মীম।ইংরেজিতে যার বানান হয় meem.এই নামকে উল্টে লিখলেও একই থাকে।ব্যাপারটাকে বলা হয় palindrome.আচ্ছা এ রকম আর কোন নাম কি আছে যাকে উল্টে লিখলেও একই থাকে?গত দশ মিনিট ধরে আমি সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি।এতে অবশ্য লাভ কিছু হচ্ছেনা।হওয়ার কথাও না।এই মুহূর্তে আমি মীম নামের এক অতি রূপবতী তরুণীর সামনে বসে আছি।রূপবতী তরুণীদের সামনে চুপচাপ বসে থাকা অস্বস্তিকর কাজ।এ সময় স্বাভাবিকভাবে কোন কাজকর্মই করা যায়না।যাবতীয় চিন্তা ভাবনা রূপের মাঝে আটকা পড়ে যায়।আমি মীমের মত অন্য নাম ভাবার চিন্তা বাদ দিলাম।ঠাণ্ডায় জমে থাকা গলাটা কিছুটা পরিষ্কার করে বললাম,
-কি অর্ডার করা যায় বলো?
-তোমার যা ইচ্ছা।
মেয়েটা আবার আমাকে ভীষণ বিপদে ফেলে দিল।এ ধরনের আইসক্রিম পার্লারের কোন আইটেম সম্পর্কে আমার ধারণা নেই।তার উপর আমার অর্ডারের উপর নির্ভর করবে অনেক কিছু।মেয়েদের স্বভাবসুলভ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা দিয়ে যাচাই করা হবে আমার রুচি,আচরণ,পছন্দ,অপছন্দ।প্রথম দিন ডেট এ এসে এরকম বিপদে পড়তে হবে জানা ছিলনা।জানলে সাধারণ কোন খাবার দোকানে গিয়ে বসে পড়তাম।যেখানে মেন্যু দেখার আগেই চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারতাম বার্গার বা চিকেন ফ্রাই। মাছের পেটে গিয়ে ইউনুস নবী কি যেন একটা দুআ পড়েছিলেন।মনে পড়ছে না।আচ্ছা এরকম আইসক্রিম পার্লারের পেটের ভিতর থেকে মুক্তির কোন দুআ আছে?সে যুগে কি আইসক্রিম পাওয়া যেত?মনে হয় যেত না।কাজের কাজ কিছু না করে যতসব উদ্ভট চিন্তা করে যাচ্ছি।এবার মেয়েটা কথা বলল,
-প্রায়ই আসা হয় এখানে?
-না।আজই প্রথম।
-ও আচ্ছা।যেভাবে মেন্যু দেখছিলে ভাবলাম এত এত ফ্লেভার তোমার টেস্ট করা হয়েছে যে ঠিক ডিসিশান নিতে পারছিলেনা আমার জন্য কোনটা চুজ করবে।এখানকার সুইস চকোলেট খুব ভালো।নিতে পারো।
সেধে সেধে কেউ অপমানিত হতে প্রেম করতে আসে আজকের এই দিনটা না থাকলে কখনোই বুঝতাম না।আমি ওর কথামত অর্ডার শেষ করে বসে রইলাম।এই মুহূর্তে হালকা লাগছে বেশ।মনে হচ্ছে বিশাল সমুদ্রের মাঝখান থেকে তীরে ফিরে এসেছি।তবে চোখ মুখ থেকে সূক্ষ্ম অপমানের অস্বস্তি মুছতে পারছিনা।
-আনইজি ফিল করার কিছু নেই।পেটের ক্ষুধায় আমরা কেউই মারা যাচ্ছিনা এখন।আর এখানে খাওয়াটা একটা উপলক্ষ মাত্র।আমরা দেখা করতে এসেছি।সামান্য একটা অর্ডার নিয়ে সময় নষ্ট করার জন্য না।তোমাকে দেখে মনে হচ্ছিল একটা খাবারই জীবনের সব।আমার সাথে অত ফর্মালিটির দরকার নেই।বি ন্যাচারাল।তুমি যা তাতেই তোমাকে আমি পছন্দ করি।এটাই কি হওয়া উচিত না?
