লতা–আ–আ...! চিৎকার করতে গিয়ে পারলাম না। শব্দ বেরোল না। বেশি ঘাবড়ে গিয়েছি। ঘাবড়ে গিয়ে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ব্রেক কষে ট্রাকটা সজোরে ঝাঁকুনি দিয়ে থামল। জোর করে চোখ মেললাম বিস্ময় নিয়ে। স্বস্তির বিস্ময়। দানবীয় ডাইমলার ট্রাক মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে দাঁড়িয়ে। ডানে-বামে গাড়ি চলা রাস্তায় আরেকটু হলে আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে যেত। ভাগ্যিস, সামনের রাস্তাটা খালি; আর পেছনের রাস্তায় গাড়িগুলো সিগনালে দাঁড়িয়ে। তা না হলে লতার হাতের ওপর দিয়ে...। আর ভাবতে চাইলাম না। এদিকে, ড্রাইভার আমার উড়ে এসে তার গাড়ির সামনে পড়ার দোষে শাপশাপান্ত শুরু করে দিয়েছে। বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য না করে এক সেকেন্ডে দৌড়ে পৌঁছে গেলাম লতার কাছে।
হাঁটু মুড়ে বসে সবার আগে লতার হাতটা কোলে তুলে নিলাম। কী করব, মাথা কাজ করছে না। গত মাসে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য ফার্স্ট এইড কোর্স করেছিলাম। তার কানাকড়ি কিছুই মনে পড়ছে না। শুধু কবজিটা হাতড়ে হাতড়ে কোনোমতে পালস পেয়ে বুঝলাম জ্ঞান নেই। খুব দ্রুত ভাবতে গিয়ে সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে আমার। লতার মাথাটা এবার কোলে নিয়ে ঝুঁকে পড়ে জোরে জোরে ডাকলাম, ‘লতা, লতা...’। লাভ হলো না। হাতটা ভেজা ঠেকল। চমকে গিয়ে দেখি মাথার পেছনটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ফুটপাথেও রক্তের একটা সরু ধারা চুঁইয়ে রাস্তায় গিয়ে পড়েছে। আমার মেরুন শার্ট কালো ছোপে ভরে গেছে। এত রক্ত দেখে মাথা ঝিমঝিম করছে। স্কুলে বায়োলজি নিতে পারিনি যে কারণে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঝাপসা দেখছি। কিন্তু জ্ঞান হারানোর মতো বোকামি করার সময় এটা না।
জোর করে চোখ সরিয়ে আরেক দিকে ফেরালাম। এক হাত দূরে পড়ে থাকা লতার ব্যাগটার ভেতর থেকে নীল টুপিটা উঁকি দিচ্ছে। উবু হয়ে টুপিটা টান দিয়ে এনে লতার মাথায় চেপে ধরলাম। রক্তটা বন্ধ হওয়া খুব দরকার। টুপির সঙ্গে লতার ব্যাগ থেকে স্মার্টফোনটা বেরিয়ে এসেছে। মাথায় কাজ করল, এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি ফোন দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ডাকা। কিন্তু, নম্বরটা যেন কী? নাইন ওয়ান ওয়ান? নাকি নাইন নাইন নাইন? কিন্তু একটা তো আমেরিকার, আরেকটা বাংলাদেশের। জার্মানিরটা কী? মাথা পুরো সাদা হয়ে গিয়েছে ঘটনার বিহ্বলতায়। না, না, মনে পড়েছে। ওয়ান ওয়ান টু। এক হাতে খুব সাবধানে লতার মাথাটা সামান্য উঁচু করে পকেট থেকে বার কয়েকের চেষ্টায় নিজের ফোন বের করলাম। হাত ঘামছে প্রচুর। কিছুতেই স্ক্রিন লকটা খুলতে পারছি না। ঘেমে যাওয়া বিশ্বাসঘাতক আঙুলগুলো কিছুতেই কথা শুনছে না। পরপর তিনবার ভুলভাল করে ফোনটাই লক হয়ে গেল। মুঠোয় ধরে থাকা ফোনটার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকালাম।
