বইমেলার কিছু কিছু স্টলকে চিপসের প্যাকেটের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। বিনা কারণে ফুলে থাকা প্যাকেটগুলোতে যেমন চিপসের চেয়ে বাতাস বেশি, তেমনি সে স্টলগুলোর আশেপাশেও একটা ফাপা ফাপা অবস্থা বিরাজ করতে দেখা যায়। গত বছর বইমেলায় এমনি এক স্টল দেখে সেটার দিকে এগিয়ে গেলাম।
স্টলের নাম আমার এই মুহূর্তে খেয়াল নেই, তবে সেটা আদিবাসীদের প্রকাশিত নানা সাহিত্যকর্ম দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সম্ভবতঃ সময়টা তখন সন্ধ্যের ঠিক আগে আগে; আধো আলো আধো ছায়ায় দেখতে পেলাম অস্পষ্ট, ধুসর বেশ কিছু বই নিয়ে একজন আদিবাসী মানুষ বিরস মুখে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন, চোখেমুখে তার জগৎসংসারের প্রতি উদাসীনতার ভাবটুকু স্পষ্ট।
যাই হোক- আমি কিছুক্ষণ এই বই সেই বই নাড়াচাড়া করে শেষমেষ উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট, রাঙ্গামাটি এর প্রকাশিত একটা বই কিনে ব্যাগে ভরলাম। বইয়ের নাম- 'উপজাতীয় রূপকথা, লোককাহিনী এবং কিংবদন্তী'। মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে যখন দিতে যাচ্ছি, তখন পেছন থেকে শুনতে পেলাম কে যেনো বলছে- "আরে ধুর! এইডা চাকমা স্টল। চল, সামনে যাই...." (কোন একটা বিচিত্র কারণে আদিবাসী মানেই আমাদের বাঙ্গালিদের কাছে সে 'চাকমা'। যেন চাকমা ছাড়া আর কোন জাতিসত্তা এ দেশে নেই)
২১ শে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে এই ব্লগেই গত কয়েকদিন ধরে একটা প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে- যেটা খুবই স্বাভাবিক। বেশ কিছু তথ্যবহুল ও মানসম্পন্ন লেখাও লিখেছেন অনেকে। নিজের ভাষার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে হোক, আর শ্রদ্ধা জানাবার জন্যেই হোক- সেরকম প্রতিটি লেখাই এই ব্লগ-জগত, অন্তর্জাল, সর্বোপরি বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য এক মূল্যবান সম্পদ বলেই আমি মনে করি।
যাই হোক, আমার এই পোস্টের উদ্দেশ্য- বাংলাদেশের বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভাষা এবং তার বর্তমান দুরবস্থা নিয়ে অতি সামান্য আলোচনা। এমন গৌরবোজ্জ্বল একটা সময়ে এসে নিজেদের দুর্বলতা নিয়ে ঘাটাঘাটি করাটা কি আদৌ ঠিক হবে কি না- কে জানে! কিন্তু আমার মনে হয়- আজ হোক, কাল হোক- সে আলোচনা জোরেশোরে শুরু হওয়া উচিত। যে দেশের মানুষ মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বুলেটের মুখোমুখি দাড়িয়েছেন, যারা মায়ের ভাষার স্বীকৃতি আদায় করবার জন্য নিজেদের মাথা উচু করেছেন বারবার- সে জাতি, সে বর্ণমালার ধারক বাহক হয়ে আজ যদি অন্য কারো মাতৃভাষাকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে দেখা লাগে, তাও আবার সেই বাংলাদেশেই- তবে সেটা নিঃসন্দেহে ভাষা শহীদদের অপমান, অপমান একুশের চেতনার!
