'জনগণ কেন আমার বিরুদ্ধে পেবে?'
'কারণ পূর্ব পাকিস্তানে পরাজয়।'
কিন্তু এ পরিস্থিতির জন্য তো রাজনীতিবিদরা দায়ী, আমি নই।
জনগণ এ জাতীয় ছল চতুরতা বা জটিলতা বোঝে না। কারণ তারা গড়পড়তা মুর্খ।
এসব বাকবিতণ্ডার মাঝে ট্রেনের কারণে এক ক্রসিংয়ে গাড়ি থামল। এমন নির্জন স্থানেও কিছু লোক ইয়াহিয়াকে দেখে চিনে ফেলল। তারা পাথর ছুড়তে শুরু করল। ঘটনার আকস্মিকতায় ইয়াহিয়ার মুখ ছাইবর্ণ হয়ে গেল।
এ রকমই ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন সরদার মুহাম্মদ চৌধুরী তার লেখা 'দি আলটিমেট ক্রাইম' বইটিতে। পাকিস্তানের সাংবাদিকদের মধ্যে একটা বড় অংশ মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে নিরপে থাকার চেষ্টা করেছেন। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা রাখার জন্য পাকিস্তানে তিরস্কৃতও হয়েছেন। এখানে পাকিস্তানি সাংবাদিকেরা মুক্তিযুদ্ধকে কীভাবে দেখতেন- তা তুলে ধরা হলো।
বিগ্রেডিয়ার এ আর সিদ্দিকী
বিগ্রেডিয়ার এ আর সিদ্দিকী ৭১ সালে ছিলেন আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ দফতরের পরিচালক। ১৯৭৫ সাল থেকে ২২ বছর তিনি ছিলেন 'ডিফেন্স জার্নাল' পত্রিকার প্রকাশক ও প্রধান সাদক। তার দৃষ্টিতে ২৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিদেশি সংবাদদাতাদের বহিষ্কার করা ছিল বিরাট বড় ভুল। তিনি টাইম ম্যাগাজিন, ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, সিনহুয়া, রয়টার্স, নিউইয়র্ক টাইমস'র কয়েকজন সাংবাদিককে নিয়ে উপদ্রুত এলাকা ঘুরিয়ে দেখান। তারপর তাদের দেশত্যাগ করার অনুরোধ করেন। তিনি মিডিয়া সেলে নিয়োজিত ছিলেন।
রোয়েদাদ খান
১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন পাকিস্তানের তথ্যসচিব। কিন্তু ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা যে অভিযানে নামবে তা তিনি নিজেই জানতেন না। ৭১'র ২৫ মার্চে তিনি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ছিলেন। কায়সার রশিদ তার ঘনিষ্ট বাংলাদেশি বন্ধু ছিলেন। ওইদিন কায়সার রশিদ রোয়েদাদ খানকে ডিনার খেতে নিয়ে যান মগবাজারের ইস্পাহানির বাড়িতে। ওখানে ইস্পাহানির বাড়িতে বেশ ক'জন বিদেশি সংবাদিকও নিমন্তিত ছিলেন। হঠাৎ সেই আসরে টেলিফোনের রিং বাজতে কে একজন বললেন, আমি অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের লোক। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে রোয়েদাদ খানের সর্বশেষ ঢাকায় দেখা হয় ২৩ মার্চ। অথচ ইয়াহিয়া খান সেদিন ইশারায়ও জানাননি যে, আলাপ আলোচনা সত্যিকার অর্থেই ভেঙে গেছে।
তাহেরা মাযহার আলী
তাহেরা মাযহার আলী পাকিস্তানের এক সময়ের অন্যতম সাংবাদিক 'ডন' পত্রিকার সাদক মাযহার আলীর ী ও বিশ দশকের অন্যতম ছাত্রনেতা তারেক আলীর মা। তাহেরা মাযহার আলী মনে করেন, ৭১ সালে পাকিস্তান টাইমস'র নিয়ন্তণ সরকারি হাতে তুলে নিয়ে ভুল করেছিলেন আইয়ুব খান। সে সময় তার স্বামী মাযহার 'ডন' পত্রিকাতে ১২টি নিবন্ধ লিখেছিলেন। এ নিবন্ধ লেখার ফলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তার ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছিল। তাহেরা মাযহারের ছেলে তারেক জিয়াউল হকের বিরুদ্ধে ও বাংলাদেশের পক্ষে কলম ধরেছিলেন।
