ডিজিটাল সরকারের এনালগ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিদিন যেসব বািচত করছেন, তার আগামাথা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ১৮ ফেব্রুয়ারি সবাইকে অবাক করে তিনি বললেন, রুনি-সারওয়ার মামলার দায়িত্ব স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নিয়েছেন। তিনিই মামলার সবকিছু জানেন। হাসিনাই তদারক করছেন। মামলার তদন্ত চলছে তারই নির্দেশনা অনুযায়ী।
বেশিরভাগ লোকজনই এখন আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথাবার্তাকে কোনো পাত্তা দেন না। তিনি কখন কী বলবেন, তার ঠিক নেই। আবোল-তাবোল বলা নাকি তার পুরানা রাজনৈতিক অভ্যাস।
কিন্তু আগডুম বাগডুম কথাবার্তারও তো একটা সীমা আছে! এতদিন জানতাম, প্রধানমন্ত্রী প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দায়িত্বশীল। তিনি কবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকেরও দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন? আর প্রধানমন্ত্রীই যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাজ করবেন, তখন সাহারা খাতুনের নামকাওয়াস্তে মন্ত্রী থাকার দরকারই বা কী! মহাজোট মন্ত্রিসভার মহামন্ত্রীদের এখন একটা মহারোগে পেয়ে বসেছে! কোনো অঘটন ঘটলেই তারা সব দায়দায়িত্ব শেখ হাসিনার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। রুিন-সারওয়ারকে কারা খুন করেছে, কীভাবে করেছে তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব পুলিশ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। এই হত্যা-তদন্তের দায়িত্ব হাসিনা নিতে যাবেন কেন! এর আগে শেয়ারবাজার নিয়ে মহাকেলেঙ্কারি হলো। সেই কেলেঙ্কারি এখনও চলছে। একটা সময় আমরা দেখলাম, অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আর দায়িত্ব নিলেন না। তিনিও ঘোষণা দিয়েছিলেন, কেলেঙ্কারি নিয়ে, তদন্ত নিয়ে, সব কিছু প্রধানমন্ত্রী জানেন!
পদ্মা সেতু নিয়ে এতো দুর্নীতি-কেলেঙ্কারির অভিযোগ— সবই সৈয়দ আবুলকে ঘিরে। আবুলও সুকৌশলে সব দায়দায়িত্ব শেখ হাসিনার একাউন্টে ট্রান্সফার করে সরে পড়েছেন। প্রধানমন্ত্রীও পড়েছেন আচ্ছা গ্যাঁড়াকলে। ‘পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয় নাই’ বলে একই আর্তনাদ তিনি করে চলেছেন।
প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং যাই বলুন, সাধারণ মানুষ কিন্তু এসব কেলেঙ্কারির জন্য তাকেই দুষতে শুরু করেছে। এ যে দেখছি, যত দোষ, নন্দ ঘোষ। মহাজোট মন্ত্রিসভা প্রাইভেট লিমিটেড করে একদল অযোগ্য, অকর্মণ্য, অথর্ব নারী-পুরুষকে মন্ত্রী করেছিলেন তিনি। এখন সেই লিমিটেড কোম্পানির সুফল কুফল দেখা দিতে শুরু করেছে। দিন যতো যাচ্ছে সরকারের একের পর এক ব্যর্থতার দায়িত্ব সুদিনের মন্ত্রীরা নিতে চাচ্ছেন না। তারা সব দায়িত্ব শেখ হাসিনার ওপর চাপিয়ে সটকে পড়ার তাল করছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তো আরেক কাঠি সরস। তার ভাষায় ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় যে তদন্ত চলছে’ তার বিরুদ্ধেও কথা বলতে শুরু করেছেন তিনি। ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজারবাগে রুনি-সারওয়ার তদন্ত ব্যর্থতা সম্পর্কে বলেন, এ নিয়ে সাংবাদিক সমাজ যে আন্দোলন করছে, ক্ষোভ-বিক্ষোভ জানাচ্ছে তা খুবই যৌক্তিক। তিনি যদি মন্ত্রী না হতেন তবে তিনিও এই ইস্যুতে সাংবাদিকদের সঙ্গে রাস্তায় নামতেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা শুনে হাসবো না কাঁদবো। কে বলছে এই কথা? স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী! ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দিয়ে যিনি ব্যর্থ হয়েছেন। তার জন্য মাফ চেয়েছেন। তারপর ১০ দিন গেল। কোনো খবর নেই। শেষে সুযোগ বুঝে প্রধানমন্ত্রীকে দায়দায়িত্ব ঠেলে দিয়ে একদিনও অপেক্ষা করতে পারলেন না। নিজেই সরব হয়ে উঠলেন প্রধানমন্ত্রীর ‘তদন্ত নির্দেশনা’র ব্যর্থতার বিরুদ্ধে। মন্ত্রী হওয়াই নাকি তার কাল হয়েছে। নইলে তিনিও রাস্তায় মিছিল-মিটিংয়ে নেমে আসতেন। হা হা হা। রবিঠাকুরের লেখায় তাসের দেশ-এর কথা পড়েছি। সত্যজিত রায়ের অনন্য ছায়াছবি হীরক রাজার দেশে-তে অদ্ভুত সেই দেশের রাজা ও মন্ত্রীর নানা কাণ্ডকীর্তি দেখে হেসে লুটিয়ে পড়েছি। মহাজোট জমানার বাংলাদেশও দেখছি সে সবের চেয়ে কিছু কম নয়।
একজন মিডিয়া বিশ্লেষক বলছিলেন, চলতি আমলে টিভি নিউজের রেটিং আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। এর নেপথ্য কারণ, মন্ত্রীদের নানা প্রহসনমূলক কর্মকাণ্ড, কৌতুককর বক্তব্য। মন্ত্রীরা একেকজন বিনোদনের খনি। তাদের চটুল সংলাপ হাসির নাটকের ডায়ালগকেও হার মানাচ্ছে। ওবায়দুল কাদের সব সময় নোয়াখালীর টোনে অদ্ভুত ভাষাভঙ্গিতে কথা বলেন। টেনে টেনে সুর করে। তার কথায় যাত্রাপালার বিবেকের সংলাপেরও রেশ থাকে। ‘বেলা শেষের মন্ত্রী; সূর্য যখন অস্তাচলে’ তার এই বটতলার সাহিত্যও প্রভূত আনন্দের জন্ম দেয়। অর্থমন্ত্রীর ভাবভঙ্গি যেন তিনি হলিউডি ছবির কামলা। কথায় কথায় শিট, রাবিশ, রাস্কেল ইত্যাদি শব্দ বিচিত্র ভঙ্গিমায় উচ্চারণ করছেন। সাহারা খাতুনেরও কথাবার্তার কোনো মাথামুণ্ডু নাই। টিভি মিডিয়ার তিনি মধ্যমণি। টিভি জার্নালিস্টরা জানেন— এরা যাই বলুক, তাই দর্শকদের মাঝে বিনোদনের খোরাক যোগাবে। এ জন্য তাদের দেখলেই সামনে মাইক্রোফোন পেতে ধরেন।
সৈয়দ আবুল হোসেন রসময় কথাবার্তা বলার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। পেটে পেটে যেন কত রস—এমন ভাবভঙ্গি। তার সংলাপও কৌতুকপ্রদ। শাহজাহান খানও কিছু কম না। তিনিও ভিলেন টাইপ কথাবার্তা অতি সরস ভঙ্গিতে বলার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছেন। কামরুল ইসলাম আর মাহবুবুল আলম হানিফ (ইনি মন্ত্রী নন; কিন্তু মন্ত্রীর চেয়েও বড়) সব সময় বোম ব্লাস্টিং কথাবার্তা বলে চলেছেন। একদল কৌতুক করছেন; এরা বোমা ফাটাচ্ছেন—সব মিলিয়ে ভালোই জমেছে মহাজোটের যাত্রাপালা। মতিয়া চৌধুরী, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল জলিল—এই মন্ত্রী-উপদেষ্টারাও সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন কিন্তু পেরে উঠছেন না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সব সময় আছেন লাইমলাইটে। তবে তার রসবোধ ভাঁড়ামোর পর্যায়ে পড়ে না। তিনি সরস ভাষায় কথা বলেন; কিন্তু তাতে তার মোটিভ থাকে খুব পরিষ্কার। সে তুলনায় সাবেক চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আমরা শুধু একজন স্টার-মিনিস্টার পেয়েছিলাম। লুত্ফুজ্জামান বাবর। লুকিং ফর শত্রুজ। সাহারা খাতুনের ‘লুকিং ফর রুনি-সারওয়ারস কিলার’ নাটকের সংলাপ চিত্রনাট্য এবং অনবদ্য পারফরম্যান্স দেখে বাবরের কথা কারও মনে পড়ার সুযোগ নেই।
২.
