৪/৫ বছর আগের কথা; তখন একটা রিয়েল-এস্টেট কোম্পানির মার্কেটিং হেড হিসেবে ছিলাম
... এক দুপুরে খবর এলো যে আমার পুরান ঢাকার এক নির্মাণাধীন প্রজেক্টের ৭ তলা থেকে একটি ইট, নিচে এক পথচারীর পায়ে পড়েছে;
মারাত্মক ব্যাথা পেয়েছে পথচারী ভদ্রলোক ... গার্ড রুমে, স্যুট পরা এই ভদ্রলোকের মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে... ভয়ে, মুখ দিয়ে ফ্যানা ম্যানা বের হয়ে একাকার
সিকিউরিটি অফিসারকে বললাম, এখনই মেডিকেলে নিয়ে যাও... খরচ কোম্পানি দিবে ... যা করা লাগে করো
... আধা ঘণ্টা পরে ভদ্রলোক উঠে বসলেন
উনার সাথে ফোনে আলাপ করলাম আমি... অত্যন্ত বিনয়ী ভদ্রলোক ... তিনি এখন যেহেতু হাঁটতে পারছেন, তাই উনি চলে যেতে চাচ্ছেন কারন অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে তার
আমি বললাম, “প্লিজ আমার লোক একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাক আপনাকে”
তিনি বললেন, ‘আরে ভাই কিছুই তো হয়নি আমার... সামান্য ব্যাথা পেয়েছি... আর বাংলাদেশে চলতে গেলে টুকটাক এরকম হয়ই... অফিসে শেষ করে বাসায় যাওয়ার পথে যদি তখনও ব্যাথা থাকে, তখন না হয় একটা এক্সরে করে নিব... আপনি চিন্তা করবেন না প্লিজ’
ফোনেই প্রোজেক্টের একাউন্টেন্টকে বললাম “উনাকে জোর করে হাজার পাঁচেক টাকা দাও ... আর হ্যাঁ এই বিল্ডিঙের কন্ট্রাকটারকে লাথি মেরে এখনই প্রজেক্ট থেকে বিদায় করো ... এমন খামখেয়ালী ওয়ার্কার দরকার নাই আমার ... কবে দেখা যাবে সাংবাদিক/পুলিশ এর ঝামেলায় পড়ে যাই”
... বেচারা পথচারী খোঁড়াতে খোঁড়াতে প্রোজেক্ট থেকে বের হয়ে গেলেন
তার ঠিক ৩ মাস পরে, আরেক সকালে ফোন এলো ‘শান্তি নগরে আমাদের নির্মাণাধীন একটা প্রজেক্ট থেকে রডের টুকরা পড়ে, এক পথচারী আহত’
ঘটনা একটু ফরওয়ার্ড করি, গার্ড রুমে চিত পটাং হয়ে শুয়ে আছেন... ভয়ে, মুখ দিয়ে ফ্যানা ... আধা ঘণ্টা পরে স্যুট ঝাড়তে ঝাড়তে উনার উঠে পড়া... বাংলাদেশে এরকম টুকটাক হওয়ার ডায়লগ... অফিসের মিটিং এর জন্য লেট হয়ে যাওয়া... মিটিং শেষে না হয় বাসায় ফেরার পথে এক্সরে করার ইচ্ছা পোষণ করা
আমি উনাকে ফোনে বললাম, “ভাই আমার প্রজেক্ট একাউনটেন্ট আপনাকে হাজার পাঁচেক টাকা দিবে এক্সরে করার জন্য। টাকাটা তুলতে ব্যাংকে গেছে...একটু বসবেন কি!”
সাথে সাথে আমি আমার পুরনো ঢাকার সেই প্রজেক্টে ফোন করে ওদের একাউন্টেন্টকে বললাম “এক্ষন যাও বেইলি রোডের অমুক প্রজেক্টে... যেয়ে দূর থেকে দেখো তো ইনিই সেই ভদ্রলোক নাকি যার পায়ে গত তিন মাস আগে ইট পড়েছিল”
... নিশ্চিত হওয়া গেল ইনিই সেই বান্দা
প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ারকে বললাম, “সে করছে কি এখন?”
