ধান্মন্ডী বাসার তিন তলাতে ছিল আমাদের গেস্ট্রুম। বেশ বড় খোলামেলা, দুটো স্প্রিঙ্গওয়ালা, খাট বেশ বড় সেক্রেটারি টেবিল, খান দুএক চেয়ার। সে রুমের মোটামুটি পার্মানেন্ট একজন গেস্ট আমার এক সৎ মামা, আর প্রায় সময়ই আসতেন আমদের এক কাকা, বাবার মামাত ভাই। তা দুই বিয়ান ওই ঘরেই ঘুমাতেন, আর দিনমান ঘর ফাঁকা পরে থাকত। কোন এক মিষ্টি ভোরে আমি হানা দেই ওই ঘরে সঙ্গে কেউ একজন ছিল ঠিক মনে নেই, ঘর ফাঁকা, কেউ নেই, কি এক দুষ্টু বুদ্ধি এল মাথায়, টেবিলে উঠে, কোমরের বেল্ট খুলে বাঁধলাম ফ্যানের পাখায়, ভাবলাম এবার সুইচ অন করলে বুঝি বেশ বন বন করে ঘুরবো, যেই চিন্তা সেই কাজ, বেশ কষে বেল্টটা বেঁধে সাথে যে ছিল তাকে বললাম সুইচ টিপতে কিন্তু বিঁধি বাম টেবিল ছাড়িয়ে পা শুন্যে আসতেই পপাৎ ধরণীতল, কপাল গুনে হাড়হাড্ডি কিছু ভাঙ্গেনি
সে রুমের আরেক ভয়াবহ স্মৃতি আছে, যে কাকার কথা বললাম উনি বাবার মামাত ভাই,বাবার নানা এলাহি নেওয়াজ খান ছিলেন নেত্রকোনার বিখ্যাত উকিল, একনামে সবাই চেনে সম্ভবত বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার প্রথম মুস্লিম গ্র্যাজুয়েট উকিল। সেই মন্টু কাকাকে একবার কি নাজেহাল হতে হয়ে ছিল ভাব্লে এখনো লজ্জা পাই, তবে ভাগ্য ভালো শার্মীনের (আমার ইমিডিয়েট বড় বোন) সাথে কাকার শেষ দেখায় সে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলো, আমি যেহেতু ওর চ্যালা হয়ে অপারেশন এ ছিলাম আমি অটো ক্ষমা পেয়েগেছি নিশ্চিত, না হলে এই ফাঁকে ক্ষমা চেয়ে নিলাম। একদিন আমি আর শার্মীন সকাল সকাল গেস্ট রুমে গেলাম কিছু একটা খুঁজতে কেউ নেই ঘরে, হঠাত শুনি লাগোয়া বাথ্রুমে পানি পরার শব্দ, মুহূর্তে দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল, দিলাম আমরা বাইরে থেকে ছিটকিনি আটকে, প্ল্যানিং ছিল কিছুক্ষণ আটকে রাখার কিন্তু এর মাঝে নিচ থেকে ডাক আসায় আমরা চলে এলাম আর বেমালুম ভুলে গেলাম আর এদিকে কাকা, “ছুটির ঘনটা”। কাকার ট্রেইন মিস। পরে উদ্ধার পেয়ে তার সে কি রাগ দোষ পরল তার বেয়ানের উপর আমরা বেমালুম চেপে গেলাম সব।
বেচারা আমার সৎ মামা! আমার বিমাতা ভয়ঙ্করীর ভাইদের মাঝে একমাত্র ভালো মানুষ এবং ফানি! একদিন এসে আমাদের বলছে তোমরা “মামা বাবা বাবা মামা” গানটা শুনছো? আমরা তো কিছুই বুঝি না ও বাবা এ কেমন গান। অবশেষে উদ্ধার হল এটা বনিঅ্যামের “বাহামা মামা” যাক বাবা উদ্ধার হল। সেই মিড এইটিস, বনিঅ্যাম, অ্যাবার বিশাল ক্রেইজ, যেখানেই যাই সেখানেই তাদের সিগনেচার টিউনগুলি কানে বাজে, বি জিস, অলিভিয়া নিউটন জন, আর পরে লরা ব্রানিগান সুপার হিট সব গান, এখনকার মত শুধু