(“ আজ প্রথম দিন। জীবনে এমনও দিন আসবে কে ভেবেছিলো আগে? সব ঠিক আছে শুধু আমি একা। কেউ নেই পাশে। জীবনটা কেন এমন?”
পাতা উল্টাতে উল্টাতে দেখলো “ সাতটা দিন হলো ২৪ ঘণ্টা করে অথচ সারা আমাকে দেখেনি, ডাকেনি। সে আমার বোন নয়, রক্তের কেউ নয়। তাহলে কে সে? তার জন্য এত কষ্ট হয় কেন?” আমি কি করব? কাকে বলব আমার যে কষ্ট হচ্ছে সারাকে ছাড়া?)
সিফাত ও সারা আমাদের গল্পের মূল চরিত্র।
সিফাত বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান,
সারার পরিচয় কেউ জানেনা। ছোটবেলা থেকে একসাথে বেড়ে উঠেছে সারা আর সিফাত।
বুঝ হবার পর থেকেই সে নিজেকে সিফাতদের বাড়িতে দেখছে। সারার বাবা-মা মারা গেছেন ছোটবেলাতেই। নাগরিকত্বে বাংলাদেশী হলেও পৈত্রিক সূত্রে আরাকানি মুসলিম। আরাকানে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জুলুমের শিকার হয়ে সারার মা-বাবা অন্যান্যদের মত সৌদিতে হিজরত করেন। ১৯৯৮ সালের কথা। কয়েকদিনের ব্যবধানে সৌদীতেই সারার বাবা ও মা দুজনেই মারা যান ।
সৈয়দ হাশেম আলী সাহেব তখন একটি বিদেশী সংস্থার সম্মেলনে জেদ্দায় অবস্থান করছেন। সেখানেই সারাদের প্রতিবেশী এক ডেলিগেট এর কাছে সারার সন্ধান পান। আইনী প্রক্রিয়া সেরে তাকে নিয়ে আসেন ঢাকায়, তখন থেকেই নিজের মেয়ের মত মানুষ করছেন ।
হাশেম সাহেবের ছেলে সিফাত সারার চেয়ে বছর তিনেকের বড় হবে। সে একজন খেলার সাথী পেলো। সারা বড় হতে লাগলো হাশেম সাহেবের মেয়ে হিসাবে। চেহারাতেও বাংলাদেশি না বলে মনে হয়না।
----------------------------------------------------------০-------------------------------------------------------------
সবকিছু ঠিকঠাক মতই চলছিলো। সময় থেমে থাকেনা। সারা ও সিফাত দুজনই প্রাপ্তবয়স্ক এখন। সিফাতের বয়স এবার আঠারো, সারার আঠারো।
এখন ওদের মাঝে পর্দা করা ফরজ, কিন্তু সেটা কি করে বুঝানো যায়। হাশেম সাহেব বা তার স্ত্রী দুজনেই বিভিন্নভাবে দু’জনকে আলাদা কাজ দিয়ে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেন কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ চালানো যায়।
তাছাড়া ওরা দুজন যেভাবে একসাথে মানুষ তাতে হঠাৎ করে কি করে আলাদা করা যাবে সেটা কেউই ঠাউরে উঠতে পারলেন না।
হাশেম সাহেবের মাথায় একটা আইডিয়া এলো। স্ত্রীকে ডেকে বললেন , ওদের দুজনকে যদি বিয়ে দেয়া হয় তাহলে তো আর সমস্যা হচ্ছেনা, দুজনের মধ্যে বুঝাবুঝি ভালো, একজন আরেকজনের সার্বক্ষণিক সাথী, আর অবস্থা যা দাঁড়াচ্ছে তাতে ওদের আলাদা করাটাও অসম্ভব।
স্ত্রী প্রথমে একমত হতে পারলেন না। ওরা দুজন একসাথে কিছুটা ভাই-বোনের মত বড় হচ্ছে, ওরা কি মেনে নিতে পারবে? মানুষে কি বলবে? তাছাড়া এত অল্প বয়সে বিয়ে দেয়া শেষ পর্যন্ত কি হয় কে জানে?
