বন্ধুদের বাড়ীতে আমার যাতায়াত খুবই কম। সেই ছোটবেলাকার অভ্যাস এটি। কম হলেও, বাদ দিতে পারিনি। সবসময় তাদের আমন্ত্রণ-আবদার ফিরিয়ে দেয়া যায় না। তাই, অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেতে হয়।
হাসানদের (রূপক নাম) বাড়ীটা অনেক দূর, ঢাকার অন্যএক প্রান্তে। দূরের যাতায়াত আমার একদম অপছন্দ, অনেকবারের রিকোয়েস্ট সত্ত্বেও একাধিকবার মিস করেছি, এবার আর তাকে ফেরাতে পারিনি। তার বোনটার বিয়েতে যেতে পারিনি, ভাইয়ের বিয়েতে না গেলে বন্ধুত্বটা আর থাকবে না।
জীবনে বিয়ের আমন্ত্রণ পেয়েছি কয়েকশ। গিয়েছি সর্বোচ্চ ১০টিতে, অথবা তারও কম। বেশ অনেক বছর পর এবার বিয়েতে এলাম, হাসানের ভাইয়ের বিয়ে, ২০০২-এর ঘটনা এটা।
বিয়েবাড়ীতে যা হয়, হাসানদের বাড়ীতেও ঠিক তাই। আনন্দ-হুল্লোরের শেষ নেই। অনেক বড়ো বাড়ী তাদের। বিয়েকে কেন্দ্র করে এ বাড়ীতে থাকবে দুচারদিন, এমন অতিথি-আত্মীয়ের সংখ্যাও অনেক। অনেকগুলো গ্রুপ, বিভিন্ন বয়সের। আমাদের গ্রুপটাই ছিলো সবচে ছোট, মাত্র ৫ সদস্যের। ছোট হলেও কাজবাজ ও বিভিন্ন খবরদারির ব্যাপারে অনেক বেশি দায়িত্ব ছিলো আমাদের বন্ধুদের কাধে। দায়িত্ব পেয়ে ওরা সহাস্যখুশী। আমি ছাড়া ৪জনই ভয়ঙ্কর কর্মতৎপরতা দেখিয়ে সকল কাজ শেষ করলো। আমার উপর কোন দায়িত্ব ছিলো না, কারণ আমি কোনদিন কোনপ্রকার কাজে থাকতে আগ্রহী নই, ব্যাপারটি জেনেই বন্ধুরা আমাকে বিরক্তিকর অবসরে পাঠিয়ে দেয়।
কেউ কাজ করছে, কেউ আনন্দ করছে, কিন্তু আমার দুটোর একটিও করার নেই। বিয়েবাড়িতে এলে আমি এমনিতেই আনইজি ফিল করি খুব, আনন্দ করবো কেমনে। আর কাজ, সর্বোচ্চ গ্লাসে পানি ঢেলে খাওয়া। এরচে বেশি কিছু নিজের জন্যও আমি করতে পারি না, প্রয়োজনেও না।
সবাই যখন এভাবে-ওইভাবে কাজ আর আনন্দে ব্যস্ত, আমি এদিক ওদিক হাটাহাটি করে সময় পার করছি। আমার দিকে লক্ষ করার মতো কারোই অবসর ছিলো না সেই বাড়ীতে। খুব বোড় হয়ে গিয়েছিলাম, একটু পর পর শুধু বাইরে গিয়ে সিগারেট খেয়েছি, ব্যাস এটুকুই।
হাসানের বড়ো বোনের মেয়ে ব্যাপারটি লক্ষ করলো, বলেই বসলো, মামা আপনার কি খারাপ লাগতাছে? আসেন, আমাদের সাথে থাকেন, দুষ্টুমি করি। একপ্রকার টেনেই নিয়ে গেলো আমাকে। গিয়ে দুচার মিনিট ওদের সাথে থেকে চলে এলাম। একটু পর সে আবার এসে হাজির, মামা, কই গেলেন। আপনেরে খুজতাছি। বললাম, গ্রুপের মধ্যে থাকতে ভাল্লাগে না। তোমার যদি মন চায় মামারে সময় দিতে, তাইলে গ্রুপ ছাইড়া আসো। বললো আচ্ছা মামা চলেন, বড়ো মামার রূমের ওদিকে চিল্লাপাল্লা নাই, ওদিক গিয়া বসেন। আমি খাওনের কিছু নিয়া আসি, তারপর কথা কমুনে। বললাম, খাবারের কিছু আনতে হবে না। ছাই ফেলার কিছু নিয়া আসো। ও গেলো, অ্যাশট্রে পেলো না কোথাও, একটা পাত্রে পানি নিয়া আসলো। বললাম তুমি যেখানে যাদের সাথে ছিলা, সেখানে চলে যাও। মাঝে মধ্যে আইসা আমারে দেইখা যাইও। অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো আমার বন্ধুর বোনের বালিকাবয়েসি কন্যা আশা, আপনে না কথা কইবে, গল্প করবেন। বললাম, কথা বলি আর গল্প বলি, আগে তো মনে করতে হবে, নইলে কোত্থেকে বলবো। তুমি ঘুরেফিরে একটু লম্বা সময় পর আসো, দেখি কোন কথা বা গল্প মনে পড়ে কী না! এভাবে বুঝিয়ে আশাকে পাঠিয়ে দিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। ভাবতে লাগলাম, এই বাড়ীতে আমার ছোট-বড়ো-সমান অনেক মানুষ আছে। বোকার মতো আমাকে ঘোরাফেরা করতো অনেকেই দেখেছে ; আশা-ই কেনো আমার কাছো আসলো, আমাকে তাদের মাঝখানে নিয়ে গেলো, আমি পালিয়ে চলে এলে আবার খুজে বের করলো, কেন?
