প্রিন্স মাহমুদ
মিউজিকের প্রতি তার নেশা ছিল ছেলেবেলা থেকেই। তবে বাসার কেউই জানতেন না তিনি গান শিখবেন বা গাইবেন। এ কারণেই ১৯৭৮ ও ১৯৮২ সালে নতুন কুড়িতে যখন গেলেন তখন বলা যায়, অনেকটা একাই গিয়েছিলেন তিনি। প্রত্যেক প্রতিযোগীর সঙ্গে বাবা-মাসহ আরো অনেকে গেলেও প্রিন্স মাহমুদের ক্ষেত্রে নিজের প্রতিভা ছাড়া সঙ্গী কিছুই ছিল না। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, দেশাত্মবোধক আর ছড়া গান নিয়ে তার এ আগ্রহের বিষয় স্কুল জীবনে এসে ট্রান্সফার হয় ব্যান্ড সঙ্গীতের প্রতি। মাধ্যমিক পর্যায়ে এসে এ কারণেই হয়তো পাচ বন্ধু মিলে গঠন করেন ব্যান্ড দল দি ব্লুজ। মাইলস, বিটলস, ফিডব্যাকসহ আরো অনেকের গান এতো বেশি শুনতেন যে, পড়ালেখাটাই তখন সবচেয়ে বিরক্তিকর মনে হতো। দি ব্লুজ ব্যান্ডের ভোকালিস্টও ছিলেন তিনি। নিজে গান লিখে সুর করতেন। তারপর স্টেজ পারফরম্যান্স। ততো দিনে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ লাইফও শেষ প্রায়। এ সময় সাউন্ডটেকের সত্ত্বাধিকারী মি. সুলতান মাহমুদ বাবুল তাকে ইংরেজি গানের কপি করতে বলেন।
প্রিন্স মাহমুদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেন বাবুল। তাকে ও তার গানকে শ্রোতাদের কাছে নিয়ে যেতে ক্যাসেট যে মিডিয়া হিসেবে ব্যবহৃত হয় তা বাবুলই তাকে বুঝিয়ে দেন। কিন্তু এ সময় আরেক বড়ভাই মিন্টু তাকে কপি না করে সুরকার হওয়ার পরামর্শ দেন। তার কথামত ১৯৯৫ সালে বের হয় প্রিন্স মাহমুদের প্রথম অ্যালবাম শক্তি। এরপর একে একে বের হয় তার অনেক অ্যালবাম। তবে ১৯৯৮ সালে ক্ষমা অ্যালবামটি বের হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি বুঝতেই পারেননি যে, তার অ্যালবামগুলো শ্রোতাদের কাছে এতোটা প্রিয়। আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, মাকসুদ, খালিদ, হাসানসহ প্রায় সব শিল্পীই তার সুরে গান করেছেন।
মিক্সড অ্যালবামের কনসেপ্টে বলা যায়, প্রিন্স মাহমুদই ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। ১০ জন সেরা শিল্পীকে দিয়ে মিক্সড অ্যালবাম ধারাবাহিকভাবে বের করার বিষয়টি সে সময় এতোটাই জনপ্রিয় ছিল যে, শ্রোতারা আগে থেকেই উন্মুখ হয়ে থাকতেন প্রিন্স মাহমুদের এরপর কোন অ্যালবামটি কবে বাজারে আসবে।
একটি অ্যালবামে শিল্পী ও গীতিকার ছাড়াও মূল ভূমিকা থাকে সুরকারের। সাউন্ডটেকের সুলতান মাহমুদ বাবুলই এ বিষয়টি আরো প্রচার করার জন্য প্রিন্স মাহমুদের চতুর্থ অ্যালবাম ক্ষমায় তার ছবি ব্যবহার করেন ও অ্যালবামের নামের আগে লিখে দেন প্রিন্স মাহমুদের সুরে কথাটি। এরপর অন্য কম্পানিও সুরকারদের প্রমোট করা শুরু করে।
