গতকাল বুধবার ১১ মে ২০১৬ শেরে বাংলা নগরের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৪ প্রদান করা হয়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের নির্মাতা, প্রযোজক, শিল্পী, কলাকুশলী, পরিবেশক ও সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষের এক মিলনমেলায় পরিনত হয় জমকালো অনুষ্ঠান। এই প্রথম কোনো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত ছিলাম। যে কারণে অনুষ্ঠানের সকল অভিজ্ঞতাও আমার কাছে প্রথম।
কিন্তু অনুষ্ঠানের কিছু সুস্পষ্ট বিষয়ের প্রতি আমি তথ্য মন্ত্রণালয়ের সদয় দৃষ্টি আকর্ষন করছি। ২০১৪ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার হিসাবে বছরের শুরুতে প্রথমে মুরাদ পারভেজ পরিচালিত ’বৃহন্নলা’ ছবিটিকে শ্রেষ্ঠ ছবি’র পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের গল্প চুরির অভিযোগে মুরাদ পারভেজের ছবি ‘বৃহন্নলা’ কে পুরস্কারের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। পরে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা মাসুদ পথিক পরিচালিত ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ ছবিটিকে শ্রেষ্ঠ ছবি হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এটা নিয়ে আগেও আমরা অনেক লেখালিখি করেছি। কিন্তু আজকের অনুষ্ঠানেও মুরাদ পারভেজ ভূত ভর করেছিল।
অনুষ্ঠানে ২০১৪ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার হিসাবে ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ ছবিটির নাম ঘোষণার সময় প্রযোজক হিসাবে মাসুদ পথিকের নামের সঙ্গে ঘোষিকা মুরাদ পারভেজ জুড়ে দেন! ঘোষিকা ঘোষণা করেন ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ শ্রেষ্ঠ ছবির প্রযোজক মাসুদ পথিক মুরাদ পারভেজ! মাসুদ পথিক যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার গ্রহণ করছেন, তখন ঘোষিকা দ্বিতীয়বার উচ্চারণে শুধু মাসুদ পথিক বলেছেন।
আমার প্রশ্ন হলো, যে অনুষ্ঠানে স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রধান অতিথি হিসেবে, যেখানে স্বয়ং তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী ও সচিব এবং জাতীয় সংসদের তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি উপস্থিত, সেই অনুষ্ঠানে একজন ঘোষিকার পক্ষে লিখিত স্ক্রিপ্টের বাইরে একটি শব্দও কী উচ্চারণ করা সম্ভব? জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে শ্রেষ্ঠ ছবির প্রযোজকের নাম কীভাবে ঘোষিকা ভুল করেন? নাকি এই ভুল ইচ্ছাকৃত? কারণ মাসুদ পথিকের নামের সঙ্গে এই ‘মুরাদ পারভেজ’ যোগ করার মধ্যে একটি ছোট্ট ইনটেনশন বা রাজনীতি ছিল। যা উপস্থিত দর্শকদের কাছে দৃষ্টিকটু ঠেকেছে।
একজন ঘোষিকা যিনি শ্রেষ্ঠ ছবির প্রযোজকের নাম ভুল পড়েন, তিনি কোন যোগ্যতায় এমন একটি জাতীয় অনুষ্ঠানে ঘোষিকা হবার সুযোগ পান? কাদের ইসারায় এমন ঘোষিকারা জাতীয় অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন? এটা কী আমাদের জাতীয় লজ্বা নাকি এর ভেতরে আমাদের চলচ্চিত্র অঙ্গনের নোংরা রাজনীতির কোনো অশুভ ইঙ্গিত দৃশ্যমান? একজন ঘোষিকা তো ঠিকমত ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’-ই উচ্চারণ করতে পারলেন না, নাকি এটাও ইচ্ছাকৃত ভুল? তথ্য মন্ত্রণালয় এসব ভুল নিয়ে জাতিকে আসলে কী উপহার দিচ্ছে!
