ছেলেটা আমার একটু সামনেই প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে তার শাস্তি ভোগ করছে। বয়স আনুমানিক ৮-১০ বছর। হাতে ছোট একটা বালতি, বালতিতে সেদ্ধ ডিম, ঝাল-লবন, কাটা পেপার। তার চোখ ছলছল করছে, অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকে রেখেছে। তার লাল আধময়লা হাফ হাতা শার্টের পেটের কাছে একটা বুতাম নেই, গোড়ালির কাছে ছেঁড়া রংচটা পুরানো জিন্সের প্যান্ট পরা, কিন্তু পা খালি। এক হাতে ডিমের বালতি হাতে নিয়ে অন্য হাতে বাসের সিট ধরে আদ্র চোখে জড়ানো কন্ঠে একটু পরপর তার পাশে বসে থাকা দাড়িওয়ালা ভদ্রলোককে বলছে, স্যার, ভুল হইয়া গেছে, মাফ কইরা দ্যান। ভদ্রলোক যেন এইসব কানেই তুলছেন না, জাগতিক কোন শব্দই যেন তার কানকে স্পর্শ করছে না। তার হাতে কাগজে মোড়ানো একটা সেদ্ধ ডিম, তিনি সেটা খাচ্ছেনও না, হাতে নিয়ে বসে আছেন আর একমনে জানালা দিয়ে শেষ বিকেলের নৈসর্গিক দৃশ্য দেখছেন।
ঘটনার সূত্রপাত এরকম, আম্মু আর আমি বিকেলের বাসে বরিশাল থেকে ঢাকায় ফিরছি। বাসায় ফিরতে বেশি রাত হয়ে যাবে ভেবে বাসস্ট্যান্ড এসেই যখন তৎক্ষণাৎ মোটামুটি মানের একটা বাস পেয়ে গেলাম তখন বিলম্ব না করে টিকেট কেটে বাসে উঠে বসলাম। বিকেলের বাস তাই কিছুকিছু সিট এখনো ফাঁকা। বাস মস্তফাপুরে আসার পরে ছেলেটা বাসে উঠলো "ওই ডিম দশ, সেদ্ধ দশ, গরম দশ" বলতে বলতে। আমরা বাম পাশের সিটে বসা, ডান পাশের দুই সিটের একটা ফাঁকা জানালার পাশের অন্যটায় ভদ্রলোক বসা। ভদ্রলোকের বয়স মাঝারি, পাঞ্জাবি পরা মাথায় টুপি।
- ডিম কি দেশি মুরগির? দেশি হইলে দে তো।
- এইগুলান সব দেশি মুরগারই ডিম, কয়ডা দিমু কন?
- আগেই তোরে বইরা রাখি, ডিম ফার্মের হইলে কিন্তু আমি নিমু না। দেশি হইলে একটা দে।
- ডিমের সাইজ দেইক্কা বুঝেন না? হাঁসের ডিমও আছে, মুরগার ডিমও আছে, হাঁসেরডা ১৫ টাকা। কোনডা দিমু?
- হাঁসের লাগবে না, মুরগিরই দে। সাইজ দেইখা কি ডিম চেনা যায়? খোসা ছড়া তাইলে বুঝবোনে ডিম দেশি নাকি ফার্মের।
ডিমের খোসা ছড়িয়ে বালতির হাতলে বাঁধা সুতো দিয়ে ডিমের মাঝ বরাবর কেটে ঝাল-লবন দিয়ে পেপারে মুড়ে ভদ্রলোকের হাতে দেবার পরেই জালিয়াতি ধরা পরলো।
- ঐ ছ্যামরা, এইডা দেশি মুরগির ডিম? এই বয়সেই ভাঁওতাবাজি শিখছোস? থাপড়াইয়া দাঁত ফালাইয়া দিমু। তোরে কইছিনা ফার্মের হইলে দিবি না? ডিম চেনাস আমারে? তুই চিনোস আমারে?
