‘সুমি সাধারণত ধর্মবিষয়ক গ্রন্থগুলোই পড়ত। মাঝে মাঝে আমাকেও পড়তে দিত, তবে সেসব নিয়েও তেমন কোনও কথা হত না। আমাদের মধ্যকার দূরত্ব কমাতে বার কতক নিরিবিলি বেড়াতে নিয়ে গেছি। পৌঁছেই বলা শুরু করত “চলো বাড়ি যাই।”
ডান কাঁধে মুখ গুঁজে মেঝের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার বলতে শুরু করল, ‘মনে হত আমার সঙ্গে কথা না বলতে পারলেই যেন বাঁচে! তখন মেজাজটাই যেত বিগড়ে।’
‘ভাবি আসলে একশ বছর আগে জন্মালে ঠিক হত। তখন নাকি স্বামী-স্ত্রীতে দরকার ছাড়া কথা হত না।’
‘এর পেছনে কারণও আছে, তখন বেশির ভাগ পরিবারই যৌথ পরিবার ছিল, কথা বলার সুযোগ কোথায়? কাজ আর বাড়ি ভর্তি মানুষ...’ দিপু নিরস কণ্ঠে জবাব দেয়।
‘কারণ আরও ছিল ভাই, সে সময় স্ত্রী স্বামীর চেয়ে বার-চোদ্দ বছরের ছোট থাকত, তাই তারা স্বামীকে একটু ভয়ও করত, জীবন সম্পর্কে তার তুলনায় স্বামীর অভিজ্ঞতা বেশি, খুব স্বাভাবিক কারণেই সে গুরুত্ব পেত। আবার বয়সের জন্য শ্রদ্ধাও করত— বড়দের সম্মান করা তো আমাদের মজ্জাগত।’
নীলার যুক্তি উপস্থাপন দেখে, মুগ্ধতা আর সম্মানের চোখে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে। ভাবল মেয়েটা বড় হয়ে গেছে। নীলা একটু আড়ষ্ট হয়, বলে— ‘এতকাল শুনে এসেছি স্বামীরা স্ত্রীদের সময় দেয় না, তাই নিয়ে যত অভিযোগের পাহাড়, আপনার বেলায় উলটো...’ মুচকি হাসল সে।
‘আমার কী মনে হয় নীলা— কম-জানা-মানুষ ধর্মভীরু হলে একটু স্বার্থপর হয়ে যায়। শুধু নিজের ভালটাই চিন্তা করে। কী করলে স্বর্গে পৌঁছানো সহজ হবে, সেই চিন্তায় মশগুল থাকে। আশেপাশে, আত্মীয় যারা আছে— তাদের ভাললাগা মন্দলাগা সম্পর্কে একেবারেই উদাসীন হয়ে যায়। তারা গরিবকে সাহায্য দেয় নিজের জন্য, পরকালের সঞ্চয় বাড়াতে, তাকে সহায়তা করার চিন্তা থেকে দেয় না। নিজের স্বার্থের বেলায় একটুও ছাড় দিতে রাজি নয়। তার আচরণের ফল স্বরূপ স্বধর্মের লোক যে অন্যগ্রামে বা অন্যদেশে বিপদে পড়তে পারে বা তার পরিবারও বিব্রত হতে পারে, ওতে তার কিছুই যায়-আসে না।’
‘দিপু ভাই আপনি বলছেন বক-ধার্মিকদের কথা— ধর্মে বরং বলা আছে আত্মীয়দের প্রতি সদয় হওয়ার জন্য। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি কেমন আচরণ করবে তার কথা কি বলা নেই? আপনার নিজের জীবনের ঘটে যাওয়া, ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে, সব কিছু বিচার করছেন...’
দিপু হাসতে হাসতে বলল, ‘সবাই কি তাই করে না?’ — ঘাড় কাত করে সোজা নীলার চোখে চোখ রাখল।
নীলা যেন সামান্য বিব্রত হল— ‘না মানে বলতে চাইছি... আসলে ঠিকই আছে... সবার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক তা নয়... আমি অবশ্যই বলব, ভাবি ধার্মিক নয়, বক-ধার্মিক। ঘরে অসুস্থ স্বামী, সেদিকে কোনও...’
