somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফাহমিদুল হকের বহুলপঠিত একটি পোস্ট এবং ব্লগের লিখিয়েরা: একটি পর্যবেক্ষণ

১৩ ই মে, ২০০৮ দুপুর ২:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আলাপ

২০ মার্চ ২০০৮ তারিখে পোস্ট করা ফাহমিদুল হকের একটি লেখা পড়ছিলাম সামহোয়ারইনে। বেশিদিনের পুরনো নয়। কিন্তু সামহোয়ারে আসার পর আমার পড়া প্রথম দিককার পোস্টগুলার একটি ফাহমিদুল হকের এই লেখা। তখনো আমার এই ব্লগে মন্তব্য করার অধিকার জন্মায় নাই। আর জন্মাইলেও তাতে মন্তব্য হয়তো করতাম না তখনই। ভাবনা গজাইলেই তাতে কমেন্ট করার স্বভাব এবং আর্টটা আমি এখনো রপ্ত করতে পারি নাই। তখনতো নয়ই। তবে লেখার বিষয় এবং কমেন্টের ব্যাপ্তি কৌতুহলজনক ছিল খুব। আমি পড়ে মজা পেয়েছি। পোষ্টটাতে অনেকগুলো বাজারি বিতর্কের হদিস পাওয়া গিয়েছিল। এটি ২৯৬৪ বার পঠিত হয়েছে এ পর্যন্ত এবং ৩৯৬ টি মন্তব্য পেয়েছে। এই পরিসংখ্যানটা বিষয়ের জনপ্রিয়তা এবং বাজারি গুরুত্ব বুঝানোর জন্য দিলাম। লেখক নিজে এবং আরো অনেকেই পোস্টের বিতর্কে অংশ নিয়েছেন সেসময়। সম্ভবত এখনো চলছে সেই বিতর্কগুলো ওখানে।

আমি লেখাটা এবং বিতর্কগুলো খুব আগ্রহের সাথে পড়েছি।

সেদিন সেই বিতর্কগুলো পড়তে গিয়ে তার প্রবণতাসমূহ যা আমার চোখে পড়েছে এবং পরবর্তীতে আমার অভিজ্ঞতায় আরো অনেকগুলো প্রপঞ্চের ভাবনার কথা এখানে বলার চেষ্টা করবো। তার আগে অন্য একটি
আলাপ পাড়তে চাই, আমার এক বন্ধু জহিরের কথা বলে।

আমার একজন বন্ধু আছে, জহির নাম। নামটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারে কোন বিষয় আপনি বলার পরে তার যাবতীয় দৃষ্টি এবং ধৈর্য নিয়ে তার প্রথম প্রশ্নের উত্তরটা আপনাকে দিয়ে দিতে হবে। তা হলো, এতে আপনার পলিটিক্সটা কোন জায়গায়। তারে নিয়ে আমাদের বন্ধুমহলে একটা গল্প রচিত হয়েছে ইদানীং, তার অজান্তে।

সেটা এরকম: ধরা যাক ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ স. ইসলাম নিয়ে আসলেন কার্লমার্কসের যুগের পরে। খুব ঠাণ্ডা মাথায় মুহাম্মদের কাছে বন্ধুটির প্রথম প্রশ্ন হবে এরকম: আপনার পলিটিক্সটা কোন জায়গায় একটু খোলাসা করবেন?

ইসলামের নবীর সামনে জহিরের এপ্রোচটা কী হতো জানা সম্ভব নয়, নবীতো সবাই হন না, আমরা যারা মানবিক সংসারে মানুষ হিশেবেই টিকে থাকার লড়াই করে যাই; এই ডিসকোর্সের কালে আমাদের রাজনৈতিক সচেতনা আমাদেরকে তার পলিটিকসটা বুঝতে প্ররোচনা দেয়। পলিটিকসটা বুঝতে পারলে আমাদের মানবিকতাবোধের লড়াই সহজতরো হবে।

