''একটা খুব মজার ব্যাপার আমি খেয়াল করেছি, আল মাহমুদ বিষয়ে হালের সাহিত্যপাতা এবং গণমাধ্যমগুলোতে দরদ দিয়ে কিছু বলেছে তার পুরোটা না পড়ে বা না শুনে অই আলোচনার গন্তব্য বুঝা যায় না। ভাবটা প্রতারণামূলক- এটা এমন যে, ইশশ এত্ত ভাল মানুষটি যারে একটু আগে এত ভাল বললাম তারে আসলে খাঁটি ঘেন্না ছাড়া কিছুই দেয়া যাচ্ছে না! এটা খাঁটি ভন্ডামি ছাড়া কিছুই নয়। একজন মানুষ যখন সমাজের পরিচিত একটা ভাষায় কথা বলছে তারে সেই ভাষায় এবং যুক্তি তর্কের মাধ্যমে মোকাবেলা করার পরিবর্তে গালাগালি করাটা প্রতিক্রিয়াশীলতার ভয়াবহ রূপ। এবং পলায়নপরতা।...
আল মাহমুদের সাম্প্রতিক কবিতাপ্রচেষ্টা বিষয়ে আমার অনেক কিছু বলার আছে। সেটা তার ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে ধর্মে উত্তরণের বিষয়ে শুধু নয়। কবিতা, একই সাথে তার শিল্প এবং রাজনীতির দায়, বাঙালী মুসলমানের মনোকাংখা, - এসবের দিক থেকে আল মাহমুদের সাহিত্য বিচার এখনো বড় আকারে করা হয়নি। সেটা খুবই দরকার।...
কিন্তু সেটা এখানে আলোচ্য নয়। আপনার গন্তব্য ছিল অন্য।
ধর্মনিরপেক্ষতা নামে এক অদ্ভুদ জিনিশ- যা সম্পর্কে খুবই আগ্রহী দেশের স্বল্প কিছু শহুরে লোক, যারা মন ও মননে শহর এবং শহুরে ন্যাকামীর বাইরে যেতে পারে না। এর ভয়াবহ রূপ হলো ধর্মবিদ্বেষ। এবং নির্লজ্জ রূপ হলো সাম্রাজ্যবাদ তোষণ। আর একটা মজার ব্যাপার হলো, যাদের ধর্ম নেই, তারাও নিজেদের জন্য একটা ধর্মের প্রয়োজন অনুভব করে। বর্তমানে বামপন্থার ধর্ম হল সেকুলারিজম- যার অনুশাসনগুলি ধর্মীয় মানুষের ঐশি কেতাবের চেয়ে কম পবিত্র নয়।
তাই ধর্মনিরপেক্ষতা একই সাথে বুদ্ধিবৃত্তির দৈনতা এবং বৈশ্বিক রাজনীতির পরিমণ্ডলে দেখলে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অন্যতম হাতিয়ার এখন।...
ধর্মনিরপেক্ষতা (এটা কী জিনিশ) শব্দটার যাবতীয় ঐতিহাসিক অর্থসহ এটা বর্তমান সময়ের বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে একটি ষড়যণ্ত্রতত্ত্বের যাবতীয় উপাদান হাজির করে আমাদের সামনে। দেশে যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ট সম্প্রদায় মুসলিম এবং বর্তমান বিশ্বের ক্ষমতার রাজনীতির সাথে ইসলাম নামটা ওঁতপ্রোতভাবে জড়িত, তাই এখানে ধর্মনিরপেক্ষ নামের প্রতিতী এবং প্রত্যয়টা ওর যাবতীয় মুখ-মুখোশসহ ইসলাম এবং সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলিমের ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে ব্যয়িত হয়।
এটা খুবই ভয়ঙকর একটি ব্যাপার।
এইটা ভেবে দেখা এইজন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, ধর্মনিরপেক্ষতা এমন এক চিজ গ্রামের সাধারণ কৃষকরা যা ছাড়াই চলতে পারে। কিন্তু ধর্ম এমনই গুরুত্বপূর্ণ তাদের জীবনে, যা ছাড়া তাদের জীবন কল্পনাই করা যায় না।...
