কাঁচা কলা এক রাতে পাকা হয় কেমনে?
আজকেই গাছ থেকে কাঁচা কলা কাঁটা হলো। কোনো মতে রাত পারালেই সেই কলা পেকে একেবারে টুকটুকে হলুদ হয়ে যায়। যাকে বলে সোনাই চাচার বিচিত্র কেরামতি! খাওয়ার সময় আপনি টেরই পাবেন না যে, এই কলা গতকালও গাছে একেবারে কাঁচা ছিল, সঙ্গে প্রচুর কসও ছিল। একবার ভাবুন তো কী জাদুতে এই কাঁচা কলা এক রাতে পেকে অমন পাকা কলার মত খাবার উপযোগী হলো?
ঢাকায় যারা কলা বিক্রি করেন, তাদের প্রত্যেকের কাছে আছে কাঁচা কলার আরোতদারদের মোবাইল ফোন। কাঁচা কলার আরোতদার সারাদিন কাঁচা কলা কিনে একটা ঘরে সেই কলা জড়ো করেন। যে ঘরে এই কলা জড়ো করা হয় ওটাকে বলতে পারেন কলার গুদাম। তো সোনাই চাচার মত কেউ কলার গুদামে নিজের শরীর ঘুরানো যায় মাঝখানে এমন একটু বৃত্তাকার জায়গা রেখে চারপাশে কাঁচা কলা থরে থরে এমনভাবে সাজান, যেন নিজের মাথা সমান উঁচু হয় সেই কলার গোল চাকতি। এবার সোনাই চাচা মাথার উপরে ঝুলানো আংটা ধরে খুব কৌশলে কলার চাকতি থেকে নিজেকে টেনে বের করেন।
এবার কলার চাকতিতে ঘুরে ঘুরে খুব ভালো করে বিষাক্ত কীটনাশক ওষুধ চারপাশ থেকে স্প্রে করেন। সোনাই চাচা এই স্প্রে যত মন দিয়ে করবেন, কলা পাকবে ঠিক সেই তালে। স্প্রে করা শেষ হলে ট্যাংকি ভরতি কেরোসিনের হেরিকেন ফুল ভলিউমে জ্বালিয়ে ওই কলার চাকতির ভেতরে উপর থেকে কায়দা করে বসিয়ে দেন সোনাই চাচা। এবার প্রথমে মোটা পলিথিন দিয়ে ওই কলার চাকতিকে এয়ারটাইট করে আটকানো হয়। এই মোটা পলিথিনকে সোনাই চাচা বলেন ত্রিপল। ত্রিপল খুব সুন্দরভাবে বাঁধার পর সোনাই চাচা পরবর্তী কলার চাকতি বানাতে কাজে ব্যস্ত হয়ে যান।
স্প্রে করা এই কাঁচা কলা এয়ারটাইট পলিথিনের ভেতরে হেরিকেনের তীব্র তাপে নেয়ে-ঘেমে একেবারে একাকার হয়ে যায়। আর এভাবে কয়েক ঘণ্টা কাঁচা কলা চাকতির ভেতরে দমবন্ধ হয়ে আটকা থাকলেই পেকে একাকার হয়ে যায়। এবার সেই ফকফকা পাকা কলা পরদিন ঢাকার বাজারে বা সারা দেশের হাটেঘাটে বন্দরে ভোক্তার জন্য সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা হয়।
এখন কেউ যদি কলা খেয়ে ভেতরে চাকা পায় এবং বিক্রেতাকে কোনো ধরনের কমপ্লেইন করে, তাহলে ওই বিক্রেতা মোবাইল ফোনে সোনাই চাচারে একটা ধমক লাগায়। ওই মিঞা কলা এমন জিঙ্গা হইলো কেমনে? যে কলা ঠিকমত পাকে না, ওটাকে ওরা বলে জিঙ্গা। কোন কলা জিঙ্গা হবে, তা নির্ভর করে সোনাই চাচারা কী পরিমাণ বিষাক্ত কীটনাশক স্প্রে করেছিলেন, তার উপর। চাচা যদি কম স্প্রে করেন, তাহলে সেই কলা জিঙ্গা হবে। বিক্রেতা আগেভাগে টের পেলে দামও কম হবে সেই কলার। কলায় যদি ভালোমত স্প্রে হয়, তাহলে সেই কলা খুব সুন্দরভাবে পাকবে। সেক্ষেত্রে সোনাই চাচা খুব মনযোগ দিয়ে যদি স্প্রে করেন, তাহলে কলার ভেতরে কোনো ধরনের চাকা পাওয়ার আর কোনো সুযোগ নাই। আপনি খেয়ে বলবেন, আহা কী সুস্বাদু কলারে ভাই। চাচা আরেকটা খাই। এইডা কী নরসিংদীর কলা?
