শুক্রবার বিকেল। খাগড়াছড়ির সাজেক থেকে চান্দের গাড়িতে করে সবাই রাঙামাটির বাঘাইছড়ি যাচ্ছি। আগের রাত ও সেই দিনের জার্নিতে ৯ জনের সবাই-ই পরিশ্রান্ত। তবুও নগর জীবনের যান্ত্রিকতা থেকে পাহাড়ের দেশে ঘুরে বেড়ানোর প্রশান্তি ছিল সবার চোখে-মুখে। উঁচু-নীচু পাহাড়ী রাস্তা ধরে চান্দের গাড়ির ভ্রমণটাও কম রোমাঞ্চকর ছিল না। তবে পথে ৮জন উপজাতি নিয়ে ৩টি মোটরসাইকেল আমাদের সকলেরই কম-বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। কারণ হিসেবে বলা যায়, এরা দীর্ঘক্ষণ আমাদের পেছনে পেছনে আসছিল ও মাঝে মধ্যেই ওভারটেক করছিল।
ওভারটেক করার কিছু সময় পর আবার সেগুলোকে জানি না কিভাবে যেন আমরা আবার আমাদের গাড়ির পেছনেই আবিষ্কার করতাম। অজানা এক শঙ্কা সকলের মধ্যেই জেগে উঠতে শুরু করলো। কারণ, এর দিন তিনেক আগেই সেখানকার তিনজন বনরক্ষীকে অপহরণ করার ঘটনা ঘটেছিল। যাই হোক, বাঘাইছড়ি যাবার অনিশ্চয়তাকে আরো বাড়িয়ে দিলো আমাদের চান্দের গাড়ির চালক স্বয়ং। সাজেক ছেড়ে আসার দেড় ঘন্টা পর সে মূল রাস্তা বাদ দিয়ে হঠাৎ করেই বিকল্প একটি ভাঙ্গাচোরা রাস্তায় গাড়ি প্রবেশ করা্লো। কারণ হিসেবে সে বললো, শর্টকার্ট রাস্তা হিসেবে স্থানীয়রা এটি ব্যবহার করে। রাস্তার দু'পাশে ঘন জঙ্গলছাড়া জনবসতি তেমন একটা নেই।
প্রথম ১০-১২ মিনিট আমরা তেমন কিছু বলিনি। কিন্তু যখন দেখলাম পূর্বে দেখা তিন মটরসাইকেলের মধ্যে দুটি আবারো আমাদের ফলো করছে তখন সকলের মধ্যেই ভয় আর আতঙ্ক প্রকট হয়ে উঠতে থাকলো। চালকের কাছ থেকে চাবি নিয়ে গাড়ির টুল বক্সের মধ্যে ৩/৪টা মোবাইল ও ক্যামেরা রেখে আবারো তালা লাগিয়ে দেয়া হলো। ইতিমধ্যে তিনটি মটর সাইকেলের দুটি আমাদের গাড়িকে ওভারটেক করেছে ও অপরটি পেছনে পেছনে আসছে। চালককে বারংবার ফিরে যেতে বললেও সে প্রতিবারই আমাদেরকে আশ্বস্ত করছে যে, কিছুই হবে না।
এসময় দেখলাম রাস্তার পাশে দুটি মোটরসাইকেলের ৫জন দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের গাড়ি তাদেরকে পাশ কাটিয়ে যাবার সময় তারা দেখলাম খুব ভালো করে আমাদের গাড়ির ভেতরে লক্ষ্য করছে। তারা হয়তো কনফার্ম হতে চাইছে যে, গাড়িতে সবাই নিরস্ত্র কিনা বা মোট কতজন আছে। আমরা মোটামুটি শিউর হলাম এদের মোটিভ সম্পর্কে। তবে দুর্ভাগ্য হলো সেখানে সব মোবাইলের নেটওয়ার্ক নাই। উপরন্তু দুর্গম জায়গা হওয়াতে সহসা কোন সাহায্যের আশা করাটাও বৃথা।
শেষমেষ নিরুপায় হয়ে আমরা চালককে জিজ্ঞাসা করলাম সামনে সেনাবাহিনী বা পুলিশের কোন ক্যাম্প আছে কিনা। চালক বললো, একটাই ক্যাম্প আছে এই রাস্তায়। রাস্তা খুব খারাপের জন্য চালকও গাড়ি খুব দ্রুত চালাতে পারছিলো না। ইতিমধ্যে তিনটি মোটরসাইকেলের একটি আমাদেরকে ওভারটেক কের চলে গেছে। আর পেছনে রয়েছে দুটি।
অবশেষে আমরা ক্যাম্পের সামনে পৌঁছালাম। আমরা ক্যাম্পের সেনা সদস্যদের সহায়তা নিতে চাইলেও চালক আমাদেরকে বারবারই নিরুৎসাহিত করছিলো। কিন্তু আমরা তার কথায় কান না দিয়ে ক্যাম্পের গেটে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাসদস্যকে পুরো ঘটনাটি জানাই। সে সঙ্গে সঙ্গে তার কমান্ডিং অফিসারকে বিষয়টি ইনফর্ম করে। দুজন সেনাসদস্য চালক ও তার সহকারীর কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য লিখে নেয়।
