১.
আজকাল এই বঙ্গদেশে একশ্রেণীর অতি-মুসলমানের আবির্ভাব হইয়াছে যাহারা পারিলে একেবারে ইসলামকে ধুইয়া তিনবেলা তাহা দিয়া পানাহার করে । এই ভণ্ডকূলের অত্যাচারে বোধকরি ফেরেশতাগণও বিরক্ত বোধ করিয়া থাকিবেন । এই অতি-মুসলমানগণ দিন-রাত্রি কেবল খুজিয়া বেড়ায় কোথায় কে দাড়াইয়া প্রস্রাব করিল আর কাহার হিজাব একটুখানি নামিল । ইহারা ‘রাস্তায় পড়িয়া থাকা অর্ধ-নগ্ন অভুক্ত মৃতপ্রায় ভিখারিণিকে দেখিয়া সামান্য বিচলিত হয় না , অথচ সুন্দরীর একটুখানি মাংস দেখা গেলে একেবারে হুলুস্থুল বাধাইয়া দেয় ’। ইহারা মাকে পায়ে ঠেলে – কিন্তু ফাকিস্তানি হুজুরদের পারিলে পশ্চাৎদেশ ধুইয়া দেয় । যদি তখন ভুল করিয়াও আমাদিগের মতন কোন সাধারণ মুসলমান যাইয়া তাহাদিগকে নবীর (সাঃ) মাতৃভূমির প্রেমের কথা শুনায় তাহলে তাহারা তলোয়ার বাহির করিয়া বলিয়া ওঠে ‘নিজের সুবিধা মতন হাদিস ছাড়িস- দূর হ’ ; যেন কেবল তাহাদের মুখ নিঃসৃত না হইলে তাহা তাৎপর্য পাইবে না । ইহাদের পূর্ব-পুরুষেরাই এককালে কবি নজরুলকে ধর্মদ্রোহী বানাইয়া ফতোয়া দিয়াছিল – আবার পরে তাহারাই নজরুলের গজল ছাড়া মিলাদ পড়াইতে পারিত না । তখন নজরুলই হইয়া ওঠেন তাহাদের এক ও একমাত্র কবি – অবশ্য তাহার পেছনেও স্বার্থ ছিল - আর তাহা হইল হিন্দু রবি ঠাকুর কে বাংলা হইতে উটপাটন !! হায়রে মুসলমান !!! ইহারা আফগানে যাইয়া পারিলে যুদ্ধ করিয়া শহীদ হয় ; খুবই ভালো কথা , – কিন্তু সিডরে দেশ লন্ড ভন্ড হইলে ইহাদের কর্ণে কোন আর্তনাদ পৌছায় না কেন ভাবিয়া পাই না । ইহাদের মন প্রাণে ‘পাক-সার-জমিন-সাদ-বাদ’ বাজিতে ত্থাকে , আমার সোনার বাংলা , শহীদ মিনার আর স্মৃতি-সৌধ তাই ইহাদের কাছে হিন্দুয়ানি । বাংলাও নাকি হিন্দুদের ভাষা !!! তাই বাংলার সাথে খানিক উর্দু মিশাইয়া না বলিলে ইহাদের জম্ম সার্থক হয় না ।
এই ভন্ড মুসলমানেরা যে কেবল দেশের আর সমাজের ক্ষতি করিতেছে তাহাই নয় , মাঝে মাঝে মনে হয় , ইহারা ইহুদি-নাসারাদের তৈরি কৃত্রিম মুসলমান – যাহারা ইসলামের সর্বনাশ করিতে জিহাদে নামিয়াছে । তাহারা মানুষ মারে আল্লাহর নামে , অথচ আল্লাহ তাহাদের কখন কবে মানুষ মারিবার অধিকার দিলেন ইহা ভাবিয়া পাই না । এই ভণ্ডগণ আবার অন্য কারো মুখে আল্লাহর নাম শুনিলেও দ্বিগুণ ক্ষেপিয়া ওঠে – যেন ভাব খানা এই যে,পরপ করুণাময় কেবল তাহাদেরি করুণা করিয়াছেন যে আল্লাহর নাম কেবল তাহারাই জপিতে পারিবে – আল্লাহর বাণীর ব্যাখ্যাও কেবল তাহারাই রচিবে ।
এই ভন্ড প্রতারকদেরকে আল্লাহ কী শাস্তি দেবেন জানি না, তবে তাহা যে শয়তানের শাস্তির থেকে কোন অংশে কম নয় – তাহা নিশ্চিত । কেননা শয়তান প্রকাশ্য বিশ্বাসঘাতক-আর উহারা ছদ্মবেশী শয়তান, উহারা মুখে আল্লাহর নাম লইয়া অন্তরে অন্য দেবতার মন্দির গড়িয়া তুলিয়াছে- সেই মন্দিরে সাধনা হয় না – হয় ধ্বংস আর সর্বনাশের নীল নকশা ।
২.
