মাঝরাত।ছেলেটা বসে আছে আই সি ইউর বাহিরে,ভেতরে যে লোকটা মরার মত পরে আছে সেই লোকটা তার বাবা।ডাক্তার বলে দিয়েছে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুব কম,এই ক্ষেত্রে ফিরে আসে খুব অল্প সংখ্যক মানুষ।সে মরে গেছে বললেই ভালো হয়।দীর্ঘ বিরতি নিয়ে একেকটা নিশ্বাস নেওয়া আর না নেওয়া একি কথা।
বাহিরে বসে ছেলেটা ভাবছে,বাবা চলে গেলে কি হবে এই চিন্তা সে করছে না।ভদ্রলোক ব্যাংক ব্যালান্স করে যেতে পারেননি ঠিক তবে ছেলেকে দাড় করিয়ে গেছেন শক্ত ভীতের ওপর।ভালো চাকরী করে মা আর ছোট বোনকে নিয়ে তার দিন রাজার হালেই কাটার কথা।এসব ভাবছে না ছেলেটা,ছেলেটা ভাবছে ভিন্ন কিছু।
এতো বছর হয়ে গেলো কই কখনও তো বাবাকে কাঁদতে দেখেনি সে,তাহলে কি বাবা পাষাণ?পাষাণ হলে নিশ্চয়ই গভীর মমতায় পরিবারকে আগলে রাখতো না এতো বছর।এইতো সেদিন ইস্কুল থেকে ফিরে রাজ্যের কথা বলতো বাবাকে,হটাত কি যে হল।বাবাটা চোখের সামনে থেকেও হারিয়ে গেলো।সহজ স্বীকারোক্তির মধ্যখানে লজ্জা আর ভয় এসে দাঁড়ালো,শুধু আমার ক্ষেত্রে না আমার ছোট বোনটার ক্ষেত্রেও একি ঘটনা ঘটলো।সে সামান্য কলম থেকে কাপড় পর্যন্ত সবকিছুই খুঁজে ফিরল মার কাছে।
বাবাটা কেমন যেন,অনেকখানি খারাপ আবার অনেকখানি ভালো।পরিক্ষা খারাপ করেছিলাম বলে একবার খুব বকা দিলো,আবার যখন ম্যালেরিয়া বাঁধিয়ে শুয়ে ছিলাম দীর্ঘ একমাস।প্রতি রাতেই আমি ঘুমনোর পর হাত পায়ে চুমো দিত।অনেক ইচ্ছে করতো বলতে "বাবা পায়ে চুমো দিবা না,সুড়সুড়ি লাগে" বলতে পারি নাই।
দাদী মারা যাওয়ায় খুব কষ্ট পেয়েছিলাম আমি,এই কষ্টের মাঝেও আমার মনে বিরাট বাসনা বাবার চোখে পানি দেখবো।দেখতে পারিনি,দাদীর লাশ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল বাবা।বাবার চোখে সানগ্লাস।
ম্যাট্রিক পরিক্ষা যখন শুরু হল,বাবা সাথে যেত।প্রথম পরিক্ষার দিন রিক্সায় হটাত আমার হাতটা নিয়ে নিজের ঘড়িটা পরিয়ে দিল।চোখের পানি লুকিয়ে ছিলাম রাস্তার অন্যপাশে তাকিয়ে।খুব বলতে ইচ্ছে করছিলো "ধন্যবাদ বাবা"।বলতে পারিনি,বেঈমানি করছিলো জিহ্বা।
অগণিত রাত আমি চোখের পানি ফেলে গেছি,একটা প্রশ্ন করবো বলে বাবার পাশে গিয়ে বসেছি নানা অজুহাতে,শেষ পর্যায়ে প্রশ্ন করার সাহস হারিয়ে ফিরে আসতাম।ব্যর্থ সন্তান হওয়ার নমুনা কি এই?
নাহ এবার আমি প্রশ্নটা করবো।বাবা সুস্থ হয়ে উঠলেই প্রশ্নটা করবো।বাবার অনেকগুলো ধন্যবাদ পাওনা,সেগুলো দেবো।বাবুনীকে বলবো বাবাকে নিয়ে লেখা কবিতাটা শোনাতে।আমি কেঁদেছিলাম শুনে,বাবাও কাঁদবে হয়তো।বাবাকে খুশীর খবরটাও দিয়ে দেব।"চাকরী হয়ে গেছে আমার বাবা,যেন তেন চাকরী না।প্রথম শ্রেণীর চাকরী।বেতনও প্রথম শ্রেণীর।প্রতিমাসে তোমার জন্য জুতো কিনবো নতুন নতুন,এক জুতো আর কত"।বাবা কি বুঝবে বুকের মাঝে লুকনো লজ্জা পাওয়া ভালবাসা?
আজানের ধ্বনি কানে আসছে,ভেতর থেকে কেউ একজন বেড়িয়ে আসলো।আমার কাঁধে হাত রেখে বলল "আপনার বাবা মারা গেছে"।কি অদ্ভুত কথা বাবা মারা গেছে।বাবারা আবার মারাও যায়?এই লোক জানে না বাবারা অমর...??
পুত্র বাবাকে কাঁধে নিয়ে হেটে যাচ্ছে আর পুরো পৃথিবী দাঁড়িয়ে গেছে পিতা-পুত্রের ভালোবাসাকে সম্মান করতে
পুনশ্চঃ ছেলেটা অমর বাবার কবরের ফলকে পুরনো সে প্রশ্নটা লিখে দিয়েছিলো।
"এতো বড় হৃদয় নিয়ে কি করে ঘুমাও বাবা?"
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০১৬ রাত ৯:৫৪