তারা আমাদেরকে তাদের একটি ফোন নম্বর দেয় ও আমাদের একাধিক নম্বর লিখে রাখে। তারা বলে, যে কোন ঝামেলা হওয়া মাত্রই যেন তাদেরকে ইনফর্ম করি। সেনাসদস্যদের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে আরেকটি মোটরসাইকেল রাস্তা দিয়ে চলে যায়। এটা সেনাসদস্যরাও খেয়াল করেন। এসময় চালক তার গাড়ির মালিককে ফোন করলে সে বলে যে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে। মালিক এলাকার দুজন স্থানীয়কে গাড়িতে পাঠাচ্ছেন। আমরা ও সেনাসদস্যরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম যে এটাই ভালো হবে।
এমন সময় চালক বেশ দূরে গিয়ে কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলে এসে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আমাদেরকে বলে, স্থানীয় লোক আসবেন না আর কোন ঝামেলাও হবে না। সেনাসদস্যরাও আমাদেরকে অভয় দিয়ে বলেন যে, কোন সমস্যা নাই। আমরা এ রাস্তা দিয়ে মোটরসাইকেল যাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছি। আপনারা পৌঁছানোর মেসেজ পাওয়ার পরই কেবল রাস্তা ওপেন করা হবে। আল্লাহ'র নাম নিয়ে আবারো যাত্রা শুরু হলো। ক্যাম্প থেকে মূল সড়কে উঠতে সময় লাগে ৪০-৪৫ মিনিট।
চালক ঝড়ের বেগে গাড়ি চালাতে লাগলো। ক্যাম্পের পরে প্রায় ৩/৪ কিমি রাস্তা একেবারে গভীর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। সবাই দুরু দুরু বুকে বসে আছি। ১৫-২০ মিনিট পর ফোন করলেন সেই সেনা ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা একজন কর্নেল। তিনি আমাদেরকে অবস্থা জানতে চান এবং আশ্বস্ত করেন এই বলে যে, কোন ঝামেলা হওয়ার খবর পাওয়া মাত্রই এই রাস্তা ও প্রয়োজনে পুরো এলাকাই তারা সিল করে দেবেন। অলরেডি তাদের আশেপাশের সব ক্যাম্পেই ওয়ার্নিং পাঠানো হয়েছে ও ফোর্স রেডি আছে। তার কথা শুনে আমরা কিছুটা অভয় পেলাম।
উল্লেখ্য, ক্যাম্প পার করার পর থেকে আমরা সেই তিনটি মোটরসাইকেলের একটিরও দেখা পাই নি। অবশেষে একসময় আমরা মূল সড়কে পৌঁছালাম এবং এর কিছুক্ষণ পরই বাঘাইছড়ি পৌঁছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। আর গাড়ি থেকে নেমেই সবার আগে কর্নেল সাহেবকে ফোন করে আমাদের পৌঁছানোর খবর জানালাম।
পাদটিকা:
সাজেক জায়গাটা খুবই সুন্দর। আমার মতে প্রত্যেকেরই জীবনে একবার হলেও এই জায়গাটা ঘুরে আসা উচিত। সাজেকে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প থাকায় এখানে নিরাপত্তার কোন সমস্যা নেই। তবে মূল সমস্যা হতে পারে সাজেক যাওয়া বা ফেরার পথে। সাজেক ঘুরতে যাওয়ার সময় একটি বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখবেন, আপনার যাওয়া ও ফেরত আসার টাইমিংটা এমন হয় যেন, দিনের আলো নিভে যাবার পরে আপনাকে রাস্তায় থাকতে না হয়। তাহলে আর কোন সমস্যা নেই। সাজেকে থাকার জন্য অনেকগুলো কটেজ রয়েছে। সেগুলোর ভাড়া খুব বেশি নয়। প্রয়োজনে সেখানে রাত থেকে পরের দিন ফিরে আসুন। আর সাজেক যাবার পথে সেনাবাহিনী অনেকগুলো ক্যাম্প রয়েছে। যে কোন সমস্যায় পড়লে সরাসরি ক্যাম্পের সেনাসদস্যদের পরামর্শ নিন। মনে রাখবেন, কেবল এলার্ট থাকলেই যে কোন বিপদকে পাশ কাটানো সম্ভব।
দৈনিক ঢাকা রিপোর্টে এবং বিএনএন অনলাইন২৪ ডট কমে প্রকাশিত