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৪ উপলক্ষ্যে তথ্য মন্ত্রণালয় একটি ৪৬ পৃষ্ঠার স্মরণিকা বের করেছে। সেখানেও ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ ছবিটি যে কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ কবিতা অবলম্বনে নির্মিত সেই কথাটি কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। নাকি এটাও ইচ্ছাকৃত ভুল। যেখানে প্রযোজকের পক্ষ থেকে ছবির বর্ণনায় শুরুতেই এই কথাটির উল্লেখ ছিল, সেটি কী কারণে বাদ যায়? তাছাড়া বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো কবিতা অবলম্বনে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সেই কথাটি স্মরণিকায় উল্লেখ না থাকাটা কী কেবল তথ্য মন্ত্রণালয়ের ভুল নাকি এখানেও সেই নোংরা রাজনীতির কোনো কারসাজি আছে? ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ ছবিটি শ্রেষ্ঠ ছবির পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক, শ্রেষ্ঠ গীতিকার, শ্রেষ্ঠ সুরকার, শ্রেষ্ঠ গায়িকা ও শ্রেষ্ঠ মেকাপ আর্টিস্ট পুরস্কার বিজয়ী। অথচ স্মরণিকায় ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ ছবির গানের যে লিরিক ব্যবহার করা হয়েছে সেখানেও গানের কলিতে ভুল! এটাও কী ইচ্ছাকৃত নাকি তথ্য মন্ত্রণালয় এরকম ভুল সবসময়ই করে থাকে?
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি পুরস্কারপ্রাপ্তদের হাতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৪ তুলে দেন। অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি একেএম রহমতুল্লাহ এমপি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। স্বাগত বক্তব্য দেন তথ্য সচিব মরতুজা আহমদ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন বিমানে চড়েন তখন সিনেমা দেখেন। বিষয়টি জানতে পেরে ভালো লাগলো। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আরো উন্নয়ন করার যে আশাবাদ তিনি ব্যক্ত করলেন, সেজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।
অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু চমৎকার বক্তৃতা করলেন। এমন চৌকশ একজন মন্ত্রী’র নেতৃত্বে প্রকাশিত এমন একটি স্মরণিকায় এত ভুল স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়া যায় না। আমার আশংকা এর ভেতরে অন্য কোনো নোংরা রাজনীতি জড়িত।
২০১৪ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার হিসাবে আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন সৈয়দ হাসান ইমাম ও রাণী সরকার। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’, প্রযোজক মাসুদ পথিক। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক পুরস্কার পেয়েছেন জাহিদুর রহিম অঞ্জন (চলচ্চিত্র: মেঘমাল্লার)। শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে ‘গাড়িওয়ালা’, প্রযোজক মো. আশরাফুল আলম (আশরাফ শিশির)।
শ্রেষ্ঠ অভিনেতা পুরস্কার পেয়েছেন ফেরদৌস আহমেদ (চলচ্চিত্র: এক কাপ চা)। শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী পুরস্কার পেয়েছেন যৌথভাবে মৌসুমী (চলচ্চিত্র: তাঁরকাটা) ও বিদ্যা সিনহা মিম (চলচ্চিত্র: জোনাকির আলো)। শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা পুরস্কার পেয়েছেন শাহ মো. এজাজুল ইসলাম (চলচ্চিত্র: তাঁরকাটা) ও শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছেন চিত্রলেখা গুহ (চলচ্চিত্র: ৭১ এর মা জননী)। শ্রেষ্ঠ অভিনেতা খল চরিত্রে পুরস্কার পান তারিক আনাম খান (চলচ্চিত্র: দেশা দ্যা লিডার) ও শ্রেষ্ঠ অভিনেতা কৌতুক চরিত্রে পুরস্কার পান মিশা সওদাগর (চলচ্চিত্র: অল্প অল্প প্রেমের গল্প)। শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী পুরস্কার পান আবির হোসেন অংকন (চলচ্চিত্র: বৈষম্য) ও শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী শাখায় বিশেষ পুরস্কার পান মারজান হোসাইন জারা (চলচ্চিত্র: মেঘমাল্লার)।
শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক পুরস্কার পান ড. সাইম রানা (চলচ্চিত্র: নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ), শ্রেষ্ঠ গায়ক পুরস্কার পান মাহফুজ আনাম জেমস (চলচ্চিত্র: দেশা দ্যা লিডার), শ্রেষ্ঠ গায়িকা পুরস্কার পান যৌথভাবে রুনা লায়লা (চলচ্চিত্র: প্রিয়া তুমি সুখী হও) ও মমতাজ (চলচ্চিত্র: নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ)। শ্রেষ্ঠ গীতিকার পুরস্কার পান মাসুদ পথিক (চলচ্চিত্র: নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ), শ্রেষ্ঠ সুরকার পুরস্কার পান বেলাল খান (চলচ্চিত্র: নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ)।
শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার পুরস্কার পান আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (চলচ্চিত্র: মেঘমাল্লার)। শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার পুরস্কার পান সৈকত নাসির (চলচ্চিত্র: দেশা দ্যা লিডার)। শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা পুরস্কার পান জাহিদুর রহিম অঞ্জন (চলচ্চিত্র: মেঘমাল্লার)। শ্রেষ্ঠ সম্পাদকের পুরস্কার পান তৌহিদ হোসেন চৌধুরী (চলচ্চিত্র: দেশা দ্যা লিডার)। শ্রেষ্ঠ শিল্পনির্দেশকের পুরস্কার পান মারুফ সামুরাই (চলচ্চিত্র: তাঁরকাটা)। শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক পুরস্কার পান মোহাম্মদ হোসেন জেমী (চলচ্চিত্র: বৈষম্য)। শ্রেষ্ঠ শব্দগ্রাহক পুরস্কার পান রতন পাল (চলচ্চিত্র: মেঘমাল্লার)। শ্রেষ্ঠ পোষাক ও সাজসজ্জা পুরস্কার পান কনক চাঁপা চাকমা (চলচ্চিত্র: জোনাকির আলো)। শ্রেষ্ঠ মেকাপম্যান পুরস্কার পান আবদুর রহমান (চলচ্চিত্র: নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ)।
২৬টি ক্যাটাগরিতে মোট ২৯ জন শিল্পী ও কলাকুশলী জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৪ বিজয়ী হন। আজীবন সন্মাননা পাওয়া দুই অভিনয় শিল্পীকে দেড় লাখ টাকা, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ও শ্রেষ্ঠ পরিচালককে এক লাখ টাকা করে এবং অন্যদের ৫০ হাজার টাকার চেক দেওয়া হয়। এছাড়া প্রত্যেককে ১৮ ক্যারেট ১৫ গ্রাম ওজনের স্বর্ণপদক দেওয়া হয়। তবে অনুষ্ঠানে পদকের রেপ্লিকা দেওয়া হয়, যা ছিল ছয় গ্রাম স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া ব্রোঞ্জের।
পুরস্কার বিতরণের পর শুরু হয় জমজমাট আলো ঝলমলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নাচ-গান আর হৈ চৈ এর এই পর্বে উপস্থাপনায় ছিলেন অভিনেতা রিয়াজ এবং অভিনেত্রী নওশীন। নৃত্যশিল্পী মৌ তাঁর দলসহ মঞ্চে কিছু নান্দনিক নৃত্য পরিবেশনা করেন। শিল্পিী ফাহমিদা নবী গেয়ে শোনান 'লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প’ গানটি আর সঙ্গীতশিল্পী মমতাজ শোনান 'নিশি পঙ্খী' ও 'আগে যদি জানতামরে বন্ধু’ গান দুটি। এছাড়াও অনুষ্ঠানে পারফর্ম করেন অমিত হাসান, ওমর সানী, নিরব, ইমন, তমা মির্জা, পরীমনি, আইরিন এবং ভাবনা।
..........................
১১ মে ২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০১৬ বিকাল ৩:২৭