থিম বেইজড-এ অনেক কাজ করেছেন প্রিন্স মাহমুদ। বাংলাদেশ, বারো মাস, বাবা, মা, জন্মদিন প্রভৃতি নিয়ে এমনকিছু গান তিনি তৈরি করেছেন, যা টিকে থাকবে বহুদিন।
মিউজিকে ভ্যারিয়েশন আনার জন্য প্রিন্স মাহমুদ অনেক মুভি দেখেন ও গান শোনেন। মুভির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ফলো করার অভ্যাস অবশ্য তার অনেক আগে থেকেই। সঙ্গে পিয়ানোর কম্পোজিশন শোনাটা তো বলা যায় তার হবি। আর সত্যাজিতের মুভির অসাধারণ ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক তো তাকে আবিষ্ট করে রাখে এখনো।
ছেলেবেলায় তিনি গান শিখেছেন খুলনার ওস্তাদ রাশেদ উদ্দিন তালুকদারের কাছে। আর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন ওস্তাদ অশোষ চক্রবর্তীর কাছে। বাসায় গানের প্র্যাকটিসের সুযোগ না থাকায় খুলনা নজরুল একাডেমিতে গিয়ে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে প্র্যাকটিস করতেন।
প্রিন্স মাহমুদের জন্মস্থান গোপালগঞ্জ নানাবাড়ি হলেও বাবার চাকরির সুবাদে তার ছেলেবেলার অধিকাংশ সময় কেটেছে খুলনায়। ফলে খুলনার সাংস্কৃতিক আবহটি তার গানেও বেশ প্রভাব ফেলেছে।
কথা প্রসঙ্গে আঞ্চলিক বিষয়টি আসাতে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠলো, হাসন রাজা বা শাহ আবদুল করিমের গান রিমিক্স করে আঞ্চলিক এসব গানকে জনপ্রিয় করার উদ্যোগ কতোটা প্রয়োজন?
প্রিন্স মাহমুদের এ ক্ষেত্রে সরাসরি জবাব : শাহ আবদুল করিম বা হাসন রাজার গানকে জনপ্রিয় করার কিছু নেই বরং যারাই এসব গানকে রিমিক্স করছে তারাই এ গানগুলো অবলম্বন করেই হিট সঙ্গীত পরিচালক হচ্ছেন। আর ধোয়া তোলা হয়, আঞ্চলিক গানকে পরিচিত করা হচ্ছে। অথচ এ গানগুলো এমনিতেই পরিচিত ও অমর। এগুলোকে রিমিক্স বা র্যাপ করার অর্থই হলো, গানের স্বকীয়তাকে নষ্ট করা। অন্যের নকল না করে মৌলিক কথা ও সুরের মাঝে কাজ করাই হলো একজন ভালো শিল্পীর মূল গুণ। এ ক্ষেত্রে নতুন ব্যান্ডগুলো যেমন আর্টসেল, শিরোনামহীন, অর্নব, হাবীব প্রভৃতি শিল্পীর মৌলিক গান ও সুরের বিষয়টি প্রাধান্য পাবে।
তবে প্রিন্স মাহমুদের মতে, বাংলা গানকে বর্তমানে অনেক ব্যান্ড ও শিল্পীই র্যাপ বা হিপ-হপ টাইপের গান বানিয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করছেন, যা কখনোই কাম্য নয়। বাংলা ভাষাকে শুদ্ধ বাংলাতেই উচ্চারণ করতে হবে। বাংলা শব্দের মাঝে ইংরেজি টোনের মতো বিকৃত রূপ উপস্থাপন করে কেউ বা কোনো ব্যান্ড পপুলার হলেও সেই পপুলারিটির মেয়াদ সামান্যই বলা যায়। কারণ যার মিউজিকে আভিজাত্য আছে, ইচ্ছা করে ইংরেজি টোন আনার তার কোনো প্রয়োজন নেই।
