ইছামতী নদীর তীরে আমার জন্ম। আব্বা তখন সাব-রেজিষ্টার রফিউদ্দিন সাহেবের বাসায় ভাড়া থাকতেন। পরবর্তীতে ক্ষিতিশ ড্রাইভারের বাড়ি আব্বা কিনেন। এই বাড়িতেই কেটেছে আমার শৈশব ও কৈশর। উভয় বাড়িই ইছামতী নদীর তীরে। কাচারী পাড়ায় আমাদের নতুন বাড়ির নিকটেই ছিল শরিয়ত পিয়নের বাড়ি। নদীর একেবারে পাড়িতে। আর্দালীর পোষাক পড়ে সে যখন অফিসে যেতো আমরা তখন তাকে তাকিয়ে দেখতাম। তার ছেলেরাও ছিল আর্দালী। চাকুরী ক্ষেত্রে শরিয়তের গুণাবলীতে মুগ্ধ হয়ে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবগণ তার পুত্রদেরকে এভাবে চাকুরী দিয়েছেন। শরিয়ত ছিল তীক্ষ্ণ মেধা ও ক্ষুরধার স্মৃতি শক্তি সম্পন্ন একজন আর্দালী। কোন জেলা ম্যাজিষ্টেটের পর কোন জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট এসেছেন, তাঁরা কে কতদিন অবস্থান করেছেন, কার আমলে কোন কোন মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তি হয়েছে এ সবই সে অবলীলায় বলে দিতে পারতো। কোন সময় অনেক পুরানো নথি খুঁজে পাওয়া না গেলে প্রয়োজন হতো শরিয়তের। মামলার নম্বর তাকে বলার দরকার হতো না। ঘটনা সম্পর্কে তাকে ধারণা দিতে পারলেই সে মুহূর্তের মধ্যেই নথি মোহাফেজখানা (Record Room) থেকে বের করে আনতো। এ কারণেই অবসর গ্রহণের পরেও তার ডাক পড়তো। একেবারে জয়ীফনা হওয়া পর্যন্ত সে এভাবেই কালেকটরেট ভবনে সেবা দিয়ে এসেছে। তার এসব কৃতিত্বের কাহিনী আমাদেরকে বিস্মিত ও মুগ্ধ করেছে। এজন্য কারো কাছ থেকে সে কোন বখশিশ দাবী করে নেয় নাই। সরকারী চাকুরী জীবীদের চাকুরীর মেয়াদ বাড়ানোর আইন সঙ্গত সুযোগ থাকলেও সে এ সুযোগ পায় নাই। কালেকটরেট ভবনে তার এই কৃতিত্বের স্মৃতি এখনও অম্লান। তার মতো গুণ সম্পন্ন আর্দালী এ পর্যন্ত কালেকটরেট ভবনে পাওয়া যায় নাই।
জেলা জজ আদালতের আর্দালী আবদুল লতিফ খান ও ছিল একই গুন সম্পন্ন। মুখে কোন কথা নাই। আপন মনে নিরবে নিজের কাজ গুলো করে যাচ্ছে। আত্মগরিমা জাহির করে জেলা জজের কাছ থেকে সুবিধা নেবার কোন প্রবণতা নাই। প্রায় পনের বৎসর আগে রায় হওয়া একটি মামলা ‘ঢাকা ল রিপোর্ট’ (DLR) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আপীল বিভাগের ঐ রায়টির মামলা সৈকতের ঐ জেলার ঘটনা নিয়ে হয়েছিল। সাম্প্রতিক একটি মামলায় ঐ নজিরের বরাত দেওয়া হয়। জেলা জজ ভাবলেন মূল নথিটি তিনি পড়ে দেখবেন। আদালতের জ্যেষ্ঠ কর্মচারীদের বলা হলেও তারা নথিটি উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হলো। জেলা জজ সাহেবকে বিচলিত দেখে তাঁকে আবদুল লতিফ জিজ্ঞাসা করলো কিছু লাগবে কিনা। মামলার ঘটনার কথা জানাতেই লতিফ নিজ মনেই একটি নম্বর বললো এবং জানতে চাইলো ঐ নথিটি লাগবে কিনা। তাকে জানানো হলো নম্বর বলার সুযোগ নাই, তবে মামলার ঘটনা তাকে জানানো হলো। তৎক্ষনাৎ সে মোহাফেজ খানায় চলে গেলো এবং আধাঘন্টার মধ্যেই সে আসল নথিটি জেলা জজের সামনে হাজির করলো। অনেক সময় ভালো কাজ করেও মানুষ স্বীকৃতি না পেয়ে সন্দেহ ভাজন হয়ে যায়। এ যাত্রা লতিফের ভাগ্যেও তাই জুটলো। জেলা জজের মনে সন্দেহ হলো লতিফই নথিটি লুকিয়ে রেখে পরে সুযোগ মতো বের করে দিয়ে জেলা জজের কাছ থেকে বাহবা নেবার চেষ্টা করেছে। কিছুদিন পর জেলা জজ বুঝতে পারলেন লতিফ আসলেই প্রখর স্মৃতি শক্তি সম্পন্ন মেধবী আর্দালী। জেলা জজ আদালতে বহু রকম মামলা হয়। প্রতিদ্বন্ধিতা মূলক প্রবেট মামলা, হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের মামলা, উত্তরাধিকার সনদ সংক্রান্ত আপীল মামলা ইত্যাদি মামলা শুধুমাত্র জেলা জজই নিষ্পত্তি করার এখতিয়ার সম্পন্ন। এসব মামলা দাযের হয় কদাচিৎ। এরূপ মামলা নিষ্পত্তিকরতে গিয়ে পুরাতন একটি নথি দেখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে তা লতিফকে জানানো হলো। তড়িৎ বেগে সে নথিটি জেলা জজের সামনে হাজির করলো। তখন থেকে কোন পুরানো নথির প্রয়োজন হলে লতিফকে তা বলা হতো এবং সে দ্রুততার সাথেই নথি এনে দিত।
