হাসান শুয়ে আছে চুপ করে।টেবিল ল্যাম্পের আলোয় ওর মুখ দেখা যাচ্ছে।আহারে।বড্ড মায়া লাগছে নিনিতার।অভিমান করে আছে হাসান।কখনোই বলেনা সে কথা।তবু বুঝে নিনিতা।বুঝবেই বা না কেন?এক বছরের সংসার ওদের।ভালোবাসার সংসার,বিশ্বাসের সংসার।তবু মান অভিমান রাগ এসব যে সংসারে রোজকার আহারের মতই।হতেই পারে।সেসব সময়ে হাসান চুপ করে থাকে।ঝগড়া করেনা কখনোই,কণ্ঠস্বর থাকে স্বাভাবিক,আগের মতই নামানো।নিনিতা একসময় ভাবে ভুল হয়ে গেল,রাগটা পড়ে যায় আপনাআপনিই।এই যেমন এখন হাসানের প্রতি গভীর মমতায় বুকটা ভরে উঠছে ওর।মেয়েদের কি এক আশ্চর্য ক্ষমতা।মনের অজান্তেই তারা রাগ করে,আবার সেই মানুষের প্রতি মমতায় হৃদয় আদ্র হয়,নিজের প্রতি গভীর করুণাবোধ হয়,ভাবে এত অবুঝের মত কাজটা কেনই বা করতে গেলাম।
চুল আঁচড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে উঠে দাঁড়ালো নিনিতা।ছোট বেলা থেকেই রাতে ঘুমুবার আগে হাতে পায়ে লোশন দেয়া,চুল আঁচড়ে পরিপাটি হয়ে ঘুমুতে যাবার অভ্যাস ওর।বড় আদরে বড় হয়েছে।বাবা মায়ের একমাত্র একমাত্র মেয়ে,কিছুটা শৌখিন।নিজের সে পরিচিত জগত ছেড়ে অনিশ্চয়তার একটা ভয় নিয়ে হাসানের ঘরে আসে ও।অথচ এই ঘরটাই যে এত আপন হয়ে উঠবে এত সহজে সে নিজেও ভাবেনি।
বিয়ের প্রথম দিনের কথা।নিজ বাসা থেকে আনা কাপড়গুলো আলমারিতে রাখতে গিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল।আলমারি ভর্তি মেয়েদের কাপড়।শাড়ি আছে কয়েক রকমের।শিফন,জামদানি।থ্রি পিছ এমনকি ওয়েস্টার্ন ও বাদ যায়নি।ব্যাপারটা কিছুই বুঝে উঠল না সে।হাসান মুগ্ধ হয়ে নিনিতার বিস্ময় দেখছে।তারপর খুব সাবলীল ভঙ্গিতেই বলতে শুরু করল,যেন দীর্ঘদিন ধরে নিনিতাকে বলার জন্যই কথাগুলো মুখস্থ করে রেখেছে সে,
"নিনিতা,একজন অতি আপনজনের সাথে জীবন কাটানোর স্বপ্ন সবারই থাকে।শুনেছি মেয়েরা নাকি কিশোরী হওয়ার পর থেকেই সে মানুষটা কেমন হবে তা সম্পর্কে ভাবতে থাকে।ছেলেদের ক্ষেত্রে সেটা হয় কিনা আমি জানিনা।আমার কখনো সেরকম ভাবনা আসেনি।তবে সে মানুষটাকে প্রচণ্ড ভালোবাসার ইচ্ছা আমি হৃদয়ে লালন করেছি।
আমার চাকরীর প্রথম বেতন পেয়েই সবার জন্যই টুকটাক কেনাকাটা করি।তখনই নিতান্ত পাগলামির বশে আমার হবু সহধর্মিণীর জন্য একটা শাড়ি কিনি।লুকিয়ে রেখেছিলাম শাড়িটা।এ ছিল শুরুর গল্প।তারপর থেকেই সময় সুযোগ হলেই জামা কাপড় কিনে রাখতাম।আমি জানিনা সে মানুষটা কি পরতে পছন্দ করে।তাই মোটামুটি সব ধরণের জামাই কেনা হয়েছে।তোমার অবাক মনে সন্দেহ করার কোন প্রয়োজন নেই যে আমার আগে কারো সাথে সংসার ছিল কিনা।নিছক ছেলে মানুষী বল বা যাই ভাবো কাজটা আমি বেশ আনন্দের সাথেই করতাম।"
হাসানের কথাগুলো শুনে নিনিতার কান্না পেয়ে যাচ্ছিলো।সত্যি এতটা কি কখনো কোন মেয়ে পায়?একটা অপরিচিত ভুবনে এসেই?কান্না আড়াল করতেই হেসে দিয়ে বলল "হাসান সাহেব তো বেশ ইন্টারেস্টিং মানুষ!"