এনবি নকভী
এনবি নকভী দীর্ঘকাল ধরে সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত। এক সময় ঢাকার 'মর্নিং নিউজ' পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে শুধু কলামই লেখেন। তার মতে, ৭১-এ পূর্ব বাংলায় আসলে কী ঘটেছিল তা পশ্চিম পাকিস্তানিরা জানত না, সে কারণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সেখানে আত্মসর্ণের খবর শুনে তারা মর্মাহত হয় বলে যে দাবি করা হয় তা সত্যের অপলাপ। তখনও বিবিসি, অল ইন্ডিয়া রেডিও, রেডিও কাবুল, ইরান ছিল। আসলে সবাই কিছু না কিছু খবর রাখত। পাঞ্জাবি বহু পরিবারের কাছেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে মানি অর্ডার আসত। আসলে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর লোকেরা যাচ্ছেতাই ন্যাক্কারজনক কাজ করেছেন। যে কোনও বিবেচনায় এ বাহিনী ছিল দুর্নীতিগ্রস্থ। তাদের অপরাধে নারী ধর্ষণও বাদ থাকেনি। জেনারেল টিক্কা খানের ভাষ্য অনুযায়ী, 'মাত্র ৩ হাজার ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে পূর্ব পাকিস্তানে।'
আই এ রহমান
আইএ রহমান পাকিানের একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক। চাকরি জীবনে নানারকম নিগ্রহ সহ্য করতে হয়েছে তার। ১৯৭০'র সাধারণ নির্বাচনের পর শেখ মুজিবুর রহমানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর থেকে ভুট্টো তার সঙ্গে দরকষাকষির আলোচনায় বসতে চাইলে আই এ রহমানসহ বেশ ক'জন সাংবাদিক পত্র-পত্রিকায় নির্বাচনী রায় মেনে নেয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টির কথা বলেছিলেন। তখন তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়। চাকরি হারানোর জন্য সাংবাদিক ধর্মঘট করেছিলেন তারা।
মিনহাজ বার্না
মিনহাজ বার্না ৭১ সালে কিছুদিন ঢাকায় ছিলেন। তিনি পাকিস্তানের সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা। ১৯৬৯ সালে ফেডারেল প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে কেজি মুস্তাফা সভাপতি নির্বাচিত হন। মিনহাজ বার্না সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ৭১ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে লাহোরের পিএইউজে'র সভাপতি কেজি মুস্তাফাকে দাওয়াত দেয়ার জন্য এক সভায় মিনহাজ বার্না ঢাকা আসেন। ঢাকা এসে তিনি দেখেন বিমানবন্দর ফাঁকা। তিনি কেজি মুস্তাফা ও এনায়েতউল্লাহ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেখান থেকে ফিরে তিনি পাকিস্তান টাইমসে লেখালেখি করলে চাকরি হারান। পাকিস্তান টাইমসে বরখাস্থ সাংবাদিকদের পরিবর্তে জামায়াত ও অন্য জনপন্থী সাংবাদিকদের নিয়োগ করা হয়। তখন জামায়াতে ইসলামীর পত্রিকাগুলো যেমন- জিন্দেগী, জাসারাত সরকারের দালালি করত।
সুহাইল জহীর লারী
সুহাইল জহীর লারী ৭১ সালে সান পত্রিকার ফটোসাংবাদিক হিসেবে বাংলাদেশে আসেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজা ত্রিদিব রায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য এসেছিলেন। ঢাকায় পৌঁছে তিনি গভর্নর হাউসে যান। সামরিক সচিব তখন ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণ শুনছিলেন। কিছুণ পরই দেখা গেল লোকজন জোরে পোগান দিচ্ছে এবং গভর্নর হাউজের গেটে উপস্থিত হয়েছে।
