১।
-সত্যি সত্যিই জুতা খায়?
-হ । কাঁচা জুতা না কিন্তু জুতা পুড়াইয়া খায় ।
কথাটা পুরোপুরি শেষ না করেই টোকাই ছেলেটা কাকে দেখে যেন হুইসেল দিয়ে ছুটে চলে যায়। আর সিদ্দিক সাহেবের চোয়াল ঝুলে পড়ে বিস্ময়ে । পাগল জীবনে কমতো দেখা হয় নি । তবু তাঁদের কার্যকলাপ সিদ্দিক সাহেবকে বরাবর ঘোরে ফেলে দেয় । বর্তমানে তার নিজের স্ত্রী মাবিয়াও মানসিক ভাবে পুরোপুরি ভারসাম্যহীন । তরল খাবার ছাড়া কিছু হজম করতে পারে না । চাদরের নিচে থাকলে মাঝে মাঝে বোঝাই যায় না খাটে কেউ শুয়ে আছে । সিদ্দিক সাহেব নিজেও পেটের রুগী । হজম শক্তি-প্রায় শিশুর পর্যায়ে । আর এই পাগল কিনা জুতা পুড়িয়ে খেয়ে দিব্যি বেঁচে আছে ! তাছাড়া এরা থাকেই জীবাণুর মধ্যে । এমন নোংরা ভাবে জীবন যাপন করেও পাগলটার স্বাস্থ্য কী তার চেয়ে একটু হলেও ভাল নয় ? প্রকৃতি যদি নিয়মেই চলে তাহলে এসবের ব্যাখ্যা কি ?
সিদ্দিক সাহেবের মন জানতে চায় আজকাল । নিজের শরীরের এই বেহাল অবস্থায় সবাই ঠাট্টা তামাশা করে । বড় ছেলের ঘরের নাতিটা তার নাম দিয়েছে নাগরিক কাকতাড়ুয়া।ব্যাপারটা ভাবতেই বেশ হতাশ বোধ করেন তিনি । বড় শ্বাস ফেলে চোখ বুজতেই ঝিমুনি চলে আসে । ঝিমুনিটা বার কয়েক তন্দ্রার ধাঁর ঘেঁষে ফিরে আসে কখনো বাদাম ওয়ালার চিৎকারে কখনো এরোপ্লেনের শব্দে । খুব কাছে একটা স্বর বিরক্তি নিয়ে বলে উঠে,
-পার্কে এহন আর বওনের সুযোগ আছে নি কুন ? হয় হিরুইঞ্ছি নাইলে বুইড়ারা কুইচ্চা মুরগীর মত ঝিমায় ।
এবার ধরমর করে জেগে উঠতে চাইলেন সিদ্দিক সাহেব । চিমসানো দুই চাপা এক করে ঢোক গেলেন আর সার্টের দুই কলার এক করে ধরেন । এটা উনার মুদ্রাদোষ । অসহায় বোধ করলেই তিনি এমনটা বেশি করেন । বয়স হলেই কী এমনটা হতে হবে ? এত আরামদায়ক শয্যাতেও ঘুম আসবে না রাতের পর রাত । আর পার্কে কিংবা পরিচিত মহলে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ঝিমুনি পাবে ! কি অসম্মানই না করে এরা বুড়োদের !
সিদ্দিক সাহেবের চিন্তা কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও থেমে যায় হাল্কা তালে দৌড়ে যাওয়া আঁটসাঁট পোশাকের উন্নত বুক দেখে । চিন্তাটা ঠিক কোথায় থেমে থাকে এই বয়সেও ঠিক বুঝে উঠতে পারেন নি তিনি । এই যে নির্লজ্জের মত চোখ চলে যাওয়া , নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকা এর জন্য বরাবরের মতো মেয়েটার দোষও নিজেকে দেখান । এভাবে নিজেকে প্রদর্শন করলেতো তাকাবেই মানুষ, বুড়ো বলে তো মানুষের খাতা থেকে নাম কাটিয়ে ফেলি নি । আড় চোখের কী কোন বয়স আছে ? কামনার জন্ম তো মনে সেটা কী কখনো বুড়ো হয় ?