পদ্মা সেতু ইস্যুটি মহাজোট সরকারের জন্য আখেরে মহাকলঙ্কের কারণ হবে তা দিনকে দিন পরিষ্কার হয়ে উঠছে। পদ্মা সেতু দুর্নীতি, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ-পিপিপি ইত্যাদির মহাচক্করে অনেক কথাই বাজারে চালু আছে। তার মধ্যে কিছু গুজব, কিছু নিশ্চয়ই সত্য।
বিরোধীরা এরই মধ্যে বলতে শুরু করেছে, সরকারের দরবেশ লুটেরা চক্র শেয়ারবাজার থেকে যে লাখ কোটি টাকা লুটে নিয়েছে তাই পিপিপির নামে পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগ করার পাঁয়তারা চলছে। ওই লুটের টাকাই মালয়েশিয়া, দুবাইয়ে ছদ্মনামে দেশের এই অতি লাভজনক সেতু খাতে বিনিয়োগ করে ৪/৫ গুণ বানিয়ে পুনরায় সুইজারল্যান্ড, আমেরিকা, লন্ডনে পাচার করা হবে।
আর এর পেছনে আছেন এই সরকারের প্রভাবশালী মিনিস্টার-মেকার। সেই রাজপুত্র-কন্যাদের ইশারাতেই হচ্ছে সবকিছু। এরাই ছিলেন শেয়ারবাজার লুটের নেপথ্যে। এবার তারা পদ্মা সেতুর মালিকানা চান।
বিরোধী দলের মেঠো কথা বলে কথা! বিরোধীরা অমন বলেই। তেমনটা ভেবে কথাগুলোর সত্যাসত্য নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাননি অনেকে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে জাতীয় ইংরেজি ও বাংলা দৈনিক পত্রিকায় যেসব অনুসন্ধানী রিপোর্ট বেরুচ্ছে তাতে বিরোধী দলের কথাকে মেঠো কথা বলে ফেলনা ভাবা যাচ্ছে না।
বহুল প্রচারিত দৈনিক প্রথম আলো ও দৈনিক কালের কণ্ঠের রিপোর্টে আমরা চাঞ্চল্যকর সব তথ্য পাচ্ছি।
‘পদ্মা সেতু প্রকল্পে মালয়েশিয়ার প্রস্তাব : বিনিয়োগের পাঁচ গুণ অর্থ তুলে নেবে ৩৪ বছরে!’ রিপোর্টে প্রথম আলো বলছে—
পদ্মা সেতু প্রকল্পে ২৩০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে ৩৪ বছরে এক হাজার ১৯৯ কোটি ডলার উঠিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছে মালয়েশিয়া, যা তাদের বিনিয়োগ করা অর্থের পাঁচগুণের বেশি।
মালয়েশিয়া সেতুটি ৫০ বছর তাদের মালিকানায় দেয়ার প্রস্তাব করেছে। প্রস্তাবিত পদ্মা সেতুর আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছে ১০০ বছর। মালয়েশিয়া বাংলাদেশ সরকারের কাছে গত সপ্তাহে পদ্মা সেতু নিয়ে সমঝোতা স্মারকের একটি খসড়া প্রস্তাব পাঠিয়েছে। সেখানে এসব কথা বলা হয়েছে।
সেতু বিভাগ জানাচ্ছে, মালয়েশিয়া ছাড়াও চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন কোম্পানি পিপিপিতে পদ্মা সেতু নির্মাণে অনানুষ্ঠানিকভাবে আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু কাজটি দেয়ার যত তোড়জোড় তা শুধু মালয়েশিয়াকে ঘিরেই। রুনি-সাগর হত্যারহস্যের মতো এখানেও মজাদার রহস্যের ঘনঘটা। প্রথম আলো আরও বলছে—
