সাজেকের পাহাড়ে
সাজেক দেখার ইচ্ছা বেশ আগে থেকেই ছিল। তবে সময়-সুযোগ কখনোই তেমন হয়ে ওঠেনি। তবে এবার শীতের শুরুতেই বন্ধুরা মিলে প্ল্যান করলাম এবার সাজেক যাবোই যাবো। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত মাসের মাঝামাঝি ৯ বন্ধু মিলে ঘুরে এলাম সাজেক।
সাজেক বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইউনিয়ন। এর আয়তন ৬০৭ বর্গমাইল। যা দেশের যে কোন জেলার চেয়েও বড়। রাঙ্গামাটির একেবারে উত্তরে সাজেক অবস্থিত। তবে রাঙ্গামাটির তুলনায় খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের দূরত্ব অনেক কম। তাই সাজেক যাওয়ার জন্য ঢাকা থেকে সরাসরি খাগড়াছড়ি যাওয়াটাই সহজ। রাত সাড়ে ১১টায় রাজধানীর কলাবাগান থেকে শ্যামলী পরিবহনের (নন-এসি) বাসে করে আমরা খাগড়াছড়ির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম। বাসের সিট ভাড়া জনপ্রতি ৫২০ টাকা।
রাতের জার্নি অনেকের জন্য কষ্টকর হলেও জার্নির আসল মজাই কিন্তু রাতে। কারণ এতে করে পরে পুরো একটি দিন ঘোরাঘুরির জন্য পাওয়া যায়। যাত্রা পথে ছোটখাটো জ্যাম পেরিয়ে যখন কুমিল্লার শেষ সীমানায় ‘ঢাকা হাইওয়ে হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে’ বাস ২০ মিনিটের যাত্রা বিরতি করল তখন ঘড়িতে বাজে রাত সাড়ে ৩টা। রাতের খাওয়া সেরেই সকলে বাসে উঠেছিলাম। তাই এখানে যে যার মতো নাস্তা করলাম। নাস্তার মেন্যু ছিল পরেটা, মুরগির ঝাল ফ্রাই, রসমালাই আর ডিম মামলেট। নাস্তার পরে এক কাপ চা পান করে আবারো সবাই উঠে পড়লাম বাসে।
পাহাড়ের উপর দিয়ে সাজেক যাবার রাস্তা
আবারো যাত্রা শুরু হলো। বাস চলছে আর সবাই ঘুমে ঢুলছে। এক সময় রাতের আঁধার কেটে সকালের আলো ফুটে উঠতে শুরু করল। যতই আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করল ততই পথের সৌন্দর্যে আমরা বিমোহিত হতে থাকলাম। আঁকা-বাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে বাস ছুটে চলেছে দুর্বার গতিতে। পথের বাঁকগুলো এতই তীক্ষè আর সরু যে একটু উনিশ-বিশ হলেই বাস সরাসরি পাহাড়ের খাদে পড়বে। তবু দক্ষ বলেই গাড়ির গতি এতটুকুও না কমিয়েই চালক ছুটে চলেছেন খাগড়াছড়ি দিকে। শহরে শীতের আমেজ এখনো ঠিক মতো না পড়লেও খাগড়াছড়ির সীমানায় ঢোকার পর কিছুটা হলেও শীতের তীব্রতা টের পেলাম।
বাস খাগড়াছড়ি পৌঁছাল সকাল সাড়ে ৮টায়। বাস থেকে নেমে খাগড়াছড়ির নারকেল বাগানের কলেজ রোডে অবস্থিত ‘শাহ মোহছেন আউলিয়া হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে’ সকালের নাস্তা করলাম ও ফ্রেশ হলাম। নাস্তায় ছিল নান রুটি, খাসির পায়া, গরুর নেহারী আর ডিম মামলেট। নাস্তার পর পরই আগে থেকে ঠিক করে রাখা চান্দের গাড়িতে আমরা সাজেকের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
সাজেকের মূল ফটক
