কোন নাগরিককে বিদ্যমান আইনের অধীনে বিচার ও শাস্তি দিতে গিয়ে আইন এবং সংবিধানের বরাত ছাড়া কোন মন্তব্য, যা ব্যক্তি-আক্রমণ ও অপমানের পর্যায়ে পড়ে,- তা করার অধিকার কি ‘মহামান্য’ আদালত আদৌ সাংবিধানিকভাবে সংরক্ষণ করেন? আবার এইসব মামলায় যদি আদালত নিজেই পক্ষভূক্ত হন, যেমন আদালত অবমাননার মামলা- তখন? আইন ও আদালতের শাসন নিয়ে আমাদের বর্তমান পাঠের বোঝাপড়ার দায় আপাতত এই জায়গাটি থেকে।
১.
গ্রীক পণ্ডিত প্লেটো তাঁর আদর্শরাজ্যের রাজা হিশেবে দার্শনিকদেরকে বেছে নিয়েছিলেন, কেননা, তাঁর মতে, দার্শনিকগণ জ্ঞান এবং সত্যের প্রতি ভালবাসা লালন করেন এবং তার মাধ্যমে প্রজ্ঞাতে উপনীত হন। তাই, দার্শনিকরাই ভাল এবং মন্দের বিচার প্রজ্ঞার সাথে করতে সক্ষম। বলা বাহুল্য, এই দার্শনিক রাজার শাসন ‘আইনের শাসন’ নয়, ন্যায়ের শাসন। তাই আইন নয়, বিচারকের প্রজ্ঞাই এখানে মূল বিচারক। এই ন্যায়ের শাসন ও ন্যায়ত বিচার নিয়ে প্লেটো থেকে শুরু করে বর্তমান দুনিয়ার আইন-দর্শনে বিস্তর বাহাস জারি আছে, আমরা সেদিকে যাবো না। কারণ আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং সাংবিধানিক দায়বদ্ধতায় আইনের শাসনে বসবাস করি১, ন্যায়ের শাসনে নয়। এই ‘আইনের শাসন’ গুরুতর জিনিশ, যার মানে হল আইন ও আইনি কর্তৃত্বের স্বৈরতন্ত্র। আবার, আমাদের আইনবিশারদরা আইনি বিচারের কোর্টরুমকে চিহ্ণিত করতে ‘আদালত’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন, আরবী ‘আদল’ থেকে যে শব্দটির উৎপত্তি, যার অর্থ ন্যায়ত-বিচার। কিন্তু আদতেই ন্যায়ত বিচার হয় না এখানে, আইনত বিচার হয়। মূলত, এই আইনের শাসন নাগরিকের সামনে উপরি যে ‘ভাব’ ধরে তার সারমর্ম হলো, কেউ আইনের উর্ধ্বে নন। রাষ্ট্রের সমস্ত নাগরিক ধর্ম-বর্ণ-বিত্ত নির্বিশেষে আইনের কর্তৃত্বের অধীনে থাকবেন, সরকার এবং তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গসমূহও যে কর্তৃত্বের বাইরে নয়। প্রত্যেকের অধিকার থাকবে তারা কীভাবে, কোন সুনির্দিষ্ট আইন অনুযায়ী বিবেচিত ও বিচার্য হবেন তা জানার। বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় আইন দিয়েই কোন সুনির্দিষ্ট ঘটনা-ঘটনের বিচার হতে হবে, কোন রকম রাজনৈতিক বিশ্বাস, আবেগ, ব্যক্তি-আক্রোশ ও আইনবহির্ভূত বরাত ছাড়া। আমরা শুরুতে যে প্রশ্ন উত্থাপন করেছি, তার ফায়সালায় আমরা এই আইনের শাসনের বরাত নিতে পারতাম। কিন্তু এসবই হলো ‘আইনের শাসন’ এর তত্ত্বীয় আবহ। ঐতিহাসিকভাবে রাষ্ট্রের নিপীড়ক অবস্থানকে সহনীয় ও আড়াল করার জন্য এই তত্ত্বীয় আবহের উৎপত্তি।