এমন মানুষের সাথে বেশি সময় রাগ করে থাকা যায়না,থাকতে ইচ্ছা করেনা।নিনিতা হাসানের কপালে হাত রাখল।চোখ খুলতেই বলল,
-এখনও রেগে আছো?
-তোমার উপর কখনো রাগ করিনা আমি।এ কথাটা তোমার অজানা থাকার কথা না নিনিতা।
-ঐ একই।রাগ বলো আর অভিমান।সেই তো মৌনব্রত পালন কর সারাদিন।মনে কর কিছু বুঝতে পারিনা না?
-আপন হয়ে গেছো ভীষণ।আপন মানুষের চোখকে ফাঁকি দেয়া যায়না।তাই সব বুঝে ফেলো।
-হুম।এতই যখন আপন ভাবেন এরকম মুখ ভার করে রেখেছেন কেন?দেখি হাসুন তো একটু?হাসলে আপনাকে কেমন দেখায় দেখি একটু।
একটু ঝুঁকে নাকটা টিপে দিতে দিতেই বলল নিনিতা।ওর গায়ের ওড়না পড়ল হাসানের মুখের উপর।ওড়নাটা সরিয়ে নিনিতার দিকে তাকিয়ে আছে হাসান।
ঠোঁটের কোণে আশ্চর্য সুন্দর এক তিল।চোখ দুটো জলজ,যেন বিষাদমাখানো।সে চোখের আলাদা মায়া আছে,সে চোখে বিশ্বাস আছে।গায়ের রঙে স্নিগ্ধতা,নিখুঁত কোমনীয়তা নরম শরীর জুড়ে।চুলগুলো খোলা,কাঁধের একপাশে সরানো।নিনিতাকে বড় ভালো লাগে দেখতে হাসানের।এই রূপের মাঝে নিছক যে একটা চাওয়ার আবদার,এক কামনা আছে তা নয়,বরং অসীম এক প্রেম,এক শ্রদ্ধা আবার এক হারানোর ভয়ও আছে।নিনিতাকে খুব কাছে পেতে চায় হাসান।যতটা কাছেই ও থাকুক না কেন হাসানের তবু মনে হয় কি জানি বাকি রয়ে গেল।ভালোবাসায় পূর্ণতা কি কখনোই আসেনা?এটা কি পুরোটাই অলীক?নাকি এই অতৃপ্তি, এই অপূর্ণতাই দুটি মানুষকে নিদারুণ ভালোবাসায় ডুবিয়ে রাখে সারাক্ষণ?হয়ত তাই।নিনিতাকে টান দিয়েই জড়িয়ে ধরল হাসান।
নিনিতার শরীর কাঁপতে শুরু করেছে।কি আশ্চর্য!কি আশ্চর্য!গত এক বছরে অসংখ্যবার এই অনুভূতির সাথে ওর পরিচয় ঘটেছে,এই শরীরের সমস্তটাই ওর চেনা।তবু এমন হয়।এক অজানা ঘোর লাগা সুখে,কিছুটা আনন্দময় বিষাদে ওর মন প্রাণ ভরে উঠে।চোখে পানি জমে।সবার কি এমন হয়?সব মেয়ের?কিংবা হাসানের?নিনিতা খুব লাজুক,চুপচাপ।অন্য কাউকে সে এসব জিজ্ঞেস করতে পারবেনা।নিনিতা ঠোঁটের মাঝে হাসানের স্পর্শ অনুভব করছে।ওর নিঃশ্বাস ভারী হচ্ছে।নিঃশ্বাসে ওর বুক দ্রুত ওঠানামা করছে।ভীষণ লজ্জা লাগছে ওর।
ভালোবাসার প্রাণ থাকে শরীর ও মনে।কখনো কখনো মন চুপ করে থাকে,চাপা অভিমানে নীরব হয়ে পড়ে অগোচরেই,অজান্তেই।তখন শরীর কথা বলে।শরীরের কথা শুনতে হয়।ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় যতনে,বড় আদরে।
নিশুতি রাতে চারদিক নিস্তব্দ।কোথায় কোন শব্দ নেই।ওরা শুধু একে অপরের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে,শরীরের উষ্ণতা অনুভব করছে।প্রকৃতি তার চোখ বন্ধ করে রেখেছে।ভালোবাসাবাসির সব দৃশ্য দেখার অধিকার তাকে দেয়া হয়নি।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০১৬ রাত ১১:৫১