কিন্তু মিস্টার কলা খাওনেওয়ালা ও মিস কলা খাওনেওয়ালী, আপনি কিন্তু একদম জানেন না যে, এই কলা গতকালও গাছে একেবারে কসযুক্ত কাঁচা কলা হিসেবেই ছিল। আর তা এক রাতেই সোনাই চাচার কেরামতিতে পেকে একেবারে আপনার জিহবার জন্য সুস্বাদু আকারে পরিনত হয়েছে। আর তা পেকেছে সোনাই চাচার ওই জাদুতে। সোনাই চাচা কাজে একটু ফাঁকি দিলে সেই কলা আপনি চোখে ঠিকই পাকা দেখবেন, কিন্তু ভেতরে চাকা চাকা পাবেন। একটু বিরক্তও হবেন। কিন্তু কলার দাম কিন্তু ভাই এক টাকাও কমবে না।
সোনাই চাচাদের কলা পাকানোর এই অভিনব বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এখন গোটা বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু কলা খাওয়ার নামে আপনি যে বিষ খাচ্ছেন, সেজন্য আপনার শরীরে খুব নিরবে মারাত্মক সব জটিল রোগেরও বাসা তৈরি হচ্ছে। সেই খবরটি আপনি ভুলেও টের পাচ্ছেন না। আর গোটা বাংলাদেশের আঠারো কোটি মানুষ এই কৃত্তিম উপায়ে বিষ দিয়ে পাকানো কলা কেবল সারা বছর আরামে খেয়ে যাচ্ছেন। আহা মিঠাই কলা। কত রঙের কলা রে ভাই!
বাংলাদেশে এখন প্রায় সকল খাবারেই এমন নানান কিসিমের ভেজাল মিশ্রিত থাকে। আপনি বাজার থেকে যে কোনো ফল কেনেন না কেন, তা যাতে না পচে সেজন্য এমন বিষাক্ত প্রিজারবেটিভ ব্যবহার করা হয়। আপনি যে মাছ কিনছেন, তা আসলে এক বিষের খনি। আপনি যে ফল খাচ্ছেন, তা আসলে বিষাক্ত খনির আব্বাহুজুর। এমনকি এসব বিষ খেয়ে আপনি যখন ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়ে যে ওষুধ খাচ্ছেন, সেই ওষুধেও আবার ভেজাল। এবার বলেন, আপনি কোথায় যাবেন?
এভাবেই বাংলাদেশের উন্নয়ন শনৈ শনৈ গতিতে জোড় কদমে এগিয়ে যাচ্ছে। যে কারণে আমাদের রাজনীতিবিদরা একটু অসুস্থ হলেই দেশের বাইরে চিকিৎসা করাতে যান। আমাদের পয়সাওয়ালারা একটু অসুস্থ হলেই দেশের বাইরে ছোটেন। কারণ, এই ভেজাল খাবারের গোটা চক্রের আসল ঘি ঘুরে ফিরে ওনাদের ঘরে যায়। কখনো কখনো নিজেদের ভুলে সেই বিষ নিজেদের পেটেও কিছুটা যায় বটে। তাই সুস্থ হবার জন্য আর ভেজাল চিকিৎসার উপর নির্ভর না করে ওনারা দেশের বাইরে গিয়ে ভালো চিকিৎসা নিয়ে আসেন। বুদ্ধি আছে ওনাদের বটে!
এই যে কাঁচা কলা রোজ আপনার চোখের সামনে পাকিয়ে খাওয়ানো হচ্ছে, এটা কিন্তু প্রশাসন জানে। আমাদের পুলিশ জানে। আমাদের রাজনীতিবিদরা জানে। এমনকি আমাদের ভেজালমুক্ত বিএসটিআই-ও জানে। কিন্তু মাগার আপনার এর জন্য দেশে কোনো ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা নাই। আপনি বাজার থেকে সামান্য লাল শাক কিনবেন। বাড়িতে নিয়ে লাল শাক ধুইতে গিয়ে দেখবেন তা দিয়ে রঙ বের হচ্ছে। মানে রঙ দিয়ে আপনাকে টাটকা লাল শাক বলে ওটা বিক্রি করেছে ওই অসাধু বিক্রেতা চক্র। কোথায় যাবেন আপনি? আপনার ভেজাল না খেয়ে কোনো উপায় নাই। যতদিন বাঁবেন ভেজালের উপর বাঁচবেন! শালা ভেজালখোর জাতি একটা!
কলা খাবেন, খান। বুঝে শুনে টিপে টিপে পাকা কলা খান। দেশে এভাবে উন্নয়নের বিশাল জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। আপনি খালি চোখে একদম টেরও পাচ্ছেন না, এত উন্নয়ন রাতারাতি কেমনে কেমনে হচ্ছে! কি বিচিত্র দেশরে ভাই! পৃথিবীর আর কোথাও এমন দেশ দ্বিতীয়টি নেই। যান বাড়িতে গিয়ে বেশি বেশি পাকা কলা খান। শরীর ভালো থাকবে।
.........................
২ নভেম্বর ২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:২৬