বাইরে মিউনিখের মেঘলা দিন। যত্ন করে সাজানো গোছানো এই শহরটা সুন্দর। কিন্তু কেনো যেন আমার মন পড়ে থাকে আরেকখানে। বহুদূরের এলোমেলো আরেকটা শহরে। আমার প্রিয় শহর ঢাকায়। মিউনিখে আমার নিজেকে নির্বাসিত নির্বাসিত লাগে। রাম সীতাকে তপোবনে নির্বাসন দিয়েছিল। আর আমি পিএইচডি নামের এক গোলমেলে বস্তুকে উপলক্ষ বানিয়ে মিউনিখ তপোবনে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছি। আর নিয়েই বুঝতে পারলাম যে দূরত্ব ব্যাপারটা কত অদ্ভূত। দূরত্ব আর মায়া-এদের সম্পর্ক নাকি ব্যাস্তানুপাতিক। যত দূরে যাওয়া হবে, মমতার টান তত গাড় হবে। কথাটা বোধহয় সত্য। কারণ এই দুইয়ের প্যাঁচে পড়ে আমি কিছুটা হতবিহ্বল। কিন্তু এরকম তো হবার কথা না। ঢাকার কোটি মানুষের ভিড় থেকে বের হয়ে ইউরোপের একটা সেই রকম ঝকঝকে জায়গায় এসে দম ছেড়ে বাঁচার কথা। আমার বেলায় কেন যেন উল্টোটা হল। দম তো ছাড়তেই পারলাম না, বরং ইলিশ মাছের কাঁটার মত দম গলায় ভালোভাবে আটকে গিয়ে বসে থাকল। এখানে বাতাসে সীসা নেই, আকাশে ভারি কালো রঙের ধোঁয়া নেই। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম যে আমি আর শ্বাস নিতে পারছি না। মনে হল ঢাকার বাতাস ফুসফুসে নিতে না পারলে যেকোন সময়ে হাত-পা বাঁকা হয়ে যেখানে সেখানে পড়ে গাঁক গাঁক করতে থাকব। প্রায়ই আফসোস হতে থাকল কেন প্লাস্টিকের ব্যাগে গিট্টু দিয়ে একটু ঢাকার বাতাস নিয়ে আসলাম না। আজকের মত এরকম এক একটা মেঘ মেঘ দিনে যখন দম বন্ধ লাগে, তখন আস্তে করে প্লাস্টিকের ব্যাগটা খুলে প্রাণভরে শ্বাস নিয়ে আবার ব্যাগটা গিট্টু মেরে সযত্নে রেখে দিতাম ঘরের কোনায়। শুধু ঢাকা না, পুরো দেশের জন্যে বিচিত্র এক অঘোম মায়ার ঘোরে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আছি আজকে বছর দেড়েক ধরে। বেশ ভালো যন্ত্রণা!
সেদিন শনিবারে ঘরের কাছের সুপারমার্কেট থেকে টুকটাক কিনে ফিরছি। হঠাৎ চমকে উঠে থমকে গেলাম। একটা বাড়ির সামনের টবে লাগানো গাঁদা ফুল। আমার সারাজীবনের অপছন্দের ফুল। শুধু তাই না, গাঁদা ফুলকে আমি ডাকি “গাধা ফুল” বলে। সোনালি হলুদে মাখামাখি নির্দোষ একটা ফুলকে ঠিক কেন যে এত অপছন্দ, তার উত্তর আমি নিজেও জানি না। আর এখন সেই “গাধা ফুল” দেখে স্থানুর মত রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেছি। বছরের এই সময়টা মিউনিখ ছেয়ে যায় মারাত্মক সব রঙ্গীন ফুলে। তাকিয়ে দেখতে ভালো লাগে, কিন্তু আপন আপন লাগে না কেন যেন। আজকে গাঁদা ফুলগুলিকে দেখে মনে হল, আরে এই ফুল এখানে আসল কি করে। একে তো চিনি। বিদেশের মাটিতে অপ্রত্যাশিতভাবে পরিচিত লোকের সাথে দেখা হয়ে গেলে যেমন লাগার কথা, তেমন লাগল ফুলগুলিকে দেখে। বাকিটা দিন মাথার ভেতরে গাঁদা ফুলের ছবি নিয়ে ঘুরে বেরালাম। মনে মনে স্বীকার না করে পারলাম না দুরত্বের শক্তি কি প্রচন্ড।
গত নভেম্বরের কথা। রাত তখন চারটা। কাছের স্টেশন থেকে ট্রেন নিয়ে ঠিক পাঁচটায় পৌঁছাতে হবে সেন্ট্রাল স্টেশনে। নইলে বাকিরা আমাকে রেখেই রওনা দিয়ে দিতে পারে। আশ্চর্যের কিছু না। জার্মানদের সময়জ্ঞান বলে কথা। যাচ্ছি হমবুর্গ। হামবুর্গ না কিন্তু। সেখানের একটা ছোটখাট কনফারেন্সে। জায়গাটা যে জার্মানির বিখ্যাত হামবুর্গ শহর না, বরং তার থেকে অনেক ছোট মোটামুটি অখ্যাত একটা মফস্বল টাইপের জায়গা-এটা জানার পর আমার উতসাহে ভাটা পড়ে গেল। সেদিন এটা জানার পর সুপারভাইজারের দিকে এমনভাবে তাকালাম যেনো আমার সাথে সূক্ষ্ একটা প্রতারণা করা হয়েছে। সে জাতিতে তুর্কি। আমার আশাহত চেহারা দেখে