কথাটা শেষ করল না— ‘মাপ করবেন আমায়।’
দিপু হেসে ফেলল— ‘এত উত্তেজিত হচ্ছ কেন?’
নীলাকে ঠাণ্ডা করার চেষ্টায় দিপু বলল, ‘আমি কিন্তু ব্যাপারটা একটু অন্যভাবে দেখি। একটা মানুষ যদি সব সময় কারও নির্দেশে চলে, সে কোনও মতবাদ বা রাজনীতির নির্দেশই হোক বা যাই হোক — “... এই করো, এই কোরো না।” তখন সে কিন্তু বিবেক দ্বারা তাড়িত হবে না, যুক্তি, চিন্তার ধার ধারবে না। পরিণামে তার মধ্যকার, সূক্ষ্ম মানবিক বোধগুলো ধীরে ধীরে লোপ পাবে। অথবা গড়ে ওঠার কোনও সুযোগই পাবে না। এক সময় সে পরিণত হবে, এক ভদ্র-রোবটে। আমাদের সমস্যাটি কী জানো নীলা? ধর্মান্ধরা— হেসে যোগ করল— কেউ কেউ, তোমার মতো যারা তারা বাদে— মনে করে “আমরা শুধু উপদেশ দেব, আর অন্যরা কেবল তা পালন করবে।” সাধারণ মানুষ তার আশেপাশে যারা আছে, কোনও বিষয়ে তাদের পরামর্শ দিতেও ভয় পায়— ভাবে যদি অধর্ম হয়। সমালোচনার মুখোমুখি না হওয়ায়, নিজেকে সর্বদা সঠিক মনে করে, তারা নিজেদের খুব শক্তিশালী মনে করে, ভিন্ন-মতকে অশ্রদ্ধা করতে শুরু করে— এক সময় মৌলবাদের জন্ম হয়। ...একটা সমাজের বেশিরভাগ মানুষ যদি সচেতন হয়, তাহলে আর কাউকে গুরু মানার প্রয়োজন পড়ে না। তখন অন্ধ অনুসারী তৈরিও হবে না। আমরা নিজে পড়ে দেখি না, ভাবি না, বোঝার চেষ্টা করি না— সহজ রাস্তা ধরি গুরু কী বলে... এটা এমন এক সমস্যা যে মানুষের স্বাভাবিক বোধটুকুনও নষ্ট হয়ে বসে। গরুকে মা মা বলে পুজো করে গরুর জন্য দাঙ্গা লাগাই—আবার সেই মা মরে গেলে মৃতদেহ সরানোর জন্য অস্পৃস্যদের ডাকি। একটুও খটকা লাগে না। আবার আমরা যারা বুদ্ধিবাজি করি, তালেবানের অপকর্মের মধ্যে শ্রেণিসংগ্রাম খুঁজে বেড়াই।’
‘সমালোচনা করতে না পারলে ভিন্নমত আসে কোথা থেকে? স্ববিরোধিতা হয়ে গেল না? যত দোষ নন্দ ঘোষ— কমিউনিস্টরাও কি তাই বলে না? বিবেক, মানবতা শব্দগুলো শুনলে তাদের গা জ্বলা শুরু হয়— সুবিধাবাদের গন্ধ পায়।’
‘তাই কি?’
‘তাই— আমি নিজের কানে শুনেছি— প্রখ্যাত এক বাম ছাত্রনেতার মুখ থেকে।’
দিপু কিছুক্ষণ নীলার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল, সহমত পোষণ করল, না প্রতিযুক্তি খুঁজে পেল না, তা ঠিক বোঝা গেল না।
‘আপনার বিপক্ষেও কিন্তু যুক্তি আছে—ওই যে বললেন নিজেই জেনে নিলে গুরুর প্রয়োজন...’
‘যেমন?’
