দুপুর ২ টা ৪৭ মিনিট -
জানালা খুলা। মাথার উপর ফ্যান একটু আধটু শব্দ করে ঘুরছে। খুব যত্নের কোলবালিশটিও একটু দূরে সরিয়ে রেখেছি। চোখের নোনতা জলের সাক্ষী হয়ে থাকা বালিশটিও পায়ের প্রায় কাছাকাছি জায়গায় অবস্থান করেছে। দু-পা দু'দিকে ছিটিয়ে উবু হয়ে শুয়ে আছি। বিছানার চাদরও আমাকে দেখে লজ্জায় মুখ সরিয়ে নিতে চাইছে। বিড়বিড় করে কি সব বলে চলছি। আমি পুরাপুরি ঘুমও নই আবার জাগ্রতও নই। মাথা অচল হয়ে আসছে। পুরাতন কিছুই মনে পড়ছে না (!) উঠে পড়েছি এবার। আর কত ?
ছোট বোনটার কথা ভাবছিঃ
আজকাল আমাকে সে ভয়ংর রকম ভয় পাচ্ছে। আগে রাফিয়া বলে দু'একবার ডাক দিলেও কোন সাড়া শব্দ পেতাম না। কিন্তু ইদানিং এক বার ডাক দিতেই তড়িঘড়ি করে ছুটে আসে। খুব চিন্তিত হয়ে চোখ মুখ গোলাপী বর্ণের করে জিজ্ঞেস করে- "আমাকে ডাকছেন ?" আমি কিছু না বলেই গলার স্বর উঁচু করে বলি- এত বার ডাকতে হয় ?
আমি শুনি নাই।
এই দিকে এসে পাশে শুয়ে থাক।
আমি স্কুলের পড়া শিখছি। আম্মু বকা দিবে।
না। কেউ কিচ্ছু বলবে না। এইদিকে এসো।
সে চুপচাপ কাছে এসে শুয়ে পড়ে।
জগতে এই ছোট একটি মানুষকে আমি নিজের চেয়েও বেশী ভালবাসি। কখনো তা বুঝতেই দিই না। এই জগতে কাউকে কিছু বুঝতে দেওয়াটা বড় রকমের পাপ। বাবা-মাকে কতটা ভালবাসি, বন্ধুদের কতটা ভালবাসি, আশেপাশের প্রতিটি মানুষকে কতটা ভালবাসি তা বুঝতে দিতে নেই। মাত্র ৬ বছর বয়স তাকে বুঝতে দিলেও কি এমন সমস্যা ? কি বা লাভ অত রাগ দেখিয়ে ? নিষ্পাপ বোনটাকে এভাবে বকা বকি করার কোন মানে হয় ?
প্রশ্নগুলো হঠাৎ উঁকি দিয়ে যায়। পরক্ষণেই বোনকে বলি-
মনি আমি তোমাকে বেশী আদর করি তুমি কি তা জান ?
হু।
কিভাবে জান ? আমি তো তমাকে বেশী বকাঝকা করি। সে চুপ করে শুয়ে থাকে। তুমি আমাকে আদর কর ?
হু।
আমি তোমাকে বেশী আদর করি নাকি তুমি আমাকে বেশী আদর কর বল তো ?
আমি।
না ... আমি বেশী আদর করি। বড় হয়ে যাও। বুঝতে পারবে।সব কিছু ঠিকঠাক মত বুঝতে পারার জন্য একটি নির্দিষ্ট বয়স আছে। সেই বয়সে তুমিও হয়তো বুঝতে পারবে।
ভাই বোনের এভাবেই কথোপকথন চলে বেশ কিছুক্ষণ। কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে সে ঘুমিয়ে পড়ে। তার এক হাত আমার বুকের উপর। আমি তাকে বুকে জড়িয়ে পড়ে থাকি। আমার চোখে পানি ভর করে। ঠোঁট কাপায়। এইভাবে ভালবাসি কেন আমার এই বোনটাকে ? এই কোমল হাতগুলোতেও এত যাদু কিসের ? একটু স্পর্শ পেলেই বা কেন আমি এতটা দূর্বল হয়ে পড়ি ?
এই প্রশ্নগুলো মাথায় বজ্রপাতের মত আঘাত করে। করলেও বা কি ? এই প্রশ্নগুলোর জবাব তো নিজের কাছেও নেই।
____বিছানা থেকে উঠেই লিখতে বসেছি। চোখের সামনে ল্যাপটপের ধপধপে সাদা স্ক্রিন। তার পাশেই সিগারেটের স্ট্রে। সিগারেট খেয়ে চলছি একটার পর একটা। মাথা ধরে আছে। কিছু ভাবতে পারছি না। এই বুঝি মাথাটা ফেটে রক্তে পাশের দেয়াল টকেটকে লাল রঙ ধারণ করবে। গত এক মাস ধরে বোনটার সাথেও কথা হচ্ছে না। নিজেকে মানুষ রূপী পিশাচ মনে হচ্ছে। আমি সত্যিই পিশাচ। মানুষ কেবল মানুষেরাই জানে।