নিজের মেয়ের বয়সী মেয়েটিকে মনে মনে কথাগুলো ছুঁড়ে দিলেও অপরাধ-বোধ বাড়তে থাকে তার ।ইতস্তত: করে বাড়ির দিকে পা বাড়ান তিনি। বয়স কী খুব বেশি হয়ে গেছে ? ঘরে বাইরে কেন স্বস্তি নেই !
পার্ক থেকে বের হতেই জুতাখোড় পাগলটাকে চোখে পড়ল এবার । ধর্ম প্রচারকের ভঙ্গীতে হাত উঁচু করে আছে রাস্তার মানুষের উদ্দেশ্যে । পথচারীদের মতো কৌতুক বোধ করেন না সিদ্দিক সাহেব । ভাবনে অপ্রকৃতস্থতার জগতে সুখের উৎস কি প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস না উন্নাসিকতা ?
২।
মুখে পানের অস্তিত্ব তেমন বোঝা যাচ্ছে না । কিন্তু একটু পর পর বোয়াল মাছের মত মুখ করে তাতে জরদা ফেলে যাচ্ছেন গওহর ঘটক।
আচ্ছা গওহর তোমার নামের আগে পিছে কি ?
কিছু না ।
কিছু না ?
না । জাত পাত পাত্রগো থাকে। ঘটকের জাত নাই।
হুম । মনে মনে একমত হন সিদ্দিক সাহেব। গওহরের তার কাছে আসার কারণ এখনো স্পষ্ট না । হয়তো ছোট ছেলের জন্য প্রস্তাব না ছোট ছেলে নিজেই পাঠিয়েছে । লোকটা ঝেড়ে কাশছে না । দুই হাঁটু হাতের তালি দেওয়ার মত বাড়ি দেওয়া আর মুখে জরদা পুরা ছাড়া কিছুই করছে না লোকটি । নিজের সাথে অন্যের স্বাস্থ্যের তুলনা দেয়াটা স্বয়ংক্রিয় ভাবেই শুরু করে দিয়েছে সিদ্দিক সাহেবের অবচেতন মন । তার চেয়ে বয়সে বড় বই ছোট হবে না গওহর কিন্তু কি ঝটপটে আর সুস্থ । ঘটকালি করে পেট চালিয়েও কী তার চেয়ে সুখী নয় ? প্রশ্নটা ঝুলে থাকতে থাকতেই গওহর মুখ খুলে,
-আসছিলাম আপনের ছোড্ডার সমন্ধ লইয়া ।
-তাতো বুঝতেই পারছি ।পাত্রীও মনে হয় ঠিকঠাক ?
-হ । কাম তাইলে শুরু কইরা দিমু ?
-শুরু কর না মানে শেষ কইরা ফালাও ।
-আপনারও একটা বিবাহ করা দরকার এখন ।
-কি!
-জি । এই দেহেন না আপনে একলা ফ্লাটে থাকেন । পোলারা বিয়া কইরা আলাদা ফ্লাট নিয়া নিতাছে। নিজেরে রাজা বাদশা ভাবতাছে । দুই দিন পর পাঁচ তলায় উইঠা আপনের খবরও নিবো না । মনে হয় এহনই নেয় না । হে… হে…। তার উপর আপনে আরো বুড়া অইবেন । রাইত বিরাইতে ধইরা টয়লেটে নেওণের লেইজ্ঞাই কামের মানুষ লাগবো । আর বুড়া মাইনষের পায়খানা সাফ করইন্না মানুষ দুই দিন পর পর ভাগে । হে… হে…।
-দূর মিয়া আউল ফাউল কথা কইবা না । যাও ভাগো ।
-ভাইব্বা দেহেন কতা সব সত্য ।কনতো আপনের বউ পাগল হওয়ার পর থেইক্কা কবে আপনের শরীরে আর মনে একটু আরাম পাইছেন ?
