প্রশ্নঃ
রাসুল সা. নয়টি বিয়ে করেছেন,অথচ অন্য মুসলমানের জন্য চারটির বেশি বিয়ে করা নাজায়েজ। এর কারণ কি? সন্তোষজনক জবাব দেবেন আশা করি।
উত্তরঃ
জাহেলী যুগে একাধিক বিয়ের ক্ষেত্রে কোন বাধা নিষেধ বা কোন সীমারেখা ছিলো না। প্রাচীনকালে প্রায় সর্বত্রই স্বামীদের একাধিক স্ত্রী ছিলো। একজন পুরুষ যত ইচ্ছা বিয়ে করতে পারতো।
ইসলাম এই রীতি বন্ধ করে দিয়েছে এবং চারটির বেশি বিয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। যেসব সাহাবার চারের অধিক স্ত্রী ছিলো, রাসুল সা. তাদের বলেছেন, তাদের মধ্যে চারজন বাছাই করে রাখো,অন্যদের তালাক দিয়ে দাও।
ইসলাম একাধিক বিয়ের অনুমোদন শর্ত সাপেক্ষে দিয়েছে। সকল স্ত্রীর সাথে একই রকমের ব্যবহার এবং একই সুবিচার করতে হবে। কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
" যদি তোমাদের এই ভয় হয় যে, তোমরা ( একের অধিক হলে) ইনসাফ করতে পারবে না, তাহলে (তোমাদের জন্য) একজনই যথেষ্ট।" (আন নিসাঃ আয়াত ৩)।
তবুও আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা. কে সকল মানুষের তুলনায় একটি বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। চারজন স্ত্রী রেখে অন্যদের তালাক দেয়ার আদেশ তাঁকে দেয়া হয়নি। তবে এরপর বিয়ে করতে নিষেধ করা হয়েছে, যদি কোন নারীকে পছন্দ হয় তবুও। আল্লাহর এই নিষেধের কথা নিম্নোক্ত আয়াতে বলা হয়েছেঃ
'' (হে নবী) এরপরে তোমার জন্যে এটা বৈধ নয় তুমি তোমার (বর্তমান) স্ত্রীদের বদলে (অন্য নারীদের গ্রহ ণ করে ) নেবে, যদিও সেসব নারীদের সৌন্দর্য তোমাকে আকৃষ্ট করে।" (আহযাবঃ ৫২)
চারজন স্ত্রী রখে অন্যদের তালাক দেওয়ার আদেশ আল্লাহ তায়ালা রাসুল সা. কে দেননি। তাঁকে এই আদেশ থেকে আলাদা রাখা হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, রাসুল সা. এর স্ত্রী হওয়ার ফলে উল্লেখিত মহিলারা বিশেষ সামাজিক মর্যাদা লাভ করেছেন। রাসুল সা. এর স্ত্রী হওয়ার কারণে তারা সমগ্র মুসলমানের মা হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
" আল্লাহর নবী মোমেনদের কাছে তাদের নিজেদের চাইতেও বেশি প্রিয়।, নবীর স্ত্রীরা হচ্ছে তাদের মা (সমান)।" (আহযাবঃ ৬)
মুসলমানদের মা হওয়ার বন্ধনের কারণে তাদের বিয়ে করা যেকোন মুসলমানের জন্য হারাম বা নিষিদ্ধ। আল্লাহ তায়াল বলেন,
" তোমাদের কারো জন্যই এটা বৈধ নয় যে, তোমরা আল্লাহর রাসুলকে কষ্ট দেবে- (না এটা তোমাদের জন্য বৈধ যে,) তোমরা তারপর কখনও তাঁর স্ত্রীদের বিয়ে করবে, এটা আল্লাহ তায়লার কাছে একটি বড় (অপরাধের) ব্যাপার।'' (আহযাবঃ ৫৩)।