‘যেমন— পথপ্রদর্শক বিভ্রান্ত করতে পারে, সহযোগিতাও তো করতে পারে। কেবলই নিজে নিজে জানতে গিয়ে দেখা গেল একটি বিষয়ে হয়ত সে পরিষ্কার নয়, তো তখন সে কী করবে? আশে-পাশে যারা আছে তার শরণাপন্ন হবে, তাতে ভুল ব্যাখ্যার আশংকা থেকেই যায়। ভিন্নমত সমাজকে যেমন এগিয়ে নিতে অবদান রাখতে পারে, বিশৃঙ্খলা তৈরিতেও তার জুড়ি নেই।’
‘হু, অবস্থা দেখছি গোলমেলে...’
নীলা হেসে প্রশ্ন করল, ‘দিপু ভাই আপনি আস্তিক না নাস্তিক?’
গুমোট পরিবেশটা একটু যেন দূর হল মনে করে, দু-হাতের আঙ্গুল উলটো করে সামনে লম্বা করে মটকাল আনন্দে।
‘আমি বাম-ঘেঁষা তাই প্রশ্নটা করলে। বিজ্ঞান সম্পর্কে আমার জ্ঞান সীমিত, আর সকল ধর্মগ্রন্থ এখনও পড়া হয়ে ওঠেনি, কাজেই...’
‘তাহলে হার মানলেন?’
দিপু অর্থপূর্ণ একটা হাসি দিল— নীলা তার অর্থ করতে পারল না। একবার ভাবে— জিজ্ঞেস করে হাসির অর্থ, আবার মনে হল, নিজের বোধগম্য-ক্ষমতা সম্পর্কে দিপু নিচু-ধারণা পোষণ করবে। তাই চুপ করে থেকে বলল, ‘আপনি মৌলবাদীদের যে বৈশিষ্ট্যের কথা বললেন, তা কিন্তু কমিউনিস্টদের মধ্যেও দেখা যায়। তাদের তবে কী বলা যায়— কমিউনিস্ট ব্র্যাকেটে মৌলবাদী।’
মিটি মিটি হাসতে লাগল— ‘মৌলবাদী আর তাই ভাবিকে ভয় পেতেন? কোনও প্রতিবাদ করতেন না?’
‘আমি তো সে কথা বলিনি। আমি ভুল করলে ও প্রতিবাদ করত, ও করলে আমিও করতাম। আমি ভুল স্বীকার করতাম, সে করত না, বরং ভুলের পক্ষে হাজারটা যুক্তি খাড়া করত। কোন একটা বিষয় নিয়ে যদি ভিন্নমত তৈরি হত— ও প্রায়ই এমন সব অপ্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো টেনে আনত যে, ওকে তখন শিক্ষিত বলে ভাবতে কষ্ট হত।’
ডান বুড়ো আঙ্গুলের নখে হাল্কা কামড়ে প্রশ্ন করল, ‘আপনি তখন কী করতেন?’
‘প্রথম প্রথম রাগে দু-একবার চড়-থাপ্পড় দিয়েছি, পরে আর কিছুই বলতাম না, চুপ করে শুয়ে থাকতাম।’
‘হাসলেন যে বড়?’
‘তুমি-না আবার আমায় খোঁচা দাও তাই ভেবে— “রেগে গেলে শুয়ে পড়তে হ...”
নীলা হাসল।
‘যাক যা বলছিলাম— গায়ে হাত ওঠালে সবাই আমারটাই কেবল চোখে দেখত। কিন্তু গা-জ্বালা করা কথাগুলো তো আর কেউ শুনত না, মাঝখান থেকে শুধু আমার সম্পর্কে বাজে ধারণা পেত সবাই। আমার সমস্ত অর্জন একটা থাপ্পড়ের কাছে বিলীন হয়ে যেত। শেষ যেদিন চলে যায় সেদিনও আমাকে, আমার পরিবার সম্পর্কে অনেক কটু কথা বলেছে। যদিও বিয়ের পর থেকেই আমি পরিবার থেকে আলাদা, কালেভদ্রে ওর সাথে তাদের দেখা হয়। বলা ভাল— ওর শীতল ব্যবহারের জন্যই, কেউ তেমন একটা যোগাযোগ রাখে না।’
নীলা গালে হাত দিয়ে কথাগুলো শুনছিল, বলল, ‘অহেতুক আপনার পরিবার টেনে আনায়, কিছু বললেন না?’