আলগা তাচ্ছিল্য দেখান সিদ্দিক সাহেব,
-এই বয়সে আর বিয়া ! কবরে যামুগা কয়দিন পর ।
-আরে না । হুনছি আপনের প্রেশার নাই ডায়বেটিকস নাই আতকা মরবেন না। হুদাই কষ্ট করবেন । আপনে টেনশন নিবেন না।একটু আকটু বয়স্কা আর বন্ধ্যা মহিলাও আছে । সম্পত্তি ওয়লাও।গ্যঞ্জাম হইবো না। খালি বুড়া কালে একটা সঙ্গী পাইলেন আরকি ।
কিছুটা শান্ত হয়ে বসেন সিদ্দিক সাহেব । এই কথাগুলো তার ভেতর প্রতিনিয়ত পাঁক খাওয়া মুদ্রার মত ঘুরতে থাকে কোন সিদ্ধান্তে থামে না । গওহরের কথায় আজ তা যেন থেমে স্থির এক পিঠ দেখিয়ে দিল । আর অভিজ্ঞ গওহর ও সুযোগে ঢিল ছুড়ল ।
-দেখবেন কয়দিনের মধ্যে আপনের ছেলেরা সম্পত্তির বাটোয়ারা নিয়া আপনের কাছে আইবো । যে যার যার ধান্দায় আছে কাগোর কতা ভাবেন আপনে ? নিজের ভালো বুঝেন ভাইসাব ।
-আসি বলে উঠে দাঁড়ায় গওহর ।
কথা সত্য ভাবেন সিদ্দিক সাহেব । কিন্তু মাবিয়া ? মাবিয়ার প্রতি অন্যায় হবে কী ? তা কি করে হয় ! সিদ্দিক সাহেব চোখ বুঝে জিকির করার ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন কয়বার তারপর পাশের রুমে তার স্ত্রীর কাছে গিয়ে দাঁড়ান , না ! এই উন্মাদতো মাবিয়া নয় । একে তিনি চিনেন ই না। এক অর্থে তার বউ মৃত। কিংবা হয়তো মরে গেলে যে মাবিয়া তার স্মৃতিপট জুড়ে থাকত তাও ভাল ছিল । এমন একটা শারীরিক অবয়ব ও মানসিক গঠনে মাবিয়া তার কাছে অনেকটা কষ্ট অনেকটা দায় ।
এখন মাবিয়া তার দিকে তাকিয়ে হাসছে । কিন্তু একজন বদ্ধ পাগলের হাসির মধ্যে নিষ্পাপ কিছু থাকে না কিছু বিকৃত ঘৃণা ছাড়া । তার প্রতি ভীষণ কৌতূহলে একটা ভেংচি কাটল মাবিয়া । তারপর মশা মারায় ব্যস্ত হয়ে গেল।
-একটা, চারটা, দশটা, একশোটা ।
মশা মারতে পারলেই দেয়ালে লেপ্টে ফেলে মাবিয়া । খাটের পাশের দেয়ালটা প্রায় ভরে ফেলেছে সে । ছোপ ছোপ দাগগুলোর দিকে যতবার তাকান সিদ্দিক সাহেব নানান আকারের বস্তু দেখতে পান যেন । এখন মনে হচ্ছে একটা টুপি পড়া যুবক নিচু হয়ে আছে।
সিদ্দিক সাহেব তার স্ত্রীর পাশে বসলেন তার স্ত্রীর মুখ ভাল মতো দেখতে দ্বিধাটা যাচ্ছে না । আসলেই তিনি মাবিয়ার প্রতি অন্যায় করবেন না তো ! তার স্ত্রী দেয়াল থেকে ঝট করে মুখ ঘুরিয়ে সজোরে সিদ্দিক সাহেবের মুখে থু তু ছিটলেন । ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন তিনি । লুঙ্গীর ধাঁর দিয়ে থু তু মুছতে মুছতে দেখলেন তার স্ত্রীর চোখে হিংস্র আনন্দ চক্ চক্ করছে।