চিন্তা করে দেখুন রাসুল সা. যদি চারজন স্ত্রী রেখে অন্যদের তালাক দিতেন তবে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীদের বাকী জীবন অন্যকোন পুরুষের সাথে নিষিদ্ধ হতো। ফলে বাকী জীবন তাদেরকে স্বামীবিহীন অবস্থায় কাটাতে হতো। রাসুল সা. এর সাথে বিয়ের কারণে তারা যে সামাজিক মর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন, তালাকের পর সে মর্যাদা থাকতো না। এর অর্থ হচ্ছে কোন অপরাধ না করেও তারা শাস্তি ভোগ করতেন এবং বঞ্চনার স্বীকার হতেন। তাছাড়া যদি তাঁকে এ আদেশ মেয়া হত যে, আপনি চারজন স্ত্রী রেখে বাকী স্ত্রীদের তালাক দিন তবে রাসুল সা. এর জন্যে কঠিন সমস্যার সৃষ্টি হতো। কারণ তিনি কাকে রেখে কাকে তালাক দিবেন ? তার দৃষ্টিতে সকল স্ত্রী ছিলেন সমান। শুধু তাই নয়, চারজন রেখে বাকীদের সামাজিক মর্যাদাহানি হতো। তারা মু সলমানদের মা হওয়ার যে গৌরবলাভ করেছিলেন সেই গৌরব থেকে বঞ্চিত হতেন।
এ কারণে তাঁর সকল স্ত্রী বহাল থাকা ছিল যুক্তির দাবী। তবে পরবর্তীতে অন্য কোন নারীকে বিয়ে করতে রাসুল সা. কে আল্লাহ তায়ালা নিষেধ করেছেন। এ সম্পর্কে ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
এখানে একটা তা স্পষ্ট করা দরকার যে, রাসুল সা. যাদের বিয়ে করেছিলেন, তাদের কারো রুপে আকৃষ্ট হয়ে বা যৌন কামনার বশবর্তী হয়ে করেননি। পাশ্চাত্যের লেখকরা যদিও রাসুল সা. এর শানে বেয়াদবের মত এরকম গোস্তাখিপূর্ণ কথা উল্লেখ করেছে। কিন্তু চিন্তা করে দেখুন, রাসুল সা. পঁচিশ বছর বয়সে প্রথম বিয়ে করেছিলেন। হযরতখাদীজা রা. ছিলেন সেই সময় রাসুল সা. এর পনের বছরের বয়োজ্যেষ্ঠ। তাছাড়া ইতিপূর্বে দু'বার তাঁর বিয়ে হয়েছিল এবং সন্তানও হয়েছিল। তবুও বিবি খাদিজার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং চমতকার প্রীতিপূর্ণ জীবন যাপন করেন।
হযরত খাদিজা রা. এর ইন্তেকালের পর রাসুল সা. তার প্রসংগে সবসময় ভাল কথা বলতেন এবং তার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতেন।
হযরত খাদিজা রা. এর মৃত্যূর পর রাসুল সা. অন্যান্য বিয়ে করেছিলেন। ৫৩ বছর বয়সে রাসুল সা. হযরত সাওদা বিনতে জামায় রা. কে নিজ সন্তানের দেখাশুনা এবং ঘর সংসারের দায়িত্ব পালনের প্রয়োজনে বিয়ে করেন। হযরত আবু বকর রা. এবং হযরত ওমর রা. এর সাথে সম্পর্ক অধিকতর মজবুত করার উদ্দেশ্যে আয়েশা রা. এবং হাফসা. রা.কে বিয়ে করেন। একই উদ্দেশ্যে ওসমান রা. এবং আলী রা. কে নিজ কন্যাদের সাথে বিয়ে দেন। চিন্তা করে দেখুন তো, এটা কি কাকতালীয় ব্যাপার ছিলো যে, রাসুল সা. এর ওফাতের পর উল্লেখিত চারজনই পরে খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেন।