‘আইনের শাসন’ এর এই তত্ত্বীয় আবহ কিছুক্ষণের জন্য রাষ্ট্রের নাগরিকদের আইন ও আইনি কর্তৃত্ব সম্পর্কে একটি ভক্তির ঘোর তৈরী করে দেয়। এটি এমন ঘোর, যখন জন-ইচ্ছে- মত প্রকাশ ও নাগরিকের স্বাধীন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা- বলপ্রয়োগ- আদালতের হুলিয়া, পুলিশ-র্যাবের ক্রসফায়ার, রিমাণ্ড ও খুন এইসব ঘটে, তখনও এই ভক্তি টইটম্বুর থাকে, কারো কারো। অথচ আইনের বরাত ও আইনি কর্তৃত্বমূলে রাষ্ট্র ও তার সশস্ত্র আইনি বরকন্দাজদের এইসব তৎপরতা ভক্তির জিনিস নয়, বল প্রয়োগের ক্ষমতার কাছে নতি স্বীকার করে মেনে নেয়া ও আনুগত্যের ব্যাপার। মূলত আইন, রাষ্ট্র, সংবিধান এইসব জিনিশ তার পাত্রপাত্রিদের কাছ থেকে আনুগত্য আশা করে- ভক্তি নয়। নাগরিক অবস্থান থেকে আমাদের এই ভক্তির ঘোর কাটিয়ে ভাববার ফুরসত ও সাহস দরকার। দরকার পর্যালোচনা- নাগরিক হিশেবে আইন, রাষ্ট্র, সংবিধান এর ভিতরে নিজেদের অবস্থান চিহ্নিত করা ও তার সাথে আমাদের স্বাধীনতার যেটুক অংশ শেয়ার করতে রাজি আছি সেইসব স্বার্থের বিষয়-আশয় নিয়ে দর কষাকষি- আলোচনা- সমালোচনা ও যদ্দুর সম্ভব নায্য হিস্যা বুঝে নেওয়ার লক্ষ্যে তৎপরতা চালানোর সাহস ও প্রস্তুতি।
ভক্তিকে বাদ দিয়ে- শাদা কথায় 'আইন' ও আইনের শাসনের হদিস খুঁজতে গেলে ইংরেজ আইনতাত্ত্বিক অষ্টিনের দেওয়া আইনের শাদামাটা ও জংলি সংজ্ঞাটাই পাঠযোগ্য হয়। অষ্টিনের মোদ্দাকথা হলো, বলপ্রয়োগের ক্ষমতাই আইন তৈরী করে, এহেন ক্ষমতা সম্পন্ন সভারেন যা বলে তাই আইন। শুধু তাই নয়, আইন কেবল তার হয়ে কথা বলে এবং আইন এর বাস্তবায়নও হয় বলপ্রয়োগের মাধ্যমে। এমনকি, এই বলপ্রয়োগের ক্ষমতাই হল আইনের বৈধতার নির্ণায়ক। সোজা কথায়, জোর যার, মুলুক তার। এখন, এমন একটি আইন বা বিচারব্যবস্থায় যেখানে 'আইন' বলপ্রয়োগের শক্তির স্বপক্ষে কথা বলে, আদালতও তেমনি বলবে তাই স্বাভাবিক। তাই আইনের শাসনের জায়গা থেকে আদালতকে প্রশ্ন করে এমন আলোচনার কোন মানে নেই। বরং আইন ও আদালত বিষয়ক সমস্ত ভক্তির ঘোর কাটিয়ে এই কৌতুহলকর ব্যাপারটিকে বোঝার খাতিরে বেশ কিছুদিন আগে করা একজন রাজনীতিবিদ এর মন্তব্যকে কোট করতে পারি, যখন তিনি বলেন, ‘আমরাও একদিন ক্ষমতায় আসবো, তখন- আমাদেরও পক্ষে কথা বলবে আদালত’২। মোদ্দাকথা, আইন ও আইনী কর্তৃত্বের শাসন মূলত ‘ক্ষমতা’র খবরদারি ও দাপট ছাড়া আর কিছুই নয়। সত্ত্বেও আমরা নাচার হয়ে আইন ও আদালতের শরণ নেই, রাষ্ট্রও কিছু অধিকার রক্ষার প্রতিশ্র“তি দেয় সংবিধানে, তা ভঙ্গ করার ক্ষমতা সহই, নিজের টিকে থাকার প্রয়োজনে।
২.
