এক.
৩০১১ সাল। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা আর ডিজিটালাইজেশনের এই চরম মুহুর্তে পৃথিবীতে এরকম উটকো ঝামেলা দেখা দেবে ভাবতে পারেনি কেউই। বিংশ শতাব্দীর দিকেও যেসব আবিষ্কার আর প্রযুক্তিগত বিষয় আশয়-কে নিছক কল্পনা আর ফিকশন ভাবা হতো, তার অনেক কিছুই এখন মানুষের আয়ত্তের মধ্যে। এখন পৃথিবীর মানুষের গড় আয়ুষ্কাল ২৭৭ বছর। ১০০ বছরের আগে বিবাহ এবং ১৫০ বছরের আগে সন্তান ধারণ পৃথিবীর আইনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আর এক সময় গ্লোবালাইজেশনের যে স্বপ্ন দেখতো পৃথিবীর মানুষ, বছর পঞ্চাশেক আগে তাও ধরা দিয়েছে। এখন গোটা পৃথিবী নিয়ন্ত্রিত হয় একটি কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃত্বে। আর ‘ফিউচার আর্থ স্টেশনের’ মাধ্যমে সৌরজগত কিংবা আউটার ওয়ার্ল্ডের অনেক কিছুই এখন পরিষ্কার মানুষের সামনে। ‘ফিউচার আর্থ স্টেশনের’ মাধ্যমে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই সবাই জানতে পারছে কী ঘটতে যাচ্ছে পৃথিবীতে। ভূমিকম্প, সাইকোন, বজ্্রবৃষ্টি, নত্রের পতন থেকে শুরু করে কোন কিছুই বাদ পড়েনি ‘ফিউচার আর্থ স্টেশনের’ ভিজুয়াল উপস্থাপনার মধ্যে। আজ এমনই এক ক্রান্তি লগ্নে বিকল হয়ে পড়েছে সেই ‘ফিউচার আর্থ স্টেশনও। ‘ফিউচার আর্থ স্টেশনে’ দানবদেহী গ্রহান্তরী আগন্তুকের আগমনের আগে কোন ভিজুয়াল যেমন ধরা পড়েনি ঠিক তেমনি এই অদ্ভুত দানবদের আগমনের পর পরই এ বিষয়ে সার্চ দেয়ার পর থেকে বিকল হয়ে পড়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে আশ্চর্যতম আবিষ্কার ‘ফিউচার আর্থ মেশিন’। কী এমন মহাশক্তি আছে ওই দানবদেহী গ্রহান্তরী আগন্তুকদের কাছে? একথা কেউই বুঝতে পারছে না। মিডিয়া থেকে শুরু করে চায়ের দোকান এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরেও আলোচনার বিষয় দানব এবং ফিউচার আর্থ স্টেশনের বিকল হয়ে পড়া।
দুই.
অধ্যাপক রিচার্ডসনের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো ফিউচার আর্থ স্টেশনের সবচেয়ে তরুণ ও সম্ভাবনাময় বিজ্ঞানী মুশফিক গুলজার। রুমের এন্ট্রি কার্ডটা পাঞ্চ করেই রুমে ঢুকে পড়লেন তিনি। ফিউচার আর্থ স্টেশনের ইনচার্জ অধ্যাপক রিচার্ডসনের রুমটা তিন ভাগে বিভক্ত। যাকে বলে একের ভেতর তিন। প্রথম অংশ অনেকটা রিসিপশন টাইপ। দ্বিতীয় অংশ রিচার্ডসনের রিডিং কাম রেস্ট রুম। আর তৃতীয় অংশটা তার পার্সোনাল ল্যাবরেটরি। রুমে ঢুকেই অধ্যাপকের ক্রুদ্ধ গর্জন শুনতে পেলেন মুশফিক গুলজার। বোঝাই যাচ্ছে এখন দারুণ উদ্বিগ্ন এবং উত্তেজিত অধ্যাপক রিচার্ডসন। মুশফিক একটু দ্ভিধায় পড়ে গেল। এই মুহুর্তে অধ্যাপকের সামনে যাওয়া কী ঠিক হবে? স্যারের যা মেজাজ! ঐদি তাকে দেখে তিনি আরো বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েন! তবে কী একটু ঘুরে আসবে সে? কিন্তু না অত সময় তো হাতে নেই! তখনই আবারো গর্জন শোনা গেল অধ্যাপকের। ‘তোমার হাতের চায়ের চেয়ে ঐ রোবটের হাতের চা-ও অনেক ভালো। তোমার কাছে আমি চা চেয়েছি স্টুপিড! গরম পানি নয়! এখন যাও। যত্তোসব!’ অধ্যাপকের মেজাজ দেখে ঢোক গিললেন মুশফিক। এই লোকটা অদ্ভুত চা-খোর। সারা দিন অনর্গল চা খেতে থাকেন। চায়ের মধ্যে যে তিনি কী খুঁজে পান, সৃষ্টি কর্তাই জানেন। আর লোকটার মেজাজ মর্জিও বোঝা বড় কঠিন। এই মুহুর্তে অধ্যাপকের রুমে যাওয়া আর তার রোষানলে পড়া একই কথা। কিন্তু যেতে তো হবেই। গত দু’দিন ছুটিতে ছিলেন মুশফিক। আজও ছুটি ছিল। কিন্তু দানবদেহী গ্রহান্তরী আগন্তুকের আগমনের পর ছুটে না এসে পারলো না সে। উদ্দেশ্য- অধ্যাপক রিচার্ডসনের সঙ্গে কথা বলা। সাহস করে স্যারের রুমে ঢুকে পড়লেন- মুশফিক। অধ্যাপক শুধু চোখ তুলে তাকালেন। ইশারায় তাকে বসতে বললেন। মিনিটখানেক নীরবে কাটার পর মুশফিকই প্রথম মুখ খুলল।
- স্যার দানবদেহীদের নিয়ে কী ভাবলেন?
রিচার্ডসন কোন উত্তর দিলেন না। কিছুণ নিশ্চুপ থেকে তারপর বললেন-
- মুশফিক ওদের নিয়ে আসলে চিন্তা –ভাবনা আর ভয় পাবার কিছুই নেই।
চমকে উঠলেন মুশফিক। কী বলছেন অধ্যাপক রিচার্ডসন? চমক বজায় রেখেই স্যারের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন তিনি
- কী বলছেন স্যার- চিন্তার কিছু নেই?
- ওরাতো আমাদের কোন তি করছে না। করেছে কী?
- এখন পর্যন্ত করেনি।
উত্তরে বলল মুশফিক। পরণেই সে বললো-
-কিন্তু ওদের প্রতিহত করার জন্য আমরা যে চেষ্টাই করেছি, তাই ব্যাহত হয়েছে। ওদের কিছুই করা যায়নি। তাছাড়া ওদের েেত্র আমাদের ফিউচার আর্থ মেশিন পর্যন্ত কাজ করছে না। এগুলো কী চিন্তার বিষয় নয়?
এাথা নেড়ে মুশফিককে সমর্থন জানালো প্রফেসর। এরপর মুশফিকের চোখে চোখ রেখে বললো-
-আমরা যদি ওদের প্রতিহত করার নামে ওদেরকে এভাবে ডিস্টার্ব করতে থাকি তাহলে এর ফলাফল আরো খারাপ হতে পারে।
- কী রকম?
প্রশ্ন করলো মুশফিক। প্রফেসরও আগ্রহের সাথে উত্তর দিলেণ
- খুব সহজ আমরা এখনৗ ঐ দানবদেহী গ্রহান্তরী আগন্তকদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুই জানি না। আবার এরা এখন পর্যন্ত সরাসরি মানব জাতির কোন তিও করেনি। তাই আমাদের আগে ওদেরকে ওয়াচ করা উচিত। জানা উচিত ওরা কোথা থেকে কেন এসেছে।
- এটা অবশ্য ভালো বলেছেন।
প্রফেসরকে সমর্থন জানালেন তরুণ বিজ্ঞানী মুশফিক গুলজার। এই বিষয়েই কিছু সুপারিশ তৈরীর জন্য কাগজ তুলে মুশফিককে লিখতে দিলেন অধ্যাপক রিচার্ডসন। মুশফিক লিখতে শুরু করলেন।
তিন.