কোন উত্তর মাথায় আসছিলো না সমাধানের মতো করে। কিন্তু অদ্ভূত সব উত্তর ঘোরাফেরা করছিলো মাথার আশপাশে। হাসানের সাথে আমার যে সম্পর্ক, সে সম্পর্ক দিয়েই কি এই বাড়ীর সবাইকে আমার বিচার করতে হাবে! আর আশা আমাকে এত্তোবেশি মামামামা ডাকছে যে, আপন মামারও বিরক্ত লেগে যাওয়ার কথা, আমার তো লাগবেই। আশার তখন যে বয়স, সে বয়সটা আমারও ফুরফুরে। আশার সাথে ভবিষ্যতে যে ছেলেটার বিয়ে হবে, সে ছেলেটার বয়স কোনক্রমেই আমার চেয়ে কম হবে না। এই বাড়ীতে শুধু আশাকেই আপাতত আমি কাছে পাচ্ছি, মামু-ভাগনির সম্পর্কের দোহাই দিয়ে এ মূল্যবান সময়টা নষ্ট করার মতো বদ ছেলে আমি না ...।
এমনসব উল্টাপাল্টা চিন্তা করতে করতে ৫/৬টা সিগারেট খেয়ে নিলাম। বাজে চিন্তার পথ দিয়ে ট্রেন ছুটেই চলেছে। প্রায় ঘন্টাখানেক হয়ে এলো আশা গেছে, আসছে ও না। আমার কথা কি ভুলে গেছে, নাকি মামার বন্ধুর সাথে এমন একটা আড়ালজায়গায় সে কথা বলতে চায় না। এমন হাবিজাবি নেতিইতি চিন্তায় মাথাট ভার হয়ে এলো। উঠে গিয়ে আশাদের মযমার কাছে গেলাম, আমাকে দেখামাত্র বললো সরি মামা, একদম ভুইলা গেছি। বললাম বললাম সরির কিছু নাই, ঠান্ডা পানি নিয়া ওইখানে চলে আসো। একটু পর ঠান্ডা পানির সাথে আরও হাবিজাবি নিয়া আশা হাজির সেই জায়গায়। এসেই তার প্রশ্ন, মামা সিগারেট না খাইলে কী হয়? বললাম, সিগারেট না খাইলে অনেক কিছুই হয়। সবচে বড়ো যে ক্ষতিটা হয়, সেটা হচ্ছে- বন্ধুর ভাগনি কে ভাগনি ডাকুম নাকি অন্যকিছু ডাকুম, এই সিদ্ধান্তটা নেওয়া যায় না। বললো, মামা এই জিনিশটা চিন্তা করতে এতগুলা সিগারেট লাগে? আচ্ছা, এগুলা খাইয়া কী সিদ্ধান্ত নিলেন শুনি তো। বললাম, যা বুঝলাম, তোমারে ভাগ্নি বলা যাবে না, কিন্তু অন্যমানুষের সামনে বলা যাবে আর তুমিও কেউ না থাকলে মামা ডাকতে পারবা না। বললো মামা আপনে তো অনেক মজার মানুষ। কী কথা কোন দিক দিয় কেমনে কন, আজীব লাগলো। ... এমন প্যাচাল পারতে পারতে আমি আর আশা ঘন্টাদুয়েক কাটিয়ে দিলাম।
বিয়ে বাড়ীতে যে দুচারদিন ছিলাম, প্রতিদিনই আশা আমার খোজখবর নিতো। কিছু খাওয়ার সময় আমার জন্যও নিয়ে আসতে চাইতো। বলতো, মামা বিয়া শেষ হইলে যদি চলে যান, তাইলে আবার কবে আসবেন? বিয়ের মতো একটি আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে থেকে টুকটাক কথাবার্তাই বলেছিলাম শুধু, কিন্তু ফেরার পথে আশার প্রতি কেমন একটা টান নিয়েই সেই বাড়ি ছেড়েছি।
ইচ্ছাসত্ত্বেও খুব দ্রুত আর যেতে পারিনি হাসানদের বাড়ী। গেলেও অল্পসময়ের জন্য, কিন্তু আশার জন্য কোন সময়ই দেওয়া হয়নি আলাদা করে। তবে অল্পসময়ের জন্য হলেও আমি গেলে আশা খুব খুশি হতো। কিন্তু কথাবার্তার সময় পেতো না, আমিও পেতাম না। তারপর আবার বেশ ক'মাস যাওয়া হয়নি। হাসানও ব্যস্ত, আমিও ব্যস্ত, কেমনে বেড়াই কারো বাড়ী? তবে দূর থেকে আশাকে খুব ভালো লেগে গেছে। হাসানের সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক না, সে হিশেবে আশাও আমার রক্তের ভাগ্নি নয়। ভাবনায় এসে পড়লো ; আমার যখন বিয়ের বয়স হবে, তখন আশার বিয়ে না হয়ে থাকলে প্রস্তাব দিয়ে দেখবো। আবার মন বলে ; হাসানকে বলে রাখি, তোর ভাগ্নির বিয়ের সময় হলে আমারে আওয়াজ দিস। না, অবশেষে আর কিছুই করা হলো না। কাউকে কিছু জানানোই হলো না। বছরখানেকের মাথায় শুনলাম আশার বিয়ে হয়ে গেছে, তার ফুপাতে ভাইয়ের সাথে। ছেলেটা বিদেশ থাকে, আছে মোটামোটি ভালো, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমারও বিয়ের সময় হয়নি, ওর তো হয়-ই-নি। এমন অবস্থায় ওর বিয়েটা হয়ে গেছে, আমার কী-ই-বা করার আছে, নাই...।
