প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকারের পক্ষে কারও বেডরুমে গিয়ে পাহারা দেয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন, সাগর-রুনি তাদের বাসায় বেডরুমে মারা গেছে। আমরা কী মানুষের বেডরুমে বেডরুমে পুলিশ বসাতে পারব? তাতো পারব না। তবে এ হত্যা মামলার যথাযথ তদন্ত চলছে।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকারীদের চিহ্নিত ও গ্রেফতারে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনার মধ্যে গতকাল প্রধানমন্ত্রী একথা বলেন। গণভবনে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন প্রসঙ্গে আরও বলেন, এখন তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নেমেছে এটা ভালো কথা। কিন্তু আফসোস হচ্ছে, যখন মানিক সাহা, হুমায়ুন কবীর বালু ও হারুনসহ ১৫/১৬ সাংবাদিক হত্যা হলো, তখন যদি আমাদের সাংবাদিকরা এভাবে আন্দোলনে নামত, তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটত না। কেন নামেনি জানি না। হয়তো তখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, সাহস পায়নি। আজ আমি ক্ষমতায় আছি, তাদের সাহস আছে।
ওই হত্যাকাণ্ডে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশে সাংবাদিকরা সঠিক ভূমিকা রাখেনি মন্তব্য করে তিনি বলেন, মাত্র ৬ বছরের একটা ছোট্ট শিশু, তাকে জিজ্ঞাসা করা তার বাবা-মা কোথায় খুন হয়েছে, কেমনভাবে খুন হয়েছে, কী দেখেছে ইত্যাদি। আমার মনে হয়, এটাতো সাংবাদিকদের কাজ না, এটা গোয়েন্দাদের কাজ। বার বার ছোট্ট শিশুটিকে জিজ্ঞাসাবাদের কারণে তার মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এর থেকে অমানবিক কাজতো আর হতে পারে না। সাংবাদিকদের অনুরোধ করি, ছোট্ট শিশুটাকে রেহাই দিন।
সাংবাদিকদের বলব, ঘটনার বিষয়ে কোনো তথ্য থাকলে গোয়েন্দাদের কাছে সরবরাহ করে সহযোগিতা করুন।
শেখ হাসিনা নাম উল্লেখ না করে বলেন, একটি ইংরেজি দৈনিক ছোট শিশুটির ইন্টারভিউ ছাপিয়ে সেটাকে তাদের কৃতিত্ব হিসেবে জাহির করেছে। আপনারা এটা কীভাবে পারলেন— যার বাবা-মা মারা গেছে, তার ইন্টারভিউ করতে? আর এতটুকু শিশুর সাক্ষাত্কার নিয়ে রিপোর্ট করার কারণে খুনিরা সচেতন হয়ে নিজেদের আড়াল করার সুযোগ পাচ্ছে। এটা কারোরই কাম্য হতে পারে না।
এ প্রসঙ্গে নিজের সঙ্গে সাক্ষাতের প্রসঙ্গটি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি যখন মেঘকে কাছে ডেকে নিয়েছিলাম তখনও সে অনেকটাই বিপর্যস্ত ছিল। নিজে থেকেই অনেক কথা বলতে শুরু করেছিল। আমি তাকে বলেছি, ওইদিনের ঘটনা বিষয়ে তোমাকে কোনো কথা বলতে হবে না।
হত্যাকাণ্ডের পর সাগর-রুনির বাসায় বেশি লোকসমাগমে আলামত নষ্ট হয়ে গেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ ঘটনা ঘটার পরে যেভাবে ওই বাড়িতে এত মানুষ গেছে তাতে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার লোক সেখানে যাওয়ার আগেই মানুষের পায়ের পাড়ায় আলামত নষ্ট হয়ে গেছে। খুনিদের পায়ের ছাপ, হাতের ছাপ মুছে গেছে। আগামীতে এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা না যাওয়া পর্যন্ত কেউ ভেতরে ঢুকে আলামত নষ্ট করতে না পারে।
গণমাধ্যমের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গণমাধ্যম আজ মুক্ত-স্বাধীন। স্বাধীনভাবে অনেক কথা লিখছে। আবার, অনেক মিথ্যা, অসত্য তথ্য ও মনগড়া সংবাদ পরিবেশন করছে। আমাদের বক্তব্য বিকৃত করে প্রচার করা হচ্ছে, এটা ঠিক নয়।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা এ বিচার শেষ করবই। যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে আন্দোলনের নামে জনগণকে কষ্ট দেবেন না। লাশের ওপর পা দিয়ে ক্ষমতায় যেতে চেষ্টা করলে জনগণ তা মেনে নেবে না।
সংসদে কথা বলতে দেয়া হয় না—বিরোধী দলের এই অভিযোগের জবাবে সংসদ নেত্রী বলেন, নবম জাতীয় সংসদে খালেদা জিয়া সর্বসাকল্যে পাঁচ-ছয় দিন সংসদে এসেছেন। এর মধ্যে চার দিন বক্তৃতা দিয়েছেন। প্রত্যেকটি এক ঘণ্টার কম নয়, তিনি সর্বোচ্চ দেড় ঘণ্টা বক্তব্য দিয়েছেন।
তিনি অভিযোগ করেন, বিএনপি সবসময় ক্ষমতায় যেতে বাঁকা পথ খোঁজে। জনগণের প্রতি আস্থা নেই বলেই অগণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা দখলের চিন্তা করে। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি বলেই জনগণের ভোটের অধিকার সুরক্ষিত করেছি। জনগণ যাকে ইচ্ছে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনবে। আমাদের ভোট দিলে ক্ষমতায় আসবো, নইলে নয়। কিন্তু জনগণই ঠিক করবে তারা কাদের ক্ষমতায় দেখতে চায়। দেশবাসীকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা শান্তি-সমৃদ্ধি চায়, নাকি অতীতের মতো সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, দুর্নীতিবাজদের আবার ক্ষমতায় দেখতে চায়।