আইনের শাসন তার তত্ত্বীয় আবহে রাষ্ট্রের নাগরিকদের আইন ও আইনি কর্তৃত্ব সম্পর্কে একটি ভক্তির ঘোর তৈরী করে দেয়, এটি আমরা জেনেছি। আর আদালত হল এই আইনের ‘অবতার’, সাক্ষাত বিধান দাতা, এটি মনে রাখতে হবে। তাই আদালতের উপর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক পরিসরে কিছু অতিরিক্ত ‘পবিত্রতা’, ফলত ভক্তির আইনী বাধ্যবাধকতা আরোপ করে রাষ্ট্র। যেমন ‘আদালত অবমাননা আইন’- যেটি বাংলাদেশে বর্তমানে ‘আইন’ আকারেও চুড়ান্ত হয় নাই, অথচ ক্ষমতা ও আইনী কর্তৃত্বের জোড়ে এই অভিযোগে নাগরিকদেরকে নজিরবিহীন শাস্তি প্রদান হয়ে গেছে, বেশ কয়েক মাস আগে একটি সাড়া জাগানো মামলায়৩। ভক্তির ঘোর কাটিয়ে আইন ও আইনি কর্তৃত্বর ন্যাংটা মুহূর্ত বোঝার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মানে আইন থাকুক না থাকুক, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বই আইন। আবার আইনের ‘পবিত্র’ অবতার, সাক্ষাত বিধান দাতা- এই ভাবমূর্তি আদালত মনে রাখে এবং এ সম্পর্কে সশস্ত্রভাবে সচেতন থাকে। এই পবিত্রতা ও সশস্ত্রতার জোড়ে আদালতের আচরণে যে ভাবমূর্তিগত স্বেচ্ছাচার ঘটে, ছদ্ম-ন্যায় ও ধর্মভাবের আবির্ভাব ঘটে, বর্তমান দুনিয়ার একাডেমিক আলোচনায় এমন পরিস্থিতিকে জুরিস্টোক্রেসি বা আদালতের অভিজাততন্ত্র নামে আলোচনা করা হচ্ছে। যেমন, আদালতের এই অভিজাততন্ত্রের বিষয়টি নিয়ে একাডেমিশিয়ানদের পাঠগুলোতে এমন প্রশ্নও হাজির হয়েছে যে, বিচারকগণ কি আমাদের স্বাধীনতা হাইজ্যাক করে নিচ্ছেন? যেমন ধরুন এ সংক্রান্ত একটি স্টাডির শিরোনাম হলো, ফ্রম ডেমোক্রেসি টু জুরিস্টোক্রেসি- মানে, গণতন্ত্র থেকে বিচারবিভাগীয় অভিজাততন্ত্র। যদিও এইসবই নাকাল প্রশ্ন। মূলত আইনের শাসন ও এই কথিত আদালতের অভিজাততন্ত্রর সম্পর্ক পরস্পর সম্পূরক, এমনকি একটি না হলে আর একটির অস্তিত্বই থাকে না। এই কথাটি ভুলে গিয়ে ‘আইন’ ও ‘ক্ষমতা’র বিচারকে প্রাসঙ্গিক না করে স্রেফ আদালতের অভিজাততন্ত্রর বিচার সম্পূর্ণ হয় না।
৩.