আমারো তাই পলিটিকসটা মাথায় আসে প্রথমে।

ফাহমিদুল হককে আমি চিনি না, পাঠ করতে গিয়ে জানতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার শিক্ষক, একটি পত্রিকা সম্পাদনার সাথেও যুক্ত আছেন তিনি। তার এই পরিচয়টা গুরুত্বপূর্ণ নয় এই আলোচনায়, কিন্তু তাঁর শ্রেণীচরিত্র এবং প্রবণতা বুঝার জন্য এটাও একটি জরুরী এলিমেন্ট হিশেবে বিবেচিত হতে পারে আলোচনার কোন এক পর্যায়ে। এবং ব্লগের লিখিয়েরা, যারা সেই বিতর্কে অংশগ্রহণ করেছেন, ফাহমিদুল হকের মতই তাঁরা আমার কাছে অপরিচিত, তাদের লেখার অংশটি ছাড়া।

ফাহমিদুল হক এবং অন্যান্য ব্লগাররা যারা এই লেখাটা পড়ছেন, আমাকে ক্ষমা করবেন। ব্যক্তিকে বিশ্লেষণ এখানে আলোচনার উদ্দেশ্য নয়। গণমাধ্যমে ফাহমিদুল হকের প্রকাশিত একটি লেখা এবং সেই লেখাকেন্দ্রিক তর্ক-বিতর্কে প্রবলভাবে উপস্থিত শ্রেণীপ্রবণতাটা আমি নিজের ক্ষুদ্র জ্ঞান দিয়ে পড়তে চাই। আমি তার পলিটিকসটা ধরতে চাই, যার মইধ্যে একই সাথে আমাদের বুদ্ধিজীবীতা এবং রাজনীতির সংকট জড়িত।

বিস্তার

প্রসঙ্গে যাবার আগে কিছু প্রাকইতিহাস বলা প্রয়োজন।

প্রথমত বাংলাদেশের উত্থান মুহূর্তে ভূমিকা পালনকারী দৃশ্যমান দুটি শ্রেণী, বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত্বশ্রেণী-উদ্ভূত পলিটিক্যাল এলিট এবং পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাকারী ইন্টালেকচুয়াল এলিট; উভয়ের পাকিস্তানী হেজিমনির বিরুদ্ধে যে দৃশ্যত অবস্থান (দৃশ্যত বলা হচ্ছে, কারণ তার ভিতরে একটি সুবিধাবাদী অবস্থানও ছিল), তা বাংলাদেশ-বিপ্লব পরবর্তী সময়ে তার চরিত্রের মৌলিক কোন ট্রান্সফরমেশন ঘটাতে পারে নি। ফলে এই উভয়বিধ শ্রেণী বাংলাদেশ-বিপ্লবের অন্তর্নিহিত মর্মার্থ- হাজার বছরের লড়াই, সংগ্রাম ইত্যাদির ভিতরকার নানা বাঁক, টানাপোড়ন ও শক্তির জায়গাগুলো- ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের উত্থানের পর ক্লাস ফরমেশনের যে প্রক্রিয়া, তাতে দেখা যায় মনস্তাত্ত্বিকভাবে উভয় শ্রেণীই কোন না কোনভাবে পার্টিলগ্ন হয়ে পড়েছে। এই পার্টিলগ্নতার চরিত্র আমাদের খুব পরিচিত বাঙালী বনাম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের বিতর্কে স্থুলভাবে দৃষ্ট। প্রবণতাটা আমাদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণী এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দুটি আলাদা ফ্র্যাকশনে বিভক্ত করে ফেলেছে; যেটা তৃতীয় বিশ্বের ছোট দেশগুলির নিরাপত্তা বলে কথিত বিষয়টিকে ভিতর থেকে হুমকির মুখোমুখি করে। ফলত আমাদের দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক ধারাগুলো পার্টি ইন্টারেস্ট কাম ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট কাম আন্তর্জাতিক কুটনীতির আওতায় তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলো নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