আমি মুগ্ধ হয়ে কথাগুলো শুনলাম।হ্যা সূচক মাথা নেড়ে ক্রমশ মেয়েটার মাঝে আবার ডুবতে লাগলাম।ও মনোযোগ দিলো ওর ফোনের দিকে।যেন ওর সামনে কেউই নেই।আমারও ইচ্ছে করছে নিজের ফোনটা বের করে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।কিন্তু আমার ফোনে কল বা টেক্সট করা ছাড়া আর কোন কাজই নেই।আজকের দিনে যাবতীয় তুচ্ছতা কি যত্ন করেই না আঁকড়ে ধরেছে।আবার পিনপতন নীরবতা।
এই নীরবতায় আমি অবাক হয়ে ভাবছি।আমার একবার মনে হচ্ছে যেন জনম জনম ধরে ওর সাথে আমার পরিচয়,যোগসূত্র।আবার মনে হচ্ছে এইতো সেদিন ও আমরা ছিলাম অপরিচিত।প্রথম দেখায় প্রেম হয় এর সত্যটা কতটুক সেটা আমার জানা নেই।তবে ওকে যেদিন দ্বিতীয়বারের মত খেয়াল করি, নভেম্বার ২৮ এ,ঠিক সেদিন থেকে আমি নিশ্চিত ভাবে বুঝতে পারি আমি ভয়াবহ ভাবে এই মেয়ের প্রেমে পড়েছি।অথচ আমি তখনও কিছুই জানতাম না।না ওর নাম,ঠিকানা।শুধু বুঝতাম মেয়েটা আমার জগতের সবটা দখল করে নিচ্ছে।যেসব বিকালে ওর দেখা পাবার কথা থাকত আমি নিয়ম করে নফল নামাজ পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে ও সামনে যাবার চেষ্টা করতাম।তারপর ব্যর্থ হয়ে যখন বাসায় ফিরতাম সারাটা রাত কি অসহ্য যন্ত্রণাই না হত আমার।ইচ্ছে হত এখনই যদি মরে যেতাম!যতবার ওকে দেখতাম,ওর হাসিতে হারাতাম,প্রতিবার ওকে ছাড়া এ জীবনটা খুবই তুচ্ছ মনে হত।একটা জীবন যে এতটা অর্থহীন হতে পারে আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি।নিজের জীবনের আদ্যোপান্ত স্বাভাবিকতা যখন একে একে নিঃশেষ হতে লাগলো ঠিক তখন কিভাবে কিভাবে জানি ওর সাথে আমার পরিচয় হয়।এই পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে ঘোর,যেন চমৎকার কোন এক স্বপ্ন।মনে হয় প্রচণ্ড রকমের ক্লান্তিবোধে আমি এক নিদ্রায় ডুবে আছি।সেই নিদ্রায় এক বসন্ত হয়ে মেয়েটা এসেছে।যেন এই নিদ্রা কেটে গেলেই আমি ওকে হারিয়ে ফেলব।আমার ভ্রম কেটে যাবে।এত ভয়ের মাঝেও আমার আনন্দ হয়।এই মেয়েটাকে পাশে পাবার আনন্দ।যেই আনন্দের খোঁজে মানুষ জনম জনম তৃষিত হয়ে থাকে।
আজকে যতটা চুপচাপ হয়ে ও আছে ঠিক এতটা চুপচাপ ও না।গল্প করা,খুব কথা বলা,পাগলামী সবই আছে ওর মাঝে।খুব অভিমানী মেয়েটা।আমার বড় ভালো লাগে ওর সেসব পাগলামীকে।একবার ওকে বলেছিলাম,
-তুমি আসলে একটা বাচ্চাই আছো এখনো।
মেয়েটা তৎক্ষণাৎ খুব বড় হয়ে গেলো।বিজ্ঞের মত করে ভারী ভারী কিসব কথা শুনিয়ে দিল আমাকে।বললো,
-"দেখো,আমাদের প্রত্যেকের মাঝেই একটা বাচ্চা লুকিয়ে থাকে।সবার সামনে তা প্রকাশ পায় না।সবাই সে বাচ্চামীটা দেখতেও পায়না।তুমি যদি কারো প্রিয় মানুষ হও,আপন হও বা কাউকে খুব ভালবাসো তবেই সে রূপটা দেখতে পাবে।সে হিসেবে তুমি আমার আপন মানুষের তালিকায় আছো ভেবেই তোমার খুশি হয়ে যাওয়া উচিত।"
কথাটা বলেই মেয়েটা হেসে দিল।সে হাসিতে বিষাক্ত এক নেশা ছিল।যেই নেশা আমাকে খুন করত প্রতি মুহূর্তে।আমার মনে হত সৃষ্টিকর্তার কাছে জীবনের সব কিছুর বিনিময়ে যদি এই মেয়েটাকে পাশে চাই তিনি কি আমাকে ফিরিয়ে দিবেন?