হিন্দি গান হিট করে তা না, ইংরেজি গান ও আম জনতার কাতারে ছিল। হিন্দি গান তখনো ছিল, সেই সময় হিট ছিল “আপ জেইসা কয়ি” কিংবা কুরবানি কুরবানি এইসব আর স্ম্যাশ হিট ছিল “ম্যারে আনাগানেমে”, বড়দের ভাষায় এ গান টা খুবি অশ্লীল ছিল, ভাবলে অবাক লাগে আজ কালকার লিরিক্সের তুলনায় এ নেহাতি দুগ্ধ পোস্য। গানের কথা উঠলেই আমার বাবার কথা মনে পরে যায়। চোখের সামনে ভেসে উঠে অন্য ছবি।
খুব সক্কালবেলা ঘুম ঘুম চোখ মেলে দেখতাম, বাবা উঠে গেছেন, জানালার ফাঁকফোকর দিয়ে আলোর রেখাগুলি ঘরে ঢুকছে, লাইনগুলিতে অজস্র ধুলি, কি সুক্ষ বালিকণাগুলি উড়ছে, ভাবতাম বুঝি শুধু আমিই এসব দেখতে পাই, অপলক নয়নে দেখতাম, এরি মাঝে হিল্ম্যান রেডিও তে বাবা চালু করে দিতেন বিনাকা গীতমালা, আমিন সায়ানির সুমধুর কন্ঠ, যাকে অনুকরণ করেই আমাদের প্রথম হিট আরজে নাজমুল হুসাইন তার “হাঁ ভাই” সিগনেচার আইটেম দিয়ে বাংলাদেসের মানুষের প্রিয় হয়ে আছেন। বিনাকা গীতমালা যেন প্রতিটি ভোরের সঙ্গী, কি সব গান, আর অবধারিত ভাবে শেষ হত কে এল সায়গলের গান দিয়ে, বাবাও গাইতেন গুন গুন করে, শেষ গানটা তখন মোটেও ভালো লাগতো না, এখন সেই সায়গলের গানে খুজে ফিরি সেই মায়াময় দিনগুলি। আমার প্রথম যে গানটি প্রিয় হয়েছিল সেটি “ তান ডোলে মেরে মান ডোলে” হেমন্ত কুমারএর হিট কম্পোজিশন, আর বাংলার মাঝে “ও বাক বাক বাকুম বাকুম পায়রা” সেটি ছিল অনুরোধের আসরের গান, খুব সম্ভব ছবিটিও এ দেশে মুক্তি পেয়েছিল। সেই থেকেই দুই সন্ধ্যাই আমার প্রিয়। বাবা অস্মভব গান পাগল ছিলেন, মায়ের গানের খাতায় বাবার হাতে লিখা অনেক গানের কথা লিখা আছে। আমার কাকার কাছে শুনেছি ঢাকা মেডিকেলে পড়বার সময় বেহালারো নাকি তালিম নিয়ে ছিলেন। ঝিম ধরা কোন কোন দুপুরে বাবা বাসায় থাকলে বাবার চুল টানতে টানতে কত কিছু শুনতে হত, কখন রবি শঙ্কর, কখন বাড়ে গোলআম আলি কি চাইকভস্কি তখন কি আর বুঝতাম খালি ঘুম পেত। অনেক কাল পরে বাবা যখন কালচারাল মিনিস্টার নিজ উদ্যোগে নিয়ে এসেছিলেন উস্তাদ সালামাত আলি আর নাজাকাত আলি সাহেব কে, আমাদের বাসায়ও গেয়ে গেছেন তারা, এখন পর্যন্ত এত তৈরি গলা খুব কম লোকেরই আছে, তাদের উত্তরসুরীরা এখনো রাজ করছে হিন্দি উর্দু সঙ্গীত জগত। মা ও নাকি ব্যানজো বাজাতেন চাবি টিপা ব্যানজো, আর হারমনিকায় বাজাতেন সে অমর সঙ্গীত “ হায় আপনা দিল...” যে গানটির হারমনিকার প্রিলিউডটী আজ এত কাল পরেও সবার প্রিয় হয়ে আছে। মাজ্রুর সুলতানপুরির লিখা শচীন কর্তার সুর আর হেমন্তের গাওয়া কি গান! এই সব শুনে শুনে কানটা তৈরি হয়েছে এখন কিভাবে হাল আমলের হট্টগোল মরমে পষিবে! কি যে জ্বালা! খুব