আর কথা না বাড়িয়ে তবে মূল আলোচনায় প্রবেশ করি।
প্রাথমিক পরিচয়
একেবারে সুনির্দিষ্ট না হলেও- বাংলাদেশে বাংলা ভাষার পাশাপাশি আরো প্রায় ত্রিশটির মতন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ভাষা রয়েছে বলে মনে করা হয়।
পড়ার সুবিধার জন্য আমি সে ভাষাসমূহ নিয়ে একটা টেবিলের মত বানিয়েছিলাম, কিন্তু সেটা এখানে দিতে পারলাম না। যতবার টেবিলটা দেয়ার চেষ্টা করেছি, পুরো পোস্টের চেহারা ভয়ংকরভাবে 'চ্যাগায়া' [দুঃখিত পাঠক, এই শব্দের পরিশীলিত রূপটি ব্যবহার করতে পারলাম না বলে!] গিয়েছে। শেষমেষ নিচের ক্রম অনুযায়ী বিশটি ভাষা সাজিয়ে আপনাদের সামনে পেশ করছি-
ভাষা-> জাতিগোষ্ঠী-> বাংলাদেশে বিস্তৃতি-> ভাষা পরিবার-> লিপি
১। চাকমা-> চাকমা-> পার্বত্য চট্টগ্রাম-> ইন্দো-ইউরোপীয়-> চাকমা (অব্যবহৃত)/বাংলা/ল্যাটিন
২। সাঁওতালি-> সাঁওতাল-> ময়মনসিংহ, উত্তরবঙ্গ-> ল্যাটিন/বাংলা/দেবনাগরি(ভারত) ইত্যাদি
৩। মারমা-> মারমা-> পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার-> চীনা-তিব্বতি-> বার্মিজ (ভারত)
৪। ককবোরক-> ত্রিপুরা-> পার্বত্য চট্টগ্রাম-> চীনা-তিব্বতি-> বাংলা/ ল্যাটিন
৫। মান্দি-> গারো-> বৃহত্তর ময়মনসিংহ-> চীনা-তিব্বতি-> বাংলা/ ল্যাটিন
৬। কুড়ুখ-> ওরাও-> উত্তরবঙ্গ-> দ্রাবিড়-> দেবনাগরি
৭। সাদরি-> ওরাও, মাহাতো, মাহালি, সিং, রাজোয়ার, পাহান-> ইন্দো-ইউরোপীয়-> বাংলা/ ল্যাটিন
৮। খাসি-> খাসিয়া-> সিলেট-> অস্ট্রো-এশিয়াটিক-> বাংলা(বর্তমানে প্রায় অব্যবহৃত)/ল্যাটিন
৯। ম্রো-> মুরং-> বান্দরবান-> চীনা-তিব্বতি-> ম্রো লিপি
১০। খুমি-> খুমি-> বান্দরবান-> চীনা-তিব্বতি-> --
১১। মুন্ডারি->মুন্ডা-> উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল, সিলেট জেলার চা বাগান এবং বৃহত্তর যশোর এবং খুলনা জেলায়-> অস্ট্রো-এশিয়াটিক->বাংলা/দেবনাগরি/ল্যাটিন ইত্যাদি
১২। কোচ-> কোচ-> বৃহত্তর ময়মনসিংহ, বরেন্দ্র অঞ্চল-> চীনা-তিব্বতি-> বাংলা
১৩। পাত্র বা লালং-> পাত্র বা লালং-> সিলেট-> অজানা-> নিদর্শন পাওয়া যায় নি
১৪। মৈতেয় এবং বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি-> মণিপুরি-> মৈতেয় মণিপুরি –চীনা-তিব্বতি, বিষ্ণূপ্রিয়া মণিপুরি- ইন্দো-ইউরোপীয়-> মৈতেয় মণিপুরি- বাংলা/মিতেয়ি মায়েক, বিষ্ণূপ্রিয়া মণিপুরি-বাংলা
১৫। লুসাই-> মিজো/লুসাই-> রাঙ্গামাটি, বান্দরবান-> চীনা-তিব্বতি-> বাংলা/ল্যাটিন
১৬। পাংখোয়া-> পাংখোয়া-> রাঙ্গামাটি, বান্দরবান -> চীনা-তিব্বতি-> দেবনাগরি/ল্যাটিন
১৭। চাক-> চাক-> বান্দরবান-> চীনা-তিব্বতি-> ---
১৮। রাখাইন-> রাখাইন-> কক্সবাজার, পটুয়াখালি ও বরগুনা জেলা-> চীনা-তিব্বতি-> বার্মিজ
১৯। ঠেট-> বেদে সম্প্রদায়-> অনির্দিষ্ট-> চীনা-তিব্বতি-> নিজস্ব লিপি নেই
২০। তঞ্চঙ্গা-> তঞ্চঙ্গা-> রাঙ্গামাটি, বান্দরবান,কক্সবাজার-> ইন্দো-ইউরোপীয়-> বর্মি-মনখমের
