‘মাথার ভেতর বোমারু বিমান নিয়ে মানুষ ছুটছে
ঘরহারা মানুষ;
আতঙ্কিত মানুষ;
মানুষের ভয়ে মানুষ;
রক্তের ক্যামোফ্লেজ নিয়ে ছুটছে
বউ কথা কও আর ধানশালিকের দেশ।’
(কবিতাংশঃ ডিসেম্বর ব্লাড)
--কাজী মেহেদী হাসান
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল
১
আমার ভাইটা ছিলো ফিজিক্স পাগল!
সুযোগ পেলেই বিগ ব্যাং, কোয়ান্টাম মেকানিক্স এসব হাবিজাবি বিষয় নিয়ে লেকচার দেওয়া শুরু করতো। আমি তার বকবক তেমন কিছুই বুঝতাম না, কিভাবেই বা বুঝবো। আমি তখন সবে ইন্টারমিডিয়েট ভর্তি হয়েছি, আর সে ততদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ফিজিক্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র! পনেরো-ষোল বছরের একটা মেয়ের যে অতশত বোঝার কথা না- আমার ভাইকে সেটা কে বোঝাবে! সে মনের আনন্দে ফিজিক্স নিয়ে তার মুগ্ধতা নিজের ছোট বোনটির সাথে ভাগাভাগি করে যেতো। তাতে আমি বিরক্ত হই কি খুশি- সে থোড়াই পাত্তা দেয়....
আমি অবশ্য খুশি হতাম খুব কমই- তার মূল কারণ ছিলো- একেতো আমার পড়ালেখা করতেই ভালো লাগতো না, তার উপর আবার ফিজিক্সের মতন জঘন্য একটা বিষয় নিয়ে সারাক্ষণ ঘ্যানঘ্যান। ভাইয়া তার লেকচার শুরু করবার পাচ মিনিট যেতে না যেতেই আমি অবধারিতভাবে রুক্ষ গলায় তাকে বলতামঃ "উফ ভাইয়া, বিরক্ত কইরো না তো!"
ভাইয়ার একটা চমৎকার গুণ ছিলো। সে কখনোই রাগ করতো না। আর আমার সাথে তো নয় ই! তাই ছোট বোনের মুখ-ঝামটা খেয়ে সে ক্ষণিকের জন্য চুপসে গেলেও পরক্ষণেই আবার হেসে ফেলতো। হাসতে হাসতেই বলতো- "আচ্ছা যা! বিরক্ত করা বন্ধ!"
ছোটবেলা থেকেই ভাইয়াকে আমি দেখে আসছি, এতোদিনে মানুষটির চেহারা-শরীর, আচার-আচরণ এসব কিছুই আমার অভ্যস্ত চোখে স্বাভাবিক এবং নিয়মিত হয়ে আসা উচিত ছিলো, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপারটা হোল- ভাইয়াকে হাসতে দেখে আমি প্রতিবার নতুন করে অবাক হতাম, মনে মনে ভাবতাম- "আচ্ছা! একটা মানুষ এতো সুন্দর করে হাসে কেমন করে!" সাথে সাথে আবার এটা ভেবেও কিছুটা খারাপ লাগতো যে- "ইশ, ফিজিক্স নিয়ে আরেকটু কথা শুনলে কি এমন ক্ষতিই বা হোত! বেচারা উতসাহ নিয়ে বলছিলো..."
কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই, যেটা বলার ততক্ষণে সেটা বলে ফেলেছি!
ভাইয়ার কাছ থেকেই আমার আকাশ চেনা শুরু। এক দিক থেকে বলতে রাতে দুই ভাইবোন ছাদে উঠে তারা দেখার ব্যাপারটা- আমার সত্যি ভীষণ ভালো লাগতো। তার কাছ থেকেই আমি শিখেছি সপ্তর্ষি আকাশের কোথায় থাকে কিংবা বছরের কোন সময়টাতে দেখা দেয় কালপুরুষ। বাবা-মা'কেও ভাইয়া মাঝে মাঝে জোর করে ছাদে নিয়ে তারা দেখাতো। জোছনায় মাখামাখি রাতগুলোতে আমরা অবধারিতভাবে পাশের বিল্ডিঙের ছাদ থেকে শাহিদা আপুর কন্ঠ শুনতে পেতাম- "মোর ঘুম ঘোরে এলে মনোহর.." কিংবা "আবার ভালোবাসার সাধ জাগে..."
আজ সেগুলো চিন্তা করলে সব স্বপ্নদৃশ্যের মত মনে হয়.....