সংগঠনকে শক্তিশালী এবং সরকারের অর্জিত সাফল্যগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরার জন্য তৃণমূল নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী এখন বলছেন আগামীতে ক্ষমতায় গেলে প্রতিহিংসার রাজনীতি করবেন না। এ কথার মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে যে, তিনি (খালেদা জিয়া) প্রতিহিংসার রাজনীতি করতেন। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, একদিকে বলেন প্রতিহিংসার রাজনীতি করবো না, অন্যদিকে বলেন সরকারকে ল্যাংড়া-লুলা করে দেবেন—বিরোধীদলীয় নেত্রীর কোন কথাটি ঠিক? আসলে মিথ্যাচার ও মিথ্যা অপপ্রচারে বিরোধীদলীয় নেত্রী চ্যাম্পিয়ন।
দেশবাসীকে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পাঁচ বছরের সঙ্গে বর্তমান সরকারের তিন বছরের শাসনামলের একটু তুলনামূলক বিচারের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় আসলে দেশের জন্য আনে তিরস্কার। আমরা আনি পুরস্কার। তারা সারাবিশ্বে দেশকে জঙ্গিবাদ-দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসের দেশ হিসেবে পরিচিত করেছিল। বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশ আজ সারাবিশ্বে উন্নয়নের মডেল হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে।
২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ ব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। নির্বাচনের আগে আমার ওপর চাপ থাকলেও আমি গ্যাস বিক্রি করতে রাজি হয়নি। তিনি একটি তথ্য ফাঁস করে দিয়ে বলেন, ওই সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ছিলেন বিচারপতি লতিফুর রহমান। তার বাসায় একটি বৈঠক হয়, সেখানে আমি ও দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল এবং বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও তার মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, ওই বৈঠকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার আমাদের কাছে গ্যাস বিক্রির প্রস্তাব দেন। কিন্তু দেশপ্রেমের কারণে আমি তাতে রাজি হয়নি। আমি স্পষ্ট বলেছি, দেশের মানুষের গ্যাসের চাহিদা পূরণ এবং ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য ৫০ বছরের গ্যাস রিজার্ভ রাখার পর যদি উদ্বৃত্ত থাকে তবে তা বিক্রি করা যেতে পারে। দেশের মানুষকে বঞ্চিত করে অন্যদেশে গ্যাস বিক্রির প্রশ্নই ওঠে না। একথা বলে বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসার পরও খালেদা জিয়া আরও দীর্ঘক্ষণ সেখানে ছিলেন। এ কারণে ২০০১ সালের নির্বাচনে কীভাবে ভোট কারচুপি করে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছে তা দেশবাসী দেখেছে। তিনি বলেন, বিএনপি গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় আসলেও আমাদের বিরোধিতার কারণে গ্যাস বিক্রি করতে পারেনি।
প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের অগ্রগতি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বাংলাদেশকে আর সীমাবদ্ধ অবস্থায় রাখতে চাই না। আমরা দেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে সঙ্কটগুলো সমাধান করছি। গঙ্গার ন্যায্য হিস্যা আদায় করেছি। এখন তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি এবং টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও দু’দেশের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। আমরা ভারত সরকারকে জানিয়ে দিয়েছি, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে যৌথ সমীক্ষায় বাংলাদেশের প্রতিনিধি রাখতে হবে। ওই বাঁধ নির্মাণ হলে বাংলাদেশের কোন ক্ষতি হবে কিনা, তা সমীক্ষায় উঠে আসবে। তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী আমাদের বলেছেন, বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হোক তা তারা করবে না।
মতবিনিময় সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সতীশ চন্দ্র রায়, মাহবুব-উল-আলম হানিফ, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রমুখ।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২ সকাল ৮:৩৯