মালয়েশিয়া বাংলাদেশ সরকারের কাছে যে প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে ২০১৬ থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত টোল বাবদ কী পরিমাণ আয় হবে, সেটা দেখানো হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সেতুতে বর্তমানে যে হারে টোল আদায় করা হচ্ছে, সে হারে পদ্মা সেতুর টোল আদায় করা হলে এই খাতে আয় হবে ৫৮০ কোটি মার্কিন ডলার। টোল দ্বিগুণ করা হলে আয় হবে ৯৮৬ কোটি ডলার। এর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু সেতুতে যে টোল আদায় হয়, তার ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি যোগ করলে ২০৫০ সালের মধ্যে এক হাজার ১৯৯ কোটি মার্কিন ডলার উঠিয়ে নেয়ার সুযোগ আছে।
সেতু বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, টোল কম ধরা হলে পদ্মা সেতুতে মালয়েশিয়ার মালিকানার সময়সীমা বাড়বে, টোল বাড়ালে কমে আসবে।
মালয়েশিয়া তাদের প্রস্তাবে বিনিয়োগ করা অর্থ তিন শতাংশ সুদে সংগ্রহ করার কথা বলেছে। তারা বলেছে, এই সুদের হার অনুযায়ী নির্মাণ, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ২০৫০ সাল পর্যন্ত ব্যয় হবে ৫৫০ কোটি মার্কিন ডলার।
এর আগে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপানি সংস্থা জাইকা ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সঙ্গে ২৩৫ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি হয়। দুর্নীতির অভিযোগে ঋণের কার্যক্রম স্থগিত রেখেছে দাতারা। মালয়েশিয়ার প্রস্তাব পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সঙ্গে ঋণচুক্তি বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু করেছে সেতু বিভাগ। ঋণ বাতিলের একটি সারসংক্ষেপ সেতু বিভাগ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিশ্বব্যাংকের দেয়া ঋণের সার্ভিস চার্জ বা সেবা ব্যয়ের হার দশমিক ৭৫ শতাংশ। জাইকার সুদের হার দশমিক ০১ শতাংশ, এডিবির দেড় শতাংশ এবং আইডিবির প্রায় তিন শতাংশ। অন্যদিকে মালয়েশিয়া ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বা বন্ড ছেড়ে অর্থ জোগাড় করবে বলে প্রস্তাবে উল্লেখ করেছে। তাদের ঋণের সুদের হার বেশি হবে। তারপরও রহস্যজনক কারণে পদ্মা সেতু দিতে হবে মালয়েশিয়ার গোপন মালিক গোষ্ঠীকেই। এ যেন একটা বাধ্যতামূলক কর্মসূচি। দেশের অর্থনীতি লাটে উঠুক, তবুও পরোয়া নেই।
বঙ্গবন্ধু সেতুর দৈর্ঘ্য প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। অন্যদিকে পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু সেতুতে বর্তমানে দৈনিক টোল আদায় হয় ৮০ থেকে ৯০ লাখ টাকা। এখানেই শেষ নয়। পদ্মা সেতুর ব্যাপারে কঠিন ৭টি শর্ত দিয়েছে মালয়েশিয়া। শর্ত তো নয়। দীর্ঘস্থায়ী বন্দোবস্তের ৭ অর্ডিন্যান্স।