আশার বিয়ের ছোটখাটো একটা আনুষ্ঠানিকতা হলো, দাওয়াত পেয়েছি যাইনি, কঠিন। কষ্ট একটু লাগলো, আবার লাগলোও না, আবার ধীরে ধীরে লাগতে লাগলো... । একটা সময় অন্য অনেক মেয়ের পরিপ্রেক্ষিতে আর আশার প্রতি আগ্রহই হারিয়ে ফেলি। হাসানও দূরে চলে যায় বাণিজ্যিক কারণে। এমনি এমনি আশা জিনিশটাই কেমন যেন সময়ের মধ্যে মিলিয়ে যায়।
২০১১, অনেক বছর হয়ে এলো আশার কোনপ্রকার খবর জানি না। যোগাযোগের কোন মাধ্যমই নেই। বন্ধু হাসানের সাথেও সম্পর্কটা আমার আগের মতো নেই। তবে কোথাও দেখা হয়ে গেলে একসাথে শুধু চা-সিগারেট খাওয়া সম্ভব, এমন দুর্বল গিয়ে দাড়িয়েছে আমাদের সম্পর্ক। তো একদিন দেখা হয়েই গেলো হাসানের সাথে, চায়ের দোকানে বসলাম অনেক্ষণ। টুকটাক কথাবার্তা হলো। এও মনে হলো যে, আশার কথা জিজ্ঞেস করার মতো বন্ধুত্ব আমাদের মাঝে নেই। কেমন আছোস, বাণিজ্যের কী খবর, বাড়ীর সবাই ভালো আছে তো, ব্যাস এটুকুই। কিন্তু তোর সেই ভাগ্নিটা কেমন আছে, এই প্রশ্নটা করার চেষ্টা করলেও মুখ দিয়ে বেরোয়নি। আফসোসই লাগলো, আমাদের বন্ধুত্বটা আগের মতো থাকলে আশার খোজখবরটা নেয়া যেতো, যোগাযোগটাও করা যেতো, কিন্তু সবই শেষ মনে হচ্ছে, বিষয়টা আর কোনভাবে জিইয়ে রাখা যাচ্ছে না।
হাসানের সাথে এবারের দেখার পর থেকে খুব করে মনে পড়ছিলো আশার কথা। আধুনিক এই দুনিয়া একটা মেয়ের সাথে কোনপ্রকার যোগাযোগ করা যাচ্ছে না, মেজায খারাপ হওয়া কথা। কেমন আছে আশা, কী করছে আশা, সংসার কেমন করছে- এমন অনেক প্রশ্ন, কোনোটারই উত্তর জানি না। কিন্তু প্রশ্নগুলো ঠিকই উত্থিত হয় নিজের মধ্যে। এতো বছর পর বিষয়টা খুব করে জ্বালাতন করছে নিজের মধ্যে, কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে যাওয়া বলে মনে হয়। খুবই খারাপ কাটলো দুইটা সপ্তাহ, অনেক খারাপ। আমার ইমোশনাল জায়গাটা একটু মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে আমি একদম ভেঙে পড়ি, কিছুই ভাল্লাগে না। আশার সাথে আমার প্রেমভালবাসা কিছুই ছিলো না। বিয়েবাড়ীর সেই দুচারদিন আমাদের সম্পর্কটা মামা-ভাগ্নির বাইরে যায়নি। তারপরও কেন এতোটা খারাপ লাগছে, বুঝে উঠতে পারছি না। কোন কাজেই মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। আশপাশে এতো মেয়ে, এতো বালিকা, এতো বধূ ; কারও কাছে গিয়ে শান্তি পাচ্ছিলাম না, কারও বুকে মাথায় রেখেও স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না ...। কেন যেন নিশ্চিত আশঙ্কার কথা ভাবছিলাম আশার ব্যাপারে। না পেরে, অবশেষে বন্ধু হাসানকে দেখা করতে বলি, সময় নিয়ে আসতে বলি, রাতে একসাথে কোথাও থেকে আড্ডা দেবো। একটু হলো, তবু এসে সারারাত একসাথে সময় কাটালো। আমাদের সম্পর্কে চিড় ধরার কারণগুলো নিয়ে আলোচনা হলো, বিশেষ পানাহার হলো, দুজনে সন্ধ্যাতে ভোর করে ফেললাম।
ভেবেছিলাম, এক রাতের আড্ডায় হাসান একটু স্বাভাবিক হবে। হলে, আশার ব্যাপারে খোজখবর নেবো, না, ওদিকটায় যেতেই পারলাম না। উপায়ান্তর না দেখে, ভোরের খানিক আগ দিয়ে ওর মোবাইল থেকে আশার নাম্বারটা চুরি করতে বাধ্য হলাম। সরি হাসান, নাম্বারটি চুরি করার জন্য সরি, আর কোনো উপায় ছিলো না ...।
সকালে নাস্তাপানি করে হাসানকে বিদায় দিয়েই আশার নাম্বারে (এয়ারটেল) ফোন দিলাম। একটা মেয়ে রিসিভ করলো, কণ্ঠ শুনে বুঝলাম, এটা আশা নয়। জিজ্ঞেস করলাম, আশা আছে? বললো, আছে, কিন্তু কথা বলতে পারবে না, ওর খুব পেট ব্যথা। আমাকে জিজ্ঞেস করলো আপনি কে? প্রশ্নটা শুনেই লাইন কেটে দিলাম। দুপুরে অন্য একটি আননোন নাম্বার (রবি) থেকে ফোন এলো, হ্যালো বলামাত্রই বুঝতে পারলাম আশার কণ্ঠ। কথা বলার সাহস পেলাম না, কী বলে শুরু করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না, তাই লাইন কেটে দিলাম। এয়ারটেল নাম্বারে কিছুক্ষণ পর ফোন দিলাম, আশাই ধরলো। পরিচয় লুকিয়ে কথা বলতে চাইলাম, বললো না। আবার যখন ফোন দিই, রিসিভ করে আশা বললো, ভাই, মোবাইলে অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলার অভ্যাস আমার নাই। পরিচিত হইলে পরিচয় দেন। আর অপরিচিত হইলে আমার বন্ধবীর সাথে কথা বলেন, ওর আবার অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলার অভ্যাস আছে, এই বলে মোবাইলটা অন্য একটা মেয়ের হাতে দিয়ে দিলো। মেয়েটার সাথে খুব স্বাভাবিকভাবে কিছুক্ষণ কথা বললাম। তারপর বললে, এই এয়ারটেল নাম্বারে আর ফোন দিয়েন না। যদি কথা বলতে মন চায় রবি নাম্বারটায় ফোন দিয়েন, এটা আমার নাম্বার।