দ্বিতীয়ত মুক্তিযুদ্ধের বৃহত্তর আবহ নিয়ে অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্মের (সংবেদনশীল তরুণদের কথা ব্যতিরেকে) যে জনপ্রিয় আগ্রহ বর্তমানে জারি আছে তাতে উল্লেখিত দুটি শ্রেণীরই ইমেজ বীরসুলভ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে প্রগতিশীলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের যে রেডিক্যাল বিপ্লবী অবস্থানের দরকার ছিল, সেটি স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ অভিজ্ঞতায় প্রবলভাবে অনুপস্থিত। হয়তো শ্রেণী হিশেবে গঠিত হওয়ার সময়কার আর্থ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত তাদের মনোগঠনে প্রয়োজনীয় উদ্দীপনা সরবরাহ করতে পারেনি এবং কনক্রিট সামাজিক ঐতিহাসিক বাস্তবতায় উল্লেখিত শ্রেণী দুটি অনেকটা অপরিপক্ক অবস্থায় বাংলাদেশ বিপ্লবের সামনে হাজির হয়েছিল।

আমাদের বর্তমান আলোচনায় যতটুকু ইতিবৃত্ত হাজির হল তাতে শ্রেণী দুটির গঠন, ক্রমবিকাশ এবং হালনাগাদ উত্তরাধিকার বিবেচনায় নিয়ে আমরা যারা ব্লগে লেখালেখি করছি, আমাদের সকলের শ্রেণী অবস্থান এবং তার প্রবণতা সমূহ চিহ্ণিত করা যায়। এটিও ভাববার বিষয়; আমাদের যারা অসীম সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের জন্য রেডিক্যাল বিপ্লবী অবস্থান নিয়েছিলেন, তাঁরা এর কোন বিপ্লবী দার্শনিক ভাষ্য নির্মাণ করতে পারেননি এবং সুনির্দিষ্টভাবে কাজের ক্ষেত্রও নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

ইতিহাসে প্রচেষ্টাগুলো তাই কবিসুলভ রোমান্টিক হটকারিতায় পরিণতি লাভ করেছে।

প্রবেশ

প্রসঙ্গের অবতারণা হিসেবে আরো একটি বিষয় এবার আমাদের আলোচনায় আসবে: বহুল আলোচিত মত প্রকাশের স্বাধীনতা। এ সংক্রান্ত ধারণাগুলোর পর্যালোচনায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে দু ধরণের অভিমুখের সন্ধান পাওয়া যায়। একটি হল ফ্রিডম অব চয়েজ, অন্যটি ফ্রি উইল।

প্রাচ্যীয় ঐতিহ্যগুলোতে ফ্রিডম অব চয়েজের প্রাধান্য, যেখানে কনশেন্সের নীতি অনুসরণ করে অসংখ্য বিকল্পের মধ্যে ভার্চুয়াস বিকল্পকে বাছাইয়ের উপর গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়। ধর্মগ্রন্থগুলো এটির উপর গুরুত্ত্বারোপ করে।

অন্যদিকে ধ্রুপদি গ্রেকো-রোমান এবং সেই সাথে রেনেসাঁস ও এনলাইটেনম্যান্ট আনিত আধুনিকতার মূল মটো হল ফ্রি উইল। যার ভৌত প্রকাশ মত প্রকাশের স্বাধীনতা বা ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন। ওয়েস্টার্ন এনলাইটেনমেন্টর অন্যতম প্রপাগেটর ভলতেয়ারের ভাষ্যে এটি হচ্ছে এরকম: তোমার মতামতের সাথে আমি একমত না হতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমি প্রাণ দেব।

আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ বলে, ব্লগের লিখিয়েরা সকলে শেষোক্ত অভিমুখকেই ইমিটেশন অর্থে ধারণ করেন। ফাহমিদুল হক, যার লেখাকে কেন্দ্র করে আজকের এই আলোচনার অবতারণা, এবং যারা পোস্টটিতে তার পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন তারাও এর ব্যতিক্রম নয় ঠেকে।