মালয়েশিয়ার বিশেষ মালিক গোষ্ঠীর ৭ শর্ত হলো, নির্মাণ, পরিচালনা, মালিকানা ও হস্তান্তর পদ্ধতিতে (বিওওটি) ৫০ বছরের মালিকানা দেয়া, পদ্মা সেতুতে যে পরিমাণ যান চলাচলের অনুমান করা হয়েছে তা নিশ্চিত করা, যান চলাচল কমে গেলে এর জন্য ভর্তুকি দেয়া, টোল থেকে আয় করা অর্থের কর ও আমদানি করা যন্ত্রপাতি-মালামালের শুল্ক মওকুফ, বিনিয়োগকারীদের অর্থ তুলে নেয়া বাধাগ্রস্ত করতে পারে এমন করারোপ না করা, পদ্মার প্রতিযোগী কোনো সেতু করতে না দেয়া বা টোল বাধাগ্রস্ত হয় এমন কোনো ব্যবস্থা না রাখা এবং মানবাধিকার ও পরিবেশ-সংক্রান্ত সব প্রতিবন্ধকতা আগে থেকেই দূর করা।
সেতু বিভাগের কর্মকর্তারাই খোদ বলছেন, এসব শর্ত মেনে নিলে সরকার অনেক বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবে। আগামী তিন বছরের মধ্যে মালয়েশিয়া পদ্মা সেতু নির্মাণ করলে ২০১৬ সাল থেকে টোল আদায় শুরু হবে।
জানা গেছে, পদ্মা সেতুর নকশা প্রণেতাদের প্রাক্কলন হচ্ছে, ২০১৬ সালে এই সেতু দিয়ে ১১ হাজার ৩৬৯টি যান চলাচল করবে। এখন থেকে ২৫ বছর পর অর্থাত্ ২০৩৯ সালে চলবে ৫৬ হাজার যানবাহন। মালয়েশিয়ার শর্ত মানলে যান চলাচলের এই ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক থাকতে হবে। নতুবা সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। এছাড়া পদ্মা সেতু হলে ফেরি পারাপারও বন্ধ রাখতে হবে।
‘দুবাই থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছে মালয়েশিয়া’ শীর্ষক আরেক রিপোর্টে জানা যায়, ‘পদ্মা সেতু প্রকল্পটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দুবাই থেকে একজন অর্থায়নকারী আনতে যাচ্ছে। দুই পক্ষের মধ্যে এখন সমঝোতা চলছে। আর মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের এই অর্থায়নকারীর পরিচয় ও তাদের অর্থগ্রহণ সম্পর্কে কোনো আপত্তি নেই।’
পদ্মা সেতুর নয়া উদ্যোক্তা গোষ্ঠীর দূতের এই উদ্ধৃতিসহ একটি সংবাদ সম্প্রতি মালয়েশিয়ার সরকারি সংবাদ সংস্থা বারনেমা প্রচার করেছে। দ্য মালয়েশিয়ান ইনসাইডার পত্রিকায় এটি প্রকাশিত হয়েছে।
ওই পত্রিকায় প্রতিবেদনটির ওপর ২১টি মন্তব্য করেছেন পাঠকেরা। পাঠকেরা বলছেন, প্রথম ও দ্বিতীয় পেনাং সেতু নির্মাণের কৃতিত্ব কোরিয়ার হুন্দাই কোম্পানি ও চায়না হারবার কনস্ট্রাকশন কোম্পানির। এতে মালয়েশিয়া সরকারের খুব একটা কৃতিত্ব নেই।
কেন্নাথ নামের একজন পাঠক বলছেন, ‘কবে থেকে আমরা সেতু নির্মাণে সফল? দ্বিতীয় পেনাং সেতু নির্মাণ করেছে চায়না হারবার!’ আরেক পাঠকের মন্তব্য, ‘প্রথম সেতুটি কোরিয়রা আর দ্বিতীয় সেতুটি চীনারা নির্মাণ করেছে। বাংলাদেশকে কোন সেতুটি আকৃষ্ট করেছে?’
আহমেদ আলী তার মন্তব্যে বলেছেন, ‘মালয়েশিয়া এখন পর্যন্ত কোনো মসৃণ সড়ক নির্মাণ করতে পারেনি। এখন মালয়েশিয়া সেতু বানাবে?’