অনেকটা সময় পার হলো।আজকের দিনে ওকে কিছু সুন্দর সুন্দর কথা বলা উচিত।কিছু প্রচণ্ড রকমের সত্যি কথা।সত্যের চেয়ে সুন্দর নিশ্চয়ই আর কিছু হতে পারে না।
-তুমি এত মাশাল্লাহ কেন দেখতে?
-মানে?
-তোমাকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে।
-আজ?কেনো অন্য সময় লাগেনি?
-সবসময়ই লাগে।তবু বলতে হয়,বলতে ইচ্ছে হয়।
-একটা কথা কি জানো?আজ পর্যন্ত অনেকেই বলেছে "মীম,তুমি অনেক সুন্দর।স্কুল কলেজে থাকতে মেয়েরা,সুযোগ পেয়ে পরিচিত,অপরিচিত ছেলেরা।অথচ কেউ কখনো বলেনা,মীম তোমার মনটা অনেক সুন্দর,তুমি খুব ভালো মানুষ।অথচ আমি চাই একজন ভালো মানুষ হতে,একজন সুন্দর মনের মানুষ হতে।"
আমি মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি।এই চোখের বর্ণনা করা যাবেনা।এই স্নিগ্ধতা বর্ণনার ভাষা নেই,আঁকার তুলি নেই।ওর জন্য কিনে আনা পঁচিশটা গোলাপ ব্যাগ থেকে বের করে ওকে দিলাম,
-আমি খুব গাধা টাইপের ছেলে।তাই ফুলের বাইরে অন্য কিছু দিতে পারলাম না।তবে ফুলগুলো একবারে ভোরের।শাহবাগ থেকে কেনা।
আমি মেয়েটার লাজুক দৃষ্টিতে মুগ্ধতা দেখতে পাচ্ছি।একটা মানবজন্ম স্বার্থক হবার জন্য এর চেয়ে বেশি কিছু কি প্রয়োজন হয় আর?
মেয়েটা আমাকে অবাক করে দুটো উপন্যাসের বই বের করে দিল।কি চমৎকার মলাট করা।বাসায় এত ঝামেলা সত্ত্বেও আমার জন্য কত কিছুই না করতে হয়ছে।বড় পাগলী মেয়ে।
-আমি কি তোমার আঙুলগুলো ছুঁয়ে দেখতে পারি?তোমার হাতটা বাড়িয়ে দিবে আমার দিকে?
মেয়েটার চোখে পানি জমে আছে।সব মেয়েরই কি এমন হয়?আমি অপেক্ষা করছি।বাইরে আকাশে মেঘ জমেছে।মেয়েটা কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে।সুখ কখনো হাতে ধরা যায় জানতাম না।অথচ মেয়েটা কি সহজ ভঙ্গিতেই না আমার হাতে এক মুঠো সুখ ধরিয়ে দিলো।এই সুখ,এই বসন্ত,এই মমতাময়ীকে কখনো ছেড়ে যাওয়া যায়না।
আমাদের অর্ডার করা সুইস চকোলেট চলে এসেছে।খুব মৃদু স্বরে গান বাজছে,
Sometimes an April day will suddenly bring showers
Rain to grow the flowers for her first bouquet
But April love can slip right through your fingers
So if she's the one don't let her run away.
২৬ চৈত্র ১৪২২
৯ এপ্রিল ২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ৮:৪৫