ফলত ব্লগে জামাত নেতা কামরুজ্জামানের ছেলে ওয়ামী তার পিতার নাজেহালকারীদেরকে উদ্দেশ্য করে 'কুকুরের কাজ কুকুরে করেছে' বলায় 'তাকে ব্যান করার পক্ষ বিপক্ষ' এই অর্থে মুক্তিযুদ্ধের 'স্বপক্ষ' এবং 'বিপক্ষ' উভয় গোষ্ঠিই পরস্পরের মতামত রুদ্ধ করে দেয়ার জন্য যে ধরণের আক্রমণাত্মক ভঙ্গি ( ক্ষেত্র-বিশেষে একঘরে করা, বর্জন, ব্যান এবং গালি-গালাজ দিয়ে হেনস্থা) অবলম্বন করেছেন তাতে আমাদের দেশের হালনাগাদ ইন্টেলেকচুয়াল এলিটদের মধ্যে পাকিস্তানি আমলের উল্লেখিত দুই শ্রেণীর ভিতরকার বিরাজমান সার্বিক অপরিপক্কতার বিষয়টিই নতুনভাবে দৃষ্ট হয়।

লক্ষ্য রাখতে হবে, প্রগতিশীলতার বৈশিষ্ট্য হিশেবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নামক যে প্রপঞ্চটি আমরা বহুবার আওড়িয়েছি, সেটির অন্তর্নিহিত অনুপ্রেরণার সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ আমরা প্রদর্শন করছি এইসব ক্ষেত্রে। কোন ব্যক্তির কৃত অপরাধের জন্য তাকে শাস্তি দেয়ার আইনি প্রক্রিয়ার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করা এবং আইনি প্রক্রিয়া চালু করা এক কথা, আবার উল্লেখিত ব্যক্তির নিজের অপরাধের কিংবা নির্দোষিতার পক্ষে কথা বলতে চাওয়ার অধিকারকে ঢালাওভাবে রুদ্ধ করার চেষ্টা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার।

আর একটা লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হচ্ছে ব্লগে নারীর অবস্থান সম্পর্কিত আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী। আমাদের সময়ে বেড়ে উঠা প্রজন্মের মধ্যে যারা ব্লগিং ইত্যাদিতে অভ্যস্ত, তারা শফিক রেহমানীয় অর্থে স্মার্ট। এবং দেখা গেছে তাদের সেই স্মার্টনেসে নারীরা একটু কোমল নরম এবং কম্প্রোমাইজিং অর্থে বৈশিষ্টায়িত। ফলত দৃষ্টিভঙ্গীটি অনিবার্যভাবেই ফিউডালিস্টিক। এটা প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয় যখন সামহোয়ারের নারী ব্লগাররা ভিক্টোরীয় নারী চরিত্রে কুশীলব ছিল তখন পুরুষ ব্লগারদের উচ্ছাস এবং তাদের পোস্টে প্রশংসাসুলভ অংশগ্রহণ, আবার পরপরই যখন তাঁরা আমাদের আলোচ্য বিতর্কে অংশগ্রহণ করে কোন প্রতিষ্ঠিত মতের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে তখন ফ্যাসিবাদী-সামন্ততান্ত্রিক-পুরুষতান্ত্রিক ভঙ্গীতে রমনী (রমনযোগ্য) হিশেবেই ব্যক্তিগতভাবে তাকে ট্রিট করা হয়েছে।

লক্ষ রাখতে হবে, পশ্চিমা সমাজের নিজস্ব বিকাশ এবং চলতি গতি-প্রকৃতির নিরিখে নারীবাদের জনপ্রিয় স্বরূপ, যেটি জাতিসংঘ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ এবং অন্যান্য পলিসি প্রেসক্রাইবিং প্রতিষ্ঠান-সম্পৃক্ত দাতা সংস্থা কাম এনজিওগুলোর কর্মকাণ্ডে 'উইম্যান এম্পাওয়ারম্যান্ট', 'ইকুয়াল স্ট্যাটাস অব উইম্যান' ইত্যাদি অভিমুখ নিয়ে আলটিমেটলি রাজনৈতিকভাবে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের পারপাস চরিতার্থে সহায়তা করে, সেই পাটাতনে আমার অবস্থান নয়।