এই মেয়েটার নাম সুমি। আশাদের বাড়ীতে ভাড়া থাকে। সময় পেলেই আশার কাছে চলে আসে। গলায় গলায় পিরিতওয়ালা বান্ধবীর মতো ওরা। বলা যায়, অর্ধেকটা দিন আশার সাথেই কাটায়। অপরিচিত মানুষ হেশেবেই কয়েকঘন্টা সুমির সাথে কথা বললাম। আশার ব্যাপারে খোজ নিলাম, অনায়াসেই আশা সব কথা খুলে বললো আমাকে। তবে আশার ব্যাপারগুলো খুব হালকাভাবেই শুনলাম, গুরুত্ব দিলে অনেক কিছু টের পেয়ে যেতে পারে, তাই আগ্রহটা দেখালাম সুমির সাথে, সুমির ব্যাপারেই। এক প্রকার কথার কথা হিশেবেই আশার ব্যাপারগুলো জানলাম।
তিন দিনের মাথায় সুমিকে বললাম, তোমাদের এলাকায় কাল একটা কাজ আছে, তুমি যদি চাও, দেখা করতে পারো। তবে আমি চাই, তুমি দেখা করো। গুরুত্বহীনভাবে, দেখা যাক বলেই শেষ করলো। পরদিন দুপুরে সুমিকে ফোন দিয়ে বললাম, বিকেল চারটার দিকে আমি আসছি। কাজ শেষ হতে অধঘন্টা লাগবে, পাচটার দিকে তুমি এসো পারলে। সুমি আমাকে বললো, তোমার কাজটা একদিন পর করলে হয় না? কারণ, আজকে আমি বের হতে পারবো না। কাল যদি আসো, তাইলে দেখা করতে পারলাম। বললাম না, খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ, আজকে না করলে বিপদ হয়ে যাবে। থাক, তোমার আসার দরকার নাই। আমার কাজ আমি সেরে যাই, এই বলে রেখে দিলাম (আসলে সেই এলাকায় আমার কোন কাজই ছিলো না)।
অফিসে একটু দেরি করে গেলাম। আশাকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা মাথায় ভয়ঙ্করভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে। নিজেকে বারবার তিরষ্কার করছি। আফসোস হচ্ছে, এতোদিন কেন আশার ব্যাপারে সিরিয়াস হলাম না। বছর পেরিয়ে গেলো, ভয়ঙ্কর বিপদে আছে মেয়েটা, খুব খারাপ উপাখ্যান। কাজে হাতই দিচ্ছি না, সিগারেট দিয়ে সিগারেট ধরাচ্ছি, ভালোই লাগছে না। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে সাড়ে চারটার দিকে সুমির ফোন। রিসিভ করা মাত্রই জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি আমাদের এলাকায়? বললাম, হ্যা। এখন কি চলে যাচ্ছো? বললাম, হ্যা। বললো, যদি পারো, ঘন্টাদুয়েক আমাদের এলাকাতেই থাকো। আমি ৭টার দিকে আসতে পারবো। সম্ভব? বললাম, ঠিক আছে ...।
দৌড়ের উপর চলে গেলাম, ঢাকার সেই প্রান্তে। রাস্তাটা ডেটিংসুলভ ছিলো, ঘন্টাদুয়েকের মধ্যে পৌছে গেলাম সেই, সেখানটায়। সুমি আমার আগেই চলে এসেছে, লোকেশনমতো অপেক্ষা করছিলো, আমিও গিয়ে হাজির। ভালোভাবে কথা বলতে হলে একটু দূরের এলাকায় যাওয়া দরকার, সেই ব্যাপারটা বললো। আমার তো কোন সমস্যাই নেই, মাসকট প্লাজার ওখানে চলে গেলাম দুজনে। প্রায় ১১টা পর্যন্ত ছিলাম স্প্রিঙ-এ, এতোটা সময় থাকতে চায়নি, আমিই রিস্ক নিতে বললাম। কিছুই করার ছিলো না, ভয়ঙ্কর সব আলাপ উঠে এসেছে আশার ব্যাপারে, তাই এই রাতকরা। অবশেষে যেতে দিলাম এই শর্তে, কাল সকালে আবার দেখা হবে, লম্বা সময় নিয়ে আসবে, একপ্রকার সারাদিন, সন্ধ্যায় গেলেই চলবে।
ওকে রিকশা করে দিয়ে একা রাস্তায় দাড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ, ভাল্লাগছিলো না। বাসায় যেতে মন চাইছে না, মন-মানস-শরীর সবকিছুই কেমন যেন ভঙুর মনে হচ্ছে। না বাসায় যাবো না, ট্যাক্সি নিয়ে গুলশান২-এ হলিডে প্লানেট-এ এসে উঠলাম। ফ্রেশ হয়ে খুব করে ঘুমাবার চেষ্টা করলাম, আসছিলো না। শুধুমাত্র সিগারেটের উপর ভর করে সময় কাটছিলোই না। ... একটা সময় সিগারেট টানতে টানতে ক্লান্তি এসে যায়। রিসিপশনে ফোন করে, সকালে একজন গেস্ট আসবে বলে রাখি। তারপর ঘুম। ... যে ঘুম ভাঙে সকাল ১১টায়, সুমির কল আর দরোজায় নক-এর শব্দে।
