অনুরাধা,
আমার কথা মনে আছে তোমার?রোগা পাতলা ছিপছিপে ধরনের সেই ছেলেটা।যে তোমার সাথে প্রথম কথা বলতে গিয়ে ভয়ে নীলাভ হয়ে গিয়েছিল,কথাগুলো বারবার জড়িয়ে যাচ্ছিল।সেদিন গলির মোড়ের দোকানে এসে পরপর তিন গ্লাস পানি খেয়েছিলাম।কিংবা সেই ছেলে যে অষ্টাদশ ছুঁই ছুঁই তোমাকে ভালোবাসি বলেছিল আঠারোটি প্রস্ফুটিত গোলাপে।সেই গোলাপের পাপড়িগুলি বড় যতনে ছড়িয়ে রেখেছিলে তোমার ঘরে।সেসব তোমার কিছুই মনে নেই জানি।আমি মানুষটাকেই তো তুমি চিনতে পারবেনা আজ।আর সামান্য পাপড়ির কথা বাদই দিলাম।
আমি প্রায়ই ভাবি যখন তোমার খুব মন খারাপ থাকে,ভীষণ একলা লাগে তখন তুমি কার কথা ভাবো।এক জীবনে আমি বাদে অনেকেই তোমাকে ভালোবেসেছে,আমার বাদে সবার ভালোবাসাই তোমাকে ভাবিয়েছে।সেই ছেলেটা যে তোমাকে রাত বিরাতে কবিতা পাঠাতো,সেই ছেলেটা যার ঘরে তুমি না ঘুমুনো পর্যন্ত আলো জ্বলত অথবা সে যে তোমার বিরহে মধ্যরাতে মাতাল হয়ে বলত বিশ্বাস করো অনু আমি ভালো নেই।ঐ মুসলমান ছেলেটা কেমন আছে?যে নিজের ধর্ম ভুলে সাত খণ্ড রামায়ণ মুখস্থে নেমেছিল তোমার জন্য।তোমাকে সীতা সাজিয়ে কতবার ছেলেটা রাবণ বধের রাম হতো সেসব গল্পের কিছু আমি ভুলিনি।আমার তীব্র কষ্ট হতো।তবে তোমার অল্প একটু ভালোবাসার জন্য আমি সব সহ্য করতে পারতাম।হেসে উঠেই বলতাম "এরকম লক্ষ্মী একটা পরীর জন্য এসব করা যেতেই পারে।"আমি আমার তৃষিত দৃষ্টি দিয়ে তোমার লজ্জা মাখানো হাসিটা দেখতাম।সেই লাজুকতা যে এক উচ্ছল ষোড়শীর প্রথম প্রেমে পড়ার মত তা আমার দৃষ্টি এড়ায়নি।সে হাসিতে এই কাঙাল আমি নিজের জন্য কিছুই খুঁজে পাইনি।বুঝে গিয়েছিলাম অনেক আগেই আমাদের সম্পর্কের সুতোটা মনের অজান্তেই কেটে গিয়েছে।
নিস্তব্দ রাতে একটা শুভ্র সাদা কাগজের মাঝখানে তোমাকে রেখে আমি বৃত্ত আঁকি।সেই বৃত্ত ঘিরে রাখে তোমাকে ভালোবাসতে পারা মানুষগুলো,তোমার অনুভূতির জগতে স্থান করে নিতে পারা মানুষগুলো।তাদের অনুভূতি কখন যে আমাকে তোমার থেকে আড়াল করে ফেলল।নিজেকে আলাদা করার জন্য কত সস্তা চিঠিতে তোমায় ভালোবাসি বলেছি,রাতের পর রাত তোমার জন্য জেগে থেকেছি।আমি অনেক চেষ্টা করি,অনেক ভাবে ভাবি কিন্তু বৃত্তের ভেতরে প্রবেশের কোন সুযোগ পাইনা।আমার যোগ্যতা সেসব মানুষদের ধারে কাছেও নেই।তবু কেন জানি মনে হতো একদিন তুমি আমার হাতটা শক্ত করে ধরে হেঁচকা টানে তোমার কাছে নিয়ে বলবে দূরে আছো কেন তুমি?আমিতো তোমাকেই ভালোবাসি।সেসব মিথ্যে ধারণা পুষে বাঁচার যে কি তীব্র কষ্ট তা আমি রাতের পর রাত অনুভব করেছি।
