somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বড় গল্প: দাগ অথবা কাজল (কিস্তি — ১ম)

২৯ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১১:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




শান্ত এক উপশহর। দুজন মানুষ লম্বা রাস্তা ধরে হেঁটে আসছিলেন কথা বলে, ধীর পায়ে। একতলা বাড়িটার সামনে একজন দাঁড়ালেন— নীলাচল, বাড়ি নং-৮, রোড নং-৩, উদয়পুর— ভাল করে দেখে নিলেন। প্রথম প্রথম প্রায়ই ভুল হত— তখন অনেক বাড়ির চেহারাই প্রায় এক। নতুন বসতি-এলাকা তাই গাছ-টাছও তেমন লাগানো হয়নি— বেখেয়াল হলেই অন্যের বাড়ির উঠোনে। একবার তো কোন এক বাড়িতে ঢুকে, আর চেনেন না— স্ত্রী এত মোটা হল কখন! নাকটাও কেমন খাঁদা... সেই যে অভ্যেস হয়ে গেল— ঠিকানা না পড়ে আর নিজের বাড়িতে ঢোকেন না।

লোকটি একতলা পূর্বর্মুখী বাড়িটার সদর দরজা দিয়ে মাথা নিচু করে ভেতরে ঢুকলেন। তার আজ ছুটি ছিল। পঞ্চাশ পেরিয়েছে কেবল, শরীরে জোর আছে ঠিক আগের মতোই। বাজারে ঝাঁকা-ওয়ালা বাচ্চা-ছেলেগুলো স্যার বলে এগিয়ে এলে, পাত্তা পায় না কখনও— প্রতি সকালে ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে মাখা যার অভ্যেস... দরজায় কলবেল টিপে বাজার ওখানে রেখেই, ছোট্ট বাগানের মতো উঠোনে নেমে এলেন। সাদা জবাগাছের একটি ফুলসহ ডাল ঝুলে ছিল— খাড়া করে, অন্য একটি ডাল দিয়ে চেঙ্গি দিলেন সেটায়। একটু দূরে দাঁড়িয়ে ঘাড় কাত করলেন— হ্যাঁ ঠিক আছে। অকারণেই মরিচ গাছটায় মৃদু ঝাঁকুনি দিলেন একটা। সবে ঘুম ভেঙ্গেছে ডালে ডালে— বুলেটের থোকার মতো জ্বলছে মরিচগুলো সূর্যের আলোয়। যেন বললেন, ‘কী হে খবর কী?’ আর খুশিতে পাতার ঝাঁকের ভেতর থেকে কচি মরিচগুলো উঁকি দিল, ফোকলা দাঁতে।

দরজা খুলে যাওয়ায় এগিয়ে গেলেন... ‘শুনেছ— দিপু সাহেব নাকি কয়দিন ধরে অসুস্থ... মঙ্গলের সাথে দেখা হয়েছিল— বাজার করে একত্রেই ফিরলাম।’
বাজার রেখে ডাইনিং-চেয়ারে বসলেন। মাছ রান্নাঘরে রেখে, কপাল মুছতে মুছতে স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, ‘খুব খারাপ কিছু কী।’
‘না... তেমন কিছু বলতে পারল না। বাতের ব্যথার সাথে আরও কিছু উপসর্গ নাকি আছে।’
‘দেখো এর মধ্যে আবার সুমি গিয়ে রয়েছে বাবার বাড়িতে!’
‘সুমি আবার কে?’
‘দিপুর স্ত্রীর নামই তো...’
শফিক সাহেব গ্লাসে পানি ঢাললেন, এক চুমুকে আধা গ্লাস শেষ করে, হাতে ধরা অবস্থায় তাকালেন জিজ্ঞাসার চোখে।
‘তোমার মনে নেই?’
‘আসলে সেদিন অফিসের ঝামেলায় ফিরতে এত দেরি হল যে, ভালমতো পরিচয় টুকুও...’ আরেক চুমুক খেয়ে বললেন, ‘আমাদের বাড়িটা করতে দিপু সাহেবের অনেক অবদান ছিল।’
স্ত্রী সবজি ঢালতে লেগে যোগ করলেন, ‘তাইতো— বাকিতে রড, সিমেন্ট, মিস্ত্রি জোগাড়, সব ঝামেলা তো ওই-ই সারল। আর নতুন বাড়িতে উঠে, দাওয়াত করে তোমার কোন খবর নেই।’
পেঁয়াজ-আলু গামলা থেকে গড়িয়ে মেঝেয় লুটোপুটি খেল...
‘আরে! কে জানত— হুট করে ছুটির দিনে বড় সাহেব মিটিং ডেকে বসবেন। আগে জানতে পারলে তো অন্যদিন আসতে বলতাম। চলো সন্ধ্যার দিকে একটু দেখে আসি? শিং কটা আনলাম তাই মনে করে।’ স্ত্রীর দিকে তাকালেন— যেন এবার মোহিত-বদনে দৃষ্টি ছড়াবে।