দরোজ খুলে ভরকে যাই ; এ কোন সুমি, কেমন সুমি, রাতে যে সুমিকে বিদায় দিয়েছিলাম সেই সুমি! বুঝলাম, রাত পেরুলে মেয়েদেরকে আর চেনা যায় না। রাতই হচ্ছে তাদেরকে চেনার মোক্ষমক্ষণ। রাতের বেলা সুমি আমার সাথে ছিলো না, থাকলে হয়তো এমন ভয়ঙ্কর পরিবর্তন ধরতে পারতাম। না, সাথে থাকলে হয়তো পরিবর্তনটায় অভ্যস্ত হয়ে পরতাম, ধরা যেতো না হয়তো- এসব চিন্তা করতে করতে আর সুমিকে কিছুই বলা হয়ে উঠলো না। একটা পর্যায়ে সুমিই বলে বসলো, চলে যাচ্ছি না তো, দেখার সময় পাবা, আছি তো সারাদিন এবং কিছুটা সন্ধ্যা। ... শুনে ঘোর কাটলো।
বললাম, আশা কেমন আছে, কী করছে। না, ভালো না, এটাই সুমির উত্তর। আরও অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলাম, প্রতিটা উত্তরই সে দিলো বিরক্তিকর স্বরে। একটা পর্যায়ে লক্ষ করলাম তার কণ্ঠে কেমন যেন জেলাসির দুর্গন্ধ, এ মুহূর্তে হয়তো সে আশার কথা শুনতে চাচ্ছে না, অন্তত এখন নয়। হঠাৎ বলেই বসলো, আশার ব্যাপারে পরে কথা বলা যাবে, এখন আপ্যায়নের ব্যবস্থা করো! বললাম ৩২১-এ কল করে যা ইচ্ছা অর্ডার দাও। বললো, খাবো না, খেয়ে এসেছি, পান করবো। কিচ্ছু জানি না, ব্যবস্থা করো। সব জায়গার পানীয় আমার ভাল্লাগে না, অনাস্থা কাজ করে। তাই বাইরের এক বিশ্বস্ত জায়গা থেকে অ্যারেঞ্জ করলাম, আসতে দেরি হলো, প্রায় ঘন্টা দুয়েক। দুজনেই পান করলাম। ভালোই। একটা ব্যাপার কি, শুনেছিলাম, সুমি খুব একটা সিগারেট খায় না, মাঝেমধ্যে দুএক টান দেয়। কিন্তু দেখলাম, আমার সিগারেট খাওয়ার মধ্যে সে কেমন যেন ঢুকে পড়েছে, বেশ টানলো, পুরো রুম অন্ধকার করে ফেললো মনে হয়।
দুজনই একটু অস্বাভাবিক, ইষৎ প্রকম্পিত। কথা বলছিলাম, এটা-ওটা। বারবার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিলো আশার কথা, বারবারই আমাকে থামিয়ে দিচ্ছিলো সুমি। একবার তো বলেই বসলে, আজকে আশার কথা বলতে এসেছি, বাট তুমি যেভাবে ঘ্যান ঘ্যান করছো, এ ব্যাপারটি নিয়ে আজকে আর ডিসকাস করছি না। রাগ করো আর যা-ই করো, আমার কিছুই করার নেই। আচ্ছা, তুমি কি সেক্স করা পছন্দ করো? হঠাৎ বলে বসলো সুমি। বললাম, শুধু আমি কেন, পশুপাখিও খুব পছন্দ করে, তারখাম্বা আর পেপসিরা এটা পছন্দ করে না। আমাকে থামিয়ে দিয়ে সুমি বললো, পেপসি সেক্স পছন্দ না করলেও কিস পছন্দ করে খুব, অবশ্য এটা তো আর সেক্সের বাইরের কিছু নয় ...।
বোমাফাটানো কথা আরেকটা বলে বসলো সুমি, ছেলেদের সাথে আমি দিন কেনো, রাতও কাটিয়ে দিতে পারবো অবিরাম, কিছুই হবে না, এটা জানতাম। কিন্তু তোমার সাথে দুচারঘন্টা কাটিয়েই আমি আর পারছি না, তোমার সম্মতি নিয়েই আমি তোমাকে ক্লান্ত করতে চাই। এরপর বেশ দীর্ঘসময় আমি শব্দ করে কোন কথা বলতে পারিনি। কারণ আমার আর সুমির ঠোট একীভূত হয়েছিলো, ঠোটচুমুর সময় আসলেই কথা বলা যায় না, আমিও পারিনি, সুমিও নয়, পৃথিবীর কোন মানুষ হয়তো এই সময়টায় কথা বলতে পারে না। মাঝে মধ্যে প্রশ্ন জাগে, বিশেষ এই সময়ে মানুষ যদি কথা বলতে পারতো, তাহলে তারা কতো কথাই না বলে ফেলতো...! ... অবশেষে, রাত ৮টার দিকে হোটেল থেকে বের হবো, এমন সময় সুমি বললো, একটা মেয়ে একটা ছেলেকে যতোটুকু ভালসতে পারে, আমি একটা ছেলেকে তারচে বেশি ভালবাসি। ছেলেটাও আমাকে অনেক ভালবাসে, কল্পনা করতে পারবা না। তারপরও তোমাকে একটা কথা না বলে পারছি না- আই লাভ ইউ অলসো ...। আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমিও জীবনে অনেক মেয়েকে ভালবেসেছি, এখনো ওদেরকে খুব ভালবাসি, আই লাভ ইউ শব্দটাও অনেককে বলেছি, তোমাকেও বলছি, আই লাভ ইউ, মনে কিছু নিও না! ... এরপর আমরা বেরিয়ে পড়লাম। সুমিকে আর একা ছাড়লাম না, আমিই নামিয়ে দিয়ে আসলাম তাদের বাড়ীর খুব কাছে, দূরে ছাড়তে একটু ভয় হচ্ছিলো, তাই খুব কাছে।