রুত্রা নামের একজন পাঠক বলেছেন, ‘এটি অর্থপ্রবাহের আরেকটি উপায়। কোম্পানিগুলোকে দুর্বৃত্তায়নের অর্থ পাচারের সুযোগ দেয়া হচ্ছে।
আইরাতা নামে এক পাঠক বলছেন, মালয়েশীয়দের তৈরি স্টেডিয়াম ভেঙে পড়েছে। ছোট নদীতেও তৈরি সেতু ভেঙে পড়ে বিপুল শিক্ষার্থী মারা যায়। এবার বাংলাদেশের কী যে হবে!
৩.
কালের কণ্ঠের রিপোর্টে জানা যায়, অনুমোদনের পর থেকে এ পর্যন্ত পদ্মা সেতুতে মোট এক হাজার ৯৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় হয়েছে ৮৭৩ কোটি ১৯ লাখ ৬১ হাজার টাকা। বাকি ১২৭ কোটি ৭৫ লাখ ২২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে প্রকল্প সাহায্য (আরপিএ) থেকে।
ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৫২৭ কোটি ৪০ লাখ ১৩ হাজার টাকা। পুনর্বাসন খাতে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩৭৪ কোটি ৮১ লাখ আট হাজার টাকা। নদী শাসন বাবদ মোট ব্যয় হয়েছে ৭৫ কোটি ৭৫ লাখ ৪৯ হাজার টাকা।
পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে ইতিমধ্যে ২০টি গাড়ি কেনা হয়েছে। এতে মোট ব্যয় হয়েছে ৯ কোটি ৭৭ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। এছাড়া অন্যান্য খরচ বাবদ এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে আট কোটি ১৮ লাখ ৮৭ হাজার টাকা।
৪.
প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ কোনো অবস্থাতেই বিরোধী দলবান্ধব পত্রিকা নয়। দ্য মালয়েশিয়ান ইনসাইডার পত্রিকাটি আওয়ামী লীগ, বিএনপির নাম জানে কি না সন্দেহ। দেশি-বিদেশি মিডিয়ার এসব অনুসন্ধানী রিপোর্ট তো দেখছি বিরোধী দলের মাঠের কথাকেই প্রমাণ করছে।
যে মালয়েশিয়া নিজের দেশেই নিজ উদ্যোগে একটা সেতু বানাতে পারে না; তাদের সেতু বানিয়ে দেয় চীনা, কোরিয়ানসহ বিদেশি কোম্পানি, যাদের সেতু বানানোর পর ভেঙে পড়ে, তাতে ছাত্র মারা যায়; এত প্রবল উত্সাহ নিয়ে তাদের সঙ্গে আমরা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ করতে যাচ্ছি কেন? এই দোস্তালির রহস্য বোঝা অসাধ্য নয়।
যেখানে বিশ্বব্যাংক, জাইকা, আইএমএফের কাছে আমরা সরকারি অংশীদারিত্বে টাকা পেতে পারি নামমাত্র সুদে, সেখানে ডলার সংগ্রহের জন্য আমরা মালয়েশিয়াকে দালাল নিচ্ছি কেন! সে দালাল নাকি আবার টাকা আনবে দুবাই থেকে? তা আবার অনেক বেশি সুদে।
পদ্মা দুর্নীতি তো এতদিন আবুল কেলেঙ্কারিতে সীমাবদ্ধ ছিল—এখন দেখা যাচ্ছে বহুজাতিক কেলেঙ্কারির জন্ম দিতে চলেছে। নির্লজ্জ—বেশরমরা যতই ‘আমি কলা খাই না বলুক না কেন, আবুলের দুর্নীতির ব্যাপারটি দেশবাসী কবুল করে নিয়েছে। আবুলকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে বিষয়টি মিটিয়ে নিলে এদ্দিনে সেতুর পিলার খাড়া হয়ে যেত।
কিন্তু এখানে মস্ত নদী ডাকাতির ব্যাপার আছে। মালয়েশিয়া এখানে নিতান্ত দুর্নীতির টাকা ক্যারিয়ার দালাল মাত্র। পেছনে অন্যরা খেলছে।