‘নাঃ। কিছুদিন আগে আমি চিন্তা করে একটা জিনিস আবিষ্কার করলাম— আমাকে যদি কেউ অপদস্থ করার পর লজ্জিত হয়, তবে সেটাই তার বড় শাস্তি, প্রতিবাদ করার কোনও প্রয়োজন হয় না। আবার সে যদি লজ্জিত না হয়, প্রতিবাদ করলে তো আরও মজা পাবে। আর যদি সে তার ভুল বুঝতেই না পারে, তবে এমন গর্ধপের সঙ্গে প্রতিবাদ করা শক্তির অপচয় মাত্র। সেই থেকে আমাকে আর কোনও কিছুই স্পর্শ করে না।’
‘আপনার বিশ্লেষণ অভিনব; কিন্তু প্রতিবাদ না করলে তো ওরা পেয়ে বসবে, তা ছাড়া জোর করে হলেও শোধরাতে সহযোগিতা করা উচিত।’
‘যে স্বয়ং উত্তরণ ঘটাতে চায় না, তার বর্তমান অবস্থাকেই শ্রেষ্ঠ মনে করে, তাকে তুমি কী করবে? এর চেয়ে বরং বালিবনে হিসু করা শ্রেয়।’
নীলা মনোযোগ দিয়ে দিপুর কথা শুনছিল। এক ফাঁকে রিপোর্টগুলো দিয়ে গেছে, কিন্তু এই মুহূর্তে ওসব দেখতে ইচ্ছে করছে না। নীলা ওড়নার আঁচলে মুখ মুছল— গরমের ভাব তেমন নয়, তবু ঠোঁটের চারপাশে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম...
‘যেদিন ভাবি চলে যায়, সেদিন কী হয়েছিল?’
‘তেমন কিছুই না। আগের দিন এক বন্ধুর বাড়িতে দাওয়াত ছিল— আরও দু-বন্ধু এসেছে— একজন একা, অন্যজন স্ত্রী-কণ্যাসহ। তো খাবার টেবিলে তোমার ভাবি বলল, “বাঃ বগুড়ার দই দেখছি— আমার খুব পছন্দের।” খানিকটা নিয়ে খাওয়া শুরু করে দিল, অথচ দই-পর্ব তখনও শুরুই হয়নি। এটা আমার বন্ধুর স্ত্রীর পছন্দ হল না। (নীলা চিন্তা করল— এটা কি অভদ্রতা— না তোমরা কী ভাবছ, তাতে আমার কিছুই যায়-আসে না। অন্যদের তুচ্ছজ্ঞান করা অর্থাৎ স্বার্থপরতা— এটাই তো কিছুক্ষণ আগে দিপু ভাই বলছিলেন— ধর্মান্ধরা নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত, পাপ না হলেই হল, সব ঠিক...) সে বাঁকা হাসি দিয়ে বলল, “ভাবির যখন বগুড়ার দই এত পছন্দ, বেশি করে খান...” আর যায় কোথায়... সুমি খাওয়া ছেড়ে উঠে গেল। সেটা দেখে, সেই ভাবিটিরও উঠতে দেরি হল না। (নীলা আবার ভাবতে লাগল— অন্যের বেলায় যে কিনা উদাসীন, সেই আবার নিজের সম্পর্কে পুরো উল্টো...) আসার সময় কেবল বললাম— “একসঙ্গে সবাই খেতে বসেছি, মিলেমিশে খাব— তোমার আগেই নেয়ার কী দরকার ছিল? নির্বোধের মতো এমন সব কাজ করো না?” এই আমার অপরাধ... বাড়ি ফিরে শুরু হল কালবৈশাখী কথার ঝড়... আমি শুধু তার দোষটাই দেখলাম, ঐ মহিলার কোনও দোষ দেখলাম না... আচ্ছা বলো তো নীলা, আমি কি অন্যের স্ত্রীকে নির্বোধ বলতে পারি? কোনও দোষ করলেও?’