অর্ধ-যুগ আগেও সাজেক যাওয়াটা ছিল অসাধ্য সাধনের মতোই একটি কাজ। কারণ সাজেক যাওয়ার রাস্তা ছিল খুবই দুর্গম। পরবর্তীতে নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা নির্মাণ করেন ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ খাগড়াছড়ি-দিঘীনালা-সাজেক সড়ক। ফলে সাজেক থেকে এখন খাগড়াছড়িতে নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের গাড়ি ও মোটরসাইকেল চলাচল করে।
সাজেকের পাহাড় থেকে তোলা দৃশ্য
সাজেক যাওয়ার পথে সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর হলো এর পথের দু’পাশের দৃশ্য। পাহাড়ের উপর দিয়ে রাস্তা এঁকে-বেঁকে চলেছে। কখনো গাড়ি ধীর লয়ে পাহাড়ের উপরে উঠছে তো পরক্ষণেই একেবারে খাড়া নিচের দিকে নামতে শুরু করছে। জার্নিকে রোমাঞ্চকর করতে আমরা উঠে পড়লাম চান্দের গাড়ির ছাদে। খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটা ব্যাপার হলেও চারপাশের প্রকৃতিকে প্রাণভরে দেখার জন্য এরচেয়ে আর ভালো বিকল্প নেই। সাজেক যাওয়ার পথে মজার একটা ব্যাপার হলো, উপজাতি যত ছোট ছেলে-মেয়েকে আমরা দেখতে পেয়েছি তারা সবাই আমাদেরকে হাত উঁচিয়ে অভিবাদন জানিয়েছে। এদের কেউ কেউ তো রীতিমতো স্কাউটদের মতো তিন আঙ্গুলের স্যালুটও দিয়েছে। আমরাও হাত উঁচিয়ে ওদের অভিবাদনের জবাব দিয়েছি। পুরো দিনের জন্য চান্দের গাড়িটি আমরা রিজার্ভ করেছিলাম বলে যখনই কোনো ভালো দৃশ্য দেখেছি বা চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছে গাড়ি দাঁড় করিয়েছি।
সাজেকের কেন্দ্রবিন্দু
সাজেক যাওয়ার পথে অনেকগুলো আর্মি চেকপোস্ট পার হতে হয়। বাঘাইছড়ি আর্মি চেকপোস্টে গাড়ির সবার পরিচয় জানতে চাওয়া হলো। আমাদের সঙ্গে বাঘাইছড়ির মেডিকেল অফিসার বন্ধু ডা. সারোয়ার থাকায় কোনো ঝামেলাই হয়নি। সাজেক যাওয়ার পথটি উঁচু-নিচু পাহাড়ের ওপর দিয়ে যাওয়ার কারণে গাড়ি খুব জোরে চালানো কঠিন। এতে চাকা সিøপ করার ঝুঁকি থাকে। রাস্তাগুলো এতটাই খাড়া ও ঢালু যে, সঙ্গে থাকা এক বন্ধু মন্তব্য করল, এ যেন প্রকৃতিক রোলার কোস্টার! ছোট্ট একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টা বোঝা যাবে। সাজেকে পৌঁছানোর আগে পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা ধরে কেবল উপরেই উঠতে হয়। আর সময়ও লাগে অনেকক্ষণ।
সাজেক যাবার পথ যেন প্রাকৃতিক রোলার কোস্টার
সাজেক পৌঁছানোর আগে সর্বশেষ পাহাড়টিতে ওঠার মাঝ পথে গাড়ি ১৫ মিনিটের জন্য থামানো হলো। গাড়ির ইঞ্জিনে পানি দিতে হবে। এই ফাঁকে আমরাও গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। এখানে একটি ঝরনা আছে। স্থানীয় অধিবাসীরা ও যানবাহনগুলো এখান থেকেই পানি নেয়। রাস্তার পাশে একটু পর পরই স্থানীয়দের বসতবাড়ি দেখছিলাম। আবার মাঝে মধ্যে বাজারও চোখে পড়ছিল। সময় সীমিত থাকায় বাজারে নামার সুযোগ হয়নি। উপজাতিদের ঘরগুলো স্থানীয় জঙ্গলের বাঁশ আর ছন দিয়ে তৈরি। ঘরগুলো দেখে এতই হালকা মনে হচ্ছিল যেন জোরে একটু দমকা হাওয়া এলেই এগুলো ভেঙে পড়বে। তবে অনেক বাড়ির বাইরেই দেখলাম সোলার সিস্টেম আছে। অর্থাৎ, এখানেও বিদ্যুতের সহজপ্রাপ্যতা রয়েছে। চান্দের গাড়ির চালক জানালেন, এখানকার অধিবাসীদের অধিকাংশই মিজো ও রাখাইন। পাহাড়ের নাম না জানা অসংখ্য গাছ-পালার ফাঁকে ফাঁকে জুম চাষের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিলাম।