টপটপ করে কয়েক ফোটা পানি পড়ল স্ক্রিনটায়। অবিশ্বাস নিয়ে ভাবলাম, আমি কী কাঁদছি নাকি? চোখ পড়ল লতার কপালেও পানির ফোটা। কী মনে হতে আকাশের দিকে মুখ তুলে দেখি সকালের সেই একটুকরো কালো মেঘটা ঠিক মাথার ওপরে। চারপাশ কেমন আবছা ঘোলাটে লাগছে। এক দুই ফোটা বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। দিশেহারাভাবে চারপাশে তাকালাম কাউকে ডাকব বলে। সাহায্যের জন্য। কিন্তু, লোকজন কই সব? কোথাও কেউ নেই। এতগুলো গাড়ি হাঁকানো রাস্তা আচমকাই পুরোপুরি সুনসান। শুধু এক আধটা কাচ তোলা গাড়ি পঞ্চাশের রাস্তায় ষাট-পঁয়ষট্টিতে শাঁ শাঁ করে ছুটে মিলিয়ে যাচ্ছে। হয়তো কারও চোখেই পড়ছে না পথের ধারে রক্তে ভেসে যাওয়া লতা আর অসহায়, নিরুপায় অনীককে। দোকানপাটও নেই কাছে ধারে যে ছুটে গিয়ে কাউকে ডেকে আনব। লতাকে কোলে তুলে নিয়ে যাব, তাতে যদি ভাঙা পায়ের কোনো ক্ষতি হয়? তা সেই চেষ্টা করলাম না।
হঠাৎ লতার পড়ে থাকা ফোনটা হাতের নাগালে দেখে তা-ই তুলে নিলাম কী মনে হতে। না, কোনো স্ক্রিন লক দেওয়া নেই। ওয়ান ওয়ান টু চাপতেই ওপাশ থেকে স্বর ভেসে এল। মনে হলো দেবদূতের কণ্ঠ শুনছি। গড়গড় করে এক নিশ্বাসে বলে গেলাম কী ঘটেছে আর কোথায় আছি। আমাকে জায়গা থেকে না নড়ার অনুরোধ করে বলা হলো পাঁচ-দশ মিনিটের মাথায় অ্যাম্বুলেন্স আসছে।
মুহূর্ত আগের উত্তেজনা ভুলে ক্লান্ত হয়ে আসা স্নায়ু আর নিতে পারছে না। ফুটপাথে পা ছড়িয়ে হেলান দিয়ে বসে লাল হয়ে আসা নীল টুপিটা চিপে রক্ত ফেলে আবার লতার মাথায় ধরলাম। অবাক হয়ে দেখলাম হেলান দিয়েছি একটা ল্যাম্পপোস্টে, যেটা একটু আগেও ছিল না, দিব্যি দিয়ে বলতে পারি। এদিকে ঝিরঝিরে বৃষ্টিটা অজস্র ফোটার ঝুম বৃষ্টিতে আকার নিয়েছে। বৃষ্টি নামার কী আর সময় পেল না? প্রকৃতি মাঝে মাঝে এত নিষ্ঠুর কেন? শার্টের কয়েকটা বোতাম খুলে সযত্নে বৃথাই লতার পুতুলের মতো মুখটা বৃষ্টি থেকে আড়াল করতে চাইলাম। কালবৈশাখী ঝড়ে পড়া মা শালিক যেমন ছানাটাকে ডানা দিয়ে ঢেকে রাখে, ঠিক তেমন। এবার আর কোনো কিছু বাঁধ মানতে চাইল না। গরম নোনা জল আর শীতল বৃষ্টির স্রোত মিলে ঝাপসা চোখে কোন দিকে চেয়ে যে অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকলাম অধীর হয়ে, জানি না।
(চলবে)
আগের পর্ব এখানে