এতো বিতং করে ভাইয়ার কথা বলার কারণটা হচ্ছে- গতরাতে বহুদিন পর আমি তাকে স্বপ্নে দেখেছি। কতদিন হবে সেটা- তিন মাস/ চার মাস?! আসলে এই শরণার্থী শিবিরে আসার পর থেকে আমার সময়ের কোন হিসেব নেই। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়- সময় বুঝি থেমে আছে। চারপাশের এতো কোলাহল, থেমে থেমে মানুষের কান্না কিংবা উত্তেজিত কথাবার্তা শোনার পরও পুরো এলাকাটাকে কেন আমার এমন অদ্ভূত নীরব মনে হয়- সেটা কে বলবে! শুধু মনে হতে থাকে যেনো- কি একটা নেই! যেনো, কি একটা নেই!
আবার হঠাত হঠাত এমনো ভ্রম হয়- বুঝি এরই মাঝে আসলে অনন্তকাল পার হয়ে গেছে! একই সময়ে, একই পরিবেশে এজাতীয় পরস্পর-বিরোধী দু'রকমের অনুভূতি হওয়াটা নিঃসন্দেহে অবাক করার মত বিষয়; স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলে আমি নিজেও হয়তো কিছুটা অবাকই হতাম। কিন্তু মাত্র অল্প কয়েকটা মাসের ব্যবধানে, আমার বয়েসী একজন কিশোরী যখন মৃত্যুর বিভীষিকাটাকে খুব কাছ থেকে দেখে ফেলে- তখন সে আর কোনকিছুতে সহজে বিস্মিত হয় না। আমিও যে তার ব্যাতিক্রম হব না- সে আর বিচিত্র কি!
বিষয়টা এমন না যে- যুদ্ধ শুরু হবার আগে আমি কখনো মৃত্যু দেখি নি। আমার যখন সবে নয় বছর বয়স, তখন আমার দাদী মারা যায়। মৃত্যুর সে সময়টাতে দাদীর পাশে আমি ছাড়া আর কেউ ছিলো না। কেউ আমাকে বলে দেয় নি- আমার প্রিয় দাদীমা এই মাত্র মারা গিয়েছে, কিন্তু আমি স্পষ্ট সেটা বুঝতে পারলাম! দাদীর খাট থেকে নেমে রান্নাঘরে গিয়ে মা'কে নীচু গলায় বললাম- আম্মু, দাদীমা একটু আগে মারা গেছে।
কিন্তু সে মৃত্যু আর এই যুদ্ধের মৃত্যু আলাদা। যোজন যোজন তাদের মধ্যকার ব্যবধান। ঢাকা থেকে ত্রিপুরার এই শরণার্থী শিবিরে আসার অনেকটা রাস্তা আমাদের মৃত্যু উপত্যকা পাড়ি দিয়ে আসতে হয়েছে। তবে সেটা অধিকাংশ সময়েই ছিলো আমাদের দৃষ্টি আর চেতনার বাইরে। অনেকটা দূরের সে মৃত্যু একেবারে আমাদের চোখের সামনে এসে হাজির হয় আমরা কুমিল্লা পৌছে যাবার পর। আমি যতদিন বেচে থাকবো- সে দিনের স্মৃতি নিশ্চিতভাবেই আমায় তাড়া করে করে ফিরবে; এধরনের অভিজ্ঞতা মানুষ কখনো সচেতনভাবে নিজের মধ্যে লালন করে রাখে না, বরং মনের অদেখা, অস্পর্শী কোন গভীরে অতল গর্তে ছুড়ে ফেলে দেয়।
দিনটা ছিলো মঙ্গলবার। জৈষ্ঠ্য মাসের গনগনে দুপুর ততক্ষণে শ্রান্ত বিকেলে পালটে গেছে। আমরা হাটছিলাম কোন একটা গ্রামের কাচা রাস্তা ধরে। আমরা মানে- প্রায় শ'খানেক মানুষ- পিপীলিকার স্রোতের মত গুটি গুটি পায়ে হেটে একটু নিরাপাত্তা, একটু আশ্রয়ের জন্য ছুটছে! সেখানে কোলের শিশু যেমন ছিলো, তেমনি ছিলো আশি বছরের বৃদ্ধাও। সবার উদ্দেশ্য এক- যত দ্রুত সম্ভব পাশের দেশের সীমানায় ঢুকে পড়া। সাথে সাথে সবার দুঃখটাও কিন্তু অভিন্ন, আর সেটা হোল- বাপ-দাদার চিরপরিচিত ভিটে, চিরআপন মাটি পেছনে ফেলে অনিশ্চিতের পথে যাত্রা; মানুষ যে মাটির ওপর বড় সাধ করে সুখ, দুঃখ আর ভালোবাসার ছোট্ট ঘর বাধে।
আমরা ছিলাম তিনজন- আমি, বাবা আর মা। ভাইয়া ততদিনে যুদ্ধে চলে গিয়েছে, কে জানে সে-ও হয়তো ইন্ডিয়ার কোন ক্যাম্পেই ট্রেনিং এ আছে। শুনেছি মুক্তিযোদ্ধারা নাকি বেশিরভাগই সীমানার ওপারে গিয়ে ট্রেনিং নিচ্ছে। সুযোগ মত দেশে ঢুকে অপারেশন চালানো তাদের প্ল্যান। আমরা নিজেরাও ত্রিপুরা আসছিলাম দেখেই কি না জানি না, আমার এটা ভাবতে খুব ভালো লাগতো যে- ভাইয়াও আসলে সেখানেরই কোন একটা ক্যাম্পে গিয়ে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সাথে ট্রেনিং নিচ্ছে.... এক ধরণের ছেলেমানুষী উইশফুল থিংকিং আর কি!