...আপনি শহুরে বুদ্ধিজীবী, আপনার জীবনাচরণের পুরোটাই সাম্রাজ্যবাদ নিজের প্রয়োজনে ফ্যান্টাসি বানিয়ে দিয়েছে। এই মেকি জায়গায় দাঁড়িয়ে ধর্ম আসলেই গুরুত্বহীন, কোম্পানি স্বার্থও ধর্মের বিরুদ্ধে, যেহেতু ধর্ম কোম্পানি স্বার্থের কোন কাজে লাগে না। ধর্ম আপনার মেয়েকে ফেয়ার এণ্ড লাভলির বিজ্ঞাপনের পণ্য হতে দেবে না, এমনকি ভোক্তা হতেও নিষেধ করবে। আপনি শহরে বসে বুদ্ধিজীবিতার ভাষায় যে কথা বলেন সেই বুদ্ধিজীবিতায় আমাদের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর যথেষ্ট সন্দেহ তৈরী হওয়া স্বাভাবিক। দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের অনুভূতি এত মূল্যহীন না যে তাদের ধর্মানুভুতিকে মুর্খামি বলে আপনি একা শহুরে মধ্যবিত্ত্বর বুর্জোয়ামি চালিয়ে যাবেন এবং তাদেরকে রাষ্ট্রশক্তি দিয়ে দমিয়ে রাখবেন।...
আর একটা কথা, এই ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীতা একটা আইডেন্টিটি ক্রাইসিসের আউটপুট বলেও আমার মনে হয়েছে- যেটা আমাদের দেশে এসেছে সাম্রাজ্যবাদী নগরায়নের মাধ্যমে- কোম্পানি স্বার্থ যখন পৃথিবীতে যুদ্ধ বাধিয়ে দিল।''
...............
''আর একটা ব্যাপার, ব্যক্তি আল মাহমুদের পক্ষে বা বিপক্ষে বলার মতো ব্যক্তিত্ব তিনি নন, অন্তত আমার কাছে। আর যেটুকু বুঝেছি, সম্ভবত আপনি এবং আরো অনেকের কাছেও এটা সত্য। তাই এ বিষয়ক আলোচনা গুরুত্ত্বহীন। কিন্তু আমার পক্ষে এটা ভাণ করাও সম্ভব না যে, আল মাহমুদকে ছাড়াই বাংলা কবিতাকে পড়তে পারব। তাই এটা আমি করি না।
আমার কাছে ব্যক্তি আল মাহমুদ যেমন গুরুত্ত্বহীন, তেমনি অন্যান্য অনেক প্রতিষ্ঠিত কবি সাহিত্যিক আছেন শুধু ব্যক্তি নয়, সাহিত্যের জায়গায়ও গুরুত্ত্বহীন। এটাও সম্ভবত আপনি এবং আরো অনেকের কাছে একইরকম সত্য। ব্যক্তিজীবনে আল মাহমুদ ক্রমশই ধার্মিক হয়ে উঠছেন- এবং সেটার উচ্ছাস তিনি যত্রতত্র ঘটান। সেটার দলীয় রূপটা অসুন্দর। কখনো কখনো মতিভ্রমমূলকও। কিন্তু ধর্মীয় রূপটা কবিতায় প্রকাশ হয় এবং পাঠককে রূপকথার জগতে নিয়ে যায়। যেমন: মায়াবী পর্দা দুলে উঠো।
কিন্তু কথা হলো সেটাও আমার আলোচ্য বিষয় ছিল না। কবিতা বিষয়ে অন্য কোথাও হবে।
আমার আপত্তি ছিল অন্য জায়গায়। আল মাহমুদের সমালোচনা করতে গিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার সাফাই গাওয়া। ধর্মনিরপেক্ষতা এখন বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের একটা ডিসকোর্স- আপনি স্বীকার করুন আর নাই করুন। সেটার আলোচনা উপরে করেছি।''
.............
