somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হঠাৎ স্বর্ণকেশী!-৫

০৭ ই অক্টোবর, ২০১৮ রাত ৩:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ছিপছিপে গড়নের আর সামান্য কুঁজো ষাঁট ছুঁই ছুঁই মোটা ফ্রেমের চশমাপড়া আপাতগম্ভীর ডাক্তার হেইস কিন্তু আসলে আমুদে এক ভদ্রলোক। সাথে প্রকান্ড টাক। তাকে দেখলেই সত্যজিতের প্রফেসর শঙ্কুর কথা মনে পড়ে। তো, দাঁত দেখে দুখে হেইস আমার মাথার উপর থেকে দুশ্চিন্তার মেঘ সরিয়ে জানাল, “সামান্য একটু ভেঙ্গেছে। এটা একটা “মিহানিহাল” ড্যামেজ, ব্যাপার না।“ আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম, “মিহানিহাল কি বস্তু আবার?” হেইস সজোড়ে মাথা নেড়ে অতি কষ্টে উচ্চারণ করল, আরে মিহানিহাল বোঝ না, কি বল তুমি? মিখ-খা-নিখ-খাল!” আমি বুঝলাম। সে আসলে বলার চেষ্টা করছে “মেকানিকাল”। একে ইংরেজি কম জানা ঘোড়ার ডাক্তার, তার উপর কথায় এক ধরনের আঞ্চলিক জার্মান টান আছে। কোন অঞ্চলের, সেটা জানা বা বোঝা এই অধমের জ্ঞানের বাইরে।

ডাক্তার হেইস বলেই চলছে, “কি চিবোতে গিয়েছিলে, বলত?” উত্তরে কপট রাগ দেখিয়ে বললাম, “কি আবার, তোমাদের পাথুরে রুটি, আর কি?” আমার অভিযোগ শুনে হেইস তার দাঁত দেখার যন্ত্রপাতিগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলে উঠল, “এই পাথুরে রুটি খেতে খেতে এক সময়ে এমন অভ্যস্ত হয়ে যাবে যে আর কিছু তখন মুখেই রুচবে না। জার্মান রুটির এমন গুন, বুঝলে।“ আমি এতক্ষনে কিছুটা অধৈর্য্য। তবুও মন দিয়ে হেইসের কথা শুনে যাচ্ছি কোন একটা সমাধান শোনার আশায়। ডাক্তার বুড়োটা বলেই চলছে, “যাহোক, এমন নাটকীয় কিছু হয় নি। দাঁতটা তোমার এভাবেই থাকুক না। নাকি দেবো ঘষে সমান করে?” বলেই টুথপেস্টে বিজ্ঞাপনের মত চওড়া একগাল হাসি দিল ভদ্রলোক। সোনা দিয়ে বাঁধানো তার বাম পাশের ক্যানাইন দাঁতের সোনালি ঝিলিকে পলকের জন্যে আমি অন্ধ হয়ে গেলাম। তার উপর দাঁত ঘষে সমান করে দেয়ার প্রস্তাবে আঁতকে উঠলাম। “ঘষে সমান করে দেবো”-শুনতেই কি মারাত্মক শোনাচ্ছে! সজোরে মাথা নেড়ে আপত্তি জানালাম, “না, না, ঘষতে হবে না। দাঁতের উপর কিছুদিন জিভ বুলিয়ে দেখি যদি কোন গতি হয়। আর কাজ না হলে তুমি তো আছোই।“ হেইস ডাক্তার কিছুটা হতাশ হয়ে সেদিনের মত কেইস ডিসমিস করে আমাকে ছেড়ে দিলো।

লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘড়ি ধরে ঠিক মিনিট বারোর মাথায় পৌঁছে গেলাম লতার দেখানো ক্যাফেটায়। ঢুকতেই ভাজা মাংসে স্বর্গীয় ঘ্রাণ নাকে নির্মম ঘাঁই দিয়ে গেলো। সাথে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ভাজার তেল ফুটফুটে শব্দ। সেই সকালে অতি তিতকুটে রঙ চা দিয়ে একটুকরো জেলি-পাউরুটি গিলে বেরোনো হয়েছে। ভাবছি, লতার অপেক্ষায় বসে থাকবো নাকি এই ফাঁকে চটজলদি পেটে কিছু চালান দিয়ে ফেলবো। ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় হবার আগেই মনস্থির করা দরকার। সব দেখেশুনে আমাকে অবাক করে দিয়ে ধূ ধূ মরুভূমি পেটটা এবার তামাম ক্যাফে কাঁপিয়ে প্রচন্ড “গ্রাউল..গ্রাউল” ডাক ছেড়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করল। এরপর আর কি দোটানায় থাকা যায়? সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হল যে খাবোই খাব।