যাই হোক- বাবা ঐ গ্রামের নামটা আমাকে বলেছিলো, কিন্তু আমার আর এখন সেটা মনে নেই। এ দেশের একটা গ্রামের সাথে অন্য গ্রামের পার্থক্য খুব কম হয়, সে গ্রামটিও তার ব্যতিক্রম ছিলো না। ধানখেতের স্বচ্ছ সবুজ, নারকেল-তাল-সুপারির বন, আর তার মাঝে মাঝে মায়াঘেরা কিছু মাটির ঘর বিকেলের আধোছায়ায় সমাহিত হয়ে ছিলো। যুদ্ধের সময় বলেই হয়তো চারদিকে কেমন থমথমে একটা পরিবেশ।
গ্রীষ্মের আচমকা শুরু হওয়া কালবোশেখির মতই সে স্তব্ধতা হঠাত কাচের দেয়ালের মতন ভেঙ্গে পড়লো, আমরা দেখতে পেলাম- সামনের দিকে থাকা শরণার্থী মানুষগুলো ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক সেদিক ছোটাছুটি শুরু করেছে। মুহূর্তেই অন্য সবার মাঝেও দাবানলের মত এক অজানা আতংক ছড়িয়ে পড়ে। আমি মাঝে দিয়ে শুধু বাবাকে কাপা কাপা গলায় বলতে শুনলাম- "ইয়া আল্লাহ! মিলিটারি"
এর পরপরই ছাড়াছাড়া গুলির শব্দ। মানুষের ছোটাছুটি আর বিশৃংখলা কয়েক গুণ বেড়ে গেলো সেটা শুনে। মা আমাকে ধরে পাগলের মত দৌড়াতে শুরু করলেন। দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় আমরা রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা দূরে এক পাটখেতের আড়ালে গিয়ে আত্মগোপন করলাম। আমি চোখের কোণা দিয়ে দেখলাম- সেখানে আরো অনেকে শুয়ে, বসে নিজেদেরকে লুকিয়ে ফেলবার প্রাণপন চেষ্টা করছে। আমি আর মা'ও তাদের সাথে সাথে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকি।
মিনিট পাচেকের মধ্যেই আমরা অল্প আগেই যে রাস্তাটাতে ছিলাম, সেখানে, সেই কাচা রাস্তার ওপর খাকি পোশাকের মিলিটারির বিশাল এক দল মার্চ করতে করতে জড়ো হোল। সবাই এতো অল্প সময়ে আমাদের মত দূরের এই পাটখেতে এসে লুকিয়ে যেতে পারে নি, অনেকে বিহবলের মত রাস্তার ওপরই বসে ছিলো। মিলিটারি রাস্তার আশপাশের ঝোপ ঝাড় থেকে আরো অনেককে খুজে বের করলো, তারপর কেউ কিছু বুঝে ওঠবার আগেই আবারো গুলির শব্দ। আমরা দূর থেকে চেয়ে চেয়ে দেখলাম- গুলি খেয়ে মানুষগুলো পখির মতন মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, যেনো তাদের ওজন বলতে কিছু নেই। যেন শোলার পুতুল সবাই!