বিরাট খুশি হয়ে ল্যাব কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে অ্যাবস্ট্রাক্ট সাবমিশনের তাগাদা দিয়ে আমাকে তুর্কি নাচনের উপর রেখে গেল। আরো মিইয়ে গেলাম শুনে যে বেশিরভাগ প্রেজেন্টেশন হবে জার্মান ভাষায়, যেহেতু এটা একটা ন্যাশনাল কনফারেন্স। যাই হোক, শীতের রাতের আরামের ঘুম হারাম করে পিঠের বোঁচকায় তিন দিনের কাপড়-চোপড় নিয়ে বেরোলাম ঘর থেকে। বোঁচকার নিজের ওজনই হবে দেড় কেজির মত। তার উপর কাপড়ের ভাঁজে আছে ল্যাপটপ, চার্জার ইত্যাদি। হাঁটতে গিয়ে মন হল এভারেস্ট বেয়ে উঠছি। এভারেস্টে ওঠার পথে যাত্রাবিরতি দিতে হয়। বাসা থেকে স্টেশন পর্যন্ত বিশ মিনিটের হাঁটা পথে মিনিট দশেক পর হ্যাংলা পটকা আমিও একটা যাত্রাবিরতি দিব দিব ভাবছি। রাস্তায় মানুষ তো দূরের কথা, একটা ভুতের বাচ্চাও নেই। আচমকা খেয়াল করলাম চারিদিকে একটা মায়াবী ঘোলাটে আলো। দেশে থাকতে পূর্ণিমা রাতে কারেন্ট চলে গেলে আমাদের ফুলার রোডের ক্যাম্পাস এলাকাটাকে ঠিক এরকম লাগত। মিউনিখ আর ঢাকা। একই চাঁদ। একই আলো। কিন্তু আমার কাছে বিরাট পার্থক্য লাগে। এখানের চাঁদের আলো সুন্দর ঠিকই, কিন্তু ল্যাম্পপোস্টের আলোর মত তীব্র। ল্যাম্পপোস্ট মার্কা চাঁদের আলোর প্রতি আমার তেমন আগ্রহ কাজ করে না। আমার ভাল লাগে রহস্য রহস্য গন্ধওয়ালা ঘোলাটে স্নিগ্ধ চাঁদ। এখানে আসার পর তাই আর পূর্ণিমার হিসেব রাখা হয় না। কিন্তু আজকে আকাশের দিকে না তাকিয়ে পারলাম না। অদ্ভূত ব্যাপার। সুকান্তের রুটির মত চাঁদ! একদম বাংলাদেশের চাঁদ! সাথে বোনাস হিসেবে হীরার কুচির মত ছড়ানো অসংখ্য তারা-নক্ষত্র। দেখে-শুনে আমি চন্দ্রাহত, নক্ষত্রাহত-সব কিছু হয়ে গেলাম। ক্লান্তি ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বাকিটা পথ হেঁটে যেতে থাকলাম প্রায় উড়ে উড়ে। পায়ের নিচে মিউনিখের পথ, কিন্তু আকাশে আজকে বাংলাদেশের চাঁদ। আমার নিজের দেশের চাঁদ।
যুদ্ধপ্রিয় আজকের নতুন পৃথিবীতে এমন কোটি কোটি মানুষ আছে যাদের দেশটা আর ঠিক নিজের দেশ নেই। সেদিক থেকে নিজেকে চরম সৌভাগ্যবান মনে হয়। আমার নিজের একটা দেশ আছে। বিদেশের পড়াশোনার পাট চুকিয়ে আবার ফিরে যাব সেই দেশে। কিন্তু এটাও জানি সেখানে চাকরি পাওয়া হয়তো সোনার হরিণ শিকারের মত দুঃসাধ্য হবে, স্বল্প আয় দিয়ে জীবন চালানো মুশকিল হয়ে যাবে হয়তো, হয়তো বা ট্রাফিক জ্যামে ঘন্টাখানেক ধরে আটকে পড়া রিকশায় বসে নিজের উপর রাগ হবে এই ভেবে যে ধুর, কেনো এই পোড়া দেশে ফিরলাম, কোন মানে হয়? কিন্তু এটাও জানি কোন এক পূর্নিমা রাতে আকাশজোড়া চাঁদের আলোর নিচে দাঁড়িয়ে মনে হবে, জীবনের সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছি ভয়াবহ সুন্দর এই দেশটায় ফিরে। আমার ধারণা মিউনিখে বসে আজকে আমি যেমন ভাবছি, নিউ ইয়র্ক, লন্ডনে বসে আমারো মত আরো অনেকেই একই কথা ভাবে। আমার খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে ভিনদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হাজারো তরুণ-তরুণী আমরা সবাই আজ না হোক কাল দেশে ফিরে যাব। যার সঞ্চয়ে যতটুকু নতুন জ্ঞান জমা হবে তাই দিয়ে দুর্নীতি আর দারিদ্রে জং ধরে যাওয়া খোলনলচে পাল্টে ঝাঁ চকচকে করে গড়ে তুলবো দেশটাকে। একাত্তরের পরের স্বাধীন দেশের স্বাধীন মাটিতে অনেকগুলি স্বাধীনচেতা নবীন হাত দিয়ে কি যাবে না আর একটা নতুন ইতিহাস গড়া? ছেলেমানুষী এই আশা নিয়ে একটা একটা করে দিন পার করে দিচ্ছি মিউনিখের তপোবনে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১২ রাত ২:৩৩