দানবদেহী গ্রহান্তরের আগন্তুকরা পৃথিবীতে নেমেছে আরো দুই দিন আগে। প্রায় মাইল খানেক লম্বা অদ্ভুত কালচে এক মহাকাশযানে চেপে এসেছে ওরা। এখানকার জনারণ্যেও পাশের সরিনস মরুভূমির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত দানবদেহীদের পথচলা এবং তাদের মহাকাশযান। মহাকাশের কোন প্রান্ত থেকে কী উদ্দেশ্যে ওরা এখানে এসছে কেউ বলতে পারবে না। কোনদিন এই ধরনের কোন দানবদেহীর কথা কেউ চিন্তাও করেনি। ওদেও আবির্ভাাবের পর থেকেই চতুর্দিকে অদ্ভুত অন্ধকার ছড়িয়ে অঅছে। আর এই অন্ধকারই আতঙ্ক ছড়িয়েছে সবার মধ্যে। তাছাড়া প্রায় শ’পাঁচেকের ওপর দানবদেহী এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করছে। ওরা কোন কিছু ধ্বংস করছে না। কোন মানুষের দিকে মনযোগও দিচ্ছে না। কিন্তু ওরা যেদিকেই যাচ্ছে চতুর্দিক অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে। অন্ধকারের বলিরেখাময় ওদের ছায়ায় কিছুই দেখা যায় না। বিকট শব্দ করে ওরা যখন কথা বলে তখন রীতি মতো ছোট খাটো ঝড় ওঠে। ে
ওদের প্রায় অবাস্তব দেহটা কাছাকাছি থেকে সরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কেউই কিছু দেখতে পায় না। ওদের দ্বারা এখন পর্যন্ত মানুষের তি বলতে এটুকুই হয়েছে।
চার.
- মা, ওরা কী আমাদেরকে মেরে ফেলবে?
বাচ্চার প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলেন মা তাসনুভা। নিজের দুশ্চিন্তা গোপন করে উত্তর দিল-
- না, মা। দেখোনি আসার পর থেকে মানুষের দিকে ওরা কোনো মনোযোগই দেয়নি।
- মা, ওরা কোথা থেকে এসেছে?
- দূর আকাশ থেকে এসেছে।
- মা, ওরা কী খায়?
এবার রেগে গেলেন মা। ধমক দিয়ে বললেন
- পড়ছো না কেন? এতো কথা বলো তুমি! একটা বিষয় পেলেই হলো। ওটা নিয়ে হাজারটা প্রশ্ন করা চাই। এই অভ্যাসটার পরিবর্তন করো বুঝেছো।
মা ছোট্ট ছেলেকে বোঝাচ্ছিলেন। তখনি পাশের রুম থেকে বড় মেয়ে টুসিম্পা দৌড়ে এলো-
- মা দেখো, দেখো টিভিতে জন্তুগুলোকে দেখাচ্ছে।
আগ্রহ ভরে এগিয়ে গেলেন তাসনুভা। পেছন পেছন পিচ্চি ছেলেটিও। খবর চলছিল। খবরে বলা হচ্ছে-
‘এ নিয়ে সর্বস্তরের জনগণ চরম উদ্বেগ উৎকন্ঠায় রয়েছে। এদিকে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মানুষের প থেকে ওদেও সঙ্গে কোন প্রকার যোগাযোগের সব রকম চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। যোগাযোগের উদ্দেশ্যে ওদেও কাছাকাছি গিয়ে দুইজন সেনা কর্মকর্তা ওদের পদতলে পৃষ্ঠ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। দানবদেহী গ্রহান্তরী আগন্তুকদের প্রতিহত করার জন্য সেনা বাহিনী- বিমান বাহিনী নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দানবদের উপর গোলাগুলির যতো বিস্ফোরণই ঘটুক না কেন, তাদের কোন তিই হচ্ছে না। কোন আঘাত পাচ্ছে বলেও মনে হচ্ছে না। এমন কি হাইড্রোজেন বোমাতেও ওদের কোন তি করা যাচ্ছে না। এদিকে ফিউচার আর্থ স্টেশনের সম্মাণিত ইনচার্জ অধ্যাপক রিচার্ডসন সরকারকে ওদের উপর এরকম হামলা চালানো থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। শক্তিশালী বিজ্ঞানীদের একটি বিশেষ দল ওদেরকে দু’ একদিন পর্যবেণ করবেন বলে জানা গেছে।..’