মনে পরে বাবা সেভেন ও ক্লক ব্লেইড দিয়ে সেইভ করছেন, আর হিল্ম্যান রেডিওতে বাজছে গান। সে রেডিও ছিল বড় বিস্ময়! বড় বড় গোল গোল নব, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টিউন করতে হত, আর একটা লাল কাঁটা ছিল যেটা শব্দের উঠা নামায় নড়ত, আমি দীর্ঘ দিন ভাবতাম ভিতরে বুঝি ছোট ছোট মানুষ থাকে তারা সব কায়দা কৌশল করে গায় টায় কথা টথা বলে। ছোটছোট ট্রানজিস্টার আর রেজিস্ট্যান্ট গুলি ছিল পরম বিস্ময়! কি আনন্দময়ী না ছিল পৃথিবী! রেডিওর কি সে কি মহিমা! মাঝে মাঝে আকাশবাণীর সুরটা মনে বাজে, কি গম্ভীর আর গভীর! কম্পোজার ছিলেন অয়াল্টার কফম্যান একজন চেক ইহুদী, কিভাবে হিন্দুস্তানি সঙ্গীত এভাবে এডপ্ট করলেন, কে জানে!
টিভি তখনও ঘরে ঘরে ঢুকেনি, সে সময়। বেতার তখন যেন কিন্নরী, আবিষ্ট মোহিত সকলেই। প্রতিটি বেলাই যেন জড়িয়ে ছিল সুখ, দুঃখ হাসি কান্নার সাথে। কিশোরগঞ্জ তখন ছোট্ট লাজুক মহুকুমা শহর, জেলা শহরের তকমা লাগেনি। জল হাওয়া ভালো। মানুষজন সংস্কৃতিমনা। বেশ কোমল বেতস লতার মত এক শহর। এ শহরেই আমার জন্ম। ভোর গুলি তখন ছিল লতা গুল্মের গন্ধের মতই নরম আর স্নেহরসে ভেজা। নীল টলটলে টুথ ব্রাশে পেস্ট লাগানোর আগেই শুরু হয়ে যেত রেডিও, বাবা বেরিয়ে গেলেই চলে যেত বোনেদের দখলে। বেলা বাড়লেই একে একে সব্বাই স্কুল কি কলেজে যেতে থাকতো, কারুর ফ্রক কি জামা, কারুর কামিজ পাজামা, কারুর টাইট পনি টেইল তো কারুর আলসে বেণী। একটা ছবি প্রায়ই চোখে ভাসে আমার, মেজদি বাসার গলি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কলেজে, অজানুলম্বিত বেণী পিছন থেকে দেখা যাচ্ছে, আধভাঙ্গা লালচে ধুসর পথ। কাঁচা রোদ ফেলছে ছায়া সজনে গাছের চিরল চিরল পাতার। ডালে ফোঁড়ন দেবার শব্দ আসছে এবাড়ি ওবাড়ি থেকে,পাঁচ ফোঁড়নের গন্ধে মৌ মৌ চারিদিক। কাঁঠাল গাছটার সবুজ কচি পাতা চকচকে বিস্ময় নিয়ে যেন তাকিয়ে, ছোট্ট আমি বড় বোনের হাতে বানান খয়েরি রঙের প্যান্ট পরা, মেজদির চলে যাওয়া দেখে কাঁঠাল গাছটার পাশ দিয়ে দৌড়ে ভিতরের বারান্দায় চলে আসি।
মাতৃহীন পুর পরিবারের দেখভাল করবার বোঝা আপ্পার ( আমরা বড় বোন কে আপ্পা বলি) কাঁধে, আগে থেকেই সে গিন্নী বিন্নি মানুষ, সব ঠিক সামলে নিচ্ছে, এই যে এক গাদা লোকের বিশাল সংসার অতটুকুন বয়সে ঠিক লাগাম টেনে রেখেছে, আজ বুঝি কতটুকুই বা বয়স ছিল তার ওই সময়ে, মাতৃ রুপে ঠিকই আবির্ভূত হয়ে গেছে, হাতে অভয় মুদ্রা নিয়ে। মেজ ভাই বাজার করে নিয়ে এসছে , বাচাল কাজের মেয়ে সবুজ শাড়ি পরে বলছে “কিতা আনছও? কি দিয়া ঠেমাইতাম?” ঘরে মিল্লাত ফ্যান চলছে ঘুঁই ঘুঁই করে, চক চকে কালমেঝেতে গোল গোল দাগ কেটে ঘর মুচ্ছে কেউ, রেডিওতে চলছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম, “ উড়োজাহাজ মার্কা আলকাতরা...” কিংবা গ্যাকোটাচ গ্যাকোটাচ ...