কিন্তু আমরা ঠিক আদালতের অভিজাততন্ত্র নিয়ে আলাপ এই সংক্ষিপ্ত নোটে করবো না, তাত্ত্বিক আবহে শুধু যেটুকু ইশারা এসেছে তা ছাড়া। এর কারণ হলো, আমরাও আদালত ‘অবমাননা’ বোধ করুন এমন কোন বিষয় আদালতের সামনে সাক্ষী হিশেবে বিব্রতকরভাবে উপস্থাপন করতে চাই না। যদিও, সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের কিছু নির্দিষ্ট তৎপরতা ও মন্তব্য আমাদেরকে এই ইশারাটিকে সামনে আনতে প্ররোচিত করেছে, যার প্রেক্ষিতে প্রথম প্যারাতে একটি নাকাল প্রশ্ন তাত্ত্বিক আবহে হাজির করেছি। কারণ আমরা শঙ্কায় আছি। তাই এই বিষয়গুলোর আলাপে আমরা স্রেফ সংবিধান প্রদত্ত নাগরিক অধিকার-সমূহ ও তার সংরক্ষণের ব্যাপারটি সামনে আনতে চাই। মূলত আইনের শাসন, ছদ্ম ন্যায়ের শাসন এই অনুসঙ্গগুলো মিলিয়ে বাংলাদেশের আইন, আদালত, সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে বর্তমানে যে ধর্মীয় আবহ ও তার ফলে নাগরিক-বিভ্রম ও নিপীড়ণ তৈরী হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট হদিস নেয়ার জন্য।
এটি এমন এক সময়, বাংলাদেশে আইন, বিচার, সংবিধান ও রাষ্ট্রের নিপীড়ক চরিত্র নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে বিস্তর বিভ্রম, তর্ক ও অসন্তোষ জারি আছে। একদিকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক ক্রসফায়ারের নামে বিনাবিচারে হত্যা, রিমাণ্ডের নামে নিত্য নতুন উপায়ে টর্চার ও জুলুম এর অভিযোগ, অন্যদিকে এমন বিভ্রমের মুহূর্তে নাগরিকদের মধ্যে চুড়ান্ত নৈরাজ্য, যার ফলশ্রতিতে নৃশংসতা ও গণপিটুনিতে হত্যা ও গুম এর মত ঘটনা ঘটছে। এই জগদ্দল নাগরিক বিভ্রমের মুহূর্তে উচ্চ আদালতের দৃশ্যমান তৎপরতা হঠাৎ বাংলাদেশের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্যভাবে চোখে পড়ার মতো। এই তৎপরতা, নাগরিক হিশেবে আমাদের আশা ও ভরসার জায়গা তৈরী করতে পারতো, যদি এর গন্তব্য সংবিধান প্রদত্ত জন-অধিকার সংরক্ষণ ও তার সর্বোচ্চ প্রয়োগ হতো, উপরে উল্লেখিত আইন, আইনী কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার যাবতীয় বিভ্রমসহই। কারণ উচ্চ আদালত মূলত রাষ্ট্রের বিপরীতে জন-অধিকার সংরক্ষণের আদালত, বাংলাদেশের সংবিধানের ঘোষণা অনুযায়ী। উচ্চ আদালতকে আমাদের সংবিধান রাষ্ট্রের বিপরীতে জনগণের সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার রক্ষার দায়িত্ব অর্পণ করেছে, যার কারণে হাইকোর্টে রীট অধিকার নিয়ে নাগরিকগণ ফরিয়াদি বনে যায়। যখন রাষ্ট্রের অন্য সব জায়গায় অভিযোগের দ্বার রুদ্ধ, অথচ কেউ নাগরিক অধিকারের টুটি চেপে ধরে, তখন উচ্চ আদালতের কাজ হল সংবিধান অনুযায়ী নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা এবং নিশ্চিত করা। তা ক্ষুণœ করা তো নয়ই। উচ্চ আদালতের যে কোন আচরণের মাধ্যমে তা ক্ষুণœ হওয়ার মানে হল সংবিধানের জোরে উচ্চ আদালত যে নৈতিক কর্তৃত্ব পায় আদেশ দেবার, সেটি নষ্ট হওয়া, সাংবিধানিকভাবেই। জুডিশিয়াল রিভিউর মাধ্যমে সংসদের যে কোন আইনকে অসাংবিধানিক ঘোষণার যে ক্ষমতা, তর মূলেও ‘তাত্ত্বিকভাবে’ জন-অধিকার সংরক্ষণ, জন-ইচ্ছের দলিল সংবিধানকে রক্ষা করার মাধ্যমে যার প্রকাশ ঘটে। সংবিধান অনুযায়ী, জন-অধিকার সংরক্ষণ এর বাইরে উচ্চ আদালতের আর কোন কাজই নেই।