গংবাদ তখনও চলছিল। কিন্তু রিমোট কন্ট্রোল হাতে নিয়ে টিভিটা অফ করে দিলেন তাসনুভা। মুখ দিয়ে শুধু উচ্চারণ করলেন-
- হায়! কী হবে কে জানে?
পাঁচ.
ফিউচার আর্থ স্টেশনের বিজ্ঝানীদের একটি দল নগর ভবন থেকে দানবদেহী গ্রহান্তরী আগন্তুকদের পর্যবেণ করছে। অনেণ নীরব থাকার পর মুখ খুললেন রিচার্ডসন-
- একটা কথা কিন্তু পরিষ্কার। মানুষের ব্যাপারে ওদের কোন আগ্রহ নেই।
- হ্যা ওরা সম্ভবত আমাদেও কোন তি করতে চাইছে না।
তাকে সমর্থন করলেন আরেক বয়োঃজ্যোষ্ঠ বিজ্ঞানী নিকোলাস।
- কিন্তু ওদের সুবিশাল আকৃতি আর চলাচলটাইতো আমাদের জন্য হুমকি স্বরূপ।
দুই সিনিয়রের কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে যোগ করলেন তরুণ বিজ্ঞানী মুশফিক গুলজার।
- ‘হুম’ বলেই আবারো চা আনার নির্দেশ দিলেন রিচার্ডসন। তিনি আর নিকোলাস দুজনেই চা পান করছিলেন। মুশফিক চা খায় না। এ নিয়ে রিচার্ডসন সব সময়ই কৌতুক করেন। কিন্তু মুশফিকের অভ্যাসে কোন পরিবর্তন আসেনি।
মুশফিক দানবদের দিকে তাকিয়ে উদ্বেগের সাথে বলল-
- দেখুন দেখুন, ওরা কী যেন করছে!
উজ্জ্বল দিন। চারিদিকে রৌদ্র যেন ঝিলমিল করছে। শুধু দানবদের কারনে কেমন যেন আবছা অন্ধকারে ঢেকে গেছে এলাকা। বহু দূরে দানবদের মাথা আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল ওদের। হঠাৎ চারদিক ঝাপসা হয়ে উঠলো। দুটো দানবের হাতে বিশাল গোল কী যেন।
- ওদের হাতে কী?
উদ্বেগের সাথে বলল মুশফিক।
এতোণ নিশ্চুপ ছিলেন রিচার্ডসন। এবার মুখ খুললেন তিনি। বললেন
- ওদের হাতে মেঘ! ওরা মেঘ তৈরী করছে! আর সম্ভবত এটা ওদের একটা খেলা!
হঠাৎ দেখা গেল একটা দানব হাতের মেঘগুলোকে বল বানিয়ে দূরে কোথাও ছুড়ে মারলো। দ্বিতীয় দানবটিও একই কান্ড করলো। এরপর আবার বল বানানোয় মনযোগ দিল। ওরা মেঘের বল তৈরী করে ছঁড়ে মারছে। অল্প কিছুণের মধ্যেই আকাশটা অন্ধকার হয়ে গেল। শীতল বাতাস বইতে লাগলো। বোঝা যাচ্ছে- দূরে কোথাও বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এভাবে যদি সবক’টা দানব মেঘ তৈরী শুরু করে, তাহলে সেই বৃষ্টির পানিতে ডুবে যাবে গোটা পৃথিবী। ফিউচার আর্থ স্টেশনের কর্তারা অসহায়ের মতো সেই চূড়ান্ত পরিণতির অপো করতে লাগলেন। কিছুই করার নেই!