বাজার পার হয়ে ইউনিয়ন পরিষদের রাস্তাটি সোজা চলে গেছে পূর্ব দিকে। বিকেল থেকে সে রাস্তাটি ধরেই হাঁটছে রতন। হাটবারের দিন এ রাস্তায় অনেক মানুষ থাকে। আজ একদম নিরব। সামনে ছলিমদের বাড়ি। এটিই গ্রামের শেষ বাড়ি। এখান থেকে পায়ের নিচের ইটের রাস্তাটি মেঠো পথে রূপ নিয়েছে। রতন সেই মেঠো পথ ধরে আনমনে এগিয়ে যেতে থাকে।
জংলার মত মুন্সিদের পুরনো ভিটেটা পার হয়ে রতন একবার পেছন ফিরে চায়। প্রায় সন্ধ্যে হয়ে আসা আধো-আলোতে রতন তার প্রিয় জয়ন্তপুর গ্রামটি দেখতে পায়।
এই গ্রামেরই আলো-জলে সেই ছোট্টটি থেকে আজ এতো বড় হয়েছে রতন। এ গ্রামের ধূলো-কাদা মেখেই হাঁটতে হাঁটতে একদিন দৌড়াতেও শিখেছিলো রতন। শুধু পায়ে পায়ে নয়, জীবন পথের দৌড়টাও রতন এ গ্রামেই শিখেছিলো।
রতন তার জীবনের কোন দৌড়েই কখনো হারে নি। সেই ছোটবেলায়, ক্লাস ফাইভে পড়ে তখন রতন। ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল, শুধু তাই নয় সম্মিলিত মেধা তালিকায় হয়েছিল দ্বিতীয়। সাংবাদিকরা তার ছবি তুলে নিয়ে গিয়েছিলো পত্রিকায় ছাপানোর জন্য। সেদিন রতন তার মায়ের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট বুঝেছিলো তার গরীব বিধবা মা কতটা খুশি হয়েছিলেন। এরপর একদিন চেয়ারম্যান সাহেব খুশি হয়ে পাচ'শ টাকা আর রতনের ছবি সহ একটা পত্রিকা তুলে দিয়েছিলো তার মায়ের হাতে। সেই পত্রিকা রতনের মা কাকে দেখায় নি! রতনের এখনও মনে আছে, সেদিন রাতে তার মা তার প্রিয় ইলিশ মাছ রান্না করেছিলেন। রতন আর ওর বোন তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছিলো সেদিন।
প্রামের রাস্তাটা এখানেই শেষ। সামনে জয়ন্তী নদী। রতনের জীবনের অনেকটা জুড়েই রয়েছে এই জয়ন্তী নদী। এই নদীর নামানূসারেই ওদের গ্রামের নাম হয়েছে জয়ন্তপুর। আরো একটি নাম হয়েছে এ নদীর নামানূসারে, রতনের বোন জয়ন্তী।
সারাটা দিন ওরা দুই ভাইবোন একসাথে কাটিয়ে দিতো। দু'জন মিলে কত খেলাই না খেলতো। প্রতিদিন সকালে দু'ভাইবোন মিলে কখনো যেত শিপুদের বাগানে আপ কুড়াতে আবার কখনো যেত ঝর্নাদের গাছের করমচা আনতে। এজন্য বকাও খেত অনেক। কিন্তু তবুও বোনের পিছু ছাড়তো না রতন।
একদিন হঠাৎ করেই প্রচন্ড জ্বর হয় জয়ন্তীর। এরপর হাত-পা আর মুখে উঠতে থাকে গুটি গুটি লাল দাগ। গ্রাম্য কবিরাজরা বলে, 'এ নরকের রোগ, প্লেগ। এ রোগের কোন চিকিৎসা নাই।' তারা নরকের রোগ বসুধা ছাড়া করতে কলাগাছের ভেলায় করে উত্তাল জয়ন্তীর বুকে এক শান্ত জয়ন্তীর আকুতি ভরা দ'চোখ উপেক্ষা করে ভাসিয়ে দেয়।
আষাঢ়ের ক্ষরস্রোতা জয়ন্তী নদী ছোট্ট কলাগাছের ভেলাটা মুহূর্তেই ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এ যেন তার সন্তান। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়, বিকেল গড়িয়ে রাত। মা-পুত্র সেই নদীর পাড়ে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে।
এই সেই নদীর পাড়ে।
দিনের শেষ আলোটুকু কেমন ঝাপসা হয়ে আসে রতনের চোখে।
নদীর ধার ধরে আরো পুবদিকে এগিয়ে যায় রতন। কিছুদূর যেতেই বিশাল এক বটবৃক্ষ। রতন এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে গাছটির দিকে। অনেক অনেক স্মৃতি রতনের এ গাছের সাথে।
গাছের গুঁড়ির একটা জায়গা খুঁজে নিয়ে রতন বসে পড়ে। সামনে বিশাল মাঠ। জয়ন্তীপুর শ্মশান মাঠ। আশেপাশের দশ গ্রামের এই একটিই শ্মশান ঘাট।
রতনের ভেঁজা চোখে চব্বিশ বছর আগের একটি দৃশ্য ফুটে ওঠে। কয়েকজন মানুষ ঘিরে থাকা একটি জ্বলন্ত চিতা। সেদিনও এই বটগাছটির নিচে বসে এমন ছলছল চোখে তাকিয়ে ছিলো রতন।
এভাবে কতক্ষন কেটে গেছে জানা নেই। পকেটে বাজতে থাকা ফোনের শব্দে সৎবিৎ ফিরে পায় ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সাইন্সের অধ্যাপক এবং খ্যাতিমান নিউরোসার্জন রতন বোসাক পাল।
- হ্যালো
- স্যার আপনি কোথায়? হোটেলে খোঁজ করলাম তারা জানালো আপনি নাকি সকালে বের হয়ে গেছেন।
- হ্যা, আমি একটু ঢাকার বাইরে এসেছি। রাতের মধ্যেই ফিরে আসবো।
- আগামীকাল সকালে স্যার ঢাকা মেডিক্যালে আপনার লেকচার আছে আর রাতে রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রনে ডিনার।
- হ্যা, আমার মনে আছে।
- স্যার আপনাকে RBP সিনড্রমের আবিষ্কারক হিসেবে রাষ্ট্রপতি পদকের জন্য মনোনিত করা হয়েছে।
- রাসেল, তোমার সাথে কথা বলতে বিরক্তি লাগছে।
- আমি দুঃখিত স্যার। আমি তাহলে ফোনটা রেখে দিচ্ছি।
রতন ফোনটা কেটে দিয়ে নিঃশব্দে বসে রইলো। যেন কত সহস্র বছর রতন এই নৈঃশব্দ নিজের মাঝে আড়াল করে রেখেছে। এ একান্তই তার নিজের সম্পত্তি।
আইভান
১লা সেপ্টেম্বর ২০১৫ইং
প্রথম প্রকাশঃ এখানে
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:১৯