আমাদের সাথে পাটখেতে লুকিয়ে থাকা সবাই ভয়ে কাপছিলো। দেখলাম পাশেই এক মা তার কোলের সন্তানের মুখ চেপে বসে আছে- যেনো শিশুটি কোন শব্দ করতে না পারে- তাহলে যে আমরা সবাই মারা পড়বো! দুঃখের কথাটি হোল- মুখ চেপে ধরে রাখার কারণে বাচ্চাটি পরে শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যায়। তার মা আমাদের সাথে আর বর্ডারের দিকে এগোয় নি। আমরা যখন আবার ইন্ডিয়ার দিকে রওনা দেই, তখনো তাকে দেখেছিলাম সেখানে, সে গ্রামেই; রাস্তার পাশে মৃত সন্তানকে কোলে নিয়ে চুপচাপ বসে আছে।
ওদিকে ঐ বাচ্চাটির মতন আমার মা'ও পাটখেতে আমাকে জড়িয়ে ধরে ছিলো, যেন আমি ভয় না পাই! সত্যি কথা বলতে- আমি কিন্তু এতটুকু ভয় পাই নি। খুব সম্ভবত বাবার কথা চিন্তা করছিলাম দেখেই মৃত্যু আমাকে ঐ সময়টাতে নাড়িয়ে যেতে পারে নি। মাথায় শুধু তখন একটা কথাই ঘুরছিলো- বাবাকেও কি ওরা ধরে মেরে ফেলেছে! এতো দূর থেকে কারো চেহারা তেমন বোঝা যায় না, তাছাড়া অন্ধকারও নেমে এলো বলে। আমি শুধু মনে মনে একটা কথাই বলতে লাগলামঃ "আল্লাহ আমার বাবাকে বাচাও! আল্লাহ আমার বাবাকে বাচাও!"
মিলিটারি খুব বেশি সময় সেখানে থাকে নি। তাদের কাছে সময়ের মূল্য নিশ্চই অনেক বেশি, অন্ততঃ কয়েকটা মানুষের জীবনের থেকে তো বটেই। যেভাবে হঠাত করে একটা ঝড়ের সৃষ্টি হয়েছিলো, সেরকম হঠাত করেই সেটা থেমে গেলো।
আমরা পাঠখেত থেকে বেরিয়ে এলাম আকাশে চাঁদ উঠে চারপাশ আলো হয়ে যাবার পর। মনে আছে- ফুটফুটে জোছনা হয়েছিলো সে রাতে। চাঁদের হাল্কা আলোয় জীবিত মানুষগুলো লাশের কাছাকাছি গিয়ে সবাই নিজেদের চেনা মুখগুলোকে খুজতে থাকে। আমি আর মা'ও খুজি। বাবাকে। ভুতূড়ে নিস্তব্ধতায় নিমগ্ন এক গ্রাম, নীলাভ জোছনায় হাবুডুবু খেতে খেতে ভেসে বেড়ানো চাপা কান্নার স্বর আর জীবন-মৃত্যুর সহ-অবস্থানের এক বীভৎস পৃথিবীতে আমি আমার হারিয়ে যাওয়া বাবাকে খুজে বেড়াই। আর আমার মা তার স্বামীকে। প্রথম প্রথম প্রতিটা লাশের চেহারা দেখবার আগ দিয়ে এক তীব্র আশংকা আমার মধ্যে কাজ করছিলো। যখন আবিষ্কার করতাম যে লাশটি আমার বাবার নয়- তখন সে আশংকা পালটে যেতো এক অবসন্ন স্বস্তিতে! তবে সময় যতই গড়াতে লাগলো- আমার অনুভূতি ততই ভোতা হয়ে এলো। আমার এখনো স্পষ্ট স্মরণে আছে- শেষের দিকের লাশগুলো দেখার সময় আমি পুরোপুরি অনুভূতিহীন, একরকম ঘোরের মধ্যে ছিলাম।
শেষ পর্যন্ত সে লাশের মিছিলে আমার বাবাকে আমরা খুজে পাই নি। আরো কয়েকটা পরিবারও ছিলো সেরাতে আমাদের মত, তারাও তাদের প্রিয় মানুষগুলোর সন্ধান বের করতে পারলো না। যাদের লাশ পাওয়া গেলো, তাদেরটা তো গেলোই- আর যাদেরকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না- আমরা ধরে নিলাম- তাদেরকে মিলিটারি ধরে নিয়ে গিয়েছে। আমার বাবার সাথে সেটাই আমাদের শেষ দেখা; এরপর থেকে আর বাবার সাথে আমাদের কোন যোগাযোগ নেই।
২
ত্রিপুরার শরণার্থী শিবিরে আমার আর আমার মায়ের থাকার জায়গা হয়েছে একটা গোল, বড় পাইপে। সেখানে প্রতিদিন খাবারের কষ্ট, পানির কষ্ট, নেই বাথরুম করার ভালো কোন ব্যবস্থা, মেয়েদের জন্য তো পুরো ব্যাপারটা হয়ে দাড়িয়েছে আরো ভোগান্তির; কিন্তু তারপরেও সত্যি কথা বলতে- অনেকে এখানে বেশ ভালোই আছে হয়তো! বিশেষতঃ পরিবার পরিজন নিয়ে যারা এসেছে- তারা বেশ নিশ্চিন্ত আছে বলেই মনে হয়। আর নিশ্চিন্ত থাকবেই বা না কেন- এখানে তো আর মিলিটারি ধরে নিয়ে যাওয়ার কোন ভয় নেই!