সুহাইল জানিয়েছেন, '···রাও ফরমান আলীর অধীনে কর্মরত এক ব্রিগেডিয়ারকে তিনি যখন জিজ্ঞেস করেছিলেন আপনারা কেন গুলি চালাচ্ছেন, তখন সেই ব্রিগেডিয়ার বলেছিলেন, কেবল ফাঁকা গুলি ছুড়ছি।' এ রকম নানা বাকোয়াজিতে আমরা অনেকেই বিভ্রান্ত ছিলাম। যেমন ইয়াহিয়া খান ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমপর্ণের আগের দিন এক বেতার ভাষণ দেন। তাতে তিনি বলেন, আমরা হারা যুদ্ধে জিতেছি। আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাব। এ রকম কিছু কথা। পাকিস্তানি জনসাধারণ তো সে বক্তৃতা শুনে মহাখুশি। সাধারণ মানুষের মধ্যে যারা বিবিসি'র খবর শুনত তারাই সেদিন শুধু বুঝতে পেরেছিল, যুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হয়েছে। যুদ্ধে যে কলঙ্কজনক পরাজয় ঘটেছে বেশিরভাগ জনগণ তা আদৌ জানত না। তারা জানত, বিবিসি যা বলছে তা ডাহা মিথ্যা।
আহমদ সেলিম
পূর্ব পাঞ্জাবের একজন জনপ্রিয় কবি আহমদ সেলিম। পেশাগত জীবনে প্রগতিশীল সাংবাদিক। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি প্রর্দশনের কারণে সামরিক আদালত কর্তৃক দণ্ডিত হন। শাহ হুসেন পাকিস্তানের এক বড় কবির নাম। তিনি ১৬ শতকের মোগল আমলের কবি। তার এক বন্ধুর নাম ছিল মধু। তার নামের কথা মনে রেখে আহমদ সেলিম কবিতার প্রথম চরণ লিখেছিলেন এভাবে- ' শাহ হুসেন দেখো তোমার মধু খুন হয়েছে বাংলায়।' ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় শাহ হুসেনের মাজারের দিকে যাচ্ছিলাম। আমি আমার বন্ধুদের বলি, এবারে মাজারে (ওখানে) নাচব না। খালি পায়ে সেখানে যাব এবং বাংলাদেশে আমাদের ভাইদের নিরাপত্তার জন্য মোনাজাত করব। কিন্তু তারা বলল, ব্যাপারটা ওই অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। তাই আমরা ওভাবে মাজারে যাব না। যা হোক, মাজারেই লিখি কবিতাটি। আমার মনে তখন শাহ হুসেনের বন্ধু মধুর কথাই ছিল। কিন্তু আমি যখন পড়লাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মধু নামের এক লোক ছিল, সে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ক্যান্টিন চালাত। আর তাকে ২৫ মার্চ রাতে মেরে ফেলা হয়। এ এক কাকতালীয় ব্যাপার হয়তোবা। কিন্তু আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়েছিলাম। এর একমাস পর আমি গ্রেফতার হই। শেখ মুজিবুরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ ছিল পাঞ্জাব থেকে সেই একই অভিযোগে আটক আমিই ছিলাম একমাত্র ব্যক্তি। অভিযোগের বক্তব্য ছিল, আমি ছিলাম নাকি একজন বিশ্বাসঘাতক, ভারতীয় এজেন্ট, পাকিস্তানের এজেন্ট।
খালেদ আহমদ
খালেদ আহমদ বর্তমানে লাহোর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক 'ফ্রাইডে টাইম'র সাদক। তার মতে, পাকিস্তানে ইংরেজি সংবাদপত্রের পাঠক খুবই সীমিত। উল্টোদিকে উর্দু সংবাদপত্র মানুষ বেশ পড়ে। উর্দু সংবাদপত্রের সবচেয়ে বড় অসুবিধা খবরা-খবরের উপাত্ত খুবই কম। কিন্তু বেশি মানুষ পড়ে বলে এক ধরনের জনমত তৈরি করতে পারে। খালেদ আহমদ মনে করেন, উর্দু সংবাদপত্র রাজনৈতিক স্বার্থে প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকাও পালন করে। তাহেরা মাযহার আলী পাকিস্তানের মা চাওয়ার কথা যখন তোলেন তখন বাস্তবিক অর্থেই তা করতেও যান। কোথাও হয়তো তারা করেও থাকেন। সেই তাকেই পাকিস্তানি উর্দু সংবাদপত্র ধিকৃত করেছে। এটা অন্যায়। এখনও অনেক পাকিস্তানি রয়েছেন যারা মনে করেন, বাংলাদেশের সঙ্গে অতীতে ভালো ব্যবহার করা হয়নি। এজন্য বাংলাদেশের কাছে প্রকাশ্যে মাফ চেয়ে সৌহার্দ্য পূর্ণ সর্ম্পক গড়ে তোলা উচিত।