‘তাই হয়? আর মানুষ তো আপনজনকেই শাসন করে, যেহেতু তাকে নির্ভুলভাবে পেতে চায়— কেননা এর সাথে তো তার নিজের সম্মানও জড়িত।’
‘আর দেখো অবস্থা! সারারাত খোঁচামারা কথায় ঘুমতেও পারলাম না।’
‘আমার তো মনে হয়— ভাবির মাথাই ঠিক নেই।’
‘আরেকটা কথা... যখন বললামই...’
একপলক নীলাকে দেখে নিজের পায়ের পাতায় তাকাল; দু-পায়ের আঙ্গুলগুলো ছড়িয়ে নিল। হয়ত পরীক্ষা করে নিল— সচল আছে তো... ‘আমি অফিসেই দৈনিক পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে নেই। মাঝে মাঝে রাতে দোকানে বসে, না-পড়া কিছু থাকলে পড়ে ফেলি, বাসায় টেনে না আনলেও চলে। কয়দিন সুমি ছুটিতে ছিল— বাড়ি ফিরলেই বলত— “পত্রিকা আনোনি?” ওর জন্যই দোকান থেকে পত্রিকা নিয়ে ফিরতাম। আর সেই কিনা ঐ দিন বলল— ঘরবাড়ি খবরের কাগজের গুদাম বানিয়েছি। আমার কোনও রুচি নেই, গোয়ালঘরে আমার জন্ম তাই স্বভাবটাও তেমনি...’
‘ছিঃ ছিঃ এ-তো রীতিমতো প্রতারণা ছিঃ... এসব সহ্য করেন কীভাবে!?’
‘নারীদের মুখের মার শরীরে কোনও দাগ পড়ে না।’
দিপু হাসল মলিন মুখে। নীলা সত্যিই বিব্রত। আঙ্গুলে ওড়নার কোণা পেঁচাতে লাগল, আর ডানে-বামে মাথা নাড়াতে লাগল, লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে।
‘তুমি বলো— এই ঘটনায় আমার আত্মীয়দের টেনে আনা কি রুচি সম্মত?’ করুণ করে চাইল নীলার মুখে।
‘দিপু ভাই একজন মেয়ে হিসেবে আপনার সামনে বসে থাকতে লজ্জা পাচ্ছি।’
মাথা নাড়াতে নাড়াতে আপন মনেই যেন বিড়বিড় করে বলল।
রিপোর্ট দেখতে দেখতে বাম তালুতে নাকের ঘাম মুছে বলল, ‘মনে হয় সব এখানে... ঠিক বুঝতে...’ জিজ্ঞাসার চোখে তাকাল নীলা।
‘হ্যাঁ আমার বন্ধু শৈলেশ... ওর কাছে কিছু আছে। ডাক্তার তো, ওকেই ওসবের দায়িত্ব দিয়েছি, আমি ওর কী বুঝি? কোথায় কোন টেস্ট করাতে হবে ও-ই আমায় নিয়ে যায় সাথে করে।’
নীলা বিদায় নিলে, দিপু মৌলবাদ সম্পর্কে নীলার অবস্থান, এবং তার রসিকতা নিয়ে ভাবতে লাগল, আপন মনে বলে উঠল, ‘বেশ বুদ্ধিমতী, আমার আরও একটু সচেতন হওয়া উচিত ছিল...’
বাড়ি ফিরে দেখে মায়ের মন ভার।
‘রাত করার কোনও মানে হয়?’
‘কথা বলতে দেরি হয়ে গে...’ কৈফিয়ত দেয়ার দৃষ্টিতে মার দিকে তাকায়।
‘খেতে আয়...’
দিপুর প্রসঙ্গে কোনও প্রশ্ন না করায় নীলা বিব্রত। বুঝতে পারল— কারণ, দেরি করে ফেরা। খাবার শেষে বাসন-কোসন ওঠাতে যাচ্ছিল।
‘নীলা— দিপুর শরীর কেমন দেখলি?’