আমাদের ডান পাশের পাইপে একজন মা তার দুই মেয়ে, এক ছেলে নিয়ে থাকছেন। ছেলেটার বয়স একেবারেই কম, চার কি পাচ হবে। মেয়ে দু'টো বড় বড়। একজন তো ভাইয়ার চেয়েও দু-এক বছর বড় হবে, অন্যজন প্রায় শাহিদা আপুর সমবয়েসী। মজার ব্যাপারটা হোল- উনার নামও শাহিদা! খুব স্বাভাবিকভাবেই তাই তাকে দেখে আমার শাহিদা আপুর কথা মনে পড়ে- না জানি আপুরা এখন কোথায় আছে, কেমন আছে! আমাদের মতই বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়া চলে গিয়েছে কি না, কে জানে!
আমরা যেদিন ঢাকার বাসা থেকে চলে আসছি, তার আগের দিন শাহিদা আপু আর কাকীমা এসেছিলো আমাদের বিদায় জানাতে। কাকীমা আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কাদলো অনেকক্ষণ, শাহিদা আপুও দেখলাম ওড়নার খুট দিয়ে চোখ মুছছে। বিদায় নিয়ে চলে যাবার আগে আপু আমার কাছে এসে নীচু গলায় জিজ্ঞেস করলো- "অহনা, সাখাওয়াত ভাইয়ের কোন খবর জানিস? চলে যাওয়ার পর কি আর তোদের সাথে কোন যোগাযোগ হয়েছে?"
আমি মাথা নেড়ে 'না' করলাম!
আপু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফিসফিসে, অথচ দৃঢ় গলায় বললো- "তোকে একটা কাগজ দিচ্ছি। কাগজটা খুব যত্ন করে রাখিস! সাখাওয়াত ভাইয়ের সাথে যখন দেখা হবে- তখন ওকে কাগজটা দিস। পারবি না!"
আমি কিছুটা অবাক চোখে আপুর দিকে তাকিয়ে ঘাড় কাত করলাম। আপু তার ওড়নার গিট খুলে আমাকে ছোট্ট একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে ক্লান্ত গলায় শুধু বললো- "কাগজটার কথা তুই ছাড়া আর কেউ জানে না...."
শাহিদা আপুর সেই চিঠি আজ আর আমার কাছে নেই। ঢাকা থেকে ত্রিপুরা আসার পথে কোন এক জায়গায় চিঠিটা হারিয়ে গেছে। আমি জানি না- কি লেখা ছিলো সে চিঠিতে, কখনো কাগজের ভাজ খুলে পড়া হয়ে ওঠে নি। কিন্তু চিঠিটা দেবার সময় শাহিদা আপুর দৃষ্টির গভীরে আমার ভাইয়ের জন্য যে জনম আগলে-রাখা মায়ার সন্ধান আমি দেখেছিলাম, সেই অনুভূতি মিথ্যে হবার কথা না। চিঠিটা দিয়ে সে যখন গোপনে নিজের চোখের পানি মুছে নিয়েছিলো- সে দৃশ্যও আমার চোখ এড়ায় নি; আমি তার মনের কথা খুব ভালোই বুঝতে পেরেছিলাম। আমার মনে হয়- যে কোন মেয়েই সেটা পারবে! সত্যি বলতে- সে মুহূর্তে আমার ভাইয়াকে খুব ভাগ্যবান একটা ছেলে বলেই মনে হোল!
