আজকের টেম্পারেচার অসম্ভব রকমের কম।সন্ধ্যা নাগাদ তুষারপাত শুরু হয় কিনা কে জানে।এই ঠাণ্ডার মাঝেও মেয়েটা কোল্ড কফি নিয়ে বসে আছে।গত সপ্তাহে যখন দেখা হয় তখনই ঠাণ্ডা লেগেছিল ওর।গলার স্বরের মিষ্টটা যায়নি তবে ভারী ছিল কিছুটা।পুরো সপ্তাহ জুড়ে নিজের যত্নআত্তি কিছু করেছে বলে মনে হয়না।বেশ খামখেয়ালি হয়ে উঠছে দিনে দিনে।কফির ব্যাপারটা পুরোপুরি আমাকে ঘিরে বুঝতে পারছি।আজও দেরী করে আসায় রাগ থেকে এ ঠাণ্ডা কফি গিলছে।আমি আসার পরই অতিরিক্ত কয়েকটা আইস কিউব চেয়ে নিলো কফির সাথে।আমার সাথে রাগারাগি ব্যাপারটা এখন মানায়না।তবু কেন করছে জানিনা।আমি খানিকক্ষণ অদিতির দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলাম।কি শীতল দৃষ্টি,কি মায়াময়তা।কিছুই যেন বদলায়নি।বেশিক্ষণ ওর দিকে এখনও তাকিয়ে থাকা যায়না।ওর প্রতি আমার মুগ্ধতা এত বছর পরেও কাটাতে পারলামনা।ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আমার ধোঁয়া উড়তে থাকা কফিতে চুমুক দিলাম।তরুণ বয়সের প্রেমিক হলে হয়ত অদিতির সাথে আমিও ঠাণ্ডা কফি নিয়ে বসতাম।ওর রাগ ভাঙাতে মাথায় আইস ব্যাগ দিয়ে রাখতাম।এই বয়সে এসে এসব মানায়না।তাছাড়া সাইনাসের সাথে শ্বাসকষ্টটাও বেড়েছে এখন।অনেক কিছু মেনে চলতে হয়।নিয়মের বাইরে যাওয়ার উপাও নেই।হঠাৎ রাতে ঠাণ্ডার তীব্র যন্ত্রণা হলে লেবু চা করে দেয়ার মত কেউ নেই আমার।আমাকে চলতে হয় হিসাব করে।উইদিন আ ফিক্সড লিমিট।
নীরবতা ভাঙাতে কি বলতে হয় আমি জানিনা।আগেও যে খুব জানতাম ঠিক তা না।গল্প করত অদিতি।রাজ্যজুড়ে তার আলাপ।আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত কান পেতে থাকতাম সেই শব্দ তরঙ্গে আন্দোলিত হতে।সবাই বলে নীরবতা হীরন্ময়।অদিতির কাছে নীরবতা ছিল গাবগাছের লক্ষণ।এত গাছ থাকতে গাবগাছ কেন জানতামনা।জানতে চাইওনি।একটা জীবন ভালবাসাবাসির জন্য খুব কম মনে হয় আমার।স্বাভাবিক মুগ্ধতা কাটিয়ে একে অপরকে জানতে শুরু করার আগেই জীবন শেষ।এর কোন মানে হয়?
