যখন স্কুলে পড়তাম প্রতিদিন সকালে মিথ্যে বলার অনুশীলন হতঃ 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি ' - আমার বাংলাও যেমন সোনার না, আমিও তাকে ভালো বাসি না । মা বলত আমার দেশ সুজলা সুফলা-শস্য শ্যামলা -আমি তাই শুনে ভাবতাম নিউজিল্যান্ডের ঘাস বুঝি নীল কিংবা কালো । প্রতিদিন আমার বাবা মিথ্যে শেখাত আর আমাকে অহঙ্কারি করে তুলত এটা বলে 'সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভুমি'- আমার দেশ সকল দেশের সেরা না - কিন্তু যখন এটা জানলাম ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে - আমি অনেক অহঙ্কারি হয়ে উঠেছি । আর আমি হীনমন্যতায় ভোগা শুরু করেছি -কারণ আমার শৈশবের শেখা সব সুন্দর সত্যগুলি আজ একে একে মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে । কবে বা আমি নিজেই মিথ্যে হয়ে যাব ।
আমার শৈশবের অনেক প্রিয় স্কুল, আমার বাবা-মা , আমার রবি ঠাকুর-নজরুল-জীবনানন্দ-দ্বিজেন্দ্র নাথ সবাই কেন আমার সাথে এতটা মিথ্যেচার করেছিলেন? কেন মিথ্যেই ছিল আমার প্রথম পাঠ ?
ভালোবাসতে তো মাকে সম্পদশালী হতে হয় না । তাকে পৃথিবীর সেরা সৌন্দর্যের অধিকারী হতে হয় না । পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা পেতে মাকে কেবল মা হতে হয় । আমার দেশ যদি সবচেয়ে দরিদ্র , সবচেয়ে অসুখী হয়-তবুও তাকে আমি ভালোবাসব । কেননা সে আমার মা – তার আলো-জল-বাতাসেই আমার বেড়ে ওঠা । তবে কেন আশৈশব এ মিথ্যের ফুলঝুরি ? আমাদের শৈশবের ছোট্ট কাদা মাটির মনে কেন মিথ্যে আশ্বাস আর এ ধূসর বড়বেলায় তার নির্মম প্রত্যাখ্যান । বরং আমাদের সেই শৈশবকে যদি মিথ্যে স্বপ্নে বিভোর করে না তুলে কেউ আমার অতি দরিদ্র ম্রিয়মান মাকে সমৃদ্ধ করে তুলবার প্রত্যয়ে প্রত্যয়ী করে তুলত-তবে বরং আমি মিথ্যে অহঙ্কারী না হয়ে আজ দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ হতাম । আমি হীনমন্যতায় না ভুগে আজ বাস্তববাদী আর যুক্তিনিষ্ঠ হতাম । আমি স্বপ্নভঙ্গের যাতনায় জর্জরিত না হয়ে বরং স্বপ্ন-নির্মাণের পথে অগ্রসর হতাম ।
অনেক ‘কেন’র উত্তর খুজে পাই না আমি । সামনের পথ তাই ধূসর লাগে বড় । জমাট বাধা সেই সব কেনরা আমায় তাড়া করে অণুক্ষণ ।