হাশেম আলী রাসুল সা: এর পালকপুত্র যায়েদের ঘটনাটা টানলেন। ইসলামে এরকম সম্পর্কের ভিত্তি নেই। আর ওদের দুজনকে দুজন থেকে আলাদাও করা যাবেনা। আপাতত আমরা যেটা করতে পারি তা হলো ওদের বিয়ে সম্পর্কে জ্ঞান হয়েছে কি না পর্যবেক্ষণ করতে হবে। যদি জ্ঞান হয়ে থাকে একেকজনকে আলাদাভাবে শরীয়তের বিধানাবলী সুন্দরভাবে তুলে ধরতে হবে। তাতে দুটো কাজ হবে হয় ওরা ইসলামের বিধান মেনে নিয়ে পর্দা পালন করবে, সেটা যদি কষ্ট হয় তাহলে কিছুদিন পর ওদের সামনে দ্বিতীয় পথটি তুলে ধরতে হবে।
আর যদি বিয়ের জ্ঞান তথা স্বামী-স্ত্রীর জ্ঞান তাদের মধ্যে না হয়ে থাকে তাহলে তাদেরকে এখন আক্বদ করিয়ে রাখলাম, যাতে পর্দার খেলাফ না হয়। জ্ঞান হওয়ার পর যদি মনে করে বাবা-মায়ের সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো তাহলে সমাধানের পথ তো আছেই।
জুমা মসজিদের শায়খের কাছে পাঠানো হলো সিফাতকে আর শায়খকেও বিষয়টি জানানো হলো যাতে তিনি এ ব্যাপারে সুন্দর নসিহত করেন।
সকল বিষয় জানার পর সিফাত প্রথমে ভীষণ লজ্জা পেলো। পরের দিন দিনের বেলায় সিফাতকে আর বাসায় পাওয়া যায়না। ক্লাস শেষ হওয়ার পর লাইব্রেরিতে, মাঠে বেড়াতে যায় একেবারে এশার নামাজের পর বাসায় ফেরে। ফিরেই সোজা নিজের ঘরে।
------------------------------------------------------------০----------------------------------------------------------
এদিকে সারা প্রথমে নিজের পরিচয় জানার পর থেকে কান্নাকাটি করেছে অনেক। তারপর থেকে ফাতেমা বেগমর কাছ থেকে নড়ছেনা। ফাতেমা বেগম মেয়েকে আদর করে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, তুই আমার পেটে না হলেও আমারই মেয়ে। আমার কোনো মেয়ে হয়নি তাই আল্লাহ তোকে দিয়েছেন।
একদিন দু’দিন পার হয়ে গেলো। সারা এবং সিফাত দুজন দুজনের সামনে আসতে পারছেনা পর্দার কথা ভেবে, কিন্তু কথা তো বলা যায়, সেটাও বোধহয় লজ্জায় হয়ে উঠছেনা।
এতদিনের পিঠাপিঠি সম্পর্কের মধ্যে মুহূর্তেই অদৃশ্য দেয়াল পড়ে গেলো। কিন্তু দু’জন দু’জনকে খুব মিস করছে সেটা বলার উপায় নেই।
-------------------------------------------------------------০---------------------------------------------------------------
এভাবে সপ্তাহ-খানেক কেটে গেলো। সিফাতের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা শুরু হলো। পরীক্ষার মাঝে হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় বেশ গা গরম করে জ্বর এলো। আরো ২টি পরীক্ষা বাকি। চিন্তায় পড়ে গেলেন বাবা-মা। একদিন গেলো জ্বর কমার কোনো লক্ষণ নেই, নামকরা ডাক্তার এসে বাসায় দেখে যাচ্ছে। ওষুধ পত্র, খাবারদাবার কতকিছু কিন্তু কিছুতেই কিছু হলোনা। পরবর্তী পরীক্ষার আর মাত্র ২ দিন বাকী। সিফাত বেহুশ হয়ে আছে। সারা পাশে দাঁড়িয়ে পানি ঢেলে দিচ্ছে, মা হাত বুলাচ্ছেন মাথায়। বাবা পাশেই একটা চেয়ারে বসা।
জ্বরের ঘোরে সিফাত অস্ফুট স্বরে কি যেন বলছে। আঁচ করতে পারলেন মা। সারাকে বললেন একটু রান্নাঘরে যেতে। তারপর স্বামীকে ডেকে বললেন সিফাত তো বেহুশ হয়ে সারার নাম বলছে মুখে। ব্যাপারটা কি দাঁড়াবে কিছুই বুঝতে পারছিনা
-----------------------------------------------------------------০---------------------------------------------------
ডাক্তার এলেন একটু পর।
যাবতীয় পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে কিছুই বলতে পারলেননা।
বললেন, এটা ঠিক জ্বর না, আপনার ছেলে কোনো এক কারণে মারাত্মক মানসিক আঘাত পেয়েছে সেখান থেকেই জ্বর। এই কারণ দূর করতে না পারলে কি হবে বলা মুশকিল।
এর মধ্যে আবার অস্ফুট আওয়াজ আসতে লাগলো মুখ থেকে।
----------------------------------------------------------০------------------------------------------------------------
সারা রান্নাঘর থেকে সোজা সিফাতের ঘরে চলে গেলো। এই এক সপ্তাহ এই ঘরে তার ছায়াও পড়েনি অথচ বিগত আঠারো বছর এই ঘরেই কত সময় কেটেছে।
রুমের দরজা বন্ধ করে সিফাতের বইয়ের শেলফে নতুন আনা বই খোঁজ করতে হাত দিলো, কিন্তু কিছুই পাওয়া গেলোনা। তার মানে সিফাত ভাইয়া এই এক সপ্তাহে কোনো নতুন বই আনেননি? একটা বই উঁচু করে পাতা খুলতেই দেখলো সেটা বই নয় ডায়েরি।
দিনপঞ্জি লেখা
“ আজ প্রথম দিন। জীবনে এমনও দিন আসবে কে ভেবেছিলো আগে? সব ঠিক আছে শুধু আমি একা। কেউ নেই পাশে। জীবনটা কেন এমন?”