‘স্যার, ভদ্রলোক খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে প্রোজেক্ট ঘুরে দেখছেন... মনে হয় এপার্টমেন্ট কিনবেন ... কাপড় চোপড়ে তো তাই মনে হয়’
আমি ইঞ্জিনিয়ারকে বললাম, “ব্রাদারের মুখে ফ্যানা মুছে, উনাকে কোলে করে সিএনজি তে তুলে, তার দুই পাশে দুইজন টাইট হয়ে বসে ...আমার কাছে নিয়ে আসো… এক্ষন”
শুনলাম ব্রাদার আসার পথে প্রথমে একটু নড়াচড়া করেছিল কিন্তু পরে... চুপ করেই বসে ছিল
তাকে ধরে আনা হয়েছে আমার অফিসে ... উনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আমার রুমে ঢুকে, চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন
আমি বলা শুরু করলাম, “আজকে, এমন ভুল করলেন কেনও ব্রাদার? চ্যাগায়ে প্রজেক্টের নিচে আচমকা শুয়ে টুকটাক ঘটনা ঘটানোর আগে দেখবেন না কোম্পানির নাম? দেখবেন না যে এই কোম্পানির সাথে এরকম নাটক আগেও করেছিলাম। ঢাকায় তো নির্মাণাধীন বাড়ির অভাব নাই”
‘ভুল হয়ে গেছে... কোম্পানির নামটা ঠিক মত পড়া হয়নি’
“গুড... প্রতি মাসে এরকম কতবার করেন?”
‘৭/৮ বার’
“তারমানে... ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা ইনকাম আপনার??”
‘না… এক্সরের জন্য কেউই দেড়-দুই হাজারের বেশী দেয় নাহ’
“আপনাকে আমি এখন যদি পুলিশে দেই?”
‘দিতে পারেন’
কথাবার্তার এক পর্যায়ে আমার লজিস্টিকস ডিপার্টমেন্টের এর ঘাঘু অফিসার এসে রুমে ঢুকল ... ওকে ইতিমধ্যে মামলার পেপারস রেডি করতে বলেছিলাম ... সে ইতিমধ্যে চলিত ভাষায় এফআইআর ড্রাফ্ট করে ফেলেছে। ফাইলের উপরে দেখলাম বড় করে লেখা;
*নাম: মোহাম্মদ আলী হোসেন হায়দার
*বয়স: ৫০ (আনুমানিক)
*অভিযোগ: ‘নির্মাণাধীন বাড়ির নিচে যেয়ে ইট দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার অভিনয় করিতে যেয়ে হাতেনাতে ধৃত হওয়া’
...ফাইলের উপর হতে চোখ সরিয়ে হায়দার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম;
“আচ্ছা আপনার মাথায় কি আসলেই ইট পড়ে? নাকি কোথাও ইট পড়ছে দেখে দৌড়ে যেয়ে বল হেড দেয়ার মতো করে মাথায় লাগান? ব্যাপারাটা আসলে কি? আমাকে খুলে বলেন তো কি ভাবে করেন এটা”
‘প্রজেক্টে থেকে একটু দূরে দাড়ায় থাকি... লক্ষ্য রাখি এই প্রজেক্টে কি কাজ হচ্ছে। যদি দেখি এটা নীরব প্রজেক্ট তাহলে সামনের দিকে হাঁটা দেই অন্য প্রজেক্টের খোঁজে ... আর যদি দেখি এই প্রজেক্টে কাজ চলছে তাহলে রিস্কটা নেই’
“আপনার মাথায় কি আসলেই ইট পড়ে?’
‘না’
“তাহলে?”