এক সময় আমরা এসে পৌঁছালাম সাজেকে। ঘড়ির কাঁটা তখন দুপুর ১টা ছুঁই ছুঁই। পাহাড়ের ওপর এ যেন অন্য এক রাজ্য। যে দিকে তাকাই সেদিকেই সবুজ বন আর নীল আকাশ। সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩ হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের চুড়ায় সাজেক অবস্থিত। এ পাহাড়ের চূড়া থেকে মিজোরামের লুসাই পাহাড়ের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করা যায়।
সাজেকে টেলিটক আর রবির নেটওয়ার্ক রয়েছে। এছাড়া অন্য অপারেটরদের নেটওয়ার্ক তেমন একটা পাওয়া যায় না। সাজেকে দেখলাম রাস্তার দু’পাশে বেশ সুন্দর ফুটপাত। রয়েছে সোলার স্ট্রিট লাইট। রাতে এগুলো জ্বলে উঠে। সাজেকে বেশ কয়েকটি থাকার কটেজ ও খাওয়ার রেস্টুরেন্ট রয়েছে। কটেজগুলোর ভাড়া ৮০০ টাকা থেকে শুরু। আমরা স্থানীয় একটি রেস্টুরেন্টে গাড়ির চালক ও তার সহকারীসহ মোট ১১ জনের জন্য খাবারের অর্ডার দিলাম। রেস্টুরেন্টে রাখা পানি দিয়ে আমাদের কেউ কেউ ফ্রেশ হয়ে পোশাক বদলে নিল। এতজন মানুষের খাবার পর্যাপ্ত ছিল না বলে রেস্টুরেন্ট থেকে জানানো হলো যে, খাবার রান্না হতে এক ঘণ্টা সময় লাগবে। আমরাও ভাবলাম, মন্দ না, রান্নার ফাঁকে আমরাও সাজেক ঘুরে দেখি।
সাজেকে নেমেই যে পাড়াটি দেখলাম সেটির নাম রুইলুই। পুরো রুইলুই জুড়েই সাজানো-গোছানো ঘরবাড়ি। প্রায় সব ঘরের টিনের চাল সবুজ আর বেড়া লাল। বাংলাদেশের পতাকার মতো। অদূরে সেনাবাহিনীর হেলিপ্যাড রয়েছে। সেখান থেকে পুরো সাজেককে একনজরে দেখা যায়। সাজেকের দৃশ্য এতই নয়নাভিরাম যে, এটি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। সরাসরি না দেখলে বোঝা যাবে না সাজেক কতটা সুন্দর। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষেরই জীবনে অন্তত একবার হলেও সাজেক আসা উচিত। তাহলে সারা জীবন মনে রাখার মতো অন্তত ভালো লাগার মতো কোনো স্মৃতি তার থাকবে।
জুম চালের ভাত দিয়ে দুপুরের খাবার
ইতিমধ্যে সবার পেটই ক্ষিধেই চোঁ চোঁ করছে। রেস্টুরেন্টে খেতে বসলাম। খাবারের মেন্যু ছিল জুম চালের লাল ভাত, লাউ-পেঁপে-আলুর মিক্সড সবজি, ডিম ভুনা এবং হরিণের মাংস। পুরো প্যাকেজ ১৮০ টাকায়। তবে মাংসটি আসলেই হরিণের কিনা সেই আশঙ্কায় আমরা অনেকেই সেটি খাইনি। খাওয়ার পর চান্দের গাড়িতে চেপে এবার সাজেক আরো এক পাক ঘুরে দেখলাম। সবাই সাজেকের বিভিন্ন দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করে নিলাম। এরপর সাজেককে বিদায় জানিয়ে ফেরার পর ধরলাম।
দৈনিক মানবকণ্ঠে প্রকাশিত
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:৪০