আজও আমি প্রায় সাইত্রিশ মিনিট দেরী করে এসেছি।শুধু আজই না।গত আড়াই মাস ধরেই প্রতি সপ্তাহান্তে অদিতির সাথে দেখা হয় আমার।একই জায়গা,একই সময়ে।প্রতিবারই আমি দেরী করেছি।কাজটা কি আমি ইচ্ছে করে করি?জানিনা।একটা সময় এই অদিতির অপেক্ষায় আমি কিনা করতাম?সারা রাত অবধি জেগে থাকতাম।কখন না কখন মেয়েটা টেক্সট করে বসে,সূর্যোদয় দেখার আবদার করে বসে একসাথে।কোচিংয়ের সামনে পাড়ার ছেলেদের মত তীব্র রোদ মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা।তবে আজ এমন আলস্য ভর করেছে কেন আমার?এটা কি আলস্য ?নাকি ওর প্রতি ভালোবাসাটা কমে গেছে আমার।সেটা হবার কথা নয়।আমার বাসাটা অনেকটা ওর মনের মতই সাজানো।একটা ঘর রেখেছি শুধু ওর জন্য।সেখানের দেয়াল জুড়ে ওর ছবি।কোনটা ফটোগ্রাফ,কোনটা বা ফ্রেমে বাঁধানো পেইন্টিং।একপাশের দেয়ালে করা হয়েছে ওয়াল পেইন্টিং।নীল রঙের জামদানি শাড়ি,চুলগুলো বেণী করে বাঁধা।চুলে বেলি ফুলের মালা।দেখলেই মনটা অন্যরকম হয়ে যায়।মনের মধ্যে প্রায়ই আমার প্রশ্ন আসে ঈশ্বরের কৃপা কি সবার জন্য সমান?নাকি তারতম্য আছে?এ মেয়েটাকে এত রূপবতী করে পাঠানোর কি এত দরকার ছিল?প্রতি মাসেই সে ঘরে বসে দু চারটে চিঠি লিখি অদিতিকে।শেষ রাতে তীব্র এক হাহাকার জেগে উঠে আমার।এটা তো ভালোবাসার অভাব না।তাহলে?নাকি পরিবার পরিজন ছেড়ে বহুদিন বিদেশে পড়ে থাকা আমিও চাই কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক একটু?
সময় অদিতিকেও বদলে দিয়েছে।খুব কথা বলা মেয়েটিও আজ চুপ।কপালে চিন্তার রেখা।বহুদিন না ঘুমুতে পারার ছাপ চোখে।রাগত স্বরেই বলে উঠলো
-সময়জ্ঞানের এই অবস্থা নিয়ে বিদেশে টিকে আছো কি করে কে জানে।
আমি কিছু বললাম না।নির্লিপ্ত একটা হাসি দিলাম শুধু।
-সন্ন্যাসব্রত ছেড়ে এবার একটা বিয়ে করে ফেলো।
-সহ্য করতে পারবে?
-মানে?
-আমার পাশে অন্য কাউকে দেখতে কষ্ট হবেনা?
-যথেষ্ট লেইম ছিল মৃন্ময়।তোমার প্রতি আমার এমন কোন ভালোবাসা নেই যে আমার কষ্ট হবে।
-ভালোবাসা নেই বলেই তো জ্বলবে।আমার প্রতি তোমার অপরিসীম ঘৃণা।আর যার প্রতি ঘৃণা থাকে তার সুখ আমরা সহ্য করতে পারিনা।
-ও আচ্ছা।
আমি এ কথাটা কেন বললাম জানিনা।অন্যভাবেও তো বলা যেত।বলতে পারতাম "আমার প্রতি তোমার কিংবা তোমার প্রতি আমারা ভালোবাসা আছে কিনা সেটা তুমি জানোইনা।জানার চেষ্টাও হয়ত করনি।আমি অন্য কাউকে বিয়ে করলে সেটা সহ্য করা তোমার সম্ভব নয়।কারণ আমার দুর্বলতা তুমি অনেক আগেই ধরতে পেরেছো।তোমার জগতে আমার স্থান তোমার বিরহে কাটানো নিঃসঙ্গ একজন মানুষ হিসেবে।আমরা জগতের বাইরে গিয়ে ভালো থাকতে পারিনা।তুমিও পারবেনা।"
আমি অদিতির চোখের দিকে তাকালাম।তবে কিছু বোঝার চেষ্টা করলাম না।কবি সাহিত্যিকদের মত মায়ার সন্ধান করলামনা।আমি জানিনা অদিতিকে আমি ভুল বুঝছি কিনা।জানতে চাইওনা।আমি বিশ্বাস করি এ চোখে ঘৃণা আছে,তীব্র ঘৃণা।আমি অনেক রুঢ় বাস্তবতা দেখে দেখে এই বত্রিশ বছর বয়সে পা দিয়েছি।
-আমার কথা ভেবে বিয়ে করা বাদ দিয়েছো।নিজেকে মহাপুরুষ ভাবো তুমি?অনেক উদার হৃদয়ের মনে করো?