(বিস্তারিত পড়ূন, মুনতাসির মামুন ও মহিউদ্দিন আহমদ সাদিত 'পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে একাত্তর' বইটি)।
উল্টোদিকে পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সংবাদপত্রে কীভাবে বিষয়গুলো এসেছে- এখানে তা তুলে ধরা হলোঃ
'···১০ জানুয়ারি পাকিস্তনের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ঢাকায় ফিলে আসেন শেখ মুজিবুর রহমান। ওইদিন রমনার রেসকোর্স ময়দানে ক্রন্দনরত অবস্থায় শেখ মুজিব বলেন, 'বিশ্বকে মানবেতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি নিরপে আন্তর্জাতিক দল এই বর্বরতার তদন্ত করুক- এটাই আমার কামনা' (দৈনিক বাংলা-১১-১-৭২)
তিনি ১৪ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ অফিসে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতিশোধ গ্রহণের পথ পরিহার করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'দালালদের অবশ্যই দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দেয়া হবে।' (পূর্বদেশ, ১৫/১/৭২)
৬ ফেব্রুয়ারি কলাকাতায় এক সমাবেশে তিনি বলেন, 'যারা গণহত্যা চালিয়েছে তারা সমগ্র মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে। এদের মা করলে ইতিহাস আমাদের মা করবে না।' (দৈনিক বাংলা, ৭/২/৭২)
১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর একটি আকস্মিক সরকারি ঘোষণায় দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত এবং বিচারাধীন সকল আটক ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির প্রতি সাধারণ মা ঘোষণা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী এই দালালদের দেশগড়ার কাজে সামিল হবার জন্য আহ্বান জানান।
১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে মতাসীন হন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার প্রথম কাজ ছিল সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেতা বাদ দেয়া। ফলে ৭১-এ বাঙালি হত্যার নেতৃত্ব দেয়ার কারণে যে সমস্ত দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল সেগুলি পুনরুত্থিত হওয়ার সুযোগ পায়। যাদের রক্তে স্বাধীন হয়েছিল এই দেশ তাদের খুনিরা এদেশে রাজনীতি করার হারানো অধিকার ফিরে পায়। ইতোপূর্বে '৭৬ সালের প্রথম দিকে একটি বিশেষ মহল থেকে বাংলাদেশ ইসলামী প্রজাতন্ত ঘোষণা এবং পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। এই দাবির স্বপক্ষে ১৯৭৬ সালের মার্চে এয়ারভাইস মার্শাল মোহাম্মদ গোলাম তওয়াব এবং গোপনে সংগঠিত জামায়াতে ইসলামী এক গণ-জমায়েত ও বিক্ষোভের আয়োজন করে। (সাপ্তাহিক বিচিত্রা- ২৫ সংখ্যা/০৩ নভেম্বর'৮৪)