পছন্দের কেউ হলে, স্ত্রী কিছু তৈরি করে নিতে চান— ভালই জানা তার। রোগী হলে শিং বা কবুতর। মাথায় কে যেন খোঁদল করে বুনে দিয়েছে— তাহলে অসুখ দ্রুত ছুট দেবে। দাওয়াইতে কাজ দিল।
‘আমিও সে-ই ভাবছি— কটা মাছ আলু দিয়ে ঝোল করি।’
‘আলু দেবে?’
‘হ্যাঁ, আমাদের জন্য...’



দিপু শফিক সাহেবের প্রতিবেশী, তবে বাড়ি করেছে বেশ আগে। সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিতে বড় পদে চাকরি করা অবস্থায়ই রড-সিমেন্টের দোকান খুলে বসে। অফিস থেকে ফিরে রাতে কর্মচারীর কাছ থেকে শুধু হিসেব বুঝে নেয়া— কত বস্তা সিমেন্ট আর কত টন রড বিক্রি হল। সেসময় এই উদয়পুর মাত্র গ্রামীণ পরিবেশ ঝেড়ে ফেলে, শহরের অবয়ব ধরতে শুরু করেছে। এদিক ওদিক যে ঘরবাড়ি উঠতে লাগল, তা প্রায় সব একই ধরণের। একজনের টা দেখে অন্যজন কাজ শুরু করে, পরামর্শ করে। মিস্ত্রি, শ্রমিকরাও সেই একই। একই গৎবাঁধা কাজ— ওরাও এটাই চায়— পাকা হয়ে উঠতে সময় লাগল না ওদের। এক সময় ঝাঁকে ঝাঁকে বাড়ি গজাতে থাকে, কেলাসের মতো— গুড়ের তাওয়ায় যেভাবে কেলাসন ঘটে— বলকে বলকে। কেলাসন ঘটল সমাজেও, খুব গরিব বা খুব ধনী নেই, তাই গ্রাম্য সামাজিকতা একেবারে বিলুপ্ত হল না। এই-ই কাজে লাগাল দিপুর ব্যবসায়ে। কেবল দোকান খুলে বসে না থেকে, নিজে ও কর্মচারীদের দিয়ে জমির মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, রড-সিমেন্ট, মিস্ত্রি, সরবরাহ করা ধরল, আর বাড়ি তৈরির নানা পরামর্শ— বিনামূল্যে। লোক বুঝে বাকিতে মাল সরবরাহ করা ধরল। অল্পদিনে ভাল টাকা হল। ভাড়া-বাড়ির কাছেই এক টুকরো জমি কিনে দোতলা বাড়ি ওঠাল।

পূর্ব ও উত্তর পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। পূর্বের গেট দিয়ে ঢুকতেই এক চিলতে বাগান। ছোট মতন কিছু ফলের গাছ, কলমের— আম, সফেদা, কামরাঙা... খুব ভেবে চিন্তে লাগানো— বীজের গাছ এত বাড়ে যে, শহরের ক্ষুদ্র পরিসরে স্থান হয় না। যে দু-চারটি ফুলের গাছ, তাও যেন বস্তির হাড় বের করা, অপুষ্ট শিশুদের মতো— বহু কষ্টে তারা টিকে থাকে, কেবল টিকে থাকার জন্য। বাগান পার হলেই দোতলা বিল্ডিং, দক্ষিণ দুয়ারি, উত্তর রাস্তা ঘেঁসে। উত্তরে নিচতলায় তিনটি দোকান— একটি রেখে বাকি দুটো ভাড়া দেয়া— এক সময় নিজেই চালাত। সিঁড়ির ঘরটা বেশ বড় করে করা— তাতে বাইরের-জনদের জন্য, সহজেই বসার ঘর করে ফেলা। দোতলায় উঠতে নিচের ড্রয়িংরুম ছাড়া উপায় নেই। নিচের দুই বেড এর ছোট্ট ফ্ল্যাটে, ছোট্ট একটি পরিবারকে ভাড়া দিয়ে নিজে স্ত্রীসহ দোতলায় উঠে আছে। ছড়ানো ছিটানো বিল্ডিং উঠলেও ফাঁক-ফোঁকর অনেক— এখনও ভোরের তাজা সূর্যের দল জানালায় বসে ডানা ঝাপটায়, পাখিরা ঠোঁটে করে বৃষ্টি আনে। পূর্বের দেয়ালে চিরহরিৎ সফেদার শাখা দোলা দেয়— ইটের গুঁড়ো মাখানো মার্বেল নিয়ে খেলা করে, আর মাঝরাতে হঠাৎ হঠাৎ খসখস শব্দ ঘুম কেড়ে নেয়— যেন আঁচলটা ঠিক করে নিল কেউ। তার চুল থেকে খসে পড়া, বিন্দু বিন্দু জল, পাতার ফাঁকে আটকে থাকে, সূর্যের আলোয় জ্বলে ওঠা পর্যন্ত।