এখানে উল্লেখ্য, উপরের ভাষাগুলো ছাড়াও কিন্তু বাংলাদেশে আরো কিছু ভাষা দেখতে পাওয়া যায় (উদাহরণ- হাজং, পাহাড়িয়া, মাহালি, বম ইত্যাদি)। কলেবর বেড়ে যাবে দেখে এখানে সেগুলো আর উল্লেখ করলাম না।
আদিবাসী ভাষার বর্তমান অবস্থা
সত্যি কথা বলতে- অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। একটা ভাষা কতটা সমৃদ্ধ- তার একটা মাপকাঠি হতে পারে- সে ভাষার নিজস্ব সাহিত্য-ভান্ডার কতটা ঐশ্বর্যশালী। উদাহরণস্বরূপ চাকমা ভাষার কথা বলা যেতে পারে। বাংলাদেশে সংখ্যার বিচারে চাকমারা সর্ববৃহৎ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী, 'চাকমা' তাদের মাতৃভাষা। সে ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা 'চাকমা' বর্তমানে আর তেমন ব্যবহৃত হয় না; বাংলা অথবা ল্যাটিন লিপি তার জায়গা দখল করে নিয়েছে। চাকমাদের মাতৃভাষায় সাহিত্য আছে ঠিকই, কিন্তু আশংকার কথা হোল- চাকমা জাতিসত্তার অল্প কিছু মানুষ শুধু সে সাহিত্য সম্পর্কে ভালোমত জানে। 'সিল ইন্টারন্যাশনাল' নামক এক আন্তর্জাতিক ভাষা-ভিত্তিক সংগঠনের জরিপ থেকে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। জরিপে অংশ নেয়া চাকমাদের অর্ধেক লোকের মতামতই হচ্ছে- তাদের নিজেদের ভাষার বেশিরভাগ উপকরণই তাদের নিজেদের কাছে দুর্বোধ্য। জরিপের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বলেছেন শুধুমাত্র প্রার্থনার সময়েই চাকমারা নিজেদের ভাষা ব্যবহার করেন।
এ তো গেলো বাংলাদেশের সব থেকে বড় আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর কথা, অন্যদের কি অবস্থা? সিলের জরিপ থেকে উঠে এসেছে প্রায় অর্ধেক সাঁওতাল- তাদের নিজস্ব সাঁওতালী ভাষায় পড়তে বা লিখতে পারে না। এখানে উল্লেখ্য- সাঁওতালরা বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী।
উত্তরবঙ্গের ওঁরাও জাতিগোষ্ঠীর ভাষা 'কুড়ুখ' আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। একই অবস্থা মিজো বা লুসাই ভাষার। আনুমানিক মাত্র ৬০০ জন প্রতিনিধির এ জনগোষ্ঠী মূলতঃ বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস করে। খাসি ভাষার অবস্থা বাংলাদেশে আশংকাজনক, হারিয়ে যাচ্ছে কোচ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষাও। ইউনেস্কো থেকে রাজশাহীর জাতিগোষ্ঠী 'কডা'দের ভাষা অতিবিপন্ন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সব মিলে পরিস্থিতি এতোটাই খারাপ যে- সৈয়দ শাহরিয়ার রহমান (সহযোগী অধ্যাপক, ভাষাতত্ব বিভাগ, ঢা.বি.) বলেন- গ্রেডেড ইন্টারজেনারেশনাল ডিসরাপশেন স্কেল (ভাষার বিপন্নতা/ দৃঢ়তা মাপার জন্য এক ধরণের মানদন্ড) অনুযায়ী এ কথা বলাই যায় যে বাংলাদেশের সব আদিবাসী ভাষার অস্তিত্বই হুমকির মুখে।
এই অধঃপতনের কারণ
বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষাগুলোর এমন অধঃপতনের কারণ হিসেবে খুব স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার প্রসঙ্গটা চলে আসে। বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির শিশুরা নিজ মায়ের ভাষায় কথা বলার ক্ষেত্রে প্রথম এবং বোধকরি সব থেকে বড় হোচটটা খায়- স্কুলে ভর্তি হবার পর। জন্মের পর থেকে শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে যে বাচ্চাগুলো মায়ের ভাষা ব্যবহার করে, সেই তারাই প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য বিদ্যালয়ে এসে আবিষ্কার করে- শিক্ষকদের কথা আর তারা বুঝতে পারছে না। তাকে যে বইগুলো দেয়া হয়েছে- সেখানে অবোধ্য সব অক্ষর, তার মায়ের ভাষা থেকে যে বর্ণমালার দূরত্ব যোজন যোজন। সেই আদিবাসী শিশুটি- না শিক্ষক, না ক্লাশের অন্য ছাত্রদের কথা ভালোভাবে বুঝতে পারে, না পারে নিজের শৈশবের হাসি-আনন্দ অন্য শিশুদের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে। অনেকে সংগ্রাম করে টিকে থাকে, যারা পারে না- তারা পড়ালেখাই ছেড়ে দেয়।
বেশিরভাগ আদিবাসী ভাষারই নিজস্ব বর্ণমালা নেই- যা তাদের ভাষা সংরক্ষণের কাজটাকে আরো কঠিন করে তুলেছে। ত্রিপুরা, গারো, খাসি, খুমি- এ ভাষাগুলোর কোনটিরই নেই নিজস্ব লিপি। পরিস্থিতি আরো খারাপ মনে হয় যখন আদিবাসীদের আর্থিক অবস্থার বিষয়টি সামনে চলে আসে। যেখানে পেটে ভাত যোগানোর জন্যই দিনরাত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়, সেখানে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষা করাটা তো একরকম বিলাসিতাই! পূর্বে উল্লেখ করা সিল ইন্টারন্যাশনাল এর জরিপেই সে বাস্তবতা অনেকটা উঠে এসেছিলো- জরিপে অংশ নেয়া প্রায় অর্ধেক সাঁওতালই মনে করেন- নিজেদের ভাষার চেয়ে বাংলা তাদের কাছে বেশি 'প্রয়োজনীয়'। আর সে 'প্রয়োজনীয়তা' থেকেই তারা বাংলা ভাষাকে নিজ ভাষার তুলনায় প্রাধান্য দিচ্ছেন।
সব মিলে ঘুরে ফিরে এগুলোই আসলে ভাষা বিপন্ন হবার পেছনের কারণ।
বিশেষজ্ঞ মত অনুযায়ী সম্ভাব্য সমাধান যা যা হতে পারে
স্পর্শকাতর এ বিষয়টির উন্নয়নে সব ধরণের পৃষ্ঠপোষকতা দান করবার কথা মূলতঃ সরকারের; এ বিষয়ে কাজও যে হচ্ছে না, এমন নয়। তবে সেটা এখনো বলা যায়- আটকে আছে কাগজে কলমেই। খাতা পত্রের সে নীতিও যদি অন্ততপক্ষে দ্রুত বাস্তবায়ন করা শুরু হয়, তাহলেও বিরাজমান পরিস্থিতির অনেকখানি উন্নতি করা সম্ভব। সে উদ্দেশ্যে অনতিবিলম্বে যা যা করা যেতে পারে, সেগুলো মোটামুটি এই-
১. জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর আলোকে প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা যার যার মাতৃভাষায় দান করবার জন্য পরিবেশ তৈরি করাটা জরুরি। এ লক্ষ্যে প্রথমেই আদিবাসী ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনা ও সে ভাষার শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। এমন চিন্তাধারা থেকেই স্বল্প পরিসরে প্রথমে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাদরি ও গারো ভাষার শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের লক্ষ্যে কাজও শুরু হয়েছে, কিন্তু এখনো সেটা পুরোপুরি গুছিয়ে আনাটা সম্ভব হয় নি....