আমার সবটুকু দিয়েও তোমার অনুভূতির দেয়াল ভাঙতে পারিনি।তোমার মনকে স্পর্শ করতে পারিনি।অথচ সেসবের মাঝে তোমার জন্য কি যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল তা যদি কখনো বুঝতে!বরং শেষকালে এসে তোমার অপমানের কাঁটাগুলি কতটা যে আমাকে যন্ত্রণা দিয়েছে তা আমি জানি,আমার প্রতি পাহাড়সম ঘৃণা দেখে মনে হতো ভালোবাসার প্রাপ্তি বুঝি এমনই হয়।
এখন রাত্রির তিনটা।আমার সামনে বিসিএস পরীক্ষার জন্য কেনা মোটা মোটা সব বই।এই নিয়ে মোট চারবার পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি।জানি এবারও হবেনা।আমার নিউরনের প্রতিটা সেল অনেক আগেই তুমি আবদ্ধ করে ফেলেছো।গত আটটা বছর এই যন্ত্রণা পেতে পেতে আমি ক্লান্ত।তবু এখন আগের থেকে অনেক ভালো আছি।কষ্টগুলো ভুলে থাকার জন্য যখন উৎকট গন্ধের তরল খেয়ে ঘর ভাসিয়ে বমি করতাম,গাঁজার ধোঁয়ায় কাশতে কাশতে পাঁজরের হাড়গুলোকে জর্জরিত করতাম তখন থেকে ভালো আছি।প্যাথেড্রিনের নেশায় নিজের শরীরকে কতবার যে ক্ষত বিক্ষত করেছি আমি।শেষ পর্যন্ত সব কিছু থেকে বেরিয়েছি শুধু তোমার নেশাটা রয়ে গেছে এখনও।
অনুরাধা মৃত্যুর পর কি ঈশ্বরের সাথে দেখা করার উপায় আছে?খুব জানতে ইচ্ছে করে তার কাছে যেই তোমার মনে আমার জন্য কোনকালে ভালোবাসা ছিলই না আমি কেন সেই তোমাতে এত করে ডুবতে থাকলাম।কেন এমন করলে অনুরাধা?আমার তীব্র ভালোবাসার খানিকটাও তুমি বুঝতে পারোনি কখনো?কখনো কি মনের অজান্তে হেসে উঠে নিজেকে প্রশ্ন করোনি কেন ছেলেটা তোমাকে এতটা ভালোবাসে?আমার সঙ্গ কি কখনো তোমার ভালো লাগাকে ছুঁতে পারেনি?হয়ত তুমি ভেবেছিলে এটাই স্বাভাবিক।সবাই তো এমনই করছে আমার জন্য।কিন্তু তার মাঝে যে অসাধারণ ভালোবাসা সাজানো ছিল তার খোঁজ তুমি কখনই করতে চাওনি।না অনুরাধা তুমি কখনোই আমাকে ভালোবাসনি।অজস্র ভালোবাসি বলার পর সবটাকে যখন বয়সের মোহ বলে শেষ করে দিলে বিশ্বাস করতে চাইনি।তবে আজ জানি।সে সত্য বড় বিষাদের,বড় যন্ত্রণার।
তোমাকে এখন আর ভুলতে চাইও না।ভুলতে গেলেই কেন জানি আরও জড়িয়ে পড়ি তোমার মাঝে।তোমার বিষণ্ণতা আমাকে নিঃশেষ করে দেয়।তাই তোমার হাসিটুকুর জন্য,সুখটুকুর জন্য আমার কোন আক্ষেপ নেই তোমার কাছে।নিজের জন্য ভাবারও কিছু নেই আমার।তোমাদের মত স্বাভাবিক জীবন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি আমি।কোন মমতাময়ী কণ্ঠ আমাকে বলবেনা "কালতো ছুটি।চলোনা কোথাও ঘুরতে যাই।"ঘরে ফিরেই কাউকে বলবনা "কই?আমার মামণিটা ঘুমিয়ে পড়েছে?"অথচ এমন একটা জীবন আমারও পাবার কথা ছিল।অপেক্ষা নামের সমুদ্রে যে নিঃসঙ্গতার জাহাজের নাবিক হয়েছি আমি তা নিয়েই ভালো আছি বেশ আছি।ভালো থেকো অনুরাধা,ভালো থেকো।
ইতি,
..........