অথচ মুশকিল হলো উচ্চ আদালতের এই সাম্প্রতিক তৎপরতাসমূহ নাগরিকদের আতঙ্কিত করছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। কারণ, এই তৎপরতাসমূহের বাদি হলো উচ্চ আদালত নিজেই এবং তার ‘ভাবমূর্তি’, বিপরীতে আসামী হল সংবিধিবদ্ধ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনগণ। এই তৎপরতাসমূহের আইনি নাম ‘আদালত অবমাননা’- যেটি পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে, বাংলাদেশে এখনতক যার জন্য এমন কি কোন চুড়ান্ত আইন পর্যন্ত তৈরী ও গ্রহণ করা হয়নি। আবার, সাম্প্রতিক এই ধরণের মামলাগুলোতে ব্যক্তি-আক্রমণ, অপমান ও প্রতিশোধ-স্পৃহা প্রকাশক মন্তব্য, বিবাদীকে এজলাসে বিনা বিচারে দাঁড় করিয়ে রাখার মত ঘটনাও ঘটেছে আদালত কর্তৃক, যা বিভিন্ন সময়ের পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে৪। শুরুতে যে বিষয়টি প্রশ্ন আকারে হজির করেছি আমরা। একেতো এইসব মামলায় জনগণই আসামী, উচ্চ আদালতের ‘সম্মান’ ও ‘ভাবমূর্তি’র বিপরীতে, তার উপর সেই আসামীর বিচার করতে গিয়ে উচ্চ আদালতের ব্যক্তি-আক্রমণ ও আক্রোশমূলক মন্তব্য, যা নাগরিকের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার রক্ষা তো দূরে থাক, হরণ করে। মনে রাখতে হবে, আইনের বরাতে শাস্তি প্রদান করা এক জিনিশ, কিন্তু সেই শাস্তি দিতে গিয়ে ব্যক্তি-আক্রমণ, অপমান ও প্রতিশোধ-স্পৃহা প্রকাশক মন্তব্য, বিবাদীকে এজলাসে বিনা বিচারে দাঁড় করিয়ে রাখার মত ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিশ। একে আদালত অবমাননার খড়গ, তার উপর সাংবিধানিক নাগরিকের লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনা- আমাদের জন্য আইন, বিচার, সংবিধান ও রাষ্ট্রের নিপীড়ক চরিত্র নিয়ে নতুন ভাবনার মুহূর্ত তৈরী করে বৈকি। কারণ, হাইকোর্টসহ যে কোন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ‘ঘোষিতভাবে’ জনগণের ইচ্ছে এবং গণতান্ত্রিক অধিকার এর রক্ষাকবচ- এবং যতক্ষণ তা নিশ্চিত না করছে- হাইকোর্ট জনগণ থেকেও এই রক্ষাকবচ পাওয়ার অধিকারী না, জনগণের রাজনীতির দিক থেকে। এই রাজনীতির জায়গা থেকে, গণতন্ত্রের মূলনীতির বিরোধী বিচারব্যবস্থা বা আইন- যে কোন কিছুর প্রশ্নহীন একনায়কতন্ত্রও জনগণ মানতে বাধ্য না। বিদ্যমান ব্যবস্থার সমালোচনার পাশাপাশি বিদ্যমান সংবিধান ও আইনি ব্যবস্থায় যেইসব নাগরিক অধিকার এর প্রতিশ্র“তি নিশ্চিত করা হয়েছে- তার ব্যাপারে খোঁজ খবর রাখা এবং সচেতন থাকা আমাদের নাগরিক কর্তব্য। ন্যায়বিচার বহুত দূর- কিন্তু বিদ্যমান আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ ও সংবিধানপ্রদত্ত নাগরিক অধিকারই যদি খোদ বিচারদাতা এজ এন ইনস্টিটিউশন লঙ্ঘন করে- সেই ইনস্টিটিউশনের প্রতি আমাদের জগদ্দল ভয় থাকবে।
তথ্যসূত্র:
১. ‘It shall be fundamental aim of the state to realise through the democratic process a socialist society, free from exploitation - a society in which the rule of law, fundamental human rights and freedom, equality and justice, political economic and social, will be secured for all citizens.’ : Preamble to the constitution of Bangladesh.