‘কী ব্যাপার মা এখনও রান্না শেষ হয়নি? খুব খিদে পেয়েছে?’
কলেজ থেকে বাড়ি ঢুকতে বলল নীলা। নিজের ঘরে না ঢুকে টেবিলে ব্যাগ রেখে, রান্না ঘরে গেল আগে।
‘ঝটপট গোছল করে আয় রান্না শেষ।’
কী রাঁধছ মা?’
‘এটা আমাদের না রে।’
চামচ নাড়াতে নাড়াতে বললেন। বাম বাহুতে মুখের ঘাম মুছে হাতের কাছে দাঁড়ানো মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন— ‘চার-টুকরো ইলিশ সর্ষে দিয়ে... বিকেলে দিপুকে দেখতে যাব।
‘দেখতে যাবে মানে! কী হয়েছে তার!’
‘ক-দিন ধরে নাকি অসুস্থ— তোর বাবা খবর এনেছে।’
‘সে না-হয় বুঝলাম, কিন্তু তরকারি নিয়ে... তোমাদের এই সব গেঁয়োমি না!...’
‘হ্যাঁ আমরা গাঁয়ের মানুষ, গেঁয়োই থাকতে চাই। তোদের যা ভাল লাগে করিস।’
‘আচ্ছা মা, উনি কি খুব অসুস্থ?’
হাঁড়ি থেকে কাঁটাচামচে এক টুকরো আলু গেঁথে মুখে পুরে গরম ধুয়া ছাড়ল, ধূমপায়ীর মতো।
‘আ-হা-হা...’ হাত ঝাঁকাতে লাগল নীলা।
‘কী-যে করিস-না! গরম না? তোর বাবা ঠিক মতো কিছু বলতে পারল না।’
কিছুদিন আগে দিপুর সাথে নীলার দেখা হলে বলেছিল, ‘এই যে নীলারানি মেডিক্যালে চান্স পেয়েছ— ভয়ে যে আর অসুখ কাছে ভিড়তেই পারে না— হা-হা-হা, খুব খুশি হয়েছি; আর চিন্তা নেই। ঘরে বসে ওরে বাবারে বললেই ডাক্তার হাজির হয়ে যাবে।’ মনে পড়ল নীলার, ‘বাবাও যাবে?’
‘হ্যাঁ, তুই তাড়াতাড়ি আয়।’
নীলা ওর রুমে চলে গেল।

কিস্তি - ২য়
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১:১৯
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ্‌ সাহেবের ডায়রি ।। পৃথিবীকে ঠান্ডা করতে ছিটানো হবে ৫০ লাখ টন হীরার গুঁড়ো

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৯:০২




জলবায়ূ পরিবর্তনের ফলে বেড়েছে তাপমাত্রা। এতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। তাই উত্তপ্ত এই পৃথিবীকে শীতল করার জন্য বায়ুমণ্ডলে ছড়ানো হতে পারে ৫০ লাখ টন হীরার ধূলিকণা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

অচেনা মানুষ আপনাদের দীপাবলীর শুভেচ্ছা

লিখেছেন আজব লিংকন, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১০:২১



আমারই বুকে না হয় শিবেরই বুকে
নাচো গো... ও নাচো গো...
পবন দা'র গলায় ভবা পাগলার গানটা কারা জানি ফুল ভলিউমে বাজিয়ে গেল। আহ.. সে সুরের টানে বুকের মাঝে সুখের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোরআন পড়বেন, ফিকাহ জানবেন ও মানবেন

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:০০



সূরাঃ ৯৬ আলাক, ১ নং থেকে ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
১। পাঠ কর, তোমার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন
২।সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক’ হতে
৩। পাঠ কর, তোমার রব মহামহিমাম্বিত
৪। যিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্নমর্যাদা!

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৩

রেহমান সোবহান একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব প্রায় ৬ কিলোমিটার। রেহমান সাহেব এমন একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন যা খুব নির্জন এলাকায় অবস্থিত এবং সেখানে যাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। অ্যাকসিডেন্ট আরও বাড়বে

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



এরকম সুন্দরী বালিকাকে ট্র্যাফিক দায়িত্বে দিলে চালকদের মাথা ঘুরে আরেক গাড়ির সাথে লাগিয়ে দিয়ে পুরো রাস্তাই বন্দ হয়ে যাবে ।
...বাকিটুকু পড়ুন

×