''উপরোক্ত কবি একটা কবিতা লিখেছিলেন- ঈগল থাকবে ইতিহাস থাকবে না। এমন একটা সময়ে লেখা যখন অধর্ম এবং কোম্পানি স্বার্থের যুদ্ধ আফগানিস্তান ইরাকে পাখির মতো মানুষ হত্যা করছিল আর আমাদের এখানে এসে 'মানবাধিকার', 'মৌলবাদ', 'টেররিজম' এবং 'ইনফিনিট জাস্টিস' শিখাচ্ছিল। এবং দেশীয় বুদ্ধিজীবীরা তার সমর্থনে ধর্মনিরপেক্ষতা। সেই যুদ্ধ এবং ডিসকোর্সের কাল এখনো কি শেষ হয়েছে?''...
................................................................
উপরের আলোচনাগুলো আল মাহমুদ সম্পর্কে আমার আবেগকে ধারণ করে না; একজন ব্লগারের আলোচনার উত্তরে প্রতি-আলোচনা করেছি, এক কথায় বিতর্ক। বিতর্কগুলোতে আল মাহমুদ সম্পর্কে আমার ভাবনাশুরুর বিন্দুটি লুকিয়ে আছে বলে আমি মনে করি। কিন্তু আমি অন্য কিছু কথা বলতে চাই।
খুব ছোটবেলায় যখন কবি বাসনা তৈরী হল তখন পড়েছিলাম যেভাবে বেড়ে ওঠি। এক দুর্মর আবেগ তৈরী হয়েছিল আল মাহমুদকে নিয়ে, কবি এবং তার যাবতীয় অর্থ তখন শুধুই আল মাহমুদ। তারপর হাতে এল সোনালী কাবিন আর তার দুর্ধর্ষ কবিতাগুলি। প্রায় মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। মুখে মুখে পড়তাম:
..ভোলো না কেন ভুলতে পার যদি/ চাঁদের সাথে হাঁটার রাতগুলি/ নিয়াজ মাঠে শিশির লাগা ঘাস/ পকেটে কার ঠাণ্ডা অঙ্গুলি/ ঢুকিয়ে হেসে বলতে, অভ্যাস; ...
তো সেই সময় একদিন একটি কবিতা লিখে ফেললাম, অর্থাৎ আমি অইটারে কবিতা বললাম। প্রচুর বর্ণনায় ভরা, পুরোপুরি আল মাহমুদীয় ঢঙে। এক সাহিত্য সভায় পাঠ করলাম খুব আবেগ ভরে, তারপর একজন আলোচক অই লেখাটার পোস্টমর্টেম করলেন নিষ্ঠুরভাবে। আমার অভিমান যায় না, এমন একটি অসাধারণ কবিতা লেখার পর এই আলোচনা!- পরের আর একটি সাহিত্য সভায় ক্ষুদ্ধ হয়ে আমি আরো কয়েকটি কবিতা এবং একটি গদ্য লিখে আনলাম। গদ্যটির শিরোনাম হলো: "কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার".. অই আলোচক মহোদয় আমার প্রতি এমন করুণার দৃষ্টি হানলেন সেই আলোচনা পড়ে, হাঃ, এখন সেইসব কবিতা আর সেই আলোচনার কথা মনে পড়লে খুব একটু আলতো করে নিজের প্রতি হেসে নিই। আল মাহমুদের সেই ''কবিতা এমন'' কবিতাটি এখনো প্রায়ই গুণগুণ করি:
কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস/ ম্লান মুখ বউটির দড়িছেড়া হারানো বাছুর/ গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর/ কবিতাতো মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়েশা আক্তার...
কোন এক আল মাহমুদ সংখ্যায় একটি স্মৃতিকথা পড়ছিলাম, দেবী রায়ের লেখা সম্ভবত, তিনি আল মাহমুদের বাড়িতে পা রাখছেন আর তাঁর মনে পড়ছে:
..এ তীর্থে আসবে যদি ধীরে অতি পা ফেলো সুন্দরী,/ মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ-মাটির গা'য়,/ ছিন্ন তালপত্র ধরে এসো সেই গ্রন্থ পাঠ করি/ কত অশ্রু লেগে আছে এই জীর্ণ তালের পাতায়...