তারপর থেকে মাঝেমধ্যেই চলে আসে সুমি, আমিও ডাকি, সেও চলে আসে ইচ্ছে করে অথবা অনিচ্ছায়। আশার ব্যাপারে মোটামুটি সবকাথাই শুনেছি, অবাক অদ্ভূত লেগেছে আশার ব্যাপারটা। স্বামী বিদেশ থাকে, শশুরবাড়ীর লোকজনও মোটামুটি স্বচ্ছল। অথচ, মাত্র ৩০ হাজার টাকার জন্য মেয়েটার অপারেশন হচ্ছে না, প্রায় দুই বছর হয়ে এলো প্রচন্ড ব্যথা সয়ে যাচ্ছে। বিয়ের আগ থেকেই আশার স্বামী আজাদ বিদেশ থাকে, ৫ বছর বিদেশ করার পরই সে বিয়ে করে এই বাচ্চা মেয়েটাকে। বিয়ের পর দুইবার বিদেশ করে এলো আজাদ। বিদেশ থেকেই শুনেছে স্ত্রীর শারিরীক অবস্থা। বলেছে, দেশে ফিরেই অপারেশন করাবে। টাকা পাঠালেই পারতো, পাঠায়নি। এমনিতেই লোকটা আশার কাছে টাকা পাঠায় না, মায়ের কাছে দেয়। পৃথিবীর বেশিরভাগ শাশুরি যেমন হয়, আশার শাশুরিও ঠিক তাই। আশার হাতে একদমই টাকা দেয় না, যা লাগবে এনে দেয়, এ ব্যবস্থাপনায় স্বামীও বেশ সন্তুষ্ট। প্রতিদিন বেশ অনেকসময় চোখের সামনে ব্যথায় কাতর হয়ে পড়লেও, এতোগুলো টাকা খরচ করার প্রয়োজনই মনে করেনি সেই জল্লাদনী। শুধু আশ্বাসই দিয়ে যেতো, একটু ধৈর্য ধর মা, আজাদ এসে প্রথমেই তোমার এ সমস্যা সমাধান করবে, নিশ্চিত থাকো। শাশুরির এ কথা শুনতে শুনতে আশা একদমই হতাশ, গালির মতো মনে হয় তার কাছে, তবু সয়ে যায়।
২০১১-এর জুলাই মাসে আজাদ দেশে আসে। স্বামীর আগমনে সে বেশ খুশিই হলো, তবে চিকিৎসার ব্যাপারটার চেয়ে তার কাছে বড়ো ছিলো স্বামী। এই মেয়েটাও কেন যে বুঝে, তীব্র পেটব্যথার চেয়ে একাকিত্বতা অনেক বেশি অসহ্য। স্বামীকে কাছে পেয়ে ব্যথাটা আর তার কাছে গুরুত্বই পেলো না, আজাদও জিনিশটা তেমন পাত্তা দিলো না।
বেশ ভালো টাকা নিয়েই এবার দেশে এসেছে আজাদ। ঢাকায় নিজস্ব বাড়ীতেই থাকে আজাদরা। বাবা নেই, ভাইদের মধ্যে সে একাই। এক বোনের বিয়ে হয়েছে, আরেকবোন ছোট। আজাদের মা বউ-এর সাথে একপাতিলে খাওয়া পছন্দ করে না, তাই বউজীবনের প্রথম বছর থেকেই আশার পাতিল আলাদা, সংসার আলাদা। ছেলে বিদেশ থাকলেও বউটাকে তিনি নিজের কাছে রাখলেন না, নিজের ফ্লোরেও না। ৩ মাস ১৩ দিন দেশে ছিলো আজাদ। ৬ কাঠার যে জমিটা কিনেছিলো বছর তিনেক আগে, এই সময়টাতে এখানে বাড়ী তুললো নতুন। প্রায় প্রতিদিনই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়ীর কাজ দেখশোন করেছে আজাদ। আর রাতে মেজায হয়ে থাকতো খিটখিটে। সারাদিন পরিশ্রম করে আসা প্রায় দ্বিগুন বয়েসি স্বামীটাকে চিকিৎসার কথাটা বলার সাহসই পাচ্ছিলো না আশা। শেষ দিকে একদিন বলেই ফেললো আশা ; আপনি না বলেছিলেন, দেশে আইসা আমার অপারেশনটা করাবেন, চলে যাওয়ার দিন তো আইসা পড়তাছে, আমারও খুব কষ্ট হইতাছে, কালপরশু একটু হাসপাতালে নিয়া চলেন। আজাদের উত্তর, রাত করে এইসব কথা বাদ দাও, ঘুমাও। দিনে মনে করিয়ে দিও। দিনে তো আপনি থাকেন না, কখন বলবো, দুপুরে খেতে আইসা তো একটু দাড়ানোর সময় পান না। আজাদ বললো, সকালে যাওয়ার সময় মনে করিয়ে দিও।
আশায়, আশ্বাসে রাতটা শেষ হলো, ভোর পেরিয়ে সকাল হলো। আজাদের যাওয়ার সময় হয়েছে, ভয়ে ভয়ে আশা প্রসঙ্গটি উঠালে আজাদ বললো, ময়ের কাছে চলো, দেখি মা কী বলে! দুজনে নিচতলায় মায়ের কাছে গেলো। আজাদই বললো, মা, ওর নাকি পেটে কী সমস্যা, অপারেশন করতে হবে। মা বললো, কী কস এইসব। টাকা কই। বাড়ী করতে গিয়া কতো টাকা ঋণ করছোস, হিশাব আছে? বউ এতোদিন কষ্ট করছে, আর কয়টা দিন কষ্ট করলে কী হয়, এইবার গিয়া অপারেশনের লাইগা আলাদা কইরা টাকা পাঠাইস। আমিই করাইয়া নিমুনে, এইসব শুনে আজাদ মেনে নিলো। আশাকে বললো, তুমি উপরে যাও, আমি যাচ্ছি, এই বলে আজাদে সিড়ি বেয়ে নেমে গেলো। আশাও চলে এলো উপরে। তার মন চাচ্ছিলো অনেক উপরে যেতে, একটা ফ্লোর উপরে গিয়েই তার থামতে হলো। আরও বেশি উপরে উঠতে পারে পাখি, তাদের ডানা আছে। আর আশার আছে শুধুই চোখের জল...।