বহু আকাংক্ষিত ডোনার কাবাব, বড় এক প্লেট ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর কলিজা ঠান্ডা করা এক বোতল কোক অর্ডার দিয়ে তীর্থের কাকের তৃষ্ণা নিয়ে কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়েছি।
হঠাৎ কানে একটা চিল চিৎকার ভেসে আসলো। কোনার টেবিলে মায়ের সাথে বসা পুতুলের মত শান্ত চেহারার বছর দেড়েকের বাচ্চাটা কেন যেন খুব ক্ষেপে গিয়ে ত্বারস্বরে জগতসংসারের উপর তার বীতশ্রদ্ধা জানান দিচ্ছে। সেই ক্ষ্যাপাগান শুনে উল্টো দিকের টেবিলে বসা বিরস বুড়োটা খিস্তিখেউড়ের বন্যা বইয়ে দিতে থাকল। তার গলাবাজি আর গালিবাজির সারমর্ম হল, ফ্রাউ মার্কেল যে কোত্থেকে লাখ লাখ গেঁয়ো ভুত ধরে এনেছে। সামনে জার্মানির ভবিষ্যৎ অমাবস্যার মত অন্ধকার। মার্কেলকে এর জন্যে পস্তাতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

ওদিকে বাচ্চা সামলাতে ব্যস্ত আপাদমস্ত বোরখায় ঢাকা সিরীয় কিংবা আফগানী বাচ্চার মার নির্বিকার মুখ দেখে বুঝলাম, বুড়োর এত সাধের জার্মান গালিগুলো একদম জলে গেছে। জার্মান ভাষাটা তার কাছে দুর্বোধ্য। খামাখা গালিগুলো তার বোরখায় লেগে বুমেরাং হয়ে ফিরে গেছে। বুড়োটার রুষ্ট আচরনে কষ্ট পেলাম। কারণ, লাখ লাখ শরনার্থীকে আশ্রয় দেয়ার পেছনে এদেশের নিজের তাগিদটাই বেশি। কারন পানিশূন্যতার মত জার্মানি এখন শিশুশূন্যতা আর অল্পবয়সী তরুন-যুবকদেরদের শূন্যতায় ভুগছে। বুড়োটাকে মিষ্টি মোলায়েম ভাষায় হালকার উপর ঝাঁপসা একটু শাসিয়ে আসার জন্যে পা বাড়ালাম। আর অমনি বাচ্চাটা মায়ের কোল থেকে একটা ঝপাৎ ঝাঁপ দিয়ে পকাৎ করে দৌড়ে পালানো শুরু করল। ক্যাফেটা রাস্তার একদম পাশে। বেরোলেই সাঁই সাঁই গাড়ি। আমি পড়িমরি করে এক ছুটে বাচ্চাটার হাত ধরে ফেললাম। এবং সাথে সাথে ছেড়েও দিলাম। হাতে ভয়ংকর এক ক্যাঁক কামড় দিয়ে দিয়েছে বিচ্ছুটা। আমি চোখে সর্ষেফুল দেখছি এখন। ফুলের মাঝখানে আবার ছোট ছোট রঙ্গিন পাখি গোল হয়ে পিক্পিক্ স্বরে উড়ে বেড়াচ্ছে।

তবে স্বস্তির ব্যাপার, এর মাঝে বিচ্ছুটার মা দৌড়ে চলে এসেছে। আজকে এই পুঁচকে সিদ্ধার্থের আর গৃহত্যাগ করা হল না তাহলে। কিন্তু বিস্ময়ে মুখ হাঁ হবার দশা হল যখন ভদ্রমহিলা কোনরকম জড়তা ছাড়া চোস্ত জার্মানে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাচ্চার ছটফটানির জন্যে এক চোট দুঃখ প্রকাশ করে কাউন্টারে বিল চেয়ে টেবিলে ফিরে গেল। সেই সাথে চিরকালের অধৈর্য্য আমাকে যেন ধৈর্য্যের একটা বড়ি গিলিয়ে দিয়ে গেল ভদ্রমহিলা।

ক্যাফের দরজার দিকে তাকালাম। লতা বা এরকম কাউকে দেখা গেল না। ওদিকে আমার অতি সাধের ডোনার কাবাব তৈরি। ইশারায় আমাকে প্লেট নিয়ে যেতে ডাকা হল। আমি হাতের কামড়ে দেয়া লাল হয়ে যাওয়া জায়গাটা ডলতে ডলতে সামনে এগোলাম। ভালো কামড়ই দিয়েছে। পাঁচটা আর পাঁচটা, মোট দশটা দাঁত দিয়ে দুই দুইটা আধ খাওয়া চাঁদ এঁকে দিয়েছে এক চোটে।