নিজের ঘরে ফিরে আসতেই মনে হল পার্কের মেয়েটার কুঁচকানো ভ্রু আর মাবিয়ার চোখের হিংস্র ঘৃণার সাথে কোথায় যেন খুব মিল।
৩।
অসুস্থ হলেই মন জেগে উঠে আর খুব সুস্থতায় শরীর ।আর শরীর মন দুটো ভাল থাকলে একজন বিপরীত লিঙ্গের, একজন নারীর, কারো মমতার, স্পর্শের, কামের কিংবা সঙ্গীর প্রচণ্ড অভাব বোধ করেন সিদ্দিক সাহেব । বয়স হয়ে যাওয়াই দিন গোনা তাই এতে আমল দেন নি এতদিন । ভেবেছেন ছেড়া পালে বাতাস দিয়ে কি লাভ! কিন্তু গওহর এই কদিনে নানান আশঙ্কার কথা বলে বলে পালে হাল্কা নয় দমকা হাওয়া দিয়ে দিয়েছে । তার মৌখিক সম্মতি ছাড়াই গওহর নাকি কাজেও নেমে গেছে ।তা গেলে যাক। সংসারের জন্য কমতো আর করেন নি এতদিন । এই সচ্ছলতাতো তার পরিশ্রমের ফসল । সংসারের মানুষেরা কী এতটুকু বুঝেব না ? ব্যাপারটাতো মোটেও অনৈতিক লাগছে না তার কাছে । মাবিয়ারও যত্ন হবে কিছুটা । কাজের লোকরা আর কতটুকু করে ।
পাশের ঘরে পুরোটা সকাল মাবিয়া খাতুন মশা মারার মত শব্দ করছে আর গুনেছে, একটা, দশটা, পাঁচটা…………। আর সিদ্দিক সাহেব ডায়রিয়ায় বিছানায় পড়ে থেকে একটু মমতার স্পর্শের জন্য কাতর বোধ করছেন। বার বার নানা রকম যুক্তি দিয়ে এই বয়সে নিজের বিয়ের চিন্তাকে একটা সিদ্ধান্তের ভিত্তি দিতে চেয়েছেন ।ভাবতে ভাবতে কখন দুপুর গড়িয়ে গেছে খেয়াল করেননি,
-সাবের খাওন দিছি টেবিলে আমি চাইর তলায় গেলাম দরজাডা লাগায় লন আর কিছু দরকার লাগলে কন ?
কিন্তু কিছু শোনার অপেক্ষা না করেই চলে যায় ময়নার মা।সিদ্দিক সাহেব বলতে বলতেও থেমে গেলেন যে, “স্যালাইনের প্যাকেট শেষ।হাতের কাছে থাকা লিটার মাপার বোতল দরকার ছিল”। যদিও অভিমানটা ঠিক কার উপর ধরতে পারছনে না এখন তবু ভাবনে, থাক কাউকে বলবেন না কিছু । দরজা উঠে লাগানোর আগেই আচমকা তার ছোট ছেলে মিয়াদ ঘর ঢুকলো,
-আব্বা গওহর কি কইতাছে ?
-কি ?
-আপনে বলে বিয়া করতাছেন ?
সিদ্দিক সাহেব চুপ করে রইলেন ।
-কথা কন না কেন ? আপনের লজ্জা না থাকতে পারে আমাদের আছে ।বুড়া বয়সে এইসব করবেন তাইলে এই বাড়িতে আগুন ধরায় দিমু । নাইলে আপনেরে খুন কইরা জেলে যামু।
-কি কইলি !
