বৈশাখের প্রখর তাপদাহের ভেতর আজ সন্ধ্যায় শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে বয়ে গেল সুরের ঝর্নাধারা। চলতি সপ্তাহের চলমান প্রচণ্ড তাপদাহ উপেক্ষা করে হল ভর্তি দর্শক শ্রোতারা মুগ্ধ হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে। ভারতের বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী শ্রীমতী সুস্মিতা পাত্র এক এক করে গাইলেন রবী ঠাকুরের বহুমাত্রিক গান। রবীন্দ্রনাথের পূজা, প্রেম, প্রার্থণা, প্রকৃতি ও স্বদেশ পর্বের গানে সাজানো টানা দেড় ঘণ্টা দর্শক শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মত এক জাদুকরী কণ্ঠের গানে আবিষ্ট থাকলেন।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একশত পঞ্চান্নতম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও রবীন্দ্র একাডেমি'র যৌথ আয়োজনে একক সংগীত পরিবেশন করলেন ভারতের বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী শ্রীমতী সুস্মিতা পাত্র। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এমপি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি এম আজিজুর রহমান। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন রবীন্দ্র একাডেমি'র সাধারণ সম্পাদক বুলবুল মহলানবীশ ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী।
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় অনুষ্ঠান শুরুর কথা থাকলেও কয়েক মিনিট দেরিতে অনুষ্ঠান শুরু হওয়ায় বক্তরা দর্শক শ্রোতাদের কথা বিবেচনায় নিয়ে খুব সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা প্রদান করেন। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তমনা লেখক, প্রকাশক, শিক্ষক ও মুক্তবুদ্ধি চর্চারত মানুষের উপর সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
দুই পর্বে সাজানো অনুষ্ঠানের বক্তৃতাপর্ব শেষ হলেই দ্বিতীয় পর্বে মঞ্চে ওঠেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুরের মেয়ে বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী শ্রীমতী সুস্মিতা পাত্র। এটা ছিল শিল্পী সুস্মিতা পাত্রের প্রথম বাংলাদেশ সফর। আর প্রথম সফরেই রবী ঠাকুরের ভিন্নধারার অল্প শোনা, বহুল শ্রুত বা একেবারে অফট্রাকের কিছু গান গেয়ে দর্শক শ্রোতাদের হৃদয় জয় করলেন। রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্বের ''প্রভু প্রভু, তোমা লাগি আঁখি জাগে/দেখা নাই পাই/পথ চাই/সেও মনে ভালো লাগে॥ ধূলাতে বসিয়া দ্বারে ভিখারি হৃদয় হা রে/ তোমারি করুণা মাগে; কৃপা নাই পাই/শুধু চাই,/সেও মনে ভালো লাগে॥'' গানটি দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করেন শিল্পী সুস্মিতা পাত্র।
তারপর একে একে গাইলেন রবীন্দ্রনাথের পূজা, প্রেম, প্রার্থণা, প্রকৃতি ও স্বদেশ পর্বের খুব অপ্রচল, অল্পশ্রুত গান 'কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো/বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো', ‘তোমার আমার এই বিরহের অন্তরালে’, ‘আমারে করো তোমার বীণা’, ‘লুকিয়ে আসো আঁধার রাতে’, ‘সুখের মাঝে তোমায় দেখেছি’,’বঁধু তোমার’, 'আমি তোমারি মাটির কন্যা', 'মধুর তোমার শেষ যে না পাই', 'চিরসখা হে ছেড়ো না', 'তোমার অসীমে প্রাণময় লয়ে'সহ একটানা প্রায় বিশ বাইশটি গান করেন শিল্পী সুস্মিতা পাত্র। রাত নয়টার দিকে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ পর্বের ''বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল/পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান/বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ/পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক হে ভগবান'' গানটি দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করেন শিল্পী সুস্মিতা পাত্র।
রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগীত বিষয়ে মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়ার কৃতিত্ত্ব অর্জনকারী শ্রীমতী সুস্মিতা পাত্রের ভরাট ও দরদী কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের অপ্রচলিত গানগুলোও যেন দর্শক শ্রোতাদের কাছে বৈশাখের তাপদাহ ভোলার একটি মোক্ষম উপলক্ষ্য হয়ে দেখা দিয়েছিল আজ কয়েক মুহূর্তের জন্য। ''আকাশ আমায় ভরল আলোয়, আকাশ আমি ভরব গানে। সুরের আবীর হানব হাওয়ায়, নাচের আবীর হাওয়ায় হানে॥ ওরে পলাশ, ওরে পলাশ, রাঙা রঙের শিখায় শিখায় দিকে দিকে আগুন জ্বলাস– আমার মনের রাগ রাগিণী রাঙা হল রঙিন তানে॥'' এই গানটি যেন সদ্য বিদায় নেওয়া বসন্তের পর গ্রীষ্মের প্রখর সূর্যের প্রচণ্ড তাপদাহের আগুন জ্বালানোর কথাকেই দর্শক শ্রোতাদের স্মরণ করিয়ে দিল।
শিল্পী'র নিজের বাছাই করা গানের ফাঁকে ফাঁকে দর্শক শ্রোতাদের পছন্দের গানও শোনালেন প্রথম বারের মত বাংলাদেশ সফরে আসা শিল্পী সুস্মিতা পাত্র। আজকের অনুষ্ঠানে শিল্পী মূলত রবীন্দ্রনাথের টপ্পা ঘরানা ও কীর্তন ঘরানার গান দিয়ে সাজিয়েছিলেন। কিন্তু শ্রোতাদের অনুরোধের কাছে হার মেনে তিনি শ্রোতাদের পছন্দের গান গেয়েও সবাইকে মুগ্ধ করেন।
শিল্পী শ্রীমতী সুস্মিতা পাত্র'র এখন পর্যন্ত তিনটি একক অ্যালবাম বাজারে এসেছে। ২০১০ সালে অনন্যা থেকে প্রথম প্রকাশ পায় তাঁর একক অ্যালবাম 'অরুণালোকে'। ২০১৪ সালে পিকাশো থেকে প্রকাশ পায় শিল্পী'র দ্বিতীয় একক অ্যালবাম 'অবেলায়'। আর ২০১৫ সালে কসমিক হারমোনি থেকে প্রকাশ পায় তাঁর তৃতীয় একক অ্যালবাম 'নয়নে সাজায়ে'। ২০১৪ সালে শোভিক মিত্রের নির্মিত 'পুনশ্চ' চলচ্চিত্রে তিনি রবীন্দ্রনাথের গান ''গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ'' গেয়েছেন। এছাড়া একটি সিডি কোম্পানি' প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের গীতিনৃত্য 'চিত্রাঙ্গদা'য় তিনি কণ্ঠ দেন। আকাশ বাণী ও দূর দর্শনেও তিনি গান করেন। এছাড়া ভারতের বাংলা চ্যানেলগুলোতে তিনি নিয়মিত গান করেন। প্রথমবার বাংলাদেশ সফরে এসেও তিনি তিনটি বাংলাদেশি চ্যানেলে গান করার অফার পেলেন। অর্থ্যাৎ এখন থেকে বাংলাদেশের দর্শক শ্রোতারা নিয়মিত শিল্পী সুস্মিতা পাত্রের গান শুনতে পারবেন।
রবীতীর্থের বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী শ্রীমতী সুচিত্রা মিত্র ছিলেন সুস্মিতা পাত্রের রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ের প্রথম গুরু। পরবর্তী সময়ে তিনি শ্রীমতী শ্রাবণী সেনের কাছে রবীন্দ্রসংগীতে উচ্চতর তালিম নেন। অনুষ্ঠান শেষে প্রথমবার বাংলাদেশ সফরে দর্শক শ্রোতাদের মুগ্ধ করা শিল্পী সুস্মিতা পাত্র আবারও বাংলাদেশে আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শিল্পী সুস্মিতা পাত্রের সঙ্গে বাংলাদেশে বেড়াতে আসা তাঁর দিদি সংহিতা পাত্র ও দাদা সৌমেন পাত্র।
..................................
৩০ এপ্রিল ২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০১৬ বিকাল ৪:২১