চোট সামলানোর খুব বেশি সময় পেলাম না। পায়ের নিচের মাটি কেমন দুলে উঠল। ভূমিকম্প নাকি? নাকি একবারে কেয়ামত শুরু হয়ে গেল?একেবারেই অপ্রস্তুত আমি পা ওপরে দিয়ে চিৎপটাং হয়ে পড়ে যাচ্ছি। ক্যাফের ঝাঁড়বাতিটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আর পড়েই যখন যাচ্ছি, তখন আর ঝাঁড়বাতির সৌন্দর্য্য দেখে কি হবে। চোখ বন্ধ করে ফেলে মাটি আছড়ে পড়ার অপেক্ষায় নিজেকে সঁপে দিতে দিতে চরম অবিশ্বাস নিয়ে দেখলাম সেই দেড়ফুটি দাঁতাল বিচ্ছু কোমড়ে হাত দিয়ে দস্যু বনহুরের মত দাঁড়িয়ে আছে। মুখে দিগ্বিজয়ী হাসি। তাহলে যত দোষ এই ক্ষুদে নন্দ ঘোষের! আমার হাঁটু বরাবর তারই এক মোক্ষম ফ্রি কিকে এখন আমি ঘায়েল টালমাটাল হয়ে ফুটবলের মত উড়ে পড়ে যাচ্ছি।

কিন্তু না। কি যে হল বুঝলাম না। কে যেন খুব শক্ত হাতে খপ্ করে ধরে ফেলল। একেবারে মেঝেতে মাথা ঠুকে যাবার আগ মুহূর্তে। বিস্ময়ে মূক আমি আস্তে আস্তে পিটপিট করে চোখ খুলে দেখি, একি! মাথার ওপর নীল আকাশ। আর সূর্যের তীব্র সোনালি ঝিলিক। আমি কই?? পরাবাস্তব জগতটা ঠুস্ করে মিলিয়ে গেল কানে আসতেই, “ভয় নেই, আমি তো আছি।“ এবার ভালো করে চোখ মেলে দেখি, নীল আকাশ কই, এ তো নীল টুপি। আর সূর্যের ঝিলিকই বা কই, এ তো সোনালি চুলের ঝাঁপি। চোখ পর্যন্ত এসে হানা দিয়ে অন্ধ করে দিচ্ছিলো।

ঘোরটা কাটার সুযোগ না দিয়েই লতা আমাকে এক হাতে এক ঝটকায় দাঁড় করিয়ে দিলো। আরেক হাত তখনো ক্রাচে ভর দেয়া। সে যে কখন, কোত্থেকে, কিভাবে ছুটে আসল, কিছুই ভেবে পেলাম না। কিন্তু ঝাড়া ছয় ফুটের আশি কিলোর কাউকে হাতে ক্রাচ আর পায়ে প্লাস্টার নিয়েও যে অনায়াসে ধরে তুলে ফেলতে পারে সে যেমন তেমন মেয়ে না। নাম লতা হলেও এই মেয়ে অন্য ধাতুতে গড়া। ঠোঁটের কোনে নরম আলতো একটা হাসি নিয়ে লতা এবার বলল, “কেমন দারুন ধরে ফেললাম, বলেন তো?” আমার ভুত দেখা ভয় পাওয়া চেহারা তখনো স্বাভাবিক হয়ে আসে নি। উত্তর না দিয়ে আমি তীব্র দৃষ্টিতে লতার গহীন সবুজ চোখের দিকে বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছি।

(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০১৮ রাত ৩:০৮
১০টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাছে থেকে আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৪৬

আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

২০০১ সালের কথা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটা আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশ গ্রহণ করে আমার কোম্পানি টেকনিক্যাল অফারে উত্তীর্ণ হয়ে কমার্শিয়াল অফারেও লোয়েস্ট হয়েছে। সেকেন্ড লোয়েস্টের সাথে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সংস্কারের জন্য টাকার অভাব হবে না, ড. ইউনূসকে ইইউ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



বুধবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত ইইউর রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার এবং সফররত এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিসের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক পাওলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নারী বুকের খাতায় লিখে রাখে তার জয়ী হওয়ার গল্প (জীবন গদ্য)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৩২



বুকে উচ্ছাস নিয়ে বাঁচতে গিয়ে দেখি! চারদিকে কাঁটায় ঘেরা পথ, হাঁটতে গেলেই বাঁধা, চলতে গেলেই হোঁচট, নারীদের ইচ্ছেগুলো ডিমের ভিতর কুসুম যেমন! কেউ ভেঙ্গে দিয়ে স্বপ্ন, মন ঢেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×