৭১'র ডিসেম্বরে দৈনিক বাংলা পত্রিকায় 'সেই তিন শয়তান কোথায়' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। দৈনিক আজাদে ৭/৫/৭২ তারিখে মাওলানা মান্নানের ছবি ছেপে 'এই নরপিশাচকে ধরিয়ে দিন' শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ৫ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখের দৈনিক পূর্বদেশে 'গণহত্যার ঘৃণ্যনায়ক শর্ষিণার পীর গ্রেফতার' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। ২০ ডিসেম্বর ৭১ সালে দৈনিক বাংলায় কালো বর্ডার দেয়া হেডিংয়ে মোটা হরফে লেখা একটি আবেদনে বলা হয়- 'জামাতে ইসলামীর বর্বর বাহিনীর নিষ্ঠুরতম অভিযানে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের অসংখ্য লাশ এখনও সেইসব নারকী বধ্যভূমিতে শনাক্তহীন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এরা শনাক্তের অযোগ্য হলেও লাওয়ারিশ নন। এরা শহীদ। এরা অমর।'
২৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে দৈনিক আজাদে একটি প্রতিবেদনের হেডিং ছিল এমন- 'আর এক সপ্তাহ গেলেই ওরা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের সবাইকেই মেরে ফেলত- বদর বাহিনীর মাস্টার প্ল্যান।'
আলবদর বাহিনীর উৎপত্তি সর্কে একটি চমৎকার দলিল হতে পারে ১৪/৯/৭১ সালে জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত 'আলবদর' নামের একটি ফিচার। এই ফিচারে লেখা হয়- '···আলবদর একটি নাম। একটি বিস্ময়। আলবদর একটি প্রতিজ্ঞা। যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী, আলবদর সেখানেই। যেখানেই দুষ্কৃতিকারী, আলবদর সেখানেই। ভারতীয়দের কিংবা দুষ্কৃতকারীদের কাছে আলবদর সাক্ষৎ আজরাইল।'
বুদ্ধিজীবী হত্যার নায়ক জেনারেল রাও ফরমান আলীর ডায়েরীতে উল্লেখ পাওয়া যায় দু’জন আমেরিকান নাগরিকের নাম। এরা হলেন হেইট ও ডুসপিক । এদের নামের পক্ষেছোট ছোট অরে ইউএসএ ও ডিজিআইএস লেখা ছিল।
হেইট ও ডুসপিক কে? ঢাকার দৈনিক বাংলার রিপোর্টে এদের সম্পর্কে বলা হয়। হেইট ১৯২৮ সালে জন্মগ্রহণ করে। সে ১৯৪৬-৪৯ পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে চাকরি করত। ১৯৫৩ সাল থেকে সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ১৯৫৪ সাল থেকে সে আমেরিকান দূতাবাসের রাজনৈতিক কূটনীতিবিদ হিসেবে বহুদেশ ভ্রমণ করেছে। সিআইএ'র এজেন্ট ডুসপিকের সঙ্গে ঢাকা সফর করে এবং রাও ফরমান আলীর সঙ্গে তিন হাজার বুদ্ধিজীবীর একটি তালিকা করে।
জেনারেলের শোবার ঘরে এই তালিকা ছিল-
১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর ঢাকার জামায়াতে ইসলামীর সাদক প্রকাশিত এক প্রচারপত্রের ভাষা ছিল- 'বিদেশ আমাদের বন্ধুরা আছেন। চীন ও আমেরিকা আমাদের সমর্থক বন্ধুদেশ।'
উল্লেখ্য, রাও ফরমান আলীর ডায়েরীতে যে দু'জন সিআইএ এজেন্টের নাম পাওয়া গিয়েছিল তারা ইন্দোনেশিয়াতে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেছিল এবং ইন্দোনেশিয়া সরকার সেজন্য তাদের অনুপস্থিতিতে বিচার করেছিল।
২১ ডিসেম্বর ৭১ সালে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বৃটেনের সাবেক মন্ত্রী জন স্টোন হাউস বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ক্যাপ্টেন থেকে জেনারেল পদমর্যাদার ১০ জন সামরিক অফিসারকে তিনি চিহ্নিত করতে পারবেন।
তিনিও কি মি· হেইটও ডুসপিককে সেদিন সন্দেহ করেছিলেন এবং রাও ফরমান আলীর সঙ্গে তাদের গোপন মিশনের কথাই ইশারা-ইঙ্গিতে বলেছিলেন- কে জানে!