-নাহ।মোটেই না।আমি কথা দিয়েছিলাম অপেক্ষা করব।সে কথাই রাখছি।তুমি অন্যের ঘরণী বলেতো আর আমি আমার কথা ভাঙতে পারিনা।আমি তোমার কাছে সব দিক দিয়ে হারতে পারব।তবে আমার ভালোবাসাকে তোমার কাছে হারতে দিবনা।কারো কাছেই দিব না।সে হিসেবে আমি খুব স্বার্থপরও বলতে পারো।
-তোমার সাথে অযথা তর্ক করতে ইচ্ছে করছেনা মৃন্ময়।আর কষ্ট করে এখানে আসতেও হবেনা।তোমার অফিসটা আশেপাশেই কোথায় বলেছিনা?তাও প্রতিদিন তোমার দেরী হয়।এতটা কষ্ট আমার জন্য করতে হবেনা।তোমার সাথে কেনই বা যোগাযোগ করলাম জানিনা।অনেক সময়ই আমরা জেনে বুঝে কিছু করতে পারিনা।যেভাবে এসেছিলাম,সেভাবেই চলে গেলাম,চারিদিকে লিলুয়া বাতাস।
আমাকে আরও বেশ কয়েকটা কড়া কথা শুনাতে পারলে শান্তি লাগত অদিতির।সেটা না করেই ও উঠে হাঁটা শুরু করল।আমি নিঃশব্দে তাকিয়ে আছি।ও চলে যাবার পর নিজেও উঠে পড়লাম।অনেক কথা বলার অদিতিকে।তবে বলতে ইচ্ছে করেনা,এক ধরনের ক্লান্তি কাজ করে।এত দিনের পরিচয় ওর সাথে।কত কি বলেছি,আরও কত কি বলার জমা পড়ে আছে।অদ্ভুত।
আমার গাড়ি ছুটে চলছে।অদিতিকে মিথ্যে বলেছিলাম।আমার এখানে আসতে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগে অফিস থেকে।এত দূর থেকে আসতে হয় জানলে অদিতি দেখা করতে চাইতনা।চাইলেও অপরাধবোধে ভুগত ও।আমি ওকে অপরাধী করতে চাইনা।অনেক কথাই আমি চেপে গিয়েছি ওর থেকে।দেখা হবে,কথা হবে,তবু কিছুই বলা হবেনা।আমি জানি অদিতি আগামী সপ্তাহে আবার আসবে।ওকে আসতেই হবে।তীব্র ভালোবাসা উপেক্ষা করার ক্ষমতা মানুষকে দেয়া হয়নি।আমি গাড়ির গতি বাড়ালাম।সামনের গ্লাসে হালকা হালকা তুষার পড়ছে।বড় সুন্দর লাগছে দেখতে।
(গল্প লিখতে গেলে নিজেকে প্রথম শ্রেণীর মিথ্যুক মনে হয়।কিসব মিথ্যে বলে বেড়াই গল্প জুড়ে।তীব্র ভালোবাসাকে মানুষ উপেক্ষা করে।বেশ ভালোভাবেই করে।আমার ধারণা তীব্র ভালোবাসাকে যদি একটা মানুষ রূপে কল্পনা করা হয় তবে থাপ্পড়টা পড়ে ঠিক তার গাল বরাবর।এ থাপ্পড় বেশ লজ্জার।একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে লজ্জা দিয়ে কি আনন্দ পায় কেউ বলতে পারে?)
২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪২২
১১ জুন ২০১৫
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ১০:৪০