পাতা উল্টাতে উল্টাতে দেখলো “ সাতটা দিন হলো ২৪ ঘণ্টা করে অথচ সারা আমাকে দেখেনি, ডাকেনি। সে আমার বোন নয়, রক্তের কেউ নয়। তাহলে কে সে? তার জন্য এত কষ্ট হয় কেন?” আমি কি করব? কাকে বলব আমার যে কষ্ট হচ্ছে সারাকে ছাড়া?
সারা আর এগুতে পারছেনা। তার চোখ দিয়ে কখন পানি বেরিয়ে গাল ভিজে গেছে খেয়াল করেনি।
তার মনে হতে লাগলো দুনিয়াটা এমন কেন? মা-বাবার কথা মনে পড়েনা, যাদেরকে বাবা-মা বলে ডেকেছি আঠারোটা বছর তারা আমার কেউ নয়? এটা কিভাবে বিশ্বাস করব। যার সাথে শৈশব কেটেছে আমার আজ সেই আমার সবচেয়ে দূরের মানুষ। হায় আল্লাহ এমন কেন দুনিয়াটা। এসব ভাবতে ভাবতে ডায়েরিটা বুকে নিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদতে লাগলো সারা।
কয়েক মিনিট পর
পিঠে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে মাথা তুললো সারা, পেছনে তাকিয়ে দেখে সিফাতের মা, বাবা আর ফুফী দাঁড়ানো।
মা ডাকলেন “সারা!
সারা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলোনা। মায়ের বুকে সপে দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। কান্না থামাতে পারছিলেন না ফাতেমা বেগম। পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন আদর করে।
-------------------------------------------------------------০----------------------------------------------------------
রাত ২টা বাজে। গোটা শহরটা ঘুমে ডুবে আছে কিন্তু ঘুম নেই সৈয়দ হাশেম আলীর বাড়ি দারুল আরকামে। বাড়িটা আত্মীয়স্বজনের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠেছে। রান্নাবান্না হচ্ছে। শহরের কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব সহকারে মেহমান খানায় গল্প করছেন সৈয়দ হাশেম আলি। অন্যদিকে সারাকে গোসল দিয়ে সাজগোজ করাচ্ছে কয়েকটা মেয়ে। আরেকটা রুমে সিফাতের সাথে বসে আছেন ডাক্তার, শায়খ আর সিফাতের দু’জন বন্ধু। সবাই হাসি ঠাট্রা করছে। রুমটা হাসিতে উচ্ছল হয়ে উঠছে।
আরেকটু পরেই জ্বরকে চিরতরে পর করা হবে সে ব্যবস্থা হচ্ছে।
এক অনন্য নজির স্থাপন করতে যাচ্ছেন সৈয়দ হাশেম আলী সাহেব। আক্বদ হয়ে গেলো।
ঝকঝকে তকতকে এক ঘরে সিফাত আর সারা বসে আছে। দু’জনেই খুব আড়ষ্ট। দরজাটা বন্ধ করা। কয়েক মিনিট নীরবতায় কেটে গেলো। হঠাৎ বাড়ির আশেপাশে কোথাও ট্রান্সমিটার বিস্ফোরণ হল। তারপর ভয় পেলে মেয়েরা যা করে আর কী, কি করে? জ্বরকে পর করার জন্য নিজেকে সপে দিলো জান্নাতি বুকে।
শিক্ষণীয়:
১। শরীয়তে দুধ সম্পর্ক ছাড়া রক্ত সম্পর্কের মত সম্পর্ক স্থাপিত হয়না, এদের মধ্যে পর্দা ফরজ, এবং বিয়ে করাও বৈধ
২। ছেলেমেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হলে পর্দার বিঁধান যেমন জরুরি, বিয়ে দেয়াটাও জরুরি।
৩। অসহায় সম্বলহীন মেয়েদের সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সন্তানের বিয়ে দেয়া উচিত।
৪। বিয়েটা কোনো কঠিন প্রক্রিয়া নয় যে আটঘাট বেঁধেই নামতে হবে, চাইলেই সম্ভব।
৫। পাপের সম্পর্ক সেটা এক সেকেন্ডের জন্য হলেও সহ্য করা উচিত নয়।