'৫২ থেকে '৭১ আমার সব অহঙ্কার মুছে গেছে । 'আমি বাংলাদেশি' - এটা আজ আর আমার কোন গর্বিত উচ্চারণ না, আজ আমি হতবিহ্বল প্রচন্ড, লজ্জায় লীন , হতাশ্বাস প্রাণ এক । আজ আমাদের দীর্ঘশ্বাসগুলিও ক্লান্ত বড় । আজ আমার কবিতাগুলি গল্প হয়ে যায় , আর গল্পগুলির জায়গা হয় ডাস্টবিনে । আজ অচেনা লাগে আমার অনেক অনেকবার দেখা সেই অনেক পুরানো স্বপ্নগুলো । আজ আমার বুক ভেঙ্গে কান্না আসে, কিন্তু অবাক বিষ্ময়ে দেখি চোখে জলের লেশমাত্র নেই, বেচারা কবে শুকিয়ে মরে গেছে খেয়ালও করি নি । কিন্তু আমি তো পুরোপুরি মরতে চাই । একেবারে অন্ধ হতে চাই যেন এই রক্তাক্ত বাংলাদেশকে আর দেখতে না হয়, আমি তো বধির হতে চাই, যেন তার আর্তনাদ আর না শুনি । আমি তো স্তব্ধ হতে চাই যেন এই পুড়ে যাওয়া, ক্ষয়ে যাওয়া সমাজ থেকে মুক্তি পাই । একদিন এই ক্ষত-বিক্ষত দেশকে ‘মা’ বলতে শিখেছিলাম – আর আজ । আজ আমিও সেই নির্মমভাবে খুন হয়ে যাওয়া লেখকের কবিতা কিংবা প্রচন্ড কষ্টের উচ্চারণ গুলি আউরিয়ে যাইঃ
রাইফেলের নির্দেশে তুমি ফোটাচ্ছ/ সামরিক পদ্ম, সাইরেনে কেপে নামাচ্ছো / বর্ষণ, নাচছো বৃষ্টিতে চাবুকের শব্দে, এক ম্যাগজিন/ ভর্তি হলদে বুলেট পাছায় ঢুকলে তুমি জন্ম দাও / নক্ষত্রস্তবকের মত কাপা কাপা একটি ধানের শিষ । প্রকাশ্য রাস্তায় তুমি/
একটা লজ্জিত রিকশা ও দুটি চন্দন পাখির সামনে একটা রাইফেল/ এক জোড়া বুট-তিনটা শিরস্ত্রাণের সাথে/ সঙ্গম সারো-এ জন্যই কি আমি অনেক শতাব্দী ধরে স্বপ্নবস্তুর/ ভেতর দিয়ে ছুটে ছুটে পাচশো দেয়াল-জ্যোতস্না-রাত্রি/ ঝরাপাতা নিমেষে পেড়িয়ে বলেছি, ‘রূপসী, তুমি,/ আমাকে করো তোমার হাতের গোলাপ ।’ (হুমায়ুন আজাদ)
অথচ এমনতো চাই নি আমরা, এমন চায় নি ওরাও-যাদের জন্য আমরা ‘সব ক’টা জানালা ’ খোলা রাখতে চাই । শুনেছি ’৯০ এ ‘এক অদ্ভূত ঊটের পিঠে’ চলছিল স্বদেশ, আর এখন ??
বাংলাদেশ, তুমি আমাকে জন্ম দিয়েছ ঠিকই, তার মানে এই নয়, তুমি যা-ইচ্ছে-তাই করতে পারো আমাকে নিয়ে । তার মানে এই নয় যে তুমি আমাকে মধ্যরাতে বুলেট আর বেয়নেটে রক্তাক্ত করতে পারো, তার মানে এই নয় যে তুমি আমাকে হঠাত রাস্তা থেকে উধাও করে দিতে পারো, তুমি আমাকে জন্ম দিয়েছ ঠিকই, তবে তার মানে এই নয় তুমি চাইলেই বাসে আগুন লাগিয়ে আমাকে সহ পুড়িয়ে মারতে পারো, তুমি আমাকে এসপবের কিছুই করতে পারো না বাংলাদেশ , ঠিক যেমন আজ প্রচন্ড ইচ্ছে হলেও আমি তোমাকে অস্বীকার করতে পারি না ।
এমনি যদি হবে তবে জন্ম দিয়েছিলে কেন ? আমার অজস্র মৃত্যু আর তোমার নিষ্ফল কান্না !!! বড় অদ্ভূত শোনায় আজ মানবাধিকার-আইন-সরকার-রাষ্ট্র-বিশ্ববিদ্যালয়-জননী-দেশমাতৃকা । আর অনুভূতি ? সুকান্ত কবিতাকে ছুটি দেবার আগেই আমি অনুভুতি-ভালবাসা-দেশ প্রেম এই সব নোংরা ব্যাপারগুলোকে ছুটি দিয়ে দিয়েছি । হয়ত একদিন কোন বেজন্মার মত তোমাকেও অস্বীকার করে বসব । তুমি কি সেদিনের অপেক্ষায় ??
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০১২ রাত ১০:৪২