তিন চার পাঁচ মিনিট গোসল করুন চুল্কানি হবে শেষ, টাচ টাচ টাচ গ্যাকোটাচ “ আর প্রতিটি বিজ্ঞাপনের ফাঁকে একটা টুরুটুট জাতিও শব্দ হত, আমার খুব মজা লাগতো এখন আর সেই চল নেই। গীতালি কি চিত্রগীতিতে প্রিয় গান বাজলে দৌড়ে এসে গান টা বাড়িয়ে দিত আপ্পা, কোমড়ে শাড়ি গুঁজে, ফর্সা মুখ উনুনের আঁচে লালচে হয়ে আছে, কুছড়ো চুল গুলো কপালে লেপ্টে আছে, কি যে ভালো লাগতো। ভিতরের উঠানে রোদ আরও বাড়ত , কলতলা শুকিয়ে ঠনঠন করতো, মাড় দিয়ে মেলা শাড়ি শুকিয়ে খড় খড়ে হয়ে থাকতো, রেডিও তে খুরশিদ আলম গাইছেন “ আজকে না হয় ভালো বাস আর কোন দিন নয়, ওই প্রেমের দরজা খোলো না কাল কি হবে জানি না”। পলেস্তরা বিহীন বাউন্ডারি ওয়ালে শ্যওলা পরে আছে ভেল্ভেটের মত, গাঢ় শ্যাওলা সবুজ, সাপের মই (গিরগিটি) যেতে যেতে থমকে দাঁড়ায় খানিক হলদে সোনালী রঙ্গ ঝড়িয়ে, গোল গোল চোখে কি জানি খুঁজে, একটা পা তুলে খানিক থমকে থাকে, তারপর তির তির করে কোথায় চলে যায়, ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের শালারা আসত আমার সাথে খেলতে, বাড়ি বানাবেন বলে একগাদা কাঠ কিনে জমিয়ে রেখছিলেন বাবা সেখানে আমরা তিনজনা খেলতাম, “সুমন, রাজন, মোহন”, কি সে খেলা আজ আর মনে নেই। ক্লান্তি হীন বেতার বেজে চলেছে তখনও। একসময় বাবা ফিরতেন চেম্বার থেকে খেয়ে দেয়ে বাবার চুল টানতে থাকতাম, বাবা শুয়ে শুয়ে পড়তেন, দাবা কি কোন কঠিন ইংরিজি বই, ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসতো। জানালা দিয়ে দেখতাম ঘন নীল আকাশ, কিছু নিম্বাস মেঘ চলিষ্ণু, পাক খাওয়া নিরলস চিলেদের দল। ঠিক দুপুর বেলা ভুতে মারে ঢিল... কি যেন একটা গান গাইত বড়রা তাই অইসব নিদাঘ দুপুর গুলি কি যেন এক ভয় হয়ে ছোট্ট বুকে থম বেরে থাকতো। চিলেতে ভয় ছিল, প্যাঁচাতে ভয় ছিল, কাবুলি ওয়ালার ভয় ছিল, আর কত শত ভয় তখন, ওঁত পেতে থাকতো। চারটে ছিল খেলতে যাওয়ার সময়, বড় একগ্লাস দুধ খেয়ে, আইরিন, শার্মীন চুল টাইট বেণী বেঁধে খেলতে যেত, আমিও তাদের পিছু পিছু, সব খেলাতেই দুধভাত। কোন একদিন বোধকরি আমার হাল্কা গা গরম ছিল তাই হয়তো খেলতে যেতে দিবে না আপ্পা আমি বসে আছি বারান্দার টেবিল্টার উপর একটু পর পর জিজ্ঞেস করছি আপ্পা চারটা বেজেছে? বার বার একি উত্তর “না ভাই”।একসময় সন্ধ্যাই হয়ে গেল। সে দিন আর চারটেই বাজল না। আমার সরল প্রশ্ন “ আপ্পা আজকে চারটা বাজবে না?” এবারো একি উত্তর “না ভাই”। কি সরল যাপিত জীবন! সন্ধ্যা হলেই ঘুমিয়ে যেতাম, রাতের স্মৃতি তাই কিছুই নেই, তবু মাঝে মাঝে ঘুম ভাঙলে শুনতাম, লং প্লে কিংবা ক্যাসেট প্লেয়ার এ বাজছে “তীর ভাঙ্গা ঢেউ, নিড় ভাঙ্গা ঝড়, তারি মাঝে প্রেম যেন গড়ে খেলাঘর” মান্না দে গাইছেন।