নীলা মায়ের দিকে না তাকিয়ে, ডালের-বাটি টান দিতে নিয়ে বলল, ‘জানাল তো তেমন কোন পরিবর্তন নেই।’
আড়-চোখে মেয়েকে দেখে, আর কোনও প্রশ্ন করল না। ভাতের হাঁড়ি পানিতে ভরে ভিজিয়ে, চুলো মুছে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মা মেয়েতে আজ আর কোনও কথা হল না।
রাতের টুকি-টাকি কাজ শেষে, খুব অল্প সময় পড়া-লেখা করল আজ। বিছানায় যেতে একটু দেরি করে ফেলল— আজ আর কোনও বই নিল না। দীর্ঘ দিনের অভ্যাসের ব্যত্যয় ঘটল। কিছুক্ষণ পূর্বে যেসব ওরা আলোচনা করেছিল, তাই ভাবতে লাগল।
‘দিপু ভাই বলেছিল— ধর্মান্ধ বা মৌলবাদীরা নিজ স্বার্থটাই আগে দেখে... বিবেক দ্বারা চালিত হয় না... সকল কাজের আগে দেখে, গুরু কী বলে... আচ্ছা ভাবি কাকে পির মেনেছিল জানলাম না... আমি বললাম, ভাবি বক-ধার্মিক— ধর্মে বরং আত্মীয়-স্বজনের প্রতি কেমন ব্যবহার করতে হবে, তার নির্দেশ আছে। এই যাঃ— দিপু ভাই তো সে কথাই বলতে চাচ্ছিলেন। আমি তো তার কথারই সায়... হ্যাঁ তাই তো... আমি তো আসলে তার বিপক্ষে বলতে চেয়েছিলাম। আর করলাম কী...
ফোন হাতে নিল, ‘কিন্তু কী বলতে চেয়েছিলাম? কারও নির্দেশে চললেই সে স্বার্থপর হবে এটা কেমন কথা! কিন্তু মানুষ নির্দেশ মতো চলবে কেন, যদি তাতে কোনও লাভ না থাকে? এই লাভের কথাই তিনি বলছিলেন। আচ্ছা লাভ-লোকসান বাদই দিলাম। কাউকে উপকার করার মধ্যে কি আত্ম-তৃপ্তি থাকে না? সেটা লাভ নয়? স্বার্থপরতা নয়? তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াল কী? মানবসেবা আর স্বার্থপরতা একই জিনিস—কীভাবে সম্ভব!’
ফোন টিপতে লাগল— কল দিল দিপুকে। কিন্তু রিং হবার আগেই কেটে দিল— ‘তার কথা এখনও ভাবছি এটা দৃষ্টিকটু...’
এপাশ ওপাশ করল কতক্ষণ। বালিশ দলা-মোচড়া করে জাপটে ধরে মুখ গুঁজল। মনে পড়ল ছেলেবেলার কথা। মাত্র নতুন বাড়িটায় এসে উঠেছে— অনেক কাজ তখনও বাকি। তবু অসম্পূর্ণ বাড়িতেই ওদের এসে উঠতে হল। পয়ঃনিষ্কাশন-কূপটা খোঁড়া হয়েছে— ওপরে ঢাকনা দেয়া হয়নি। এমন অবস্থায় হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হল। বাড়িতে বাবা এসে পৌঁছেনি, মিস্ত্রি সেদিন ফাঁকি দিয়েছে। মা-মেয়ের সে-কী ছোটা-ছুটি, কত কিছু দিয়ে ঢাকতে চেষ্টা... কী যে চিন্তা মায়ের। এদিকে বৃষ্টি বেড়েই চলেছে, ঘরে পিন্টু চেঁচাচ্ছে; মাত্র আটমাস তখন ওর। এমন সময় অফিস থেকে ফিরেই, দিপু ভাই ছুটে এলেন বেলচা হাতে। উঠোন থেকে কুপিয়ে মাটি তুললেন— বেলচায় করে নিয়ে, কুপটার চারপাশে উঁচু করে দিতে লাগলেন। নীলা ঘর থেকে দৌড়ে একটা গামলা নিয়ে এল। দিপুভাই উৎসাহ দিয়ে বললেন— ‘বৃষ্টির সাথে আমাদের পাল্লা।’ এটা শুনে নীলা আরও জোরে দৌড়ে মাটি নিতে লাগল। তারপর একটা টিন দিয়ে ঢাকলেন। পিন্টুকে উঠিয়ে, ওর পিঠের নিচ থেকে, পুরো খাট-জুড়ে বিছানো হিসু-রোধকটা নিয়ে, টিনের ওপর বিছিয়ে দিলেন। পিন্টু সেদিন কী যে বুঝেছিল— ওটা নেয়ার সময়, সমানে চিৎকার। দিপু ভাই হাসতে হাসতে বললেন, ‘আগে আকাশের হিসু থামাই, তার পরে তুমি নিও।’ কাজ শেষ করতে বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে। তাড়াহুড়োয় একবার আছাড় খেয়েছেন, আর নিজের তো হিসেব-ছাড়া। সার্ট খুলে চাপকলে ধুতে লাগলেন। নীলা সাবান হাতে-করে দাঁড়াল। ‘সেদিন যে-মানুষটাকে দেখেছিলাম! শরীরে ছড়িয়ে থাকা পেশির নাচন... আজ কী দেখলাম!’