সময় হয়ে এলে আজাদ চলে যায়। আজাদ কাছে থাকা আর দূরে থাকা, আশার কাছে সমান বলে মনে হয়। তবু এবার গিয়ে টাকা পাঠানোর আশ্বাসে কিছুটা বিশ্বাস করেছিলো আশা, দু'মাস পেরিয়ে গেলেও টাকার কোন খবর নেই, তৃতীয় মাসের শুরুতেই (ডিসেম্বর) আমি আশাকে কল দিয়েছিলাম। এখনো ডিসেম্বর চলছে, চিরকাল ডিসেম্বর থাকে না, ডিসেম্বর থেকে যাক, এটাও আমি চাই না। তবে আমি সুমিকে বললাম রোববার আমি টাকা দিচ্ছি, যেভাবেই পারো, যেমন করেই পারো, আশার অপারেশনটা করিয়ে নাও। এটা করাতে গেলে যদি আশার শাশুরি বাধা দেয়, তাহলেও কিছু করার নাই, তুমি জাস্ট রোববার সকালবেলা আশাকে নিয়ে বেরিয়ে যেও। অপারেশনের বেলায় আমিই লিখিত দেবো। আর এ কাজ করাতে গিয়ে যদি আশার সংসারে কোন ঝামেলা হয়, সেটারও দায়দায়িত্ব আমার। আর আপাতত আমার কথা কিছুই বলার দরকার নেই, তুমি নিজ থেকেই টাকা অ্যারেঞ্জ করেছো, এটা বলবে।
শনিবার আশাকে আর রাজি করাতে পারলো না সুমি, রবিবার দুপুর হয়ে এলো, অন্যের টাকায় অপারেশন করাতে রাজি হচ্ছিলো না আশা। সুমিকে বললাম, তাহলে আশার শাশুরিকে গিয়ে বলো, টাকার কথা শুনলে দেখবা রাজি হয়ে গেছে। কিন্তু আজকে না, কাল। তবে এর আগে ক্যাশ টাকা দেখাতে হবে। এ কথা শুনে বিকেলের আগেই সম্পূর্ণ টাকা পৌছে দিলাম সুমির কাছে, টাকা দেখে ভদ্রমহিলা খুশিই হলেন। কিছু বয়ানও দিলেন, মানুষ মানুষের জন্য একথাও বললেন, সাথে ছেলের দূরাবস্থার কথাও স্মরণ করলেন। অবাক করে দিয়ে আবার এই কথাও বললেন, ৫০ হাজারে যদি না হয়, এর বেশি টাকা লাগলে কী করবা? আমার হাত কিন্তু একদম খালি, তাছাড়া দুনিয়ার ঋণ মাথার উপরে। সুমি বললো, আন্টি আপনি চিন্তা কইরেন না, আমি সব খোজ নিয়া আসছি, এই টাকায় হয়ে যাবে। শেষে মহিলা বললেন, আল্লাহ তোমারে বাচাইয়া রাখুক!
পরদিন সকালবেলা আশার শাশুরি খুব সাজুগুজু করে বের হলো আশাকে নিয়ে আর সুমি, সাথে সুমির বড়ো ভাই। ধানমন্ডির এক হাসপাতালে এডমিট হলো আশা। পথে বারবার সুমির দিকে তাকিয়ে কাদছিলো আশা- এ কান্না, কিসের কান্না, শুধুই কান্না, আসলেই কি কান্না? আমি তাদের কাছে যাইনি, যেতে পারিনি, খুব ব্যস্ত ছিলো সুমি, তাই দেখা করতে নিষেধ করেছি। তবে আমি তাদের আশপাশেই ছিলাম, ধানমন্ডি ৫-এর ম্যাঙ্গোতে। সর্বক্ষণ মোবাইলে যোগাযোগ রাখছিলাম সুমির সাথে, আশা নাকি শুধুই সুমির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কাদছিলো।
সহজ, সাবলীল এবং তুলনামূলকভাবে স্বল্পসময়েই অপারেশন সম্পন্ন হলো। অপারেশনের পর আরও ৩ দিন হাসপাতালে থাকতে বলেছিলাম ওদের। মাঝে একদিন শাশুরি বাসায় গিয়েছিলো। সুমিও তার ভাইকে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। এ সুযোগে, দীর্ঘ অনেক বছর পর আমি আশাকে দেখলাম। সুমি আমাকে কাজিন বলে পরিচয় করিয়ে দিলো। আশাও আমাকে চিনতে পারলো না যে, আমি সেই মামার বন্ধু। না চেনার কারণ আছে। অনেক বছর পেরিয়ে গেছে, তাছাড়া আমিও আগের মতো নেই, বেশভুষা-চেহারা-সুরত একেবারেই বদলে ফেলেছি।
পরদিন আশার শাশুরি এসে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। বাসায় গিয়ে সুমি সার্বক্ষণিক আশার সেবাশুশ্রূষা করলো। ১৫/২০ দিন যেতেই আশা পুরোপুরিই সুস্থ হয়ে উঠলো। সপ্তাহ/মাস পেরুতেই থাকলো, মূল ঘটনা বলতে বারণই করে রেখেছিলাম সুমিকে। তারপরও মাঝে মধ্যে পুরনো ব্যথার কথা মনে করে সুমিকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করে আশা। একদিন আত্মসম্বরণ করতে না পেরে, সব ঘটনা খুলে বলে দিলো সুমি। সাথে সাথেই নাম্বার নিয়ে আমাকে কল করলো আশা, বললো এখনই আপনি উত্তরায় আসেন, নইলে বলেন, আপনে কই আছেন, আমি আসি। আমি তখন ভয়ঙ্কর রকম সমস্যায় আছি, প্রচন্ড কাজের চাপ, কোনোভাবেই সময় বের করার স্কোপ ছিলো না। বুঝিয়ে বললাম, আমি এখন এই পরিস্থিতিতে আছি। এখন সময় বের করলে আমার এই এই ক্ষতি হবে, তুমি যদি চাও আমার ক্ষতি হোক, তাইলে বলো, আমি চলে আসি। আরও অনেক কিছু বুঝিয়ে তাকে শান্ত করলাম।
