জিএসপি কি ও কেন?
জেনারেলাইজড সিস্টেম অফ প্রিফারেন্সেস (Generalized System of Preferences)
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিওটিও)-এর সাধারণ নিয়ম থেকে ছাড় দেয়ার একটি প্রথাগত পদ্ধতি,
পূর্বে এটি 'জেনারেল এগ্রিমেন্ট অফ ট্যারিফ এন্ড ট্রেড’ বা ‘গ্যাট’ নামে পরিচিত ছিল। বিশেষ করে, এটি সর্বোচ্চ বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত নীতি (মোস্ট ফেবারড নেশন - এমএফএন) থেকে ছাড় দেয়ার একটি আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি, যেখানে এমএফএন কোনো ডব্লিওটিও সদস্যরাষ্ট্রকে অন্যসকল ডব্লিওটিও সদস্যরাষ্ট্র হতে আসা আমদানীকে সমানভাবে গণ্য করতে বাধ্য করে। প্রকৃতপক্ষে, এমএফএন অনুযায়ী, সমান শুল্ক আরোপের মাধ্যমে অন্য সকল ডব্লিওটিও সদস্য রাষ্ট হতে আসা আমদানীর সাথে সমানভাবে আচরণে বাধ্য করে। এছাড়াও জিএসপি ধনী রাষ্ট্রগুলোর শুল্ক না কমিয়ে, অনুন্নত রাষ্ট্রগুলোর জন্য শুল্ক কমাতে এমএনএফ এ ডব্লিওটিও সদস্য রাষ্ট্রকে ছাড় দিয়ে থাকে। ১৯৯৪ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) গঠনের পর এখন পর্যন্ত কোনো দেশের জিএসপি বাতিলের ঘটনা ঘটেনি।
বাংলাদেশ ও জিএসপি
১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা পেয়ে আসছে। বাংলাদেশের ৯৭ ভাগ পণ্য এই সুবিধা পেলেও তৈরি পোশাকে এই সুবিধা নেই। আর তৈরি পোশাকই হলো যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য। তাই যুক্তরাষ্ট্র থেকে রফতানি আয়ের মাত্র শতকরা শূন্য দশমিক ৫৪ ভাগ আসে জিএসপি সুবিধা থেকে, যার পরিমাণ ২০১২ সালে ছিল ২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর মোট রফতানি আয় ছিল ৪ দশমিক ৯১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জিএসপি সুবিধা স্থগিত হলে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে এসব পণ্যকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে হবে।
জিএসপির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র ৪ হাজার ৮৮০টি পণ্যে ১২৯টি দেশকে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা দিয়ে আসছে। এ দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ ৫০ রফতানিকারক দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নামও রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ থেকে ৪৮০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি হয়। এর মধ্যে জিএসপি সুবিধা পাওয়া যায় মাত্র ৬০ লাখ ডলারের পণ্যে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে টোব্যাকো, সিরামিকস, ফার্নিচার, প্লাস্টিক এবং খেলনা সামগ্রী রফতানিতে জিএসপি সুবিধা পায় বাংলাদেশ। মোট রফতানির হিসাবে এসব পণ্যের রফতানি খুবই সামান্য। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোতে জিএসপি সুবিধার আওতায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের শতভাগ বিনাশুল্কে যাচ্ছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ১ হাজার ১৩৭ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলারের পোশাক রফতানি করেছে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের অনুকরণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা অন্য কোনো দেশ অনুরূপ সিদ্ধান্ত নিলে বাংলাদেশের রফতানি বিপর্যয়ে পড়বে।
জিএসিপি স্থগিতের আদেশ
২৭ জুন ২০১৩, বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্যের অবাধ বাজারসুবিধা (জিএসপি) স্থগিত করেছে ওবামা প্রশাসন। পোশাক খাতে কাজের পরিবেশের উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত এ স্থগিতাদেশ বহাল থাকবে বলে জানানো হয়। মার্কিন বাণিজ্যবিষয়ক প্রতিনিধি মাইকেল ফ্রোম্যান সেদিন ওয়াশিংটনে এক বিবৃতিতে বলেন, “প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার এক আদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা স্থগিত করা হলো। বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতে একের পর এক দুর্ঘটনা ও বিপর্যয়ের কারণে কারখানার কর্মপরিবেশের উন্নয়ন ও শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বারবার তাগিদ দিয়েছিল মার্কিন প্রশাসন। সাম্প্রতিক কয়েকটি মর্মান্তিক ঘটনায় ফুটে উঠেছে যে, বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে কাজের নিরাপত্তা ও শ্রমিক অধিকারের বিষয়ে গুরুতর ত্রুটি রয়েছে।” জিএসপি সুবিধা স্থগিত প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট ওবামার ওই আদেশে বলা হয়, ‘আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে...উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পাওয়া জিএসপি সুবিধা স্থগিত করাই শ্রেয়। কারণ, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রমিক অধিকারের মানদণ্ড অনুযায়ী তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কিংবা নিচ্ছে না।’
জিএসপি স্থগিতের মূল বা অন্যতম কারণ
