আমার সৌভাগ্য যে আমার ছোটবেলার স্মৃতিতে একটা পুকুর আছে। বর্গাকৃতির সুন্দর একটি পুকুর । ঐ পুকুরটার চারপাশে ছিলো আবার কাজী পেয়ারার গাছ । বলা যায়,পুকুর বেষ্টিত সুমিষ্ট পেয়ারার বাগান । পুকুরে মাছের পোনা ছাড়া হলো । তখন পেয়ারার ডালে ছোট্ট মাছরাঙাকে বসে থাকতে দেখতাম । সেই প্রথম আমার মাছরাঙা দেখা । লম্বা ঠোঁটের সুন্দর কারুকার্যময় মাছরাঙা!
খুব ভোরে কিংবা নির্জন দুপুরে আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি মেলে ধরতাম - পুকুর ছাড়িয়ে বড় পেয়ারা গাছটার ডালে । মাছরাঙা’টা এক লাফে পুকুরের পানি ছুঁয়ে ফিরে যেত ডালে। ভোরে মাছগুলোর খাবি খাওয়া...ছিলো আর একটি দেখার মত দৃশ্য । সবুজ পানিতে ভেসে উঠা অসংখ্য মাছের হা করা মুখ!
ভয়ের বিষয়ও ছিলো । পুকুর আর বাগান ছাড়িয়ে পাঁচতলা বিল্ডিং । তারই গেট থেকে ছোট্ট সাদা কুকুরটির তড়িৎ ছুটে আসা ।
একবার এক শুনশান দুপুড় । জাভেদ দেয়াল গলে ধপ করে নামলো পুকুর পারে। আমি দেয়ালের উপর বসা । তখনো নামিনি । নামবো নামবো করছি। তারপর, সে এক দৃশ্য! মুহূর্তেই কোথা থেকে যেন সেই সাদা অ্যালসেশিয়ানটি এসে হাজির! জাভেদের তখন আর দেয়ালে উঠার সময় নেই । তখন, একহাতে লুঙ্গি ধরে;পুকুরের চারপাশ দিয়ে, জাভেদের সে কি ভোঁ দৌড় আর চিৎকার । হা হা হা ।
তখন বর্ষা আসতো ভিন্ন ঢংয়ে । স্কুলের পাশেই কোথাও একটা কদম ফুলের গাছ ছিলো । হঠাৎ করে স্কুলের গেট ভরে যেত কদম ফুলে। সবার হাতে থাকত ছোট্ট ছোট্ট রেণুর একটা করে কদম ফুল । যাদের হাতে নেই তাদের একটা কদম ফুল পাবার কত আকুতি! কদম ফুল এভাবেই জানান দিতো বর্ষা মঙ্গলের ।
ছোটবেলায় বাসার সবাই দলবেঁধে বেড়াতে যেতাম । সিলেটে । আঁকাবাঁকা সর্পিল একটা ট্রেন । ছুটে চলেছে.... কু... ঝিক্ ঝিক্, ঝিক্ ঝিক্ । কুয়াশা ঘেরা পাহাড় । চা বাগান। ট্রেনের জানালার একপাশে দাবায় মগ্ন দুই কিশোর কিশোরী; আর আরেক পাশে চলন্ত জীবনের প্রতিচ্ছবি।
বিকেলে নেমেই সবাই পাহাড় আর চা বাগান দেখতে বের হতাম । সাথে থাকতো ছোট মামা। প্রকৃতির সান্নিধ্যে প্রাণচঞ্চল একদল বালক বালিকা । পাহাড়ি রাস্তায় পাহাড়ি ফুল কুড়ানো । চোরা কাটার হাত থেকে বাঁচার জন্য এঁকে বেঁকে চলা । কখনও বা পাহাড়ের খাদে ছায়া বৃক্ষের ডালে জড়িয়ে থাকা ঘুড়ির জন্য বায়না ধরা । সন্ধ্যার আগেই চা বাগানের গায়ে গায়ে ছবি তোলা । রাত বাড়লে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দও বাড়তে থাকে । তখন জড়ো সড়ো হয়ে গল্প শোনার আসর জমে । নানা রকম গল্প। বাঁদর, শেয়াল, বাঘ আর ভূত -পেত্নীর । খুব ভোরে, পায় শিশির ছোঁয়ানো আর বেলী ফুলের ঝাড় বা গোলাপ থেকে ঝরে পড়া ফুল তোলা । এইরকম আরো কত কি আজও স্বর্ণালী স্মৃতি হয়ে আছে!
সেই পোনা পুকুরটি আজ নেই । নেই পেয়ারা আর পেঁপে বাগানও । আর একটা কদম গাছ খুঁজে বের করার সাধ্য এখন আর আমার নেই । কংক্রীটের নগরীতে চাঁদই হরহামেশা দেখা যায় না আর কদম গাছ! জাভেদ? প্রায় ১২/১৫ বছর হলো, তার কোন খবর নেই।
আজ আর দলবেঁধে সিলেট যাওয়া হয় না। গেলেও সাথে থাকেনা কোন দাবার বোর্ড । কারও হাতে সময় থাকে না, পাহাড়, চা-বাগান ঘুরিয়ে দেখার। থাকে না সময় ছায়াবৃক্ষের ডাল থেকে ঘুড়ি পেরে দেবার ।
আর থাকলেই বা কি ? সুর যে কেটে গেছে...স্বপ্নও হারিয়ে গেছে... ।
মনের রাজ্যে যে নির্ঝর অরণ্য, যে প্রকৃতি প্রেমীর বাস... সেও আজ অবসরে কোন এক বিপন্ন অভিমানে।।
***কি আর হবে অতীত স্মৃতি রোমান্থনে!!! তার চেয়ে আসুন একটা প্রিয় গান শুনি । দুঃখ গান ।
“বসুন্ধরার বুকে বরষারি ধারা...তারাভরা হাহাকার...” ।
এস্নিপস থেকে শুনতে হলে