২. ‘আমাদের বিচারপতিবা সংবিধান রক্ষার শপথ নেন। কিন্তু কঠিন সময়ে তারা শক্তির পক্ষে অবস্থান নেন।’, ‘বিএনপি আশ্বস্ত হতে পারে এই ভেবে যে ভবিষ্যতে শক্তি নিয়ে সরকারে এলে তারাও বিচার বিভাগের সহযোগিতা পাবে।’: বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। বিডিনিউজ, ২৯ আগস্ট, ২০১০: http://bit.ly/n1HpXY,, প্রথম আলো, ২৯ আগস্ট, ২০১০: http://bit.ly/oPJviN
৩. দৈনিক আমার দেশ এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা মামলার রায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড ও এক লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়, বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত কোন আইন না থাকা সত্ত্বেও: দৈনিক আমার দেশ: ২০ আগষ্ট ২০১০: http://bit.ly/pkQny7 এক্ষেত্রে ‘আদালত অবমাননা আইন, ১৯২৬’ শিরোনামের পুরনো আইনকেও যদি আদালত আমলে আনতেন, তাহলে ‘সেই আইন অনুসারে অনুসারে আদালত অবমাননার সর্বোচ্চ শাস্তি হচ্ছে ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং/অথবা দুই হাজার টাকা জরিমানা। আইনে এও বলা আছে যে অন্য কোনো আইনে যা কিছুই লেখা থাক না কেন, হাইকোর্ট এর চেয়ে বেশি কোনো শাস্তি দিতে পারবে না।’ এই বক্তব্য লেখক আসিফ নজরুল এর, ‘আদালতের মর্যাদা কীভাবে রক্ষিত হবে’ শিরোনামের লেখায়: প্রথম আলো: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১০।
৪. ৩ মার্চ বৃহস্পতিবার ২০১১ তারিখে বয়োজেষ্ঠ্য লেখক কলামিস্ট জনাব সৈয়দ আবুল মকসুদকে বিচারপতি এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো: জাকির হোসেন সমন্বয় গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ ‘অশিক্ষিত’, ‘বর্বর’, ‘নির্বোধ’, ‘হরিদাস পাল’, ‘আহম্মক’, ‘সে’, ‘দুই দিনের বৈরাগী’ ইত্যাদি সম্বোধনে ডাকেন এবং আড়াই ঘণ্টা ধরে এজলাসে দাঁড় করিয়ে রাখেন। এসময় মাননীয় আদালত ‘একে আমরা ছাড়ব না তাকে জানতে হবে, আমরা কী করতে পারি’- এমন উক্তিও করেন। সূত্র: দৈনিক কালের কণ্ঠ, প্রথম আলো, আমার দেশ ও অন্যান্য জাতীয় পত্রিকা: ৪ মার্চ, ২০১১। ১৮ আগষ্ট ২০১০ বৃহস্পতিবার তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পরবর্তীকালের প্রধান বিচারপতি জনাব এবিএম খায়রুল হক দৈনিক আমার দেশ এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে ‘চান্স এডিটর’ বলে বিদ্রুপ করেন। সূত্র: দৈনিক আমার দেশ ও অন্যান্য জাতীয় পত্রিকা, ১৯ আগস্ট, ২০১০। বর্তমান শাসকদলের ১৯৯৬-২০০১ সময়ে তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘wrong-headed’ বলেছেন মহামান্য হাইকোর্ট। আবার, বর্তমান সময়েই, বিএনপি নেতা ‘ব্যরিষ্টার’ নাজমুল হুদা ও জামাত নেতা কামারুজ্জামান এর বিরুদ্ধে ‘আদালত অবমাননা’র মামলায় ‘মাননীয়’ আদালত এই মামলা গ্রহণ না করে তা না নেওয়ার কারণ হিশেবে বলেছেন, যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তাঁরা বিকৃত মস্তিষ্ক এবং অপদার্থ (রং হেডেড পারসন' ও 'ওয়ার্থলেস')। তাঁরা বহির্বিশ্বের একটি মামলার রায়ের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, বিকৃত মস্তিষ্ক এবং অপদার্থর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা চলে না, যার আদালত অবমাননা বিষয়েই কোন ধারণা নেই। ২ জুলাই, ২০০৯: দৈনিক সমকাল ও অন্যান্য জাতীয় পত্রিকা।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১১ দুপুর ২:০৩