সেই ঘুম চোখে অস্ফুট কিছু গান, ভোরের নরম রোদে হারানো কিছু সুর, সংসারের বুননে জড়িয়ে ছিল রেডিও জড়ির ঝালরের মত, ফ্রিলের লেইসের মত, ঝলমলে। আরও পরে আমার মা’র সোনার সংসার যখন ছড়িয়ে ছত্রখান, আমরা ছোট তিনজন কম্পমান বিমাতা ভয়ঙ্করীর নাহক তরাসে, সে সময় ও একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম এই রেডিও। হিল্ম্যান তখন হারিয়ে গেছে কোথায়? তত দিনে সেই টিভি, যা শেরে বাংলা নগরের বাসায় এসেছিল কত শত প্রিয় প্রোগ্রাম দেখে আমাদের খুব কাছের কেউ হয়ে গেছিল, তা দখলে নিয়ে গেছেন তিনি, যে ঘরে আমাদের ঢোকা বারণ। তাই শামীম ভাই তার রেডিওটি আমাদের দিয়ে দিয়েছিলেন। বুদ্ধ প্যাগডার ডিজাইনে, কমলা ঘিয়ে রঙের, চূড়টা ঘোরালে টিউন হত। আমরা ঢাকা ঘুরে আবার কিশোরগঞ্জ ব্যাক করেছি, ঢাকার বাসায় থাকে, মেজ ভাই আর ফুলদি (তিন নম্বর বোন), বড় দু বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, বড় ভাই ভাবি কে নিয়ে থাকেন শঙ্কর। আমরা ছোট তিনজনা, বিমাতা আর বিমাত্রেও ছোট এক ভাই সহ কিশোরগঞ্জ চলে এসছি। বাবা ঢাকা-কিশোরগঞ্জ, ঢাকা-কিশোরগঞ্জ করছেন। রাজনীতির তখন টাল মাটাল অবস্থা, জিয়াউর রাহমানের মৃত্যুর পর বিশ্ব-বেহায়ার খপ্পরে দেশ ( যদিও এখন তিনি বেহায়া লিস্টির অনেক নিচে চলে এসছেন)। বাবা যেহেতু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তার ছুটছুটির শেষ নেই। আমার মনে আছে প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুর একদিন পর বাবা চিটাগং সার্কিট হাউজ ভিসিটে যান, আমাকে ও সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন, দেখছিলাম গুলিতে গুলিতে ঝাঁজরা দেয়াল, একটা পোষ্টার ছিল তখন “ছেলে হউক মেয়ে হউক, দুটি সন্তানই যথেষ্ট”, পোষ্টার টি তখনও ঝুলছে অজস্র গর্ত বুলেটের। মুহূর্তে একটি দেশ ব্যাক গিয়ারে চলে এল। এরশাদ কে ইতিহাস তাই আজ আস্তা কুঁড়ে ছুড়ে ফেলেছে। রাজনৈতিক বাতাবরণেই বড় হয়েছি কিন্তু কোনদিন এর কলুষতা আমাদের স্পর্শ করেনি, বরং দেখেছি আমার বাবাকে কিভাবে অর্থ ও ক্ষমতার লোভের উর্ধে উঠে দেশ ও দশের জন্য করতে। এরশাদের কোন টোপই পাত্তা পায়নি বাবার কাছে, কাজী জাফর কিংবা আনোয়ার জাহিদরা কত দলে ভিড়ানোর চেষ্টা করেছেন কিন্তু ফলাফল শূন্য। কত দেখলাম, ত্যাগী নেতা বরিশালের সিরাজুল হক মন্টু কাকা আর