আশেপাশের অনেকেই এদিকে তাকাচ্ছে। হয়তো মজার কোন কান্ড ঘটতে যচ্ছে সেটা দেখার লোভে, অথবা ভদ্রলোকের উচ্চারিত শেষের বাক্যটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সে কোন পরিচিত মুখ কিনা সেটা দেখার জন্য। আমিও একটু ভাল ভাবে নজর দিলাম, কিন্তু চিনতে পারলাম না। ভদ্রলোক কাগজে মোড়ানো ডিমটা সামনের সিটে বসা আরেকজনের সামনে ধরে বললেন, দেখছেন ভাই, ডিমের কুসুম সাদাইট্টা। এইটুকু পোলা এহনি মানুষ ঠকানো শুরু করছে। বড় হইয়া কি হইবে আল্লাহই জানে। এই দেখেন, ডিম এক সাইড দিয়া কাটছে যেন ধরতে না পারি। বাইছা বাইছা দোকান থিকা ছোট ছোট ডিম আনে যেন দেশি মনে হয়। সবাইরে তো এমনেই ঠকায়, আমারেও ঠকাইতে আসিছে।
শেষ কথা গুলো বলার সময়ে একটু গর্বের হাসিও হেসে নিলেন। ডিম চিনতে পারার গর্ব।
সাধারণ দেশি মুরগির ডিম বয়লার বা লেয়ারের তুলনায় আকারে কিছুটা ছোট হয়। দেশি মুরগির ডিমের ভেতরে কুসুম হয় গাড়ো হলুদ, যা ফার্মের মুরগির ডিমের ক্ষেত্রে হয় হালকা হলুদ, একটু সাদাটে।
ছেলেটা তীব্র প্রতিবাদ করে বললো এইসব দেশি মুরগিরই ডিম। দোকানদার তাকে সেটাই বলেছে।
- আবার দোকানদারের দোষ দেও, না? এই বয়সেই মিথ্যা কথা বইলা মানুষ ঠকাইতে শিখছোস, এই গুলাই তো বড় হইয়া ডাকাইত হয়। নে, তোর দিম ফেরত নে। আমি ফার্মের ডিম খাই না।
- দোকানদারের তোন তো প্রত্যেকদিনই ডিম আনি, হে তো দেশি মুরগার ডিমই দেয়, আপনে কন ফার্মের ডিম। ডিম ফেরত নিয়া কি করমু, আপনে টাকা দিয়া দ্যান, নাইমা যামু।
- এত্ত সোজা, ডিম ফেরত নিলে নে নাইলে দাঁড়াইয়া থাক। দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া ফরিদপুর পর্যন্ত যাবি, তারপরে ডিমের দাম পাবি। এইটা তোর শাস্তি। এর আগে ডিমের দাম চাইলে থাপড়াইয়া দাঁত ফালাইয়া দিবো।
আশেপাশে লোকজন বেশ মজাই পাচ্ছে। অনেকেই ভদ্রলোকের সাথে একমত। সামনে বসে থাকা অতি উৎসাহী একজন বলা শুরু করলেন।
- একদম ঠিক কাজ করছেন হুজুর। এই হারামির বাচ্চারা এইভাবেই সবাইরে ঠকায়। এইগুলোর তো জন্মেরও ঠিক নেই। এইগুলোকে এইভাবেই শাস্তি দেয়া উচিৎ।
- হ ভাই, আমি তো আগেই জানতাম এইগুলা ফার্মের ডিম। দেশি মুরগির ডিমের হালি হইলো গিয়া ৪০ টাকা। সেই ডিম কিন্না সেদ্ধ কইরা তো আর ৪০ টাকা হালি বেচবে না।
আরেকজন ছেলেটাকে কিছুক্ষণ ধমকটমক দেয়ার পরে শুরু করলেন না না উপদেশ দেয়া।
একটা জিনিস খুব খটকা লাগা শুরু করলো। আচ্ছা লোকটা যদি আগেই ধারনা করে থাকে যে এইসব দেশি মুরগির ডিম না, কারন দাম কম। তাহলে সে এই ডিম কেন কিনলো? এবার কেন যেন মনে হতে লাগলো লোকটা আসলে ছেলেটাকে নিয়ে খেলছে না তো? ছেলেটাকে শাস্তি দিয়ে লোকটা আনন্দ পাচ্ছে, সে একা নয় অনেকেই পাচ্ছে। এ এক পৈশাচিক আনন্দ।