ধুম করে চলে গেল মিয়াদ । সিদ্দিক সাহেব দুই শার্টের কলার এক করতে করতে ঢোক গিলতে লাগলেন । এবার পেটে এত তীব্র কামড় দিল যে তিনি বসে পড়লেন । দাঁড়িয়ে টয়লেটে যাবার সাহস পেলেন না আর । হামাগুড়ি দিয়ে টয়লেটের দিকে এগুতে লাগলেন ধীরে ধীরে।
৪।
মাবিয়ার জবান বন্ধ হয়ে গেছে গতকাল থেকে। ধারণা করা হচ্ছে স্ট্রোক । ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে কিন্তু তার তাড়না তিন ছেলের এক ছেলে এমনকি সিদ্দিক সাহেব নিজেও পাচ্ছেন না । মরার নতুন করে আর মরা কি!তবু চিকিৎসা না করানোটাতো অন্যায়ই হবে । রাতেই একটা ব্যবস্থা নিবেন ভাবেন তিনি । কত দাপটে সংসার করেছে একসময় এই মাবিয়া ভাবলে অবাক লাগে এখন । কত স্বপ্ন! বয়স হলে নাতি নাতনী নিয়ে কি কি করবে বুড়ো বুড়ি । এখন এই তিল তিল করে গড়া সংসারের কতটুকু বুঝতে পারে মাবিয়া ? নিজেই সংসারের বোঝা হয়ে গেছে পুরোটা । এটাই বুঝি ঘোর নিয়তি । মাবিয়া চলে গেলেই সবার স্বস্তি । কি নির্মম মানুষ! এবং সিদ্দিক সাহেব নিজেও কী নির্মম নন ?
স্ত্রীর পাশে গিয়ে দাঁড়ান সিদ্দিক সাহেব । মাবিয়ার চোখগুলো আগের চেয়ে উজ্জ্বল আর বড় দেখাচ্ছে । কথা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হয়ত । অনেকটা দায়িত্ব অনেকটা করুণা থেকে মাবিয়ার চোখের ভাষা পড়তে চান সিদ্দিক সাহেব । ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে কিছু অসহায়ত্ব খুঁজেন হয়ত। কিন্তু মাবিয়া খাতুন কিছুক্ষণ ভাবলেশহীন তার দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ ফিরিয়ে নেন জানালা বরাবর । উঁউঁউঁ… শব্দ করে কিছু বলতে চান…। কেন জানি মনে হয় শব্দটার অর্থ জেদ , বা অসম্ভব কোন রাগ এবং তা সিদ্দিক সাহেবের প্রতিই কী ? একটা নিশপিশে আতঙ্ক অনুভব করেন তিনি আজও থু তু দিবে না তো মাবিয়া, আর বসে থাকতে ইচ্ছে হয় না তার । গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে পার্কে যেতে মনস্থির করেন তিনি । যাবার সময় সিঁড়িতে বড় ছেলের শাশুড়ি হাজেরা বেগমের সাথে দেখা হতেই বলেন,
-আসসালামু আলাইকুম বিয়াইন সাহেব ।
হাজেরা খাতুন অস্বস্তিতে পড়ে এভাবে লম্বা ঘোমটা টানেন মনে হয় সিদ্দিক সাহেব বিরাট লম্পট এমনকি সালামের উত্তরটাও দিলেন না । অথচ এতদিন তার সাথে সহজইতো ছিলেন । ব্যাপারটা বুঝতে পারেন তিনি । তার বিয়ে করার চাওয়ার ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেছে এই আর কি। বাড়ির বাইরে পা দিতেই গওহর যেন দেয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে,
-সাব আপনের পোলায় আমারে ধমকি দিছে ?
-কি!
-হ । তবে আমি ডরাই না । আমার কাছে পাত্রীও রেডি। কবে দেখতে যাইবেন ?
এ প্রসঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে বা সাহস হয় না সিদ্দিক সাহেবের যে কোন সময় ছেলেরা ফিরবে । তার নীরবতা দেখে গওহর অস্থির হয়।
-ডিছিশন বদলাইছেন নাকি ?