জেলা ও দায়রা জজদের আকস্মিক প্রয়োজনে দৈনিক মজুরীর ভিত্তিতে লোক নিয়োগ করার জন্য একটি বিশেষ তহবিল রয়েছে। এটাকে ‘কনট্যাক্ট কনটিনজেন্সি’ তহবিল বলে। আদালতের স্বাভাবিক কার্যাদি সম্পাদনের জন্য ব্যস্ত থাকতে হয় আর্দালীদের। সে কারণে এদের দ্বারা আদালত প্রাঙ্গন পাহারা দেওয়া , পরিচ্ছন্ন রাখা ইত্যাদি কাজ সম্পাদন করা সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই তাদের সহযোগিতার জন্য এই তহবিল থেকে চুক্তির ভিত্তিতে লোক নিয়োগ করা হয়। কালক্রমে এরাই আর্দালী পদে নিয়োগ লাভ করে। আবদুল মতিন ছিল এ ধরনেরই একজন আর্দালী। ছোট বেলাতেই সে রইচ সাহেবের বাসায় কাজ করতো। রইচ সাহেব ছিলেন একজন মুনসেফ। রইচ সাহেব বদলী হয়েছেন, পদোন্নতি পেয়েছেন কিন্তু আবদুল মতিন সব সময়ই এই রইচ সাহেবের সাথেই থেকেছে। উত্তরাঞ্চলের একটি জেলায় রইচ সাহেব জেলা ও দায়রা জজ পদে নিয়োজিত হলেন। এই সময় তিনি আবদুল মতিনকে উক্ত তহবিল থেকে ঝাড়–দারের পদ দিলেন। রইচ সাহেব বদলী হয়ে গেলেও আবদুল মতিন এই জেলাতেই রয়ে যায়। উপজেলা আদালত প্রতিষ্ঠিত হলে আবদুল মতিনকে আর্দালী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। আনুগত্য ও বিশ্বস্ততায় তার জুরি মেলা ভার। বিচারকদের জন্য অবশ্য পালনীয় নীতিমালা ও আচরণ বিধিঅনুসারে একজন বিচারক তাঁর আদালতে বিচারধীন কোনমামলা মোকদ্দমাসম্পর্কে কারো সাথেই আলোচনা করতে পারেননা। তিনি এজলাসেব সেই উভয় পক্ষের সাক্ষ্য প্রমানাদি গ্রহণ করবেন, সওয়াল জবাব শুনবেন এবং রায় বা আদেশ ঘোষণা করবেন। তিনি কোন পক্ষের উকিলের কাছ থেকে কোন প্রকার লিখিত সওয়াল জবাব বা নোট নিতে পারবেন না। তাই রায় প্রকাশিত হবার আগে তার গোপনীয়তা কঠোর ভাবে রক্ষা করা হয়। আবদুল মতিন নিরক্ষর। সে পড়তেও জানেনা , লিখতেও জানে না। তাই রায় লেখার সময় তার কাছে আবদুল মতিন ছাড়া আর কাউকেই বিজ্ঞ মুনসেফ আসতে দিতেন না। কলম কাগজ এগিয়ে দেওয়া, রায় লেখার পর তাতেসীল মোহর দেওয়া, তা সেলাই করা সহ যাবতীয় কাজ আবদুল মতিনকে দিয়েই বিজ্ঞ মুনসেফ করাতেন। মুনসেফ সাহেব ভাবতেন রায়ের ফলাফল আবদুল মতিন কিছুই বুঝেনা। একদিন আবদুল মতিন হাসতে হাসতে মুনসেফ সাহেবকে জানালো যে রায় লেখা হবার সাথে সাথেই সে মামলার ফলাফল জানতে পারে। মুনসেফ সাহেব তো অবাক । তিনি জানতে চাইলেন কিভাবে। আবদুল মতিন জানালো যে রায়ের শেষের দফা যদি ২/৩ ল্ইানের হয় তাহলে বিবাদী জিতেছে এবং উক্ত দফা যদি তার বেশী বড় হয় তাহলে বাদী জিতেছে। আবদুল মতিনের কথা সঠিক। কারণ বাদীর মামলা খারিজ হলে এ সংক্রান্ত আদেশ ২/৩ লাইনের হয়। বাদীর পক্ষে ডিক্রি হলে রায়ের শেষে সিদ্ধান্ত লেখার সাথে সাথে ঘোষণা ও নির্দেশনা থাকে তাই শেষের দফা তুলনা মূলক ভাবে বড় হয়। নিরক্ষর হলেও আবদুল মতিন বুদ্ধিমান, সে বুদ্ধিমত্তা দিয়েই আদালতের সকল কাজ সুচারু ভাবে সম্পাদন করে থাকে।
এদের নিয়েই যুগ যুগ ধরে চলছে আদালতের কার্যক্রম। অফিস আদালতের সময় সূচী থাকলেও তাদের কাজের পরিধির কারণে সে সময় সূচীর বাইরেও তাদের কাজ করতে হয়। কিন্তু তাদের দিন কাটে সীমাহীন অভাব-অনটন ও দারিদ্রের মাঝে।
সা কা ম আনিছুর রহমান খান : সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ।
দৈনিক উত্তরা প্রতিদিন
শণিবার ৩রা বৈশাখ ১৪২৩ বঙ্গাব্দ
১৬ৈই এপ্রিল ২০১৬খ্রিঃ
৮ই রজব ১৪৩৭ হিজরী।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১০:৩৪