বাবা শাজাহান পুর বাসার পিছনে দারোগা সাহেবের বাসায় আত্মগোপনে আছেন, থানা থেকে পুলিস আগেই খবর দিয়ে গেছে, রাত্রে রেইড হবে স্যার আপনারা কেউ আজ বাসায় থেকেন না। গল্ডব্লাডারের পেইন নিয়ে সারা রাত লুকিয়ে থাকতেন। এসব আজ মূল্যহীন। বিচারহীন এ সমাজে ,কলুষিত রাজনীতি। রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির কীট কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, দেশটাকে। হয়তো প্রাসঙ্গিক নয় তবুও কথা গুলি চলে এল, কোন কিছুই রাজনীতি, অর্থনীতি আর ধর্মের বাইরে নয়। ফিরে যাই প্রসঙ্গ রেডিও তে আবার।
ধান্মন্ডির বাসায় একটা প্যানাসনিক টু ইন ওয়ান ছিল ফুলদির, টার্ন টেবিলটার দখল ছিল মেজভাইয়ের, শামীম ভাই এর রেডিওটাই আমরা শুনতাম। তিনটা বাজলেই ছোট তিনজন রেডিওতে টিউন করতাম ওয়ার্ল্ড মিউজিক। তখন মনে হত শুরু হত বিটফেনের সিম্ফনি ফাইভ দিয়ে, ট্যা ট্যা ট্যা ট্যা...মাথায় ঢুকে আছে একদম। কত শত গান ভুল ভাল লিরিক্সে গাইতাম, আমার খুব প্রিয় ছিল ইয়েসটার ডে ওয়ান্স মোর, মনে হয় শনিবার হত, ঠিক খেয়াল নেই। কারপেন্টার্সের ইয়েসটার ডে ওয়ান্স মোর এর ইন্সট্রুমেন্টাল দিয়ে শুরু হত এই সেগমেন্ট। রাইনস্টোন কাউ বয়, রেইন ড্রপ কিপ্স ফলিন অন মা হেড, আই লাভ ইউ মোর দ্যান আই ক্যান সে, কিংবা নেইল ইয়াং এর হার্ট অফ গোল্ড, কত শত গান। কত শত গায়ক। কি অধীর অপেক্ষা। সহজ লভ্য এ সময়ে এর স্বাদ আস্বাদন করা সহজ কম্ম নয়।
সেই রেডিও আজ “উপহাস যেন করিতেছে মনে ছিপি পরা দাঁত তুলি”, সবার কানে হেডফোন অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে প্রগলভ কোন বালিকা নয়ত কোন অর্বাচীন বালক, বয়স তাদের যাই হউক তাদের বালখিল্য কথকতা বড় পীড়াদায়ক, ব্যতিক্রম বড় দুর্লভ। বানিজ্য বাতাসে ভেসে যাচ্ছে সব। রেপিটেডলি একি গান বাজাতেই থাকে, কার স্টেরিওতে মাঝে মাঝে একটু শুনে নেই, বুঝে নেই চলমান সময়টাকে। বড় বিপন্ন বোধ করি। সামনে কি দিন আসছে কে জানে? কে লিখবে গান আর কেই বা করবে সুর। কে লিখবে অমন “আমি আজ আকাশের মত একেলা, কোমল মেঘের ভাবনায়, বরষার এই রাত ঘিরেছে ব্যাথায়, আমি আজ আকাশের মত একেলা, একেলা, একেলা”। কি কবিতার মত সুন্দর গান। বড় বিষণ্ণ বোধ করি, আজকের এই দেউলিয়া পনা দেখে, তবু আশায় বাঁধি বুক, কেউ কেউ তো লিখে “ তোমার জন্য নিলচে তারার একটু খানি আলো…” আবার রুপে রসে রঙে ভরে উঠবে চারিদিক। সুন্দর সুরে বাঁধা পয়ার আমাদের আনারি গলায় গুন গুন বাজবে। কোন অবুঝ বালকের মুখে হাসি ছড়িয়ে দিবে রেডিওতে বাজা মিষ্টি কোন গান!
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১২:৫৩