আমরা অনেক সময় 'উইম্যানহুড' বা 'ফ্যামিনিনিটি' এবং 'প্রচলিত ফ্যামিনিজম' দুয়ের মধ্যেকার ডিসটিংশন কনসেপচুয়ালী গুলিয়ে ফেলি।

আমি ব্যক্তিগতভাবে উইম্যানহুডের বৈপ্লবিক উত্থানের প্রত্যাশী।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের এত বছর পরেও আমাদের মধ্যেকার এইসব দ্বিধামুখরতা ও আত্মবৈপরীত্যসমূহ আসলে এই দেশটির সার্বিক আর্থ-সামাজিক অগ্রগতিসূচকের ট্রায়াল এন্ড এরর প্রক্রিয়ার সমান্তরালে বিরাজমান, এটি মনে রাখতে হবে।

আরো কিছু আলাপচারিতা

নম শুদ্রের বাংলাদেশ বিপ্লব: একটি নতুন প্রারম্ভ
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ, বাংলা ভূখণ্ডকেন্দ্রীক জনগোষ্ঠীর সংগ্রামসমূহ, আদর্শবাদ ও উদ্দেশ্যবাদ, সংগ্রামসমূহে বিভিন্ন শ্রেণীর প্রদর্শিত ভূমিকা ইত্যাদি বিষয়াদি কিছু নির্দিষ্ট ধরণের ঐতিহাসিক সাহিত্য ও রাজনৈতিক প্রপাগাণ্ডা আকারে একাত্তর পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হাজির। এই সংক্রান্ত ঐতিহাসিক সাহিত্য, রাজনৈতিক নেতাদের বিবৃতি এবং সর্বব্যপ্ত প্রপাগাণ্ডাসমূহের একটি সামগ্রিক পর্যবেক্ষণে মূখ্যত দু'টি কোর প্রত্যয়কে আমাদের আলোচনার সুবিধার্থে বাছাই করা যায়।

এক. বাংলাদেশ বিপ্লবের আকষ্মিকতা কিংবা ঐতিহাসিকতা।

দুই. ভারতীয় উপমহাদেশের (বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারতের বিদ্যমান) ইতিহাস চর্চার ধারা এবং এই একাডেমিক চর্চার সাথে সম্পর্কিত পলিটিক্যাল ইন্টারেস্ট সমূহ।

বাংলাদেশ বিপ্লব সংক্রান্ত বিরাজমান সমাজতাত্ত্বিক, নৃ-বৈজ্ঞানিক, রাজনীতিবিদ্যাগত এবং ইতিহাসবিদ্যাগত সাহিত্যসমূহে বাংলাদেশের উত্থানকে হয় আকষ্মিকতা নয়তো একটি ঐতিহাসিক ক্রম বিবর্তনের ফলাফল রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। উভয় উপস্থাপনায় আদর্শবাদ (ideology) কিংবা উদ্দেশ্যবাদের (teleology) পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন শ্রেণীর ঐতিহাসিক অবস্থান সে সাথে তাদের মনোগঠন, দ্বিধা, সাড়া, দ্বন্দ্ব ইত্যাদি খুবই মনোলিথিক সাধারণীকরণে পর্যবসিত। ফলত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসসংক্রান্ত ধ্যান-ধারণা এবং আবেগের নির্মাণে এই সাধারণীকরণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দৃষ্ট হয়। এবং এই সাধারণীকরণের সর্বব্যপ্ত প্রতিবেশ নির্মাণের ক্ষেত্র প্রস্তুতিতে প্রধানত ভূমিকা ছিল রাজনৈতিক নেতৃবর্গের।