‘প্রজেক্টের নিচে যায়ে চিৎকার দিয়ে শুয়ে পড়ি... এখন শরীরে ইট পড়ল নাকি সিমেন্টের ব্যাগ পড়ল, এটা কেউ চিন্তা করে না’
“আচ্ছা আপনার পড়াশোনা কত দূর?”
‘আমি এমএ পাশ করেছি ৮৩ তে’
“বাসায় কে কে আছে?”
‘আমার ওয়াইফ আর দুই মেয়ে আছে”
“ধান্দাবাজি না করে ভাল কাজ করতে পারেন না?”
‘৮ বছর আগে পা খোঁড়া হয়ে যাওয়ার পর কেউ কাজ দেয় না... আমার পা আসলেই খোঁড়া; বিশ্বাস না হলে সত্যি সত্যি এক্সরে করে দেখতে পারেন’
“আপনি থাকেন কোথায়?”
‘বাসায়’
“ফাইযলামি করেন? বাসা কোথায় এটা বলেন ...শুনেন, আমিতো আপনাকে থানায় দিব না... আমি কি চিজ জানেন নাহ... দরকার হলে সত্যি সত্যি আপনার মাথায় ইট ভাঙব, তারপর নিজ খরচে মেডিকেলে ভর্তি করে দিয়ে আসব”
‘মতিঝিল...এজিবি কলোনি’
“এই গরমে স্যুট পরে আছেন কেন? যেনও নিজে নিজে আছাড় খেলে ব্যাথা কম লাগে... এর জন্য?”
‘নাহ... আমার আজকে আমার বড় মেয়ের বিসিএস এর ভাইভা আছে… সেখানে যাব’
“বাহ... সিনেমার ডায়লগ তো ভালই জানেন… চোরের মেয়ে এতো শিক্ষিত!!”
‘আমি কি চুরি করেছি?? ...বিকাল ৫ টায় আমার স্ত্রী আর কন্যারা মতিঝিল থেকে সেখানে আসবে... আর আমাকে যদি পুলিশে না দেন, তাহলে এখান থেকে যাবো’
“ওকে চলেন আমিও যাই আপনার সাথে”
‘তাইলে চলেন এখনই রওনা দেই ... না হলে দেরি হয়ে যাবে। দেশের যে অবস্থা... আধা ঘণ্টার রাস্তা যেতে লাগে দুই ঘণ্টা’
---
*কিছু গল্পের দ্বিতীয় পর্ব থাকে না... দ্বিতীয় পর্ব, নিজের মতো করে গুছিয়ে নিতে হয়। আমি তো আর আমার দেড় লাখ ফলোয়ারের সবাইকে, দল বেঁধে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ছোট্ট অফিসটায় নিয়ে যেতে পারি না
আপনি যদি বিশ্বাস করেন যে সে সত্যি বলছে ... সেটা আপনার পজিটিভি এটিটিউডের অংশ
আপনার এই এটিটিউড থেকেই আপনার মাথায় থেকে যাক না এই পজিটিভ চিন্তাটা যে; “সমাজের এক শ্রেণী মানুষের জন্য, খারাপ কাজ করা মানেই খারাপ মানুষ হওয়া না”
সে কিভাবে টাকা ইনকাম করেছে সেটা না হয় অন্য বিষয়... কিন্তু সেই টাকা দিয়ে সে তার মেয়েদের তো পড়িয়েছে... ভালো রেজাল্ট করার জন্য যত প্রয়োজনীয়তা, তা তো অন্তত মিটিয়েছে
আপনার কি মনে হয় যদি তার মেয়েদের নিয়ে কোনও মতে খেয়ে পরে চলার মতোও একটা চাকরি থাকত, তখন সে এই কাজগুলো করত?
…আপনিই উত্তরটা দেন
কারণ, তার বড়গলায় “আমি কি চুরি করেছি?” প্রশ্নটা, তিনি শুধু আমাকে করেনি
মুলপোস্টঃ এখানে।