এবারেও উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না তার।কিছুদিন ধরে মনে মনে ভবিতব্য সুখের যে রেখাগুলো এঁকেছেন তিনি সেগুলোকে মুছে দিতে সহসাই ইচ্ছে করে না। আবার এটাও ঠিক রেখাগুলোতে পা ফেলে চলা শুরু করতে অনেকটা বেগ পেতে হবে তার। ।তিনি নিজের সার্টের কলার চেপে ধরে বলেন,
-পরে একদিন আইয়ো ।
বলেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে পার্কের দিকে পা চালান তিনি ।
পার্কে আজ অনেক মানুষ ।কিছুক্ষণ হেটে তার প্রিয় জায়গাটায় বসতেই টোকাই ছেলেটা উত্তেজিত ভঙ্গিতে ছুটে আসে ।
-চাছা । ঘটনা জানেন ?
-কিসের ঘটনা ।
-আরও একটা পাগল আইয়া জুটছে । হ্যাঁয় কি করে জানেন ?
-কি করে ?
-ট্রাকের তলে ঘুমায় ।
-কেন! ট্রাকের তলা ছাড়া ঘুমাইলে কি হইব ?
-ক্যামনে কমু । দিনের বেলায় বাস-স্ট্যান্ডে যে ট্রাক পইড়া থাকে খুইজ্জা খুইজ্জা অইগুলির তলে ঘুমায় ।
-কেন ?
-আমি কেমনে কমু!
টোকাই ছেলেটা খবরটা দিয়েই উত্তেজিত ভঙ্গিতে চলে যায় । সিদ্দিক সাহেব বিস্ময়ের ঘোরে চলে যান । নানান প্রশ্ন তাকে ঘিরে ধরে দুই পাগলের মাঝে অবস্থান নিয়ে ধন্ধ হয় না তো ?ট্রাকের তলায় ঘুমানোর ইচ্ছের মধ্যে গভীর মনস্তত্ত্বটা কি ? দুর্ঘটনাতো ঘটতেই পারে । তার মা খাট থেকে পড়ে মরে গিয়েছিলেন । আর একটা পাগল দীর্ঘদিন রাস্তায় ট্রাকের নিচে পড়েও বহাল তবিয়তে আছে। প্রকৃতির নিয়মের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবিত হয়ে পড়েন। আর পাপ পুণ্যের ব্যাপারও ইদানীং বেশ ভাবেন । মানুষের দুর্দশা যদি তার কর্মফল হয় তবে পশু পাখির ব্যাপারটা কি ? কত ভয়ানক রোগ তাদেরও তো হয় । তাদের নিশ্চয়ই পাপ নেই।
সিদ্দিক সাহেবের চিন্তা কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে যায় একজোড়া আন্দোলিত বুক দেখে । বুক থেকে মেয়েটির মুখের দিকে চোখ যেতেই বুঝেন আজকের মেয়েটিও ভ্রু কুঁচকে আছে। ছি ! অপরাধ-বোধটা আজও মাত্রা ছাড়ায় । উঠে দাঁড়ান তিনি । চাদরটায় নিজেকে ভালমতো জড়িয়ে হাঁটতে থাকেন এলোমেলো। শীতের সন্ধ্যার মধ্যে একটা ঝিমঝিমে মনোরম ব্যাপার আছে তা বয়সকালেও তাড়িয়ে উপভোগ করতেন তিনি । ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে একটা সঙ্গীর জন্য কিছু সুন্দর মুহূর্তের জন্য আনচান বোধ করতেন। হাল্কা কুয়াশা ঘেরা আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হল,ফালি চাঁদটাও আজ শীতার্ত। অনেক দিন পর সেদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলে গেলেন তার বয়সের কথা,ছেলেদের কথা,অসুস্থ মাবিয়ার কথা। তরুণ চাঁদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আনমনে বুনতে থাকলেন কিছু উষ্ণ আর মোহনীয় স্বপ্ন ।
...
আমার প্র্থম গল্পো "ভাত কাপড় ভালোবাসা ও অন্যান্যতে প্রকাশিত