হযরত হাফসা বিধবা ছিলেন। তার অতোটা রুপ সৌন্দর্যও ছিল না। হযরত আয়েশার সাথে বিয়ের সময় তার বয়স এত কম ছিল যে, সেই বয়সে তার সাথে যৌন সম্পর্ক স্াপন কষ্টকর চিন্তা ছাড়া কিছু ছিলো না।
উম্মে সালমা রা. বিধবা হন এবং ধৈর্যের সাথে বৈধব্যকাল অতিবাহিত করেন। তার ধৈর্যের কারণে আল্লাহ তায়ালা পুরস্কার স্বরুপ রাসুল সা. এর স্ত্রী হওয়ার সৌভাগ্য দান করেন। জুওয়াইয়া বিনতে হারিস রা. কে রাসুল সা. এ উদ্দেশ্যে বিয়ে করেছিলেন যে, বিয়ের পর জুওয়াইয়ার কওমের লোক ইসলাম গ্রহণ করবে। আবু সুফিয়ানের কন্য উম্মে হাবিবাকে এ জন্য বিয়ে করেছিলেন যে, উম্মে হাবিবা হাবশায় হিজরত করার পর তার স্বামী মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল এবং মৃত্যুবরণ করেছিলো। উম্মে হাবিবার কষ্ট লাঘবের জন্য রাসুল সা. তাকে বিয়ে করেন। তা চাছাড়া এ বিয়ের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিলো ইসলামের প্রতি আবু সুফিয়ানের শত্রুতা হয়তো কিছুটা কমে যাবে।
বিস্তরিত এ আলোচনায় বোঝা যায় যে, রাসুল সা. এর প্রতিটি বিয়ের পিছনেই ছিল মহত উদ্দেশ্য। রুপ সৌন্দর্য, অর্থ সম্পদ বা যৌন কামনা তাড়িত বিয়ে একটিও ছিলো না। একত্রে চারজন স্ত্রীর অধিক রাখা যাবে না- এই বিধান জারি হওয়ার আগে রাসুল সা. ওই বিয়েগুলো করছিলেন। এই বিধানের পরে রাসুল সা. একটি বিয়েও করেন নি। তবে তাঁর স্ত্রী হিসেবে যারা ছিলেন তাদের কাউকে তালাক দেননি। এর কারণ উপরে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাসুল সা. এর একাধিক বিয়ের অন্যতম প্রধান কারণ ছিলো, ইসলামের প্রচা প্রসারে সহায়তা করা। আরও একটি উদ্দেশ্য ছিলো, তাঁর স্ত্রীরা তাঁর জীবন চরিত সম্পর্কে বেশি সংখ্যক মানুষকে অবহিত করতে পারবে। এতে সন্দেহ নেই যে, স্ত্রীরা স্বামীদের যতটা কাছাকাছি থাকেন অন্য কেউ ততটা থাকতে পারেন না।
রাসুল সা. একাধিক বিয়ে করে স্ত্রীদের সামনে নিজের বাস্তব জীবনের নমুনা পেশ করেন। স্ত্রীরা যেন সেসব মানুষকে জানাতে পারেন। রাসুল সা. বলেন আমার সম্পর্কে লোকদেরকে জানাও।
হযরত আয়েশা রা. রাসুল সা. এর জীবন সম্পর্কে লোকদেরকে বিস্তরিত অবগত করেছেন। স্বামী স্ত্রীর একান্ত ও বিশেষ সম্পর্কের কথাও তিনি গোপন করেননি।
-------------------------------------- লেখাটি 'ফতোয়া' নামক বই থেকে নেয়া। জনাব কারযাভীর বিভিন্ন প্রশ্নোত্তরের বাংলায় সংকলন করেছেন হাফেজ মুনির উদ্দিন আহমদ। বইটি প্রকাশ করেছে আল কোরআন একাডেমী লন্ডন। কাটাবনের বইয়ের দোকানগুলোতে পেতে পারেন।
আল্লামা কারযাভীকে জানতে এখানে ক্লিক করুন