আর এই গল্প তথা চলচ্চিত্রটির কেন্দ্রবিন্দু হলো একটি মেয়ে-নীতা। উদয়াস্ত পরিশ্রম করে সে সংসার চালায়, প্রথম লগ্নে তার পিতা তার সহযোগী হিসেবে আবের্ভূত হলেও ছবিটির মধ্যভাগে এসে সংসারের বোঝা নীতার উপর বর্তায়। তার এমন আত্মত্যাগ আর নিষ্ঠা একসময় আত্মহূতিতে পরিবর্তিত হয়- যখন সে দেখে তার প্রেমিক, যাকে সে ভেবেছিলো তার তওে আজীবণ অপেক্ষায় সদা প্রস্তুত এক সত্ত্বা হিসেবে সেই সনৎ যখন গীতা(নীতার ছোট বোন) কে বিবাহ করে। নির্মাতা চাইলে সনৎ কে অন্য কোন নারীর বাহুলগ্ন করতে পারতেন কিন্তু এমন এক মর্মান্তিক ট্রাজিডির রূপায়নে যথেষ্ট হতো না । ট্রাজেডি আরও ভয়াবহতা পায় আর নীতার জীবণ অর্থহীন বুদবুদে পরিণত হয় যখন নীতা বুঝতে পারে এর পেছনে রয়েছে তার মার ইন্ধন- আসলেই এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার দৃশ্যগত রূপায়ন।
ছবির শুরুতে নীতা ছিল কর্মে, উৎসাহে,যৌবনে ভরপুর এক ভাঙ্গালী রমনী আর তার এই বৈশিষ্ট্যকে রূপায়ন করতে গিয়ে নির্মাতা ক্যামেরা বন্দী করেচেন বিশাল বৃক্ষেও আলোক ছায়া, নদী স্নিগ্ধ জল, কোমল সূর্যালোক; তবে এই সবকিছু ভেঙ্গে চুরে ট্রেন এক কর্কশ ধ্বনি করে অজানায় পারি জমায়, যেমনটি ছবিটির শেষভাগে নীতার ঘটেছে। প্রকৃতির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে গলইটর রূপায়ন আমাকে মুগ্ধ করেছে।
আপাত দৃষ্টিতে মেঘে ঢাকা তারাকে ত্রিভুজ প্রেমের এক নির্মম পরিণতি মনে হলেও এখানে নির্মাতা দেশবিভাগজনিত ছিন্নমূল পরিবারের টানাপোড়ন প্রতিভাসিত করেছেন। ঋত্বিক ঘটক কোন রাখঢাক না রেখেই পুরো চলচ্চিত্রে এটা বলতে চেয়েছেন এই পরিবারটি আসলে আর কিছুই নয় বরং আমাদেও বাংলা তার শরীর ভাঙ্গনের ছাপ, কন্ঠে ভাঙ্গনের সুর, হাতে ভাঙ্গনের পরিণতি দারিদ্র,চোখে ভাঙ্গনের কারণে সৃস্ট পারষ্পরিক অবিশ্বাস, দৃষ্টিতে ভাঙ্গনের কারণে সৃষ্ট স্বপ্নহীনতা, আর আছে কেবল অস্তিত্ব রক্ষার দিবারাত্রির সংগ্রাম- এসবই বঙ্গ-ভঙ্গেও অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। আর এই সবকিছুর রূপায়নে মেটাফোর হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে নীতার পরিবারটি।
নীতার অবক্ষয়ের ট্রেজেডিকে দেশ বিভাগের ট্রেজেডির সাথে একীভুত করেছেন ঘটক।এক ষড়যন্ত্রেও জাল দেশ বিভাগের মতো নীতাকেও টুকরো টুকরো করেছে আর ষড়যন্ত্রে রচয়িতা আপন জন কেবল সামান্য সুবিধা প্রাপ্তির আশায় !!!
পরাজিত আর বিধ্বস্ত হবার চিত্রটি আরও গভীরভাবে ফুটে ওঠে এই গানে-
যে রাতে মোর দুয়ার ভাঙলো ঝড়ে
জানি না তো তুমি এলে আমার ঘরে
গব যে হয়ে গেল কালো
ডনভে গেল দ্বীপের আলো
আকাশ পানে হাত বাড়ালাম কাহার তরে।
আর এই গানটি দর্শকের অন্তরকে ফালি ফলি করতে যথেষ্ট বলে আমার মনে হয়েছে। আর গানটি স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাওয়া নীতার বিলাপ ধ্বনিতে পরিণত হয়।নির্মম এক কালান্তক বাসা বাধে তার শরীরে-তা হলো মৃত্যুর খোলা দরজা। দস্ত নীতা মুক্তি পেতে চায় এই নির্মম যাতনা থেকে। আঝোর বৃষ্টি রাতে সে বেরিয়ে পড়ে মহাকালের গর্ভে আশ্রয় নেবে বলে। কিন্তু বিগলিত এক কুরণা ধারা তাকে মুক্তি পেতে দেয় নি। সে হলো তার দাদা – যার গায়ক হয়ে ওঠা যে নীতার অক্লান্ত পরিশ্রম আর আত্মত্যাগের ফলাফল সেই দাদার করুণা/ভালবাসা তাকে আকড়ে ধরে। সয়ংসম্পূর্ণা নীতা তথা বাংলা আজ সকলের করুণা প্রার্থী, কী অসাধারণ মেটাফোরিক রূপায়ন !!!!!!
কিন্তু জীবন মৃত্যুও সন্ধিক্ষণে দুরন্ত সেই নীতা আবার বাচতে চায় - দাদা আমি তো বাচঁতে চেয়েছিলঅম--------- আর এই দৃশ্যটির রূপায়নে নির্মাতার আবার আসাধারণ ক্যামেরার কাজ, ক্যামেরা উন্মাদেও মতো ঝাপিয়ে পড়ে প্রকৃতিতে পাহাড়ে , সবুজের মাঝে- নীতা তো এসব ধরে বাচঁতে চায়। আর এসব কিছু বর্তমার রেখে বাংলা ও বাচতে চেয়েছিলো।।
তবে চলচ্চিত্রটি শেষ পর্যন্ত কেবল আত্মত্যাগ বা বিশ্বাস বিচ্যুতির গল্প হয় নি বরং অনবরত এক আশাভঙ্গের গল্পে রূপ নিয়েছে আর এই আশা ভঙ্গে ঘল্প যে কেবল কলকাতার রিফিউজি কলোনির কথকতা তা নয় বরং সমগ্র বাংলার । ।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মার্চ, ২০১৩ সকাল ১১:২৭