এই কারণেই আমি আসলে শাহিদা আপুর কথা মনে করতে চাই না! তার কথা মনে হলেই অবধারিতভাবে আমার ভাইয়ার কথা মনে পড়ে যায়। আচ্ছা, ভাইয়ারও কি শাহিদা আপুর প্রতি দুর্বলতা ছিলো? আম্মুকে জিজ্ঞাসা করলে হয়তো কিছুটা আভাস পাওয়া যেতে পারে। মায়েরা অনেক কিছু আগে আগে টের পায়।
আম্মুর শরীরটা ইদানীং অবশ্য খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। প্রচন্ড মানসিক চাপ একসময় শরীরের ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করে- আম্মুরও এখন সে অবস্থা চলছে। একসময় যার ভালোবাসার এক সংসার ছিলো, স্বামী ছিলো, ছিলো আদরের সন্তানেরা- আজ তার কিছু নেই। যুদ্ধ এই মহিলার সব ছারখার করে দিয়েছে। তাই এখন আমার মূল দায়িত্ব আসলে যে কোন উপায়ে আমার মা'কে সুস্থ রাখা। আব্বু কিংবা ভাইয়ার কথা আমি জোর করে মাথা থেকে সরিয়ে রাখতে চাই স্রেফ এই কারণে; আম্মুর দিকে তাকিয়ে মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দেই- "আমাকে শক্ত থাকতে হবে। আম্মুর মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও আমাকে এখন শক্ত থাকতে হবে।"
তাই সকাল থেকে নিয়ে আমার ডিউটি শুরু হয়। আমাদের শিবিরের প্রতিটা শরণার্থী পরিবারের জন্য একটা করে রেজিস্ট্রেশন কার্ড দিয়ে দেয়া হয়েছে। সে কার্ডে পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনুযায়ী প্রতিদিন খাবার বিতরণ করা হয়। প্রথম দিকে পুরো ব্যাপারটা বেশ একটা বিশৃংখল অবস্থায় ছিলো, কিন্তু এখন পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি ঘটেছে। সেখানে প্রতিবেলায় খাবারের জন্য লম্বা লম্বা কয়েকটা লাইন হয়, আমি ধৈর্য ধরে মানুষের আকাবাকা সে সারিতে দাঁড়িয়ে খাবারের জন্য অপেক্ষা করে থাকি।
আমাদের সৌভাগ্য যে আমি কিংবা মা, আমরা কেউই এখানে আসার পর অসুস্থ হয়ে পড়ি নি। চিকিৎসার বড় আকাল আমাদের এই শিবিরে। যদিও ইদানীং ছোট্ট একটা ডিসপেন্সারির মত খোলা হয়েছে, কিন্তু ইতিমধ্যেই অনেকে মারা গেছে পর্যাপ্ত ওষুধ আর চিকিৎসা সেবার অভাবে। আমাদেরই কয়েক পাইপ বামে খুব সম্ভবঃ শ্বশুর-শাশুড়ি, ছেলে-বৌ আর তার দুই সন্তানের যে পরিবারটা জুলাইয়ের শেষের দিকে উঠে এসেছিলো, এখন তাদের সদস্য সংখ্যা কমে এসেছে তিনে; ছোট বাচ্চা দু'টিই গত সপ্তাহে কলেরায় মারা গেছে। আমার খুব খারাপ লেগেছিলো বৌটাকে দেখে- একেবারেই কম বয়স মেয়েটার; আমার থেকে বড়জোড় কয়েক বছরের বড় হবে! আর এই বয়েসেই বেচারিকে কি না সন্তান হারানোর মত প্রবল শোক সইতে হচ্ছে! আহারে!
বেশিরভাগ রাতেই আমি প্রথমে মা'কে ঘুম পাড়িয়ে তারপর নিজে ঘুমানোর চেষ্টা করি। মনে মনে ভাবি- ইশ! আজ রাতে যদি আবার সেদিনের মত ভাইয়াকে স্বপ্নে দেখতে পেতাম! আম্মুকে সেদিন আমার স্বপ্নের কথা বলাতে আম্মু খুব খুশি হয়েছিলো, চোখ মুছতে মুছতে ধরা গলায় বলেছিলো- "খুব ভালো স্বপ্ন দেখেছিস রে মা, খুব ভালো স্বপ্ন দেখেছিস".... কোথায় যেন পড়েছিলাম- মানুষ নাকি নিরুপায় হলেই কেবল বাস্তবতার ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে অলৌকিকতার দারস্থ হয়- আমার মায়ের ক্ষেত্রেও মনে হয় এখন সেটাই ঘটেছে। তা না হলে সামান্য একটা সুখ-স্বপ্নের কথা শুনে কেউ কি এতো উচ্ছ্বসিত হয়, না হওয়া উচিত?!
