দিনো'র মা'র পাঠশালা ছিল আমার প্রথম স্কুল। আমাদের হরিসভার ঠিক পেছনে বিপদভঞ্জন দাদু'র বাড়ি। বিপদভঞ্জন দাদু'র বাড়ির পেছনে একটা পুকুর। পুকুরের পাড় ঘেঁষে দিনোদের গোয়াল ঘর। গোয়াল ঘরের ঠিক পশ্চিম পাশে পূর্বমুখী আমাদের পাঠশালা। তার ডানপাশে দক্ষিণমুখী দিনোদের বসত ঘর। বসত ঘরের ডানদিকে দিনোদের রান্নাঘর। গোয়ালঘর, পাঠশালা, বসত ঘর আর রান্নাঘরের মাঝখানে দিনোদের উঠান। পাঠশালা আর বসত ঘরের মাঝখান থেকে শশধরদের বাড়িতে যাবার রাস্তা। আর গোয়াল ঘর ও রান্নাঘরের মাঝখান থেকে বিপদভঞ্জন দাদু'র বাড়িতে যাবার রাস্তা। সাধারণত আমরা বর্ষাকালে শশধরদের বাড়ির পথ দিয়ে পাঠশালায় যেতাম। আর শুকনোকালে যেতাম সোজা মাঠ পেরিয়ে গোয়াল ঘর আর রান্না ঘরের মাঝখানের পথ দিয়ে। দিনোদের বাড়ির পূর্বপাশটা ছিল ফাঁকা মাঠ। ওই ফাঁকা মাঠ দিয়ে সোজা পূর্বদিকে আমাদের বাড়ি প্রায় মাইল খানেক দূর।
আমাদের বাড়ি থেকে দিনোদের বাড়ি আর বিপদভঞ্জন দাদু'র বাড়ি তখন খালি চোখে দেখা যেত। শুকনোর সময় আমরা দলবেঁধে ফাঁকা মাঠের ভেতর দিয়ে দলবেঁধে হেঁটে হেঁটে পাঠশালায় যেতাম। আর বর্ষাকালে যেতে হতো গ্রামের রাস্তা ধরে কৃষ্ণদের বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে, তারপর বাড়ৈ বাড়ির পুকুর পাড় থেকে যতীন মণ্ডলের বাড়ির ভেতর দিয়ে শশধরদের উঠোন মাড়িয়ে। তবে শুকনো মৌসুমেও পাঠশালা থেকে ফেরার পথে সাধারণত আমরা বর্ষকালের ঘুর পথই বেছে নিতাম। কারণ গাছের ছায়ায় ছায়ার আসার জন্য ওই দূরের পথ মাড়াতে হলেও তা ছিল অনেকটা আরামদায়ক আর ঘটনাবহুল।
আমাদের বাড়ি থেকে দিনো'র মা'র পাঠশালায় যেতাম আমরা পাঁচজন। আমার বড় তিন বোন, আমার চাচাতো ভাই কালাম আর আমি। কালাম ছিল বয়সে আমার চেয়ে মাত্র এক মাসের বড়। কিন্তু মারামারিতে কখনো আমার সাথে পারতো না। আমাদের সাথে তখন পড়ত বিনয়, ভজন, স্বপন, ঋষিকেশ, কৃষ্ণ, শশধর, সুখময়, বীরেন, সুনীল, সুবোধ, প্রকাশ, জীবন, প্রভাতী, সুভাষিণী আর পারুল। এদের মধ্যে শশধর আর জীবনকে আমরা সবাই দাদা ডাকতাম। কারণ ওরা বয়সে আমাদের চেয়ে অনেক বড় ছিল। আর মেয়েদের মধ্যে প্রভাতী ছিল বয়সে বড়।
পাঠশালায় যাওয়া-আসার পথে প্রায়ই তখন শশধর আর জীবনের মধ্যে একটা কনফ্লিক্ট হতো। আমরা ছোটরা তখন প্রায় পুরোটা পথ একেক সময় ওদের যুদ্ধরত একেকজনের পক্ষ নিতাম। পাঠশালা থেকে কৃষ্ণদের বাড়ি পর্যন্ত আমরা প্রায়ই থাকতাম শশধরের পক্ষে। কারণ ওই পর্যন্ত ছিল শশধরের টেরিটরি। এরপর আমরা ইনিয়ে বিনিয়ে নানান কিসিমের অযুহাত দেখিয়ে জীবনের পক্ষ নিতাম। কারণ পরের পথটুকু পাড়ি দিতে সামনে জীবনের বাড়ি পড়তো। মাঝে মাঝে আমাদের উপরের ক্লাসের গোউর, নিতাই, রমেশরা যেদিন শশধরের পক্ষ নিতো, সেদিন একেবারে বিমলদাদের বাড়ি পর্যন্ত আমরা শশধরের পক্ষেই থাকতাম। বিমলদাদের বাড়ির ঠিক পরেই ছিল জীবনদের বাড়ি। তখন আমরা আবার দু'চার কথা ইনিয়ে বিনিয়ে শশধরের নামে বলে জীবনের পক্ষ চলে আসতাম। মাঝে মাঝে কখনো পুরো পথ আমরা জীবনের বিপক্ষে থাকতাম। সেদিন অবশ্য সুনীল, সুবোধ, প্রকাশরা মিলে আমাদের একেবারে জীবনদের বাড়ি ক্রোস করে ঘরামী বাড়ি যেখানে শেষ সেই ত্রিমোহনা পর্যন্ত আমাদের সাথে থাকতো। যাতে জীবন আমাদের কিছু করতে না পারে।
শশধর আর জীবনের মধ্যে যুদ্ধটা শুরু হতো পাঠশালায় বসেই। আমরা তখন তালপাতা ক্লাসের ছাত্র। দিনো'র মা'র নিয়ম কানুন ছিল ভারী কড়া। তালপাতার উপর লোহা পুড়িয়ে বড়রা আমাদের অক্ষর লিখে দিত। পাঠশালায় গিয়ে আমাদের প্রথম কাজ ছিল দোয়াতের মধ্যে জল আর কয়লা গুলিয়ে পছন্দ মত ভালো কালি বানানো। কালি বানানো শেষ হলে আমরা টুনির কলম দিয়ে সেই তালপাতায় প্রথমে লিখতাম স্বরবর্ণের অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, ৯, এ, ঐ, ও, ঔ, অং, আঃ। তারপর লেখা শেষে দিনো'র মাকে তা দেখাতাম। দিনো'র মাকে আমরা ডাকতাম দিদিমণি। দিদিমণি'র যে কোনো কথার জবাব দিতে হতো 'আজ্ঞে' বলে। দিদিমণি প্রত্যেকের তালপাতা খুব মনোযোগ দিয়ে পরখ করতেন। তারপর আরেকবার ব্যঞ্জনবর্ণ ক, খ, গ, ঘ, ঙ, চ, ছ, জ, ঝ, ঞ, ট, ঠ, ড, ঢ, ণ, ত, থ, দ, ধ, ন, প, ফ, ব, ভ, ম, য, র, ল, ব, শ, ষ, স, হ, ক্ষ, ড়, ঢ়, য়, ৎ, ং, ঃ, ঁ লিখে আবার দিদিমণিকে দেখাতাম। তারপর তালপাতা ধোয়ার জন্য দিনোদের পুকুরে যেতাম হৈ হৈ করতে করতে। যতক্ষণ আমরা পাঠশালায় থাকতাম, ততক্ষণ এটাই ছিল আমার ডিউটি। আর দুপুর বারোটা বাজলেই আমাদের ছুটি হতো। তখন সবাই দিনোদের উঠানে ক্লাস অনুযায়ী কয়েক লাইনে দাঁড়িয়ে ক'য় অ কারে কা, ক'য় ই কারে কি, ক'য় ঈ কারে কী ইত্যাদি পড়ে দে বাড়ির দিকে ছুট।
তালপাতা ধোয়ার জন্য পুকুর পাড়ে যাবার সময়ই শশধর আর জীবনের মধ্যে প্রথম যুদ্ধটা শুরু হতো। প্রথমে জল ছিটিয়ে, তারপর একেঅপরের গায়ে তালপাতার কালি মাখিয়ে দিয়ে। এরপর একসময় হাতাহাতি। ভেতর থেকে কেউ দেখে ফেললেই সেই যুদ্ধে তখন কয়েক ঘণ্টার বিরতি লাগত। কখনো কখনো দিনো'র মা নিজেই রান্না ঘর থেকে এই হাতাহাতি দেখে ফেলতেন। তখন শশধর আর জীবন দু'জনকেই কড়া শাস্তি দিতেন। মাঝখানে কোনো এক সময় শশধর পাঠশালা থেকে পালিয়ে একবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসত। আসলে শশধর তখন জীবনকে মারার জন্য পথে কোথাও লাঠি লুকিয়ে রেখে আসতে যেত। পাঠশালা ছুটির পর তখন যুদ্ধটা আবার শুরু হতো পথে। কখনো কখনো জীবন তখন মাইর খাওয়ার ভয়ে ফাঁকা মাঠ দিয়ে বাড়ি চলে যেত। আর যদি জীবন ছায়াপথে যেত তখন যুদ্ধটা তর্ক দিয়ে শুরু হতে হতে নিতাইদের বাড়ি পর্যন্ত চলত। তারপর নিতাই আর কৃষ্ণদের বাড়ির ফাঁকা রাস্তায় মারামারিটা হতো। মাঝে মাঝে জীবন প্রথম মাইরটা খাবার পর হয় শশধরের লাঠি কেড়ে নেবার চেষ্টা করত। আর তখন লাঠি কেড়ে নেওয়া নিয়ে শুরু হতো দু'জনের মহা ঠাসাঠাসি। আমরা পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তখন হাততালি দিতাম।
তখন একটা বিষয় প্রায়ই ঘটত সেটা হলো, ওদের মারামারিতে আমাদের মত দর্শক না থাকলে সেদিন ওরা পরম্পর গালাগালি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকত। পরে ও ওকে দেখে নিবে এমন হুমকি ধমকি দিয়ে সেদিনের যুদ্ধ শেষ হতো। দর্শক না থাকলে কদাচিৎ ওরা মারামারি করত। কিন্তু দর্শক থাকলে তখন ওরা মারামারিতে সবসময় বেশি আগ্রহ দেখাত। এমন ভাব দেখাত যে, আজকের লড়াইটাই জীবনমরণ লড়াই। কেউ একজন বাঁচবে আর অন্যজন আজ নিশ্চিত মারা যাবে। কখনো কখনো জীবন প্রথম মাইরটা খাওয়ার পর গাছের ডাল ভেঙ্গে পাল্টা শশধরের উপর চড়াউ হতো। তখন সত্যি সত্যি যুদ্ধটা খুব জমতো। তবে লাঠির চেয়ে হাতাহাতি'র যুদ্ধটাই আমরা বেশি উপভোগ করতাম। কারণ তখন ওরা কিছুক্ষণ হাতাহাতি করার পরেই এক পর্যায়ে ঠাসাঠাসি শুরু করত।
কেউ নিচে বেশিক্ষণ থাকলে আমরা দর্শকরা আবার ওদের পেছন থেকে ঠেলা দিয়ে তখন উল্টে দিতাম। এই কাজটা সাধারণত বেশি করত রমেশ আর বীরেন। কারণ আমরা ছোটরা কেউ এই কাজে জড়ালে আড়চোখে ওরা দেখে নিত কে কাকে উল্টে দিতে সহায়তা করছে। তখন কখনো কখনো নিজেদের মারামারি বাদ দিয়ে ওরা সেই তৃতীয় দুর্বল পক্ষকে অ্যাটাক করতো। তবে প্রকাশ, সুবোধ, সুনীল, রমেশরা কেউ এটা করলে জীবন আর পাল্টা আক্রমণে তখন সাহস পেত না। কারণ সুবোধ আর প্রকাশ ছিল চাচাতো ভাই। আবার রমেশ আর সুনীলও পরস্পরের চাচাতো ভাই। আবার সুবোধ, সুনীল, রমেশরা মামতো-পিসাতো ভাই। সুনীলের বাবা হলো সুবোধের বড় মামা। আর রমেশের বাবা হলো সুবোধের মেজো মামা। সেই হিসাবে প্রকাশ, সুবোধ, সুনীল, রমেশরা অটোমেটিক একটা শক্তিশালী জোট হয়ে যেত। জীবন তখন এমনিতেই লেজ গুটিয়ে বাড়ির পথ ধরতো।
আবার তখনো শশধরের পক্ষে ওদের পাড়ার নিতাই, গোউর, কৃষ্ণ, ঋষিকেশ, স্বপনরা থাকতো। তাই কৃষ্ণদের বাড়ি পর্যন্ত জীবন মূলত একাই লড়াই করত। কখনো গোউর নিতাইদের সাথে রমেশের কোনো ব্যাপার ঘটলে সেদিন দেখা যেত রমেশ বীরেন, সুখময়রা শশধরের পক্ষ ছেড়ে জীবনের পক্ষ নিতো। সেদিন আসলে লড়াইটা বেশি জমতো। শশধর আর জীবনের এই লড়াই ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার। যেদিন পাঠশালা বন্ধ থাকতো, সেদিন বিকালে খেলার মাঠেও এই যুদ্ধটা গড়াতো। এই লড়াইটা না করলে আসলে সেদিন ওদের কারোর পেটের ভাত হজম হতো না। যেদিন মারামারিটা একটু বেশি হতো বা কেউ সিরিয়াস ইনজুরি হতো, সেদিন আবার এটা নিয়ে পরে বিচার-শালিশ বসতো। সেক্ষেত্রে পরবর্তী কয়েকদিন শশধর আর জীবনের লড়াইটা কেবল গালাগালি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকতো। পরে মাঝখানে কয়েকটা দিন গেলেই আবার শুরু হতো ওদের সেই নিত্যকার যুদ্ধ।
সাধারণত শশধর আর জীবনের এই লড়াইয়ে আমি যেদলে যেদিন থাকতাম, আমার চাচাতো ভাই কালামও সেদিন সেই দল বেছে নিতো। কোনো কারণে যদি কালাম আমার বিপক্ষ দল বেছে নিতো, সেক্ষেত্রে ত্রিমোহনা থেকে আমাদের বাড়ির রাস্তায় এসেই কালাম আর আমার মধ্যে শুরু হতো ঠিক শশধর আর জীবনের করা লড়াইটার শেষ অংক। আর সেদিন কালাম ঘুঘুঠাসা আর দু'চারটা মাইর খেয়ে বাড়িতে এসে মা'র কাছে কেঁদেকেটে নালিশ দিতো। সেই নালিশে আবার আমার বিচার হবার পালা আসতো। সেই বিচার সবসময় করতেন বাবা। যেদিন কালাম মাইর খেয়ে বাড়িতে এসে মা'র কাছে বেশি নালিশ দিতো, সেদিন আবার আমার দুপুরের খাওয়া থাকতো বন্ধ। কারণ ভয়ে আমি বাবার সামনে খাবার খেতে যেতাম না। আমি তখন কালামদের ঘরের খাটের নিচে গিয়ে পালিয়ে থাকতাম।
কালামের মা মানে আমার চাচী তখন আমাকে ডেকে খাবার দিতেন। কালাম তখন চোখ পাকিয়ে পাকিয়ে দাদির কাছে নালিশ দিতো। বলতো, ও আমারে মারছে, আবার আমাদের ঘরে খাচ্ছে। কখনো কখনো সেই খাবার খাওয়ার সময় কালাম পাল্টা অ্যাটাক করতো আমাকে। আমি তখন খাওয়া ফেলে আবার মারামারি শুরু করতাম। কালামদের ঘরে বসে সেই মারামারিতেও আমাকে হারানো কালামের সাধ্য ছিল না। ও আসলে ছিল একটা ভীতুর ডিম। আমার তখন কাজ ছিল লাফ দিয়েই কালামকে জাপটে ধরে ঠাসাঠাসি করা। কারণ গায়ের শক্তিতে কালাম আমার সাথে তখন কিছুতেই পারতো না। তখন দাদী আর চাচী মিলে আমাদের সেই যুদ্ধটা ছাড়াতেন। সেক্ষেত্রে কখনো কখনো ভয়ে আমি রাতের খাবারও কালামদের ঘরেই খেতাম। কারণ এসব মারামারির খবর মা ঠিকই বাবাকে একফাঁকে বলে দিতেন।
বিপদভঞ্জন দাদু ছিলেন একজন জাত শিল্পী। ওনার নিজের একটা কীর্তনের দল ছিল। তিন মেয়ে সবিতা, কবিতা, নমিতা ও একমাত্র ছেলে বিনয়, আর একই পাড়ার বিন্দু, মরাইদা (শশধরের বড় ভাই), বিষ্ণু, সাধু (সুবোধের মেজো ভাই), মনোজদের নিয়ে ছিল এই কীর্তনের দল। সকালে আমাদের পাঠশালা যখন শুরু হতো, ওদিকে ওপাশে তখন বিপদভঞ্জন দাদু বিন্দু, সাধু, মরাইদা, সবিতা, কবিতাদের নিয়ে গান অনুশীলন করতেন। হারমোনিয়াম, মন্দিরা আর খোলের শব্দ শুনলেই আমার পাঠশালার পড়াশুনার তখন কার্যত বারোটা বাজত। তখন একফাঁকে আমি পাঠশালা ফাঁকি দিয়ে (সাধারণত তালপাতা পুকুর ঘাটে ধুইতে এসে) পালিয়ে বিপদভঞ্জন দাদু'র বাড়িতে গিয়ে হাজির হতাম। বিপদভঞ্জন দাদু আমাকে খুব ভালোবাসতেন। আমাকে দেখলেই তিনি কোলে নিয়ে বসাতেন। আর হারমোনিয়াম বাজাতেন। বিপদভঞ্জন দাদু হরিসভায় যখন কীর্তন করতেন, তখন বাজাতেন খোল। তখন হারমোনিয়াম বাজাতেন মনোজ কাকু। বিন্দু, কখনো মন্দিরা কখনো খোল কখনো বাঁশি বাজাতেন। মরাইদা বাজাতেন মন্দিরা। সাধু বাজাতেন মন্দিরা বা খোল। আর গায়ক গায়িকা ছিলেন সবিতা, কবিতা, নমিতা আর বিনয়। পেছন থেকে বিপদভঞ্জন দাদু আস্তে আস্তে বলে ওদের প্লট ধরিয়ে দিতেন। বিনয় আমাদের সঙ্গে পড়লেও হরিসভায় যখন কীর্তন করতো তখন বড়দের মত ধুতি পড়তো বিনয়। এই পুরো কীর্তনের দলের দলপতি ছিলেন বিনয়ের বাবা বিপদভঞ্জন দাদু। যেদিন কীর্তনের এই অনুশীলনটা বেশি বেশি দেখতাম, সেদিন পাঠশালা থেকে কখনো বিনয়, কখনো সুনীল, বীরেন, সুখময়কে পাঠিয়ে দিদিমণি আমাকে ডেকে পাঠাতেন। আমাকে ডাকতে এসে ওরাও তখন কিছুক্ষণ এই কীর্তন অনুশীলন দেখতে মজে যেতো।
সাধারণ পরপর তিনদিন পাঠশালায় বেশি ফাঁকি দিয়ে কীর্তন দেখলে আমার নামে বাড়িতে আপাদের কাছে নালিশ পাঠাতেন দিদিমণি। সেক্ষেত্রে আমার কাজ ছিল পাঠশালা ছুটির পথে শশধর আর জীবনের লড়াই না দেখে আপাদের ম্যানেজ করার জন্য আগেভাগেই তাদের সাথে বাড়িতে ফেরা। আর যদি কোনো কারণে ওদের লড়াই দেখার জন্য পথে জমে যেতাম, তখন নালিশটা বাবার কানে কখনো কখনো পৌঁছাত, মা ভায়া হয়ে। তবে আপাদের কেউ আমার বিরুদ্ধে নালিশ করে বেশিক্ষণ সেই খুশি হজম করতে পারতো না। কারণ, আমি তখন বানিয়ে বানিয়ে বা কখনো পেছনের কোনো সত্য ঘটনার কাহিনী আরো লম্বা করে পাল্টা ওদের নামেও কেস ফিট করার হুমকি দিতাম। কখনো সেই হুমকিতেই কাজ হতো। ওরা