আসলে আল মাহমুদকে দিয়েই কবিতা ব্যাপারটা সম্পর্কে আমার যত কৌতুহল আর তার নিবৃত্তি হয়েছিল সেই ছোটবেলায়। তার সেই কবিতাটির কথা মনে আছে, তখন প্রায় মুখস্ত ছিল, সারাক্ষণ মুখে মুখে থাকত ...আমি যার ক্রীতদাস মাঝে মাঝে সম্রাটের মতো/ উড়ে আসে অবিবেকী সেই জাদুকর।/ সোনার মলাটে লেখা পুঁথিপত্র নিয়ে/ শেখায় সে মায়াময় যে-সব অক্ষর/ সকালেই ভুলে গিয়ে সেই সব শ্লোকময় কথা/ হৃদয়ের দলগুলি ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলি।/ হয়তো বা ক্ষণকাল ইনিয়ে বিনিয়ে/ কেঁদে কেটে ক্লান্ত হয়ে পুরাতন গাথার ভিতরে/ নিজেকে ডুবিয়ে দিই।/ ছিন্নভিন্ন হৃদয়ের চামেলি ও বেলী/ এক হয়ে অন্য এক লোকোত্তর মানুষকে গড়ে।/ পানখ সাপের মতো অন্তরের বিষাক্ত কামনা/ মরে গেলে, আবার হারানো কথা আমার অধরে/ ফিরে এসে উচ্চারিত হতে থাকে ধীরে/ যেন মনে হয়,/ পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ছিল বুঝি/ আমাদের কয়েকটি কবির হৃদয়।...
দিনে দিনে বাংলা কবিতার বয়স কত হলো? এখন দারুণ বর্ষা, কথা না বলতেই বৃষ্টি শুরু হয়। আর আল মাহমুদের শেষ দিনগুলো গুটি গুটি পায়ে চলে আসছে কাছে। আর কতদূর? শাদা শ্মশ্রুমণ্ডিত বাংলা কবিতার এই রাজপুত্তুরকে আমরা আর কতদিন পাব? কতদিন? আর কে আছে এমন, যার কবিতা আরো শত বছর মণ্ত্রের মত পড়তে থাকব আমরা! কমলা রোদ্দুরে বসে বিকেলহীন বিকেলের অপেক্ষায় কবির দিন কেটে যায়:
কাল আমি আমার মার সাথে অনেক্ষণ কথা বলেছি।
অদ্ভুত বৃদ্ধা। একদা আমাকে জন্ম দিয়েছিলেন। সম্ভবত
এখন বিশ্বাস হতে চায় না। যখন মিটমিট করে
আমাকে দেখলেন। আমার গরম লাগছিল।
আমি বললাম, চলো মা আমরা একটু চা খাই।
বুড়ি হেসে তসবীহ টিপতে লাগলেন,
তোর যেখানে জন্ম হয়েছিল মনে আছে?
নিম গাছের নিচে ছনের চালায়। সে রাতে
আমাদের এক ফোটা চা-ও ছিল না।
আমি কাপটা নামিয়ে রাখতে রাখতে বললাম,
না মা, কিছু মনে নেই।
পেঁচার ডাকে আমার ভয়, এদিকে তোর কান্না
ঘরে নেই পুরুষ। তোর বাপ গেছে চরের ধান
পাহারা দিতে। কে-যেনো আজান হাঁকলো
হাজী শরীয়তের মতো গলা। ধাই মেয়ে
তোকে দোলাতে দোলাতে বললো,-
বল লেংটা তুই কোন মসজিদে যাবি?-
মনে আছে?
না মা, আমাদের কাপ জুড়িয়ে
পানি হয়ে গেল যে!
ব্যবহৃত ছবিটি arts.bdnews24.com থেকে নেওয়া, কৃতজ্ঞতা