অবসরে অনেক বই পড়েন প্রিন্স মাহমুদ। পিয়ানোর প্রতি আকর্ষণ তার বরাবরই রয়েছে। বাসায় সম্প্রতি করেছেন মিউজিক স্টুডিও শক্তি। ফলে গানের জন্য তার ভাবনা-চিন্তা ও কর্মের পুরোটাই এখন ব্যয় করেন তিনি এই মিউজিক স্টুডিওতে। তার দেড় যুগের মিউজিক জীবনের সেরা সময় কোনটি জিজ্ঞাসা করলে তার সরাসরি উত্তর, সেরা সময়টি এখনো আসেনি। তবে আগামী পাচ বছরের মধ্যেই আসবে সেই সময়টি বলে তিনি আশা করেন। বাংলা গানে সনেটকে তিনি কিভাবে কাজে লাগানো যায় তা নিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন এখন। সফল হলে মিউজিকের ক্ষেত্রে তা একটি যুগান্তকারী বিষয় বলেই চিহ্নিত হবে। বর্তমানে কোজআপ ওয়ান তারকাদের নিয়ে কাজ করছেন তিনি। গত এক বছরের কাজের মধ্যে মাহদীর একক অ্যালবাম বন্দনা'র সুণীল বরুনা, রুমির মাটি হবো মাটি, খালিদের যদি হিমালয় হয়ে গানগুলো আলোচিত হয়েছে।
বিয়ে করেছেন ২০০২ সালে। আহমদ ও আরিয়ান নামে দুই ছেলে আছে তার। সংসারের হাল ধরেছেন স্ত্রী। প্রিন্স মাহমুদ ভাবনার পুরোটাই ব্যয় করেন মিউজিকের পেছনে।
মাঝে তার কাজ দেখা যায়নি বা তাকেই কেন মিডিয়া থেকে দূরে থাকতে দেখা গেছে জানতে চাইলে প্রিন্স মাহমুদ বলেন, বলা যায় এক প্রকার অভিমান করেই মিউজিক থেকে দূরে সরে ছিলাম। বয়সের অপরিপক্বতাও এ জন্য অনেকটা দায়ী। ফলে দীর্ঘ সময় শ্রোতারা বা মিডিয়া আমাকে কাছে পায়নি। তবে এখন আমি সিরিয়াসলি কাজ করছি এবং আমার সেরা কাজগুলোই এবার শ্রোতাদের উপহার দিতে চাই। এমন কিছু কাজ করে যেতে চাই, যাতে তা অন্তত আরো ৫০ বছর অমর হয়ে থাকবে।
প্রিন্স মাহমুদের টপ টেন চয়েস
১. খালিদের- কোন কারণেই ফেরানো
২. জুয়েলের- যদি
৩. আইয়ুব বাচ্চুর- বার মাস
৪. হাসানের- এত কষ্ট কেন ভালোবাসায়
৫. জেমসের- বাংলাদেশ
৬. হাসানের- প্রশ্ন
৭. আইয়ুব বাচ্চুর- পালাতে চাই
৮. জেমসের -মা
৯. মাহাদীর- সুণীল বরুনা
১০. খালিদের- যদি হিমালয় হয়ে
এক নজরে প্রিন্স মাহমুদ
জন্ম তারিখ : ১৭ জুলাই
প্রিয় রঙ : সাদা
শখ : বই পড়া
অবসর কাটে : বই পড়েন
সুর করেছেন : ৩০-৩৫টি অ্যালবামে
গান লিখেছেন : শতাধিক
প্রথম অ্যালবাম : শক্তি
উল্লেখযোগ্য কিছু অ্যালবাম : ক্ষমা, এখনও দুচোখে বন্যা, দাগ থেকে যায়, শেষ দেখা, স্রোত, জয়-পরাজয়, ওরা এগারো জন, দেবী, যন্ত্রণা, কিশোর-কিশোরী, বারো মাস, দেশে ভালোবাসা নাই, পিয়ানো, এক মুঠো জোসনা ও তাল।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০১২ রাত ১:১৭