আমার অবশ্য একদিক দিয়ে সুবিধাই হয়েছে! আমি যেহেতু জানি- মা এধরণের কথা শুনলে খুশি হয়- তাই যখন আমার আম্মুকে দেখে খুব মায়া লাগতে থাকে, যখন মনে হয়- আজকের দিনটা অন্ততঃ এই মহিলার একটু ভালো কাটুক- তখন হঠাত মনে পড়ে গিয়েছে- এমন ভঙ্গিতে আমি আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলিঃ "ওহ আম্মু! তোমাকে তো বলা হয় নি। কাল তো আমি আবার ভাইয়াকে স্বপ্নে দেখেছি! মনে হয় আব্বুও ছিলো- পুরোটা এখন আর ঠিক মনে নেই...."
আগ্রহে জ্বলজ্বল চোখ নিয়ে আম্মু জিজ্ঞেস করেঃ "কি দেখলি?"
আমাকে তখন বানিয়ে বানিয়ে একটা স্বপ্নের কথা বলতে হয়! যে স্বপ্নে আশা আছে, আছে অনাগত সুখ-ভবিষ্যতের গোপন কোন ইঙ্গিত! আমার মামণিটা চোখেমুখে গভীর ভালোবাসার স্পষ্ট অভিব্যাক্তি ফুটিয়ে অপূর্ব সে স্বপ্নের কথা শোনে, বড় মায়া লাগে আমার!
মাঝে মাঝে দুপুরের দিকটাতে আম্মুকে ঘুম পাড়িয়ে আমি ঘুরতে বের হই। মিনিট বিশেক হাটলেই মানুষ, শরণার্থী ক্যাম্প আর রোজকার কোলাহল- এসব কিছুই আস্তে আস্তে মৃদু, স্তিমিত হয়ে আসে। আমি উদ্দেশ্যহীনের মত হাটি। আর আমার সাথে সাথে আকাশপথে ভেসে চলে সূর্য। ধীরে ধীরে তার কঠোরতা পালটে যেতে থাকে এক মন ভোলানো সম্মোহনে। যতক্ষণে আমি পশ্চিমের টিলাগুলোর কাছাকাছি পৌছে যাই, ততক্ষণে শরতের বিকেল তার মুগ্ধতা ফেরি করতে শুরু করে দিয়েছে। সে বিকেলের সোনালি-হলুদ রোদ মানুষের মনের চোখে বিভ্রমের চশমা পড়িয়ে দেয়, চেনা-পরিচিত এই পৃথিবীকে তখন মনে হয় রূপকথার কোন অপূর্ব জগত! যে জগতে দুঃখ নেই, যন্ত্রণা নেই, নেই ভালোবাসাকে হারিয়ে ফেলবার ভয়।
মাঝে মাঝে ছোটখাট কোন টিলার উপরে উঠে আমি গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাড়াই। অপেক্ষা করি সূর্য ডুবে যাবার। পশ্চিমে যে দেশ, যে শহর আমরা পেছনে ফেলে এসেছি- সে তার ওপরই রঙ্গন ফুল-রঙ্গা সূর্যটা ধীরে ধীরে ডুবে যেতে থাকে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার বাবার কথা মনে হয়, ফিজিক্স পাগল ভাইয়ার কথা মনে হয়; মনে পড়ে মায়াবতী শাহিদা আপুর স্মৃতি- যে কি না সাখাওয়াত নামের এক লাজুক ছেলের জন্য অনন্ত নক্ষত্রবীথির মতই গভীর ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করে আছে। প্রিয় মানুষগুলো স্মৃতির মেঘমালায় যে অস্থিরতা তৈরি করে, তার আলোড়নেই আমার দু'চোখ বেয়ে বেদনার শ্রাবণ নামে। আমি সাথে সাথে আবার চোখের পানিটুকু মুছে ফেলি, মনে মনে নিজেকে বলি- "অহনা, তোমাকে শক্ত মেয়ে হয়ে থাকতে হবে। কোনভাবেই ভেঙ্গে পড়া চলবে না। না না না...."
পড়ন্ত সূর্যের আলোয় গাছের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় আর আমি আমার আশ্রয়ে ফেরার পথ ধরি। আমার ক্লান্ত লাগে খুব।
কেন জানি না- গন্তব্যে ফেরার রাস্তাটুকু আমার ক্ষণিকের জন্য বড় অচেনা মনে হয়!
শেষ কথাঃ
ডিসেম্বরের ১৮ তারিখ অহনা আর তার মা দেশে ফিরে এসে বাবাকে ঢাকার বাসাতেই দেখতে পেলো। হানাদার মুক্ত স্বাধীন দেশে নিজ স্ত্রী আর মেয়েকে ফিরে পাবার খুশিতে জয়নাল সাহেব শিশুদের মত চিতকার করে কাদতে থাকেন। শুকরিয়া জ্ঞাপন করেন পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে, কৃতজ্ঞতা ভরে স্মরেণ তার অনুগ্রহের কথা। এখন শুধু ছেলেটার জন্য অপেক্ষা, আল্লাহ আল্লাহ করে সে যেন সহি সালামতে ফিরে আসে- এখন শুধু সেই প্রার্থনা! ইতিমধ্যে তিনি কিছু খোজও লাগিয়েছেন; দেখা যাক কি হয়!