আমি আমার কাজে ব্যস্ত থাকলাম, একপ্রকার সারাক্ষণই আশার সাথে লাইনে থাকতে হতো, যেহেতু দেখা করতে পারছি না, সেহেতু কথা বলেই সঙ্গ দিতে হচ্ছে। কিছুদিন পর একটা রবিবার কোন কাজ থাকলেও রাখলাম না হাতে। শুক্রবারেই জানিয়ে দিলাম, রবিবারের কথা। শুনে আশার তো একপ্রকার নাচানাচিই শুরু হলো। রবিবার রবিবার করে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে একদম। শনিবার থেকে একপ্রকার ক্ষণ গণনাই শুরু করলো আশা। দুপুর হয় না কেন? বিকেল হবে কখন? আর সন্ধ্যা ...? সময় এতো ধীরে যায় কেন? এতোদিন তো দেখতে না দেখতেই সময় চলে যেতো, এখন দেখি ঘড়ির কাটা চলছেই না! সেই কোন সন্ধ্যায় নাশতা খেয়েছি, এরপর কতোকিছু করলাম, অথচ বাজে মাত্র ১০টা- এভাবেই ক্ষণ গণনা করছিলো আশা। শনিবার রাত, সারাটা রাত আমাকে একদই ঘুমুতে দেয়নি। শুধু একটাই কথা, কখন হবে রবিবার বিকেল, আর এই বিকেল যেন বিকেলই থাকে, সন্ধ্যা যেন না হয়, একটা দিন সূর্য না ডুবলে খুব কি ক্ষতি হয়ে যাবে...? এসব বলতে বলতে, ভোর বেলায় ঘুমিয়ে পড়লো আশা, আমিও ঘুমালাম, উঠলাম ১২টায়।
বহুপ্রতীক্ষিত রবিবার, আশা এলো, সাথে সুমি। আমাকে কাছে পেয়েই রাস্তায় লোকজনের সামনেই জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলো। দৃশ্যটা দেখে সুমির চোখেও যেন পানি টলটল করছে। আমাকে ছাড়ছিলো না, মানুষ খারাপ বলবে, এই বলে নিজেকে কোনভাবে ছুটিয়ে নিলাম। সুমি বারবার ইশারায় জিজ্ঞেস করছিলো, সে কি থাকবে নাকি চলে গিয়ে অন্য কোথাও অপেক্ষা করবে। আমি যেতে বারণ করলাম। কিন্তু একটা সময়ে আশাই সুমিকে বললো, কিছু মনে করিস না, আমরা একটু কথা বলি, তুই ঘন্টাদুয়েক একটু হেটে আয়...। বেশ হাসিমুখ নিয়েই সুমি চলে গেলো, বললো, ফোন করলেই চলে আসবো, আশপাশেই কোথাও আছি। তোরা কোথায় থাকবি, এসএমএস করে জানিয়ে দিস, এই বলে সুমি চলে গেলো।
ঢাকা রিজেন্সীর টপ ফ্লোরে Grill on the Skyline-এ গিয়ে বসলাম। বেশ আবেগঘন সময় কাটালাম দুজনে, কূল-রক মিলিয়ে মিউজিকও ছিলো। এটা ওটা খেলাম। যাওয়ার সময় আমার হাত ধরে সুইমিংপুলের পাশে গিয়ে দাড়ালো আশা। খুব কাছাকাছি দাড়িয়ে বললো, পানির দিকে দেখেন, দেখলাম- আকাশের ব্যাকগ্রাউন্ড-এ আমাদের যুগল ছবি ভাসছে। আশা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো, এই ছবিটা কি সত্যি হওয়া সম্ভব? ... আমি সেদিন আশার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। পরে দিয়েছি, বুঝিয়েছি, এও বলেছি- আমি যদি কোন মেয়ের সংসার ভাঙার কারণ হয়ে যাই, সে মেয়ের ধারে কাছেও আমি আর যাই না। ... এ কথা শুনে আশা জিজ্ঞেস করেছিলো, যদি সংসারটা করে যাই, সারাজীবন করে যাই, তাইলে কি আপনেরে সারাজীবন পামু? খুব সহজেই জবাব দিলাম, পাবা, সবসময়, চিরকাল (এই উত্তরটা দিতে আমার কোনদিন সময় লাগেনি, আজও নয়)।
আশার সংসার আশা আগের মতো করে যাচ্ছে, সবকিছু ঠিকঠাক। ভালোই যাচ্ছে আমাদের সম্পর্ক, দিনকাল। আশাবিষয়ক আক্ষেপটা এখন আর আমার নেই, আমাকে কাছে পেয়ে, চিরকালের অঙ্গীকারে কাছে পেয়ে বালিকাবধু আশা এখন অনেক বেশি হাসতে জানে, ভালবাসতে জানে। সুমিও বেশ আছে, মাঝেমধ্যেই এসএমএস করে love you, miss you, umma, valo thakis, ashare peye amare vulis na kintu ...। ... এটাই জীবন, শুনতেও ভাল্লাগে...।
বালিকাবধূবিষয়ক পরকীয়ার পূর্ববর্তী পোস্ট
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১২ সকাল ৮:৫৩