এক সময় ঘুমে ঢলে পড়ল। শেষ রাতের দিকে একটা স্বপ্ন— দিপুকে নীলাদের দাদার বাড়ি নিয়ে গেছে। বাড়ির পশ্চিম-দিকের ঝোপঝাড়ে ভর্তি পুকুর-পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে গল্প করছিল ওরা। উত্তর-পশ্চিম কোণের ডুমুর গাছের গোড়ায় গিয়ে দাঁড়াল। নীলা বলল, ‘এসো— শেকড়ের ওপর বসে একটু গল্প করি।’ দিপু সেদিকে পা বাড়াতেই, পাকা ডুমুর পিষ্ট হয়ে, হঠাৎ পুকুরের মধ্যে পিছলে যেতে লাগল। নীলা খপ করে দিপুর হাত ধরে ফেলায়, নীলার হাতের টান বেয়ে বেয়ে দিপু সোজা হয়ে দাঁড়াল।
‘বিপদ কেটে গেছে, হাতটা এবার ছাড়ো...’
‘যদি না ছাড়ি?’
দুষ্টুমি-ভরা হাসি— দিপু এমনভাবে নীলার চোখ বরাবর তাকাল, নীলা যেন এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেল। নীলার হাত ধরেই বলতে লাগল—
‘তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই
হাতখানি ছেড়ে দিলে ছিটকে যাব
বহুদূর— অজানা কোনও নক্ষত্রের বুকে
আমার বিশ্বাস যত—
জমা রাখলাম তোমার কাছে।
যদি হারিয়ে যাই—
যেনে রাখো—
আবর্তিত হব
তোমাকেই ঘিরে
মিটিমিটি আলো দিয়ে যাব
আর জ্বেলে রাখব,
ঘোলাটে কিছু স্মৃতি।
স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেল। চোখের সামনে হাত দুটো এনে তাকিয়ে থাকল, কুসুম-বাতির হাল্কা আলোয়। উত্তেজনায় বুক ফেটে হৃৎপিণ্ড বেরিয়ে আসতে চাইছে। বড় বড় চোখে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল, তিনটা উনিশ। অদ্ভুত একটা আনন্দ লাগছে। উঠে বিছানায় বসল— হেসে ফেলল, অচেনা এক ভাললাগায়। আবার নিজের কাছেই নিজের লজ্জা লাগল। দুহাতে মুখ লুকল, তাতে আনন্দের মাত্রাটা আরও বেরে গেল। ভাবতে লাগল, ‘এমন স্বপ্নের কী অর্থ হতে পারে? একজন বিবাহিত লোককে জড়িয়ে স্বপ্ন দেখা... না এ অন্যায়... হতে পারে না, না... কিন্তু আমি তো ইচ্ছে করে, স্বপ্নটা দেখিনি... কেন এত ভাল লাগছে!’
স্বপ্নটা উদ্ভট, অদ্ভুত বলে দূরে ঠেলে রাখতে চাইল, অথচ ঘুরে ফিরে সদ্য-দেখা স্বপ্নে বিভোর হয়ে রইল সে। স্বপ্নে হাত ধরার শিহরণটুকু তখনও শেষ হল না।
কিস্তি - ৩য়
কিস্তি - ২য়
কিস্তি -১ম
কিস্তি - ৫ম
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১:৩৪