অন্যদিকে, সাবেক বৃটিশ উপনিবেশ ভারতে নেটিভদের মধ্যে যে ধরণের ঐতিহাসিক কল্পনার প্রসার ঘটেছিল তা থেকে তিন ধরণের ইতিহাস লেখার ধারা গজিয়ে উঠে। প্রথমত মুসলিম জাতীয়তাবাদী যা পরবর্তীতে প্রো-পাকিস্তানী হিস্টোরিওগ্রাফি, দ্বিতীয়ত সর্বভারতীয় হিন্দু জাতীয়তাবাদী যা পরবর্তীতে প্রো-ইণ্ডিয়ান হিস্টোরিওগ্রাফি এবং তৃতীয়ত সর্বভারতীয় ও স্থানিক মার্কসীয় হিস্টোরিওগ্রাফি। গবেষকদের ধারণায়, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচার এবং প্রসারের ফলে নিজের ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি আত্মবিশ্বাসহীনতা এজ ওয়েল এজ নিজ কল্পিত স্বপ্নরাজ্যের ঐতিহাসিক পটভূমি খোঁজার আত্মপক্ষ সমর্থনীয় দৃষ্টিভঙ্গিগুলো, সেই সাথে তৎকালীন বৃটিশ সাম্রাজ্যের শাসন এবং শোষনে এক একটি আলাদা সম্প্রদায় হিশেবে দুটি সম্প্রদায়ই যে ধরণের প্রতিক্রিয়া ও আকাংক্ষা পোষণ করেছে সেটিই এ ধরণের ঐতিহাসিক কল্পনার জন্ম দিয়েছে।

বৃটিশ উপনিবেশিক সময় থেকে বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের আগ পর্যন্ত সংগ্রামমুখর দিনগুলোতে পলিটিক্যাল এলিট, ইন্ট্যালেকচুয়াল এলিট ও সাধারণ জনগণের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া এবং সংগ্রামের গতি প্রকৃতি নির্ধারণে মার্কসবাদীদের ম্যাকানিক্যাল/সৃজনশীল ইন্টারেপশনের ফলে এই ঐতিহাসিক কল্পনাসমূহ হাজার হাজার মানুষের কল্পনায় রূপায়িত হয়েছে।

তাই দেখা যায়, বাস্তবতায় আমাদের সংগ্রামের বহুমাত্রিক ধারাটি যাই হোক না কেন, তার কল্পনা নির্মাণ ও প্রচারে আমাদের একাডেমিশিয়ানরা ও রাজনৈতিক নেতৃবর্গ একটি চরম অবস্থান গ্রহণ করেছেন, যেটি একই সাথে ইতিহাস চর্চার ধারাগুলোর অবস্থানও বটে।

এখানে উল্লেখ্য যে, ভারতে ষাটের দশকের নকশাল আন্দোলনের উত্থান ও পতনের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসীয় তাত্ত্বিকদের মধ্যে উদ্ভূত তর্ক-বিতর্কের বৃহত আবহের বাতাবরণে জন্ম নেওয়া সাব অলটার্ন ইতিহাস চর্চার ধারা এবং বিভিন্ন পলিসি প্রেসক্রাইবিং প্রতিষ্ঠান-স্পনসরকৃত গবেষণায় বেরিয়ে আসা অবকাঠামোগত সমস্যাকে ঐতিহাসিকভাবে পশ্চিমা উদারনৈতিক তত্ত্বায়নের মধ্যে ছাঁচকৃত ইতিহাস চর্চার ধারা আমাদের আলোচনার বাইরেই রয়ে গেছে এই ধারাগুলোর গঠনগত দশার উত্তরণ ঘটেনি বলে।

আমাদের শুরু করতে হবে এই আলোচনাগুলো শেষ করেই।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১:৫৮
২৫টি মন্তব্য ২৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখানে সেরা ইগো কার?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪






ব্লগারদের মাঝে কাদের ইগো জনিত সমস্যা আছে? ইগোককে আঘাত লাগলে কেউ কেউ আদিম রোমান শিল্ড ব্যবহার করে,নাহয় পুতিনের মত প্রটেকটেড বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার করে।ইগো আপনাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে, টের পেয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবং আপনারা যারা কবিতা শুনতে জানেন না।

লিখেছেন চারাগাছ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮

‘August is the cruelest month’ বিশ্বখ্যাত কবি টিএস এলিয়টের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘The Westland’-র এ অমোঘ বাণী যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন করে এক অনিবার্য নিয়তির মতো সত্য হয়ে উঠবে, তা বাঙালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×