২০০৭ সালের পিটিশন: শ্রমিকের স্বার্থ সুরক্ষা ও কর্মপরিবেশের নিরাপত্তাজনিত শর্ত পূরণে ব্যর্থতার কারণে ২০০৭ সালে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহারের দাবি জানায় আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার অ্যান্ড কংগ্রেস অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশনের (এএফএল-সিআইও)। পোশাক কারখানায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা, অবনতিশীল শ্রম পরিস্থিতি ও শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড (এক বছর পরও যার সুরাহা হয়নি) এবং তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ড নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যদের উদ্বেগ বেড়ে যাওয়ায় গত বছরের শেষ প্রান্তে এসে বাংলাদেশের শ্রমমান নিয়ে পর্যালোচনার প্রক্রিয়ায় গতি সঞ্চার হয়। শেষ পর্যন্ত ওবামা প্রশাসন এএফএল-সিআইওর পিটিশনটি গ্রহণ করে। আর গত এপ্রিলে রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিলের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে।
রন কার্কের চিঠি
জিএসপি সুবিধা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি রন কার্ক ২০১১ সালের ২১ ডিসেম্বর বাণিজ্যমন্ত্রী জি এম কাদেরকে চিঠি লেখেন। চিঠিতে রন কার্ক বলেছেন, বাংলাদেশের জন্য জিএসপি সুবিধা বাতিলের আবেদনপত্রে বলা আছে, এই সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে সব শর্ত বাংলাদেশ পূরণ করছে না। বিশেষ করে, শ্রমিক অধিকারের প্রশ্নে বাংলাদেশের বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। এসব ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশ সরকারের কাছে উদ্বেগের কথা জানানো হয়েছিল। এর পরই চিঠিতে রন কার্ক সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা বাতিল করার কথা বিবেচনা করছে, তা লেখেন। তিনি বলেছেন, শিগগিরই মার্কিন সরকার নিয়মানুযায়ী ফেডারেল রেজিস্ট্রারে (সরকারের গেজেট) নোটিশ জারি করবে। সেখানে ঘোষণা থাকবে, শ্রমিক অধিকারের বিষয়েই তারা বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল বা স্থগিত করার কথা বিবেচনা করছে। এ জন্য গণমতামত চাওয়া হবে। এর পরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবেন।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত কিছুদিন সময় পাবে বাংলাদেশ। সে কথা রন কার্ক চিঠিতেও লিখেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাব, তারা যেন খুব দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হয় এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে।’
আমেরিকা জিএসপি সুবিধা বাতিল করে ভালো করেছে:
বাংলাদেশে তৈরি পোষাক শিল্পে শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিষয়টি বারবার আলোচনায় আসলেও গার্মেন্টস মালিকরা এটিকে পাত্তা না দিয়ে তারা শ্রমিক শাসন করে আসছে। মুনাফা লুট করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। শ্রমিকদের কর্ম পরিবেশ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে এভাবে বছরের পর বছর শ্রমিক নির্যাতন কোনো সভ্য দেশে চলতে পারে না। মালিকরা মঙ্গল গ্রহ থেকে আসেনি। তারাও মানুষ। কিন্তু তারা তৈরি পোষাক শিল্পের শ্রমিকদের মনে করে গিনিপিগ। তাদের শ্রমের ন্যায্য মূল্য তো দেয়ই না, বরং নানাভাবে তারা শ্রমিক শাসন করছে। নামমাত্র মজুরি প্রদান করে তারা বছরের পর বছর মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার মুনাফা লুট করছে। আর এই মুনাফা যাদের শ্রমের বিনিময়ে আসছে তারা সব সময় অবহেলিত রয়ে গেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচিত বাংলাদেশের তৈরি পোষাক শিল্পের জিএসপি সুবিধা বাতিল করা
এখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহ বহির্বিশ্বের সকল ক্রেতারাষ্ট্র যদি বাংলাদেশের জন্য জিএসপি সুবিধা বাতিল করে তাহলে ষোলকলা পূর্ণ হয়। গার্মেন্টস মালিকদের দাপটের কাছে বাংলাদেশের সরকারগুলো বিগত বছরগুলোতে শ্রমিকদের দিকগুলো বিবেচনায় না নিয়ে বরং মালিকদের পক্ষে থেকেছে। গরিব মানুষের জীবনের কোনো মূল্য গার্মেন্টস মালিকদের কাছে তো নেই। সরকারের কাছেও নেই। মানুষের জীবনের মূল্য এরা ২০ হাজার টাকায় মেটাতে চায়। নিজেরা এরা মানুষ কিনা সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন! বিশ্বের সকল দেশের উচিত বাংলাদেশে তৈরি পোষাক শিল্পে শ্রমিকদের কর্ম পরিবেশ সৃস্টি না হওয়া পর্যন্ত জিএসপি সুবিধা স্থগিত করা। মালিকদের মুনাফার কাছে মানুষের জীবনের কোনো যেনো মূল্য নেই। আর কিভাবে অপমান করলে আপনাদের চোখ খুলবে?
জিএসপি সুবিধা বাতিল করে আমেরিকা বরং গরিব শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য শ্রমিকদের পক্ষে অবস্থান সুস্পষ্ট করেছে। এখন সরকারের উচিত গার্মেন্টস মালিকদের উপর চাপ সৃষ্ট করে শ্রমিকদের কর্ম পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য কঠোর অবস্থান নেওয়া। নইলে আমও যাবে ছালাও যাবে।