আজকাল এই অতি মুসলমানগণের অতি আক্রোশের শিকার ডঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল । এরা পারলে এখনই তাঁর আমলনামা লিখে দুইহাতে ধরিয়ে দিয়ে পারলে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে । ভাবটা এমন বঙ্গদেশে মানুষের আমলনামা লেখার দায়িত্বটা তাহারা বাপ-দাদার আমল থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে ভোগ দখল করে আসছে !! তিনি যাই লেখেন তাতেই তাদের আপত্তি নয় শুধু – একেবারে ঘোরতর যুদ্ধংদেহী মনোভাব । কেন তিনি লিখবেন ? তিনি যখন শিবিরদের নিয়ে লিখলেন , তখন তাঁরা বলল , ছাত্র লীগের কোন দোষ তিনি দেখতে পান না । সরকারের মদদপুষ্ট বুদ্ধিজীবি । তাঁরা ভুলে গেল টিপাইমুখ বাধ নিয়ে তাঁর অবস্থানের কথা । এবং অতঃপর তিনি বিশ্বজিতের লাল শার্টে কেপে উঠলেন , হয়ত কাদলেন ও । এবং সেখানে তিনি এক বড় অন্যায় করে ফেললেন । আর তা হল সাধারণ মুসলমান হয়েও অতি-মুসলমানদের কোরানের আয়াত শোনালেন । এ বড় অপরাধ – ভীষণ অপরাধ । সুতরাং সেই সব ছদ্মবেশীরা আবারো ক্ষেপে উঠল ।
কেউ ধার্মিক না অধার্মিক , আস্তিক না নাস্তিক – তা বিচারের দায় বা দায়িত্ব কার ? এই অতি মুসলমানদের , নাকি মহাস্রষ্টার ? এ বিচার করা তো তারই সাজে মহা বিচারক, মহা পবিত্র যিনি ।
৩.
আমি সেই সাধারণ মুসলমানদেরই একজন - যে সাধারণ মুসলমানরা শান্তি প্রিয় ভীষণ - তাঁরা যখন বহু দূরদেশের অসহায় মানুষের কান্না শোনে, তখন নিজেরাও কেদে ওঠে । তাঁরা অন্য মতের অন্য ধর্মের মানুষকেও মানুষ বলেই সম্মান দিতে জানে – কেননা তাদের পথ-প্রদর্শক, তাদের মহানবীর (সাঃ) শিক্ষাও যে তাই । তাঁরা ‘ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি’ করে না । তাঁরা রাস্তায় জ্যান্ত মানুষ পিটিয়ে মারে না – তাঁরা বোমা ফাটায় না – তাঁরা কোথাও আত্মঘাতি হামলাও করে না । তাদের কাছে একজন অসহায় মানুষ নিরাপদ- এবং নিরাপদ এই পুরো পৃথিবী । তাদের অনেকেই হয়ত ইসলামের তাত্ত্বিক বিষয়গুলি সম্পর্কে কম জানে , অনেকে জানেই না – কিন্তু তাদের অন্তরের প্রগাঢ় বিশ্বাস তাতে এতটুকুও লীন হয় না, তাঁরা হয়ত বেহেশতের সার্টিফিকেট বিক্রি করতে পারে না, কিন্তু তাদের সুন্দর হৃদয় তাদের স্বর্গ-যাত্রাকে সহজ করে নিশ্চিত । তাঁরা যেমন নিজেরা ভুল করে মহাস্রষ্টার কাছে ক্ষমা চাইতে পারে, তেমনি অন্যেরা ভুল করলে তাদের ক্ষমাও করতে পারে । এবং তাঁরা ভালোবাসতে পারে । তাঁরা ক্ষুদার্ত মানুষকে দেখলে তার মুখে খাবার তুলে দিতে চায় – তা সে হিন্দু কিবা মুসলমান যাই হোক না কেন । কারণ তাঁরা সবার আগে মানুষ । ইসলাম তাদের মানুষ হবার শিক্ষা দিয়েছে , জালিম হবার নয় । তাদের মহানবী (সাঃ) তাদের সহমর্মিতা শিখিয়েছেন , ভালোবাসা শিখিয়েছেন , বচসা আর হিংসা-দ্বেষ শিখাননি ।
এবং সেই অতি-মুসলমান কিংবা অতি হিন্দু , অতি খ্রিষ্টান অথবা অতি নাস্তিকদের প্রতি মহানবী (সাঃ) বলেছেন ‘তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না ’ । আর মহামহীম আল্লাহ জানেন - ‘তাঁরা অন্ধ ও বধির – তাঁরা কখনোই (সুপথে) ফিরে আসবে না । ’ (আমি জানি, আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের বাণী কারও বাপ-দাদার সম্পত্তি নয় – তা শোনা-মানা কিংবা বলবার অধিকার কেবল মুসলমানদের নয় , বরং পৃথিবীর প্রতিটি মানুষেরই আছে – তা সে যাই হোক – হিন্দু – বেদুঈন কিংবা নাস্তিক )
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১২ দুপুর ২:৫৭