৭ খানা শর্ত খেয়াল করুন। এ-তো বাংলাদেশকে রীতিমত বিক্রি করার জোগাড়। দালাল মালয়েশিয়ার সঙ্গে দোস্তালি রক্ষার জন্য পদ্মা সেতুর ধারে-কাছে কোন সেতু নির্মাণ করা যাবে না। করারোপ করা যাবে না। গাড়ি-ঘোড়া যদি কম চলে, তবে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে! পদ্মা সেতুর মহান মালিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য ফেরি পারাপারও বন্ধ রাখতে হবে। ব্যবসাতে লাভক্ষতি আছে। কিন্তু ৪/৫ গুণ লাভ নিশ্চিত করার জন্য মোটামুটি বরিশাল-খুলনা-ফরিদপুর এলাকার অবকাঠামো উন্নয়ন বন্ধক রাখতে হবে। কে এই মহান নেপথ্য মালিক যাদের জন্য এতো আয়োজন? মালয়েশিয়ার মোড়কে বাংলাদেশ সরকারের কুটুম্বরা মালিক না হলে এতো স্বার্থরক্ষার প্রশ্ন আসত না। কেননা, আমরা সবাই জানি, দেশের চেয়ে দল বড়। দলের চেয়ে নেতানেত্রীদের আত্মীয়-স্বজন বড়। তারাই বড় কুটুম্ব। অবস্থা দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক— সরকারেরই কেউ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের কাছ থেকে ৫০ বছরের জন্য পদ্মা সেতু কিনে নিচ্ছে।
অর্থনীতির অধ্যাপক এক বন্ধু অবশ্য বলছিলেন, শেয়ারবাজারের লুট করা টাকা দেশে ফেরত এনে পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগ—নিছকই রাজনৈতিক অপপ্রচার। তার যুক্তি—ওই টাকা এরই মধ্যে লুটেরা গোষ্ঠী ডলারে রূপান্তর করে বিদেশে নিরাপদ স্থানে জমা করে ফেলেছে। তা আবার দেশে এনে টাকায় রূপান্তর করে তারা ঝুঁকি নিতে যাবে কেন!
বন্ধুর জ্ঞাতার্থে জানাই, সেই ঝুঁকিও থাকছে না। ৫০ বছরের মালিকানায় মালয়েশিয়ায় গোপন মালিক গোষ্ঠীকে ৪/৫ গুণ লাভ শোধ করতে হবে ডলারে। যদিও সেতুর টোল আদায় হবে স্থানীয় মুদ্রা টাকায়।
অর্থাত্ এটা পরিষ্কার—আটঘাট বেঁধেই আরেকটা কেলেঙ্কারি গেম খেলতে যাচ্ছে গোপন মালিকগোষ্ঠী। তারা কাঁচা খেলোয়াড় নয়। বিদেশে অবস্থানরত এই মহাশক্তিধর মালিকের কাছে শুধু টোলের টাকা তুলে দিলে হবে না; টোলের টাকা নিয়ে মতিঝিল গিয়ে নগদ দামে ডলার কিনে তাদের কাছে সরকারি উদ্যোগে পাচার করতে হবে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, পদ্মা সেতুর ৫০ বছরের মালিকানা পিপিপির নামে সরকারের কোনো গোষ্ঠী বা বড় কুটুম্বের হাতেই তুলে দেয়া হচ্ছে। সাত শর্ত সেই কুটুম্বের স্বার্থরক্ষার জন্যই প্রণীত। তার জন্যই দেশের টাকা দেশে না রেখে ডলার বানিয়ে বিদেশে পাঠাতে হবে।
কীর্তিধন্য রাজনীতিবিদদের দেশসেবার সম্মাননা স্বীকৃতি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, বিমানবন্দর, সেতুর নাম তাদের স্মৃতির উদ্দেশে উত্সর্গ করাই রেওয়াজ। কিন্তু তাদের উত্তরাধিকাররা এতে খুশি নন। তারা কেবল সেতুর নাম চান না, তারা চান সেতুর মালিকানাও।
লেখক : কপি সম্পাদক, দৈনিক আমার দেশ, ব্লগার
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২ সকাল ১০:৩৫