প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট হয়ে গেল। সূর্য পশ্চিমাকাশে আজকের মতো বিদায় নেবার পূর্বে শেষ বারের মতো মেঘের মধ্য থেকে মাথা বের করে তার কুসুম বর্ণ রুপ দেখাবার জন্য উকি দিলো। পাঠক বুঝতেই পারছেন আন্তঃনগর বাস গুলো হাইওয়ে ধরে পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে ছুটে কতদূর যেতে পারে। বাস চলছে তো চলছেই, কোথাও থামার মতো সময় নেই তার। ছেলেটা সেই আগের যায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমদিকে সে কিছু বলার সাহস করেনি থাপ্পড়ের ভয়ে। এখন আর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ভয়ে ভয়ে মাফ চাইতে শুরু করেছে সে ভদ্রলোকের কাছে। আশেপাশের সবাই এখন নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। নাটকের মজার দৃশ্য শেষ। পিছনের সিটের দুই ভদ্রলোক কি নিয়ে যেন নিজেদের মধ্যে বেশ হাসাহাসি করছেন। সামনের সিটের সেই ভদ্রলোক, যিনি ছেলেটাকে নানা উপদেশ দিলেন, তিনি ইয়ারফোন কানে গান শুনছেন। কিছুক্ষণ আগে বাসের কন্টাক্টর এদিক দিয়ে পিছনে যাবার সময়ে ছেলেটাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এই তুই এইখানে দাঁড়াইয়া আছিস কেন? কই যাবি। পরক্ষণেই যখন বালতিটা চোখে পরলো তখন বললো, ও ডিম বিক্রি করিস। তা দাঁড়াইয়া আছিস কেন? নেমে যা, যা। ছেলেটা ভয়ে ভয়ে একবার কেবল চোখ তুলে তাকালো। কিছু বলতে পারলো না।
এতক্ষণে অনেকদূর চলে এসেছে ছেলেটা। হয়তো ফিরে যেতে খুব বেশি সমস্যা হবেনা তার। রাস্তায় রাস্তায়ই তো ওদের জীবন। আমি ভাবছি অন্য কথা। এতক্ষণ সে একটা ডিমও বিক্রি করতে পারলো না। ওর বয়সি গ্রামের ছেলেরা এখন খেলা শেষ যার যার বাড়ি ফিরে যাবে। সন্ধ্য করে বাড়ি ফেরার জন্য অনেককেই তাদের বাবা-মায়ের কাছে আদর মাখা বকা খেতে হবে। সন্ধ্যায় হাত-মুখ ধুয়ে পরেরদিন স্কুলের জন্য পড়া তৈরি করায় ব্যস্ত হয়ে উঠবে। এই ছেলেটা সেই সুযোগ পাচ্ছে না। পরিবারের দুপয়সা বারতি আয়ের জন্য সে বালতি হাতে ছুটে যাচ্ছে এই বাস থেকে ওই বাসে। এখানে ওখানে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে পৃথিবীর নির্মমতা প্রত্তক্ষ করে বড় হচ্ছে। এই ৮-১০ বছর বয়সেই সে যুদ্ধে নেমেছে। বেঁচে থাকার যুদ্ধে ক্ষুদ্র সৈনিক সে।
ছেলেটাকে আসতে করে কাছে ডেকে নাম জিজ্ঞেস করলাম। হাতে ডিমের দাম ধরিয়ে দিয়ে বললাম, দরজার কাছে যাও, সামনে যেখানে বাস স্লো করবে সেখানে নেমে যেও। সে আমার জন্য একটা ডিম উঠালো তার ছোট বালতি থেকে। বললাম, ডিম লাগবে না, আমি ঐ লোকের ডিমের দাম দিয়ে দিলাম তুমি চলে যাও। অবাক হলাম যখন সে আমার কাছথেকে ডিমের দাম নিতে অস্বীকার করলো। লক্ষ করলাম তার ভেতরে আত্মমর্যাদাবোধ প্রবল। হয়তো আমার দেয়া টাকাটা সে দয়া হিসেবে দেখছে তা নিতে অস্বীকার করছে। বাধ্য হয়েই বললাম উনি আমার পরিচিত তাই আমি দাম দিয়ে দিচ্ছি।
সন্ধ্যা হয়েছে প্রায় ঘন্টা খানেক হলো। বাইরে বেশ অন্ধকার। বাসের ভিতরের বড় লাইট গুলো নিভানো, কেবল মাথার উপরে নীল আলো জ্বলছে। রহস্যময় নীলাভ পরিবেশ বাসের ভিতরে। ছেলেটা চলে যাওয়ার পর থেকেই আড়চোখে দাড়িওয়ালা ভদ্রলোককে লক্ষ করছিলাম। ডিমটা সে এখনো হাতের মধ্যে ধরে আছে। কাগজে মোড়ানো ঝাল-লবন দেয়া ডিম। হটাৎ একসময় লক্ষ করলাম সে কাগজ খুলে ডিমের একটা টুকরো হাতে তুলে নিলো, মুখে দিয়ে চিবোচ্ছেন সে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫১