পানামা পেপারস কেলেংকারী বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিশ্ব ব্যক্তিত্বদের কর ফাঁকির গোপন ডকুমেন্টস। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো পানামা পেপারস কেলেংকারীতে কোনো মার্কিন নাগরিকের নাম এখনো উচ্চারিত হয়নি। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আগামী নভেম্বর মাসে মার্কিন নির্বাচনকে ঘিরে এই পানামা পেপারস কেলেংকারী সবচেয়ে ভয়ংকর ইস্যু হবে। কারণ ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন পনামা ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট সাইন করেন তখন সেক্রেটারি অব স্টেটস ছিলেন হিলারী রডহ্যাম ক্লিনটন। হিলারী যেহেতু এবার ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যানডিডেট। আর এখন পর্যন্ত নিজ দলীয় বার্নি স্যানডার্সের তুলনায় প্রাথমিকে এগিয়ে আছেন। অতএব হিলারী বা ডেমোক্র্যাট বধ নাটকের প্রধান ঘুটি হতে যাচ্ছে এই পানামা পেপারস। যদিও পানামা পেপারস কেলেংকারীর আসল উদ্দেশ্য এখনো বিশ্ববাসী জানে না। কিন্তু মার্কিন রিপাবলিকান পার্টি আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পানামা পেপারস কেলেংকারীকে যে প্রধান ইস্যু বানাবে, এটা চোখ বন্ধ করে আমি এখনই বলে দিতে চাই। রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য পানামা পেপারস কেলেংকারী শেষ পর্যন্ত আর্শিবাদ হয়ে উঠতে পারে, পরিস্থিতি ধীরে ধীরে সেদিকেই যাচ্ছে। মূল আলোচনায় যাবার আগে চলুন পানামা পেপারস কেলেংকারী কী তা একটু জেনে নেই।
পানামা পেপারস কী?
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে নানান শ্রেণীপেশার বড় বড় রাঘব বোয়ালরা কিভাবে বিভিন্ন কৌশলে কর ফাঁকি দিয়ে নিজেদের সম্পদের পাহাড় গোপন করে রেখেছেন, তার ১ কোটি ১৫ লাখ গোপন নথিপত্র ফাঁস করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে পানামার একটি আইনি প্রতিষ্ঠান। পানামার এই আইনি প্রতিষ্ঠানটির নাম মোসাক ফনসেক। এই প্রতিষ্ঠানের অনলাইন থেকে ফাঁস হওয়া নথিপত্রগুলোকেই বলা হচ্ছে পানামা পেপারস। ইতিমধ্যে এই পানামা পেপারস কেলেংকারীকে বলা হচ্ছে ‘ক্রাইম অব দ্য সেঞ্চুরি’। মোসাক ফনসেকা নামের প্রতিষ্ঠানটি পানামার একটি আইনি প্রতিষ্ঠান। যারা গোপনীয়তা রক্ষাকারী হিসেবে বিশ্বের অন্যতম প্রতিষ্ঠান। সারা বিশ্বের মক্কেলদের পরামর্শের বিনিময়ে তারা বার্ষিক ফি নিয়ে থাকে। বৈশ্বিক ব্যবসায়িক আইনের ওপর ভর করে ১৯৭৭ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন পানামার দুই নাগরিক জার্গেন মোসাক ও রঞ্ঝামন মোসাক। বিশ্বের ৪২টির বেশি দেশে প্রতিষ্ঠানটির বর্তমানে শাখা রয়েছে। এসব শাখায় কর্মরত আছেন প্রায় ৬০০ কর্মী। তবে এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবহারকারী পানামার বাইরেরও হতে পারে। এতে ব্যক্তিগত হিসাব ছাড়াও যে কোনো কোম্পানির নামে হিসাব খোলা যায়। মূলত গ্রাহক আকৃষ্ট করতে ব্যবসায়িক সহযোগীদের নিজেদের ব্র্যান্ড নাম ব্যবহারের সুযোগ দেয় মোসাক ফনসেকা। এ প্রতিষ্ঠানটি সুইজারল্যান্ড, সাইপ্রাস, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসসহ বিভিন্ন স্থানে ট্যাক্স হ্যাভেন পরিচালনা করে। নিজ দেশের বাইরে অর্থ রাখার বিষয়ে দুনিয়াজুড়ে যেসব প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের সেবা প্রদান করে তার মধ্যে মোসাক ফনসেকার অবস্থান বর্তমানে চতুর্থ। সারা বিশ্বে অন্তত তিন লক্ষাধিক কোম্পানির সঙ্গে তারা কাজ করে। খোদ ব্রিটেনে তাদের বেশ শক্ত অবস্থান রয়েছে।
সম্প্রতি মোসাক ফনসেকা’র অন্তত ২ দশমিক ৬ টেরাবাইট সফট তথ্য এবং ১ কোটি ১৫ লাখ গোপন নথিপত্র ফাঁস হয়েছে। বিশ্বের ধনী আর ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা বা তাদের আত্মীয়স্বজনরা কিভাবে কর ফাঁকি দিয়ে গোপন সম্পদের পাহাড় গড়েছেন- এসবই ফাঁস হওয়া সেসব নথিতে উঠে এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১০ সালে উইকিলিকস এবং ২০১৩ সালে মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা অ্যাডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁস করা নথির চেয়েও পানামা পেপারস-এর পরিমাণ বেশি। ফাঁস হওয়া নথিগুলোতে দেখা যাচ্ছে, কিভাবে গোপনীয়তার আড়ালে এই আইনি প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বনেতাদের অর্থপাচার, নিষেধাজ্ঞা এড়ানো এবং কর ফাঁকিতে সহযোগিতা করেছে। সারা বিশ্বের স্বৈরশাসকসহ সাবেক ও বর্তমানসহ অন্তত ৭২ জন রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের নিজেদের দেশ থেকে অর্থ লোপাটের ভয়াবহ চিত্র রয়েছে এই পানামা পেপারস-এ।
পানামা পেপারস-এর আরেকটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো ফাঁস হওয়া এসব গোপন নথিপত্র প্রথম হাতে পায় জার্মান দৈনিক সুদেস্ক জেইটাং। পরে ফাঁস হওয়া সেসব গোপন নথিপত্রগুলো সাংবাদিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট (আইসিআইজে)-এর কাছে পাঠায় ওই পত্রিকাটি। বিবিসি, গার্ডিয়ান, ভারতের ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসসহ বিশ্বের ১০৭টি মিডিয়া হাউজের ৩২৫ জন সাংবাদিক এবং ৭৮টি দেশ এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিআইজের ডিরেক্টর জেরার্ড রাইল বলেছেন, নথিগুলোতে প্রতিষ্ঠানটির গত ৪০ বছরের প্রাত্যহিক কার্যক্রমের তথ্য স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। যদি এগুলোর সত্যতা নিশ্চিত হয়, তবে তা পুরো দুনিয়াকে সত্যি সত্যিই কাঁপিয়ে দেবে। মজার ব্যাপার হলো, এত বড় গোপন তথ্য ফাঁসের বিষয়ে খোদ মোসাক ফনসেকা কোনো বিস্তারিত আলোচনায় যেতে আগ্রহী নয়। যদিও তারা এখনো দাবি করছে গ্রাহকদের গোপনীয়তার রক্ষার দিকেই অধিক নজর তাদের। মোসাক ফনসেকা বলতে চাইছে তারা মানি লন্ডারিংবিরোধী আইন মেনে চলছেন। সেদিকে খেয়াল রেখেই তারা মক্কেলদের সেবা দিয়েছেন। নিজেদের সেবার যে কোনো ধরনের অপব্যবহার রোধে তারা সচেষ্ট ছিলেন এবং থাকবেন।
মোসাক ফনসেকা'য় সারা বিশ্বের ২শ’ দেশ ও টেরিটরির বর্তমান ও সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান, খেলোয়াড়, অভিনেতা, ব্যবসায়ীদের ব্যাংক হিসাবসহ সব মিলিয়ে ২ লাখ ১৪ হাজার লোকের নাম রয়েছে তাদের তালিকায়। যাদের মধ্যে অন্তত ১৪০ জনের বেশি রাজনীতিবিদ। এর আগে ব্যাংকিং সেক্টরে গোপন নথি ফাঁস করে ২০১৪ সালে প্রথম নজরে আসে মোসাক ফনসেকা। তখন ইউরাপের ক্ষুদ্রতম দেশ লুক্সেমবার্গের বেশ কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি ও কয়েকজন কোটিপতির ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করেছিল। এছাড়া ১৯৮০ দশকে একজন পাকিস্তানি বিনিয়োগকারীর প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের অর্থ পাচারের তথ্য এই মোসাক ফনসেকা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। মোসাক ফনসেকা'র কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়েরও প্রচুর অভিযোগ রয়েছে। বিগত ২০১০ সালে এই প্রতিষ্ঠানের ব্রাজিল কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ উঠেছিল। যার তদন্ত এখনও চলছে। তবে মোসাক ফনসেকা সেই অভিযােগ অস্বীকার করেছে।
সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, যে বা যারা লাখ লাখ গোপন নথিপত্র ফাঁস করলো, তাদের কেউ এখনো চেনে না। তাদের কেউ নাম পর্যন্ত বলতে পারে না। এমন কী তারা এই গোপন নথি ফাঁস করে কারো কাছে কোনো টাকাপয়সাও দাবি করে নাই। অথচ কর ফাঁকি দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ার গোমর ফাঁস করে গোটা বিশ্বনেতাদের ঘুম হারাম করেছে ‘পানামা পেপারস’। মোসাক ফনসেকা ‘অফশোর’ সেবায় বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান। যারা তিন লাখেরও বেশি কোম্পানির হয়ে কাজ করে। অফশোরে বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে মোসাক ফনসেকা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কর ফাঁকিতে সহায়তা করে থাকে। অফশোর কোম্পানি খোলা বা এর মাধ্যমে ব্যবসা পুরোপুরি বৈধ হলেও মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানি এবং মুদ্রা পাচারের মতো অবৈধ কর্মকাণ্ডের অর্থও মোসাক ফনসেকার মাধ্যমে এতদিন নিরাপত্তা পেয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাজটি হয়েছে শেল কোম্পানির মাধ্যমে। এসব কোম্পানির অধিকাংশই ‘ট্যাক্স হেভেন’ হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন দ্বীপরাষ্ট্রে নিবন্ধিত।
শেল কোম্পানি কী?
শেল কোম্পানি হচ্ছে একটি বৈধ ব্যবসার মুখোস। মূল অর্থের মালিকের নাম গোপন রাখার পাশাপাশি ওই অর্থের ব্যবস্থাপনা করাই এই ধরনের কোম্পানির প্রধান কাজ। সাধারণত আসল মালিকের নাম এসব কোম্পানির কোনো কাগজে থাকে না। শেয়ার মালিকদের মধ্যে থাকেন আইনজীবী ও অ্যাকাউন্ট হোল্ডাররা। কখনও কখনও মালিকের অফিসের অফিস সহকারীও এসব শেল কোম্পানির পরিচালক বনে যান। কাগজে-কলমে একটি ঠিকানা ছাড়া আর কিছুই থাকে না বলে অনেক সময় শেল কোম্পানিগুলো ‘লেটারবক্স’ কোম্পানি নামেও পরিচিত। মোসাক ফনসেকার মতো অফশোর সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এই ধরনের শেল কোম্পানি খুলতে এবং ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা করে থাকে। কোনো একটি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ থাকে এর বেশির ভাগ শেয়ার মালিকদের হাতে। শেল কোম্পানির ক্ষেত্রে সেই নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকে অন্য কোনো কোম্পানি। ওই কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে কোনো আইনজীবী হয়তো শেল কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে এসেছেন, যদিও তিনি নিজে মালিক নন। সেই নিয়ন্ত্রক কোম্পানিও হয়তো এই শেল কোম্পানির মালিক নয়। তারা হয়তো অন্য কোনো কোম্পানির সম্পদ ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে এই শেল কোম্পানিরও দেখভাল করে থাকে।
ট্যাক্স হেভেন কী?
ধরা যাক আপনি একটি শেল কোম্পানি খুলেছেন। এখন এই কোম্পানির মাধ্যমে ব্যবসা করতে আপনাকে নিয়ম অনুযায়ী নিবন্ধন করতে হবে। যেসব দেশে কর আইন কড়া, সেখানে আপনার শেল কোম্পানির জারিজুরি ফাঁস হতে সময় লাগবে না। এজন্য আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে এমন একটি দেশ বা এলাকা, যেখানে কর দিতে হয় খুবই কম, সরকার আপনার টাকার উৎস জানতে চায় না, কোম্পানির আসল মালিক কে তা নিয়েও মাথা ঘামায় না, ব্যাংকের তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করে উদারভাবে। ব্রিটিশ ভার্জিন আইসল্যান্ড, ম্যাকাও, বাহামা ও পানামার মতো দেশ ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলো এই ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্বর্গরাজ্য। এ কারণে এসব অঞ্চলকে ‘ট্যাক্স হেভেন’ বলা হয়। এ রকম কোনো একটি করস্বর্গে নিবন্ধিত হয়ে গেলেই আপনার শেল কোম্পানি ব্যবসার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। এরপর এই কোম্পানির কাগুজে ব্যবসায় অবৈধ উৎসের টাকা বৈধ হয়ে যাবে। তারপর চলে যাবে নিরাপদ কোনো অ্যাকাউন্টে। ওই টাকার মালিক আপনিই থাকবেন, এক্ষেত্রে আপনার সরকারের কাছে আপনাকে মোটা অংকের ট্যাক্স দিতে হবে না।
চাহিবামাত্র পাবে বাহক!
শেল কোম্পানি খুলে অফশোর লেনদেনে নাম লুকিয়ে মোটা অংকের অর্থ হাতবদল করার ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বাড়তি একটি বলয় হলো ‘বেয়ারার শেয়ার’ বা ‘বেয়ারার বন্ড’। টাকার ওপরে যেমন লেখা থাকে- ‘চাহিবামাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে’, বেয়ারার শেয়ারও তেমনই। অর্থাৎ যার পকেটে থাকবে, তিনিই এর মালিক। নিজের মর্জিমাফিক তিনি তা ভাঙাতে বা খরচ করতে পারবেন, কোনো ব্যাংকের লকারে বা আইনজীবীর ব্রিফকেসে রেখে দিতে পারবেন। মালিকের নাম কেউ জানবে না। পানামার কোনো ল’ ফার্মে যদি এই বন্ড রাখা হয়, তাহলে ওই বন্ড যে আদৌ আছে এবং তার মালিক যে আসলে আপনি- তা জানার সাধ্য কারও নেই।
কালো টাকা সাদা করা!
‘বেয়ারার শেয়ার ও বন্ড’র মাধ্যমেও এই প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থ আদান-প্রদান করা হয়। যার মাধ্যমে সহজেই ‘কালো’ টাকাকে ‘সাদা’ করে ফেলা সম্ভব, যা দিয়ে পরে যে কোনো দেশে ‘বৈধ’ ব্যবসা করা যায়, কেনা যায় সম্পদ। অপরাধী ও করখেলাপিরা এই সুবিধা নিয়মিত ব্যবহার করে বলে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৮২ সাল থেকেই বেয়ারার বন্ড বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে।
মুদ্রা পাচার!
আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ পথে অর্জিত কালোর ময়লা ধুয়ে ফর্সা করার একটি পর্যায় হলো মানি লন্ডারিং, যার মাধ্যমে কোনো প্রশ্নের উদ্রেক না করেই ওই অর্থ ব্যবহার করা যায়। কোনো চোরাকারবারি, বা অর্থজালিয়াতকারী বা কোনো দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদরা নিজেদের পকেটে যে মোটা অংকের কালো টাকা জমায়, তাকে ওই কায়দায় ফর্সা করে নিতে হয় আইনের হাত এড়িয়ে চলার জন্য। তারা ওই টাকা মোসাক ফনসেকার মতো কৌশলী ও ‘বৈধ’ কোনো ল’ ফার্মের মাধ্যমে কোনো একটি করস্বর্গে পাঠিয়ে দিয়ে থাকে। তারপর সেখানে ওই টাকায় একটি শেল কোম্পানি খুলে ওই অর্থ বেয়ারার শেয়ার বা বন্ডে রূপান্তর করে নেয়।
আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ!
পানামা পেপারস কেলেংকারীতে ইতোমধ্যে আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিগমান্দুর ডেভিও গুনলাগসন পদত্যাগ করেছেন। ‘অফশোর’ সেবা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পরিবার সম্পদ গড়েছেন এমন অভিযোগে সেখানে গণমানুষের বিক্ষোভের মুখে গুনলাগসন পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। ফাঁস হওয়া পানামা পেপারস-এর একটি গোপন নথিতে দেখা যায় যে, ২০০৭ সালে বৃটিশ ভার্জিন আইসল্যান্ডে সিগমান্দুর ও তার স্ত্রী আন্না সিগুরলগ পলসডোত্তির ‘অফশোর’ সেবা থেকে দুটি অ্যাকাউন্ট কেনেন। আন্না'র বাবার টয়োটা আমদানির ব্যবসা বিক্রি করে এই শেয়ার অ্যাকাউন্ট ক্রয় করা হয় ‘অফশোর’ সেবা থেকে। পরে ২০০৯ সালে সিগমান্দুর তার শেয়ারগুলোর ৫০% নামমাত্র ১ ডলার মূল্যে তার স্ত্রী'র কাছে বিক্রি করেন। এর ঠিক আট মাস পরে ডানপন্থী প্রোগ্রেসিভ পার্টি থেকে তিনি আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তখন থেকে বা ২০১৩ সালে পুনারায় প্রধানমন্ত্রী হবার পরেও তিনি সেই অবশিষ্ট ৫০% শেয়ারগুলোর কোনো ইন্টারেস্ট অফার করনেনি। প্রধানমন্ত্রী'র অফিসসূত্র বলছে যে, তাদের স্বামী স্ত্রী'র একটি যৌথ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল, যা নিয়ে হয়তো কোনো ঝামেলা হয়েছে। কিন্তু পানামা পেপারস কেলেংকারীতে আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ও স্ত্রী'র নাম প্রকাশ পেলে সাধারণ জনগণের বিক্ষোভের মুখে মিস্টার সিগমান্দুর পদত্যাগ করলেন।
পানামা পেপারস-এ কোনো মার্কিনির নাম এখনো প্রকাশ পায়নি!!
সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো পানামা পেপারস কেলেংকারীতে গোটা বিশ্বের বড় বড় রাঘব বোয়ালদের ঘুম হারাম হলেও এখন পর্যন্ত কোনো মার্কিনির নাম কোথাও প্রকাশ পায়নি। তবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সরাসরি বলেছেন, পানামা পেপারস কেলেংকারী সিআইএ'র একটি এজেন্ডা। মিস্টার পুতিন যদিও বাড়তি আর কোনো কমেন্টস করেননি। কারণ ফাঁস হওয়া ওই তালিকায় পুতিনের নামে কোনো কেলেংকারী না থাকলেও নিউ ইয়র্ক টাইমসে সবার উপরে ছাপা হয়েছে মিস্টার পুতিনের ছবি। বিশ্বের বাঘা বাঘা নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও তাদের আত্মীয়স্বজনদের অর্থ পাচার ও কর ফাঁকির প্রমাণ রয়েছে যেসব নথিতে। অথচ সেখানে কোনো মার্কিনির নাম নেই এটাই পানামা পেপারস-এর সবচেয়ে রহস্যময় ব্যাপার। তাই পানামা পেপারস কেলেংকারী রিপাবলিকান দলের আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একটি ট্রিগার পয়েন্ট, এমনটি ধারণা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
কারণ ডেমোক্র্যাট দলীয় অপর ক্যানডিডেট মিস্টার বার্নি স্যানডার্স যিনি হিলারির সঙ্গে দলীয় নমিনেশান পেতে এখন প্রতিযোগিতা করছেন, যা আগামী ১৪ জুন ফাইনাল হবে, কে হচ্ছেন ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী, সেই বার্নি স্যানডার্স গতকাল মার্কিন সিনেটে বলেছেন, বারাক ওবামা প্রশাসন যখন ২০১১ সালে পানামা ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট সাইন করে, তখন থেকেই আমেরিকানদের জন্য পানামা অফশোর ট্যাক্স হ্যাভেন-এর দরজা খুলে যায়। যা এখন আরো অনেক খারাপের দিকে গেছে। পানামা পেপারস কেলেংকারী নিয়ে এখন সিনেটের এই বিতর্কই আগামীতে হিলারী'র দলীয় নমিনেশান পাওয়াকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতে পারে। কারণ প্রেসিডেন্ট ওবামা যখন পানামা ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট সাইন করেন তখন সেক্রেটারি অব স্টেটস ছিলেন স্বয়ং হিলারী রডহ্যাম ক্লিনটন।
পানামা পেপারস কেলেংকারী নিয়ে এখন সিনেটে বিতর্ক করে মিস্টার বার্নি স্যানডার্স ডেমোক্র্যাট দলীয় নমিনেশান ভাগানোর যে চেষ্টা করছেন, তার সমাধান মিলবে আগামী ১৪ জুন। সেদিন জানা যাবে কে কে হচ্ছেন ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। কিন্তু পানামা পেপারস কেলেংকারী নিয়ে রিপাবলিকানরা মুখ খুলবে আসলে ১৪ জুনের পর আসল লড়াইয়ে জেতার জন্য। কারণ এর আগে ১৯৬৮ সালে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সিআইএ কে দিয়ে পাতা ফাঁদ দিয়ে নির্বাচনে জিতেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৩ সালে দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ের সময় যে ওয়াটারগেট কেলেংকারী করেছিলেন, যে কারণে ১৯৭৪ সালের ৯ আগস্ট নিক্সনকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। নিক্সনের সরাসরি শিষ্য অপর রিপাবলিকান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াকার বুশ সিনিয়রও সিআইএ-র পাতা ফাঁদ দিয়ে ১৯৮৯ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। আর যাদের প্রত্যেকের পূর্বপুরুষ জার্মানীর।
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো পানামা পেপারস কেলেংকারী এবার প্রথম ফাঁস করল একটি জার্মান পত্রিকা। জার্মান দৈনিক সুদেস্ক জেইটাং প্রথম পানামা পেপারস-এর সকল গোপন নথি হাতে পায়। যে কারণে পানামা পেপারস কেলেংকারীর সঙ্গে পুতিনের বক্তব্য অনুযায়ী সিআই-এর এজেন্ডাকে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে বলা যায়, আগামী নভেম্বর মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সবচেয়ে প্রধান ইস্যু হতে যাচ্ছে এই পানামা পেপারস কেলেংকারী। আর এখনো কোনো মার্কিনির নাম প্রকাশিত না হলেও শিঘ্রই এই ইস্যুতে জল ঘোলা করবে রিপাবলিকানরা, এটা আলামত দেখেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আর তখন অনেক বাঘা বাঘা মার্কিনির নাম প্রকাশ পাবে তেমন ধারণা করাই যায়। সুতরাং পানামা পেপারস কেলেংকারী নিয়ে সারা বিশ্বে যতই হৈ চৈ হোক না কেন, এই কেলেংকারীর প্রধান ইস্যু যে আগামী মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরেই আগাচ্ছে, তা এখনই অনেকটাই সুস্পষ্ট। দেখা যাক পানামা পেপারস বা ‘ক্রাইম অব দ্য সেঞ্চুরি’ কোথায় গিয়ে কতটা জল ঘোলা করে!!
...............................................
৭ এপ্রিল ২০১৬
সূত্র: গার্ডিয়ান, বিবিসি, যুগান্তর, প্রথম আলো, এনডিটিভি, আলজাজিরা
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৩:৫৮