পথেই ম্যানেজ হয়ে যেতো। বাবার কানে পর্যন্ত দিদিমণি'র নালিশ তখন পৌঁছাতো না। কিন্তু আমার ফাঁকির মাত্র সীমা ছাড়িয়ে গেলে দিদিমণি কখনো কখনো সরাসরি বাবার কাছেই নালিশ দিতেন। কারণ বাবা সন্ধ্যাবেলায় একবার পাড়ায় হাঁটতে যেতেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পান খেয়ে আড্ডা দেওয়া ছিল বাবার খুব প্রিয় বিষয়।
নালিশ থেকে যদি আমার গায়ে কখনো উত্তম-মাধ্যম কিছু পরতো, তখন আমি তার বদলা নিতাম তালপাতা ছিড়ে বা দোয়াত ভেঙ্গে। তখন নতুন দোয়াত ম্যানেজ করাটা একটা দুরূহ ব্যাপার ছিল। বড়রা তখন কালির কলমে লিখতো। সেই কালি শেষ না হওয়া পর্যন্ত দোয়াত পাওয়ার কোনো চাঞ্চ নাই। অতএব তখন দোয়াত নাই অযুহাতে ইচ্ছামত পাঠশালা ফাঁকি দিয়ে বিপদভঞ্জন দাদু'র কীর্তন অনুশীলন দেখতাম। আবার সেই ফাঁকির মাত্রা সীমা লঙ্ঘন করলে অনেক সময় অন্য কাঁচের শিশিতে কালী বানানোর জন্য বিকল্প একটা ব্যাপার করতেন বড়রা। আসলে আমরা যত ফাঁকি দেবার চেষ্টা করতাম, বড়রা তখন অল্পদিন কয় পরেই বিকল্প একটা উপায় বের করে ফেলতেন। সেই বিকল্প উপায় নষ্ট করতে আবার কিছু বাড়তি নালিশ আসার মত ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত তখন মনে আসলে শান্তি পাতাম না। তখন হয়তো খামাখা পথে কারো কারো সাথে মারামারি করতাম ইচ্ছে করেই।
আমাদের বাড়িতে তখন একটা বিষয় ছিল ভারী কড়া। স্কুল কামাই করা যেত না কিছুতেই। ওটা ছিল বাবার একেবারে কড়া হুকুম। যে স্কুলে যাবে না তার সেদিন ভাত বন্ধ। কোনো কোনো দিন বড় রাস্তা পর্যন্ত গিয়ে ইচ্ছে করেই পথ হারিয়ে স্কুল পালানো গ্রুপের সঙ্গে মিশে যেতাম আমরা। আমরা মানে আমি আর কালাম। সেদিন পাঠশালার পুরো সময়টা পর্যন্ত আমরা হয় বলেশ্বরে সাঁতার কাটতাম। নতুবা কোনো নিরিবিলি পথে বা বাগানে মার্বেল খেলতাম। নতুবা কোনো ঝোপঝাড় মার্কা গাছে বসে পুরো দুপুর কাটিয়ে দিতাম গল্প করে। ত্রিমোহনার কাছে ছিল একটা ছাড়াভিটা। সেই ভিটায় কয়েকটা ঝোপওয়ালা কাঁঠালগাছ ছিল। সাধারণত ওটাই ছিল আমাদের পাঠশালা ফাঁকি দেবার একটা বড়সর আস্তানা। একবার পাঠশালা ফাঁকি দিয়ে কালাম আর আমি সেই গাছে বসে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। পাশেই মাঠে হাল চাষ করছিলেন কামুরুল মামাদের রাখাল আক্কেল। আক্কেল গরুর হাল নিয়ে লম্বা মাঠের ওপাশ ঘুরে আমাদের কাছ থেকে ঘুরে যাবার সময় আমাদের প্রাসঙ্গিক আলোচনায় অংশগ্রহন করছিল।
আমরা যেখানে গাছের ডালে বসেছিলাম, বাইরে থেকে কারোর আমাদের দেখার কোনো সুযোগ নাই। কিন্তু রাস্তা দিয়ে কে কোনদিকে যাচ্ছিল এসব আমরা সব দেখতে পেতাম। তখন প্রায় দুপুর। পাঠশালা ছুটির সময় প্রায় হয়ে গেছে। ওই পথ দিয়ে তখন বাবা বাড়ির দিকে ফিরছিলেন। বাবার মাথায় ছাতা। বাবা হঠাৎ খেয়াল করলেন আক্কেল হাল নিয়ে ঘুরে যাবার সময় কাদের সঙ্গে যেন কথা বলছে। হঠাৎ বাবা আক্কেলকে জিজ্ঞেস করলেন, কথা কও কার সাথে? জবাবে আক্কেল কিছু বলল না। শুধু হাসলো। কারণ আক্কেলের উপর আমাদের হান্ড্রেড পারসেন্ট বিশ্বাস ছিল যে আমাদের কারো নাম সে বলবে না। বাবা আবার জোরগলায় জানতে চাইলেন, কীরে কথা কইস কার সাথে? আক্কেল তখনো হাসলো। বাবা তখন আন্দাজে গাছের উদ্দেশ্য হাঁক ছাড়লেন, গাছে কারা? আমরা তখন স্পষ্টভাবেই বাবাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। বাবা আমাদের দূর থেকে ঠিক বুঝলেন না। কিন্তু আন্দাজে ঠাওর করলেন যে আমরা হতে পারি। আক্কেল অবশ্য ইসারায় বলতে চেয়েছিল, না ওই ডাঙ্গির পোলাপান। কিন্তু আক্কেলের অধিক হাসির কারণে সেই ইসারা কোনো কাজে লাগে নাই তখন। বাবা যা বোঝার বুঝে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে চলে গেলেন। পাঠশালা ছুটির পর আপারা যখন ফিরছিল, তাদের ত্রিামোহনায় দেখামাত্রই আমরা সুরসুর করে গাছ থেকে নেমে আবার তাদের সামনে সামনে বাড়ির পথে হাঁটতে লাগলাম। পথে দোয়াত থেকে কিছু কালি দুই গালে, গায়ে, প্যান্টে শার্টে ইচ্ছা করেই মাখালাম। এগুলো হলো পাঠশালায় ব্যাপক পড়াশুনা করার হাতেনাতে চিন্থ। এই কালি দেখে কারো বোঝার সাধ্য নাই যে আমরা সেদিন পাঠশালা ফাঁকি দিয়েছিলাম।
বাড়িতে এসে দূর থেকে বাবার মতিগতি বোঝার চেষ্টা করলাম। দেখে বুঝলাম বাবা নরমাল। তার মানে পাঠশালা ফাঁকি ধরা খাই নাই। যথারীতি বাবার গোসল শেষে আমরা আবার দ্বিতীয়বারের মত ডুবাডুবি করতে পুকুরে নামলাম। তারপর যথারীতি রান্না ঘরে বাবার পাশেই খেতে বসলাম। প্লেটে ভাত মাখা মাত্র শুরু করেছি, খেয়াল করলাম বাবা মিটমিট করে হাসছেন। হঠাৎ বলা নাই কওয়া নাই বাবা প্রশ্ন করলেন, গাছে আর কে কে ছিল? তখন আমি বাবার থেকে এমন দূরত্বে বসা যে মিথ্যা বা বানিয়ে বলার কোনো বিকল্প চাঞ্চ নাই। সত্য বললে বরং মাইর থেকে বাঁচার একটা সুযোগ আছে! তাই ভয়ে ভয়ে দ্রুত নামগুলো বললাম, কালাম, মনোরঞ্জন, জীবন, স্বপন, আর কামরুল...
.......................................
২২ এপ্রিল ২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০১৬ ভোর ৪:৫০