২. ঢাকার সেগুন বাগিচাস্থ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এর কার্যক্রম সম্পর্কে উইকিপিডিয়ার পেইজে উল্লেখ আছে-
"এই প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে পৃথিবীর সব ভাষা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হবে। পাশাপাশি হুমকির সম্মুখিন ভাষার বিস্তার ঘটানোর উদ্যোগ নেয়া হবে। বিভিন্ন ভাষার উপাদান ডাটাবেজে সংরক্ষিত হবে, শ্রবণ-দর্শন যন্ত্রের মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় বা বিলুপ্ত ভাষাগুলোকে দৃশ্যমান করা হবে। থাকবে বিশ্বমানের পাঠাগার, যাতে থাকবে বিভিন্ন ভাষার উপর লিখিত বই, ব্যাকরণ....।" বলার অপেক্ষা রাখে না- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট তার পূর্ণ সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে যদি সে অনুযায়ী কাজ করে যেতে পারে, তাহলেই আদিবাসী ভাষা সমস্যার একটা বড় অংশের সমাধান হয়ে যাবে। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠির ভাষার ওপর এই প্রতিষ্ঠানের একটি সমীক্ষা প্রকল্পের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। আশা করবো খুব দ্রুত সে প্রকল্পের মাঠ পর্যায়ের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে।
৩. বিদ্যমান অবকাঠামোর আওতায় উপজাতীয় কালচারাল একাডেমির কার্যক্রম আরো শক্তিশালি, আরো বেগবান করা যেতে পারে। এ উদ্দেশ্যে আদিবাসীদেরকে এ প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট করে এগিয়ে যেতে হবে; সাথে থাকবেন এ বিষয়ে অভিজ্ঞরা।
৪. ইলেকট্রনিক কিংবা প্রিন্ট মিডিয়া এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিভিন্ন জাতিসত্তার ভাষাভাষী মানুষদের সাহিত্য তথা গল্প, গান, কবিতা তাদের নিজ নিজ ভাষায় প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে গ্রহণ করা বিভিন্ন পদক্ষেপ, একই উদ্দেশ্যে স্থাপিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান (যেমনঃ উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি) ও তার কর্মকান্ড সুনির্দিষ্টভাবে আদিবাসী সমাজ পর্যন্ত পৌছে দেবার কাজে মিডিয়ার ভূমিকাই প্রধান। উপযুক্ত পরিসরে ধীরে ধীরে এ চর্চা অব্যাহত থাকলে এবং মিডিয়ার সে অবদান একেবারে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত পৌছে দেয়া সম্ভব হলে- অবস্থার উন্নতি আশা করা যায়।
৫. একুশে বইমেলা কিংবা জাতীয় কবিতা উতসবের মত বড় বড় উপলক্ষ্যে আদিবাসী ভাষা বিষয়ক এ স্পর্শকাতর সমস্যাটির প্রতি বিশেষ যত্নবান হওয়া যেতে পারে। আশার কথা হোল- এ ধরণের অনুষ্ঠানগুলোতে আদিবাসী ভাষাভাষীদের অংশগ্রহণ- স্বল্প পরিসরে হলেও- শুরু হয়ে গেছে। ২০০৫ সালের বইমেলাতেই চাকমা ভাষার একটি উপন্যাস এসেছিলো। গত কয়েক বছর ধরে জাতীয় কবিতা উতসবে 'অন্য ভাষার কবিতা' শিরোনামে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় কবিতা পাঠের উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। হয়তো এমন দিন খুব বেশি দূরে নয়- যখন বইমেলায় মানুষ আর অনাগ্রহ নিয়ে আদিবাসী কোন স্টলের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে না, বরং শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় গ্রহণ করে নেবে অন্য নানা জাতিগোষ্ঠীরও অপূর্ব সব সাহিত্য।