তবে সে ডিসেম্বরের পর বছর ঘুরে আরো একটা ডিসেম্বর ফেরত এলেও আর ফেরে নি সে বাড়ির বড় ছেলে সাখাওয়াত। অহনা এখন আর তারা দেখতে ছাদে ওঠে না, চুপচাপ মন খারাপ করে ঘরের ভেতর বসে থাকে। মাঝে মাঝে ভাইয়ার ফিজিক্সের বইগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে- কখনো সাকুরাই এর Advanced Quantum Mechanics, কখনো ফেইনম্যান এর লেকচারগুলো। মাঝে মাঝেই যখন ধুলো পড়ে বইয়ের মলাট ঝাপসা হয়ে আসে, তখন কাপড় দিয়ে ঝেড়ে-মুছে সেগুলো পরিষ্কার করে রাখে সে। এক একবার অহনার মনে হয় বইগুলো বুঝি কিছুতেই আর ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে উঠছে না, যতই চেষ্টা করা হোক না কেন- সেগুলো রয়ে যাচ্ছে সেই অস্পষ্ট, ধূসর! বোকা মেয়েটা বুঝতেও পারে না- ধুলোর আস্তর জমে থাকবার কারণে আসলে বইগুলোকে তার কাছে ঝাপসা বলে মনে হচ্ছিলো না, ঝাপসা মনে হচ্ছে- কারণ প্রিয় ভাইয়ের স্পর্শ লেগে থাকা বইয়ের ধুলো ঝাড়তে গিয়ে- নিজের অজান্তেই তার দু'চোখ ভর্তি হয়ে এসেছে পানিতে।
পাশের বাসার শাহিদাও এখন আর আগের মত গান গায় না। তার গলায় সুর হয়তো এখনো আছে ঠিকই, কিন্তু অন্তরের সুর নষ্ট হয়ে গেছে। শাহিদার খুব ইচ্ছে করে- আবার আগের মত ছাদে উঠে গান গাইতে; সে কিন্নরী কন্ঠে গাইবে-
"জনম জনম তব তরে কাঁদিবো......"- আর পাশের ছাদে দাঁড়িয়ে সে গান শুনবে শান্ত, সৌম্য চেহারার ঐশ্বর্যবান এক যুবক। মাঝে মাঝে চোখাচোখি হবে তাদের, সাখাওয়াত তাকে দেখে হাসবে শুধু। কিছু বলবে না!
প্রতি রাতে ঘুমাতে যাবার আগে এশার নামাজ পড়ে সালেহা বেগম মোনাজাত করেন। পিতা মাতার জন্য সন্তানের প্রার্থনা তার জানা আছে- 'হে আমার প্রতিপালক! আমার বাবা-মাকে এমনভাবে করুণা করুন, যেভাবে তারা ছোটবেলায় আমাকে লালন-পালন করেছেন', কিন্তু নিজের বড় ছেলের জন্য আল্লাহর কাছে কোন ভাষায় তিনি চাইবেন- সেটা ভেবে পান না। নীরবে শুধু দু'হাত তুলে বসে থাকেন। মমতাময়ী মায়ের অশ্রু ফোটা ফোটা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। কে জানে, হয়তো এই কান্নাটুকুই সর্বশক্তিমানের কাছে শক্তিশালী কোন প্রার্থনা হয়ে পৌছে যায়।
যে প্রার্থনাটুকু সম্বল করেই বুঝি সাখাওয়াতের মত ছেলেরা বাংলার বুকে চিরদিনের মত শায়িত, সমাহিত হয়ে থাকে। শরতের তুলো-সাদা মেঘ আর দিগন্তের নিবিড়, ঘন বনরেখার ছায়া তাদের পরম মমতায় আগলে রাখতে চায়- এ জমীনের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা এখন অন্ততঃ কিছুটা বিশ্রাম করুক, কোনভাবেই যেন আর কেউ তাদেরকে বিরক্ত করতে না পারে।
বাংলার গাঢ় নীল আকাশ, এদেশের নরম মাটির ওপর ঝুকে পড়ে- তাদের উদ্দেশ্যেই যেন ফিসফিস করে আজো ঘুমপাড়ানি কোন গান শোনায়!
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ১০:৪৭