শেষ কথা
আমি নিজে ব্যাক্তিগতভাবে অত্যন্ত আশাবাদী একজন মানুষ, তাই নবীজী (সাঃ) এর একটা হাদীস আমার খুব প্রিয়- "তোমরা সহজ কর, কঠিন করো না এবং (লোকদেরকে) সুসংবাদ দাও। তাদের মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টি করো না।"[বুখারি ৬৯, ৬১২৫, মুসলিম ১৭৩৪, আহমদ ১১৯২৪, ১২৭৬৩].... চাইলেই এটা নাই, ওটা করা হয় নাই- ইত্যাদি ইত্যাদি বলে খুব সহজে শোরগোল সৃষ্টি করে ফেলা যায়, কারণ সত্যি কথা বলতে আমাদের এই দেশে অনেক কিছুরই অভাব আছে, শুধু অভাব নেই সমস্যার! তাই আমার মতে- যতটুকুই কাজ হয়েছে কিংবা হচ্ছে- সেটাকে আমরা স্বাগত জানাতে থাকি, উৎসাহ দিয়ে যাই; আর যে অংশটুকু হয় নি, অথচ হওয়া উচিত- সেটার জন্য নিজ নিজ জায়গা থেকে যতটা সম্ভব সচেতন থাকার চেষ্টা করি, সুদিন নিশ্চই আসবে!
আর অবশ্যই, অবশ্যই স্বপ্ন দেখি! স্বপ্ন দেখি এমন এক সময়ের- যখন আর কোন আদিবাসী শিশুকে ভাষার জন্য পড়ালেখা ছেড়ে দিতে হবে না। ছোট্ট লুসাই শিশুটিকে তার মা যে ভাষায় রূপকথা শুনিয়ে রাতে ঘুম পাড়াবে, সে একই ভাষা বুকে নিয়ে বাচ্চাটি আনন্দের সাথে সকালে উঠে স্কুলে যাবে। এই দেশেরই এক বাঙালি শিশু যখন আবৃত্তি করবে "আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই...", তখন ঠিক তারই বয়েসী আরেকজন, এদেশের আরেক প্রান্তে হয়তো পাংখোয়া কিংবা মান্দি ভাষার ছন্দ নিয়ে মেতে উঠবে উচ্ছ্বাসে, খেলায়! প্রথম প্রেমের মাদকতায় যখন কোন বাঙালি তরুণ নিজের মনেই গুন গুন করে গান ধরবে-
"... আপন হারা উদাসী প্রাণের
লহো গো প্রেমাঞ্জলি,
তোমারে রচিয়া ভরেছি
আমার বাউল গানের ঝুলি…।’
ঠিক তখনই, তার মতই কোন খাসিয়া কিংবা চাকমা তরুণী হয়তো নিজেকে সমর্পণ করে দেবে আপন আপন ভাষার ঐশ্বর্যশালী, ঝলমলে কোন প্রেমের কবিতার কাছে .....একসময় যে দেশের মানুষ একগুচ্ছ সাদাকালো বর্ণমালার জন্য নিজেরা রক্তের লালটুকু বরণ করে নিয়েছিলো, সে দেশে, সে ভাষার মানুষদের কাছ থেকে- আমার এ চাওয়া কি খুব বেশি কিছু!
ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল দুঃখিনী বর্ণমালা!
তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতাঃ
* প্রথম আলো, যায়যায়দিন, বিডিনিউজ২৪, সমকাল এবং সংবাদ পত্রিকার বিভিন্ন নিবন্ধ ও প্রতিবেদন
* বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ এর অফিসিয়াল সাইট
* শানজিদ অর্ণব এর 'ভাষাকোষ'
* Official site of Ethnologue
* উইকিপিডিয়া
* বাংলাপিডিয়া
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:৩৬