বধূবিদ্যা কোনো অর্থেই রূপক কিংবা কল্পনাপ্রসূত গল্প নয়। এ সিরিজটি সম্পূর্ণই পরকীয়াবিষয়ক আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সরল স্বীকারোক্তি। তবে এখানে সামাজিক গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলার কথা মাথায় রেখে ব্যক্তি ও স্থানের নামকে বাস্তব সত্যে উপস্থাপন করা যায়নি, রূপক অর্থেই ব্যবহার করতে হয়েছে বলে দুঃখিত।
৩ মে ২০১২, রাত ৩টায় বন্ধুর নাম্বারে জীবনে প্রথমবারের মতো কল দিলাম, বন্ধ পাবো, এমন শঙ্কা নিয়েই। দুতিনটা রিং বাজামাত্রই ওপাশ থেকে রিসিভ করলো বন্ধুর নির্ঘুম জীবনসঙ্গিনী। অপরিচিত মানুষ হিশেবে ৫ মিনিটের মতো কথা হলো। তার শেষ কথা ছিলো- এতো রাতে মানুষকে বিরক্ত করেন ক্যান, রাখি।
হয়তো সে ফোনটা কেটেই ঘুমিয়ে পড়েছে, অথবা জেগে ছিলো। যাই হোক, এতে আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমি ভাবছিলাম অন্যটা, অনেক দীর্ঘ অন্য জিনিশ, মেঘাচ্ছন্ন দীঘল ঘোর ...। বন্ধু তাহলে সত্যি সত্যিই বিদেশ চলে গেলো!
বন্ধু বিদেশ গেলে কারোই কিছু যায় আসে না। কিন্তু বিবাহিত বন্ধু বিদেশ গেলে আমার ভিতর বাজেসব চিন্তা খেলে যায়। এ জন্য আমার কোন আক্ষেপ নেই, অপরাধবোধ নেই। বধূটির কথা চিন্তা করলে নিজেকে বারবার ফেরেশতাই মনে হয়।
যে বন্ধুর কথা বলছিলাম, সে আমার খুব ছোটবেলাকার বন্ধু। পিচ্চিকালে একসাথে লেখাপড়া করেছি কিছুদিন, টুকটাক খেলাধুলাও করেছি, ব্যাস এটুকুই। তারপর আমি লেখাপড়াটা চালিয়ে গেছি, সে ছেড়ে কাজকামে লেগে গেছে, এ ছাড়া তার উপায়ও ছিলো না। তবে কর্মক্ষেত্রে মোটামোটি সফল। কিছুদিন চাকরীর পর নিজেই বাণিজ্য খুলেছে। তারপর বিদেশ, অনেক দূরের বিদেশ, ইউরোপ। এখন সে মাসে যে টাকাটা কামাই করে, আমরা লেখাপড়া করেটরে সেই টাকার অর্ধেকটাও কামাই করতে পারি না। মাস তিনেকেই বিদেশে অবস্থান পোক্ত করে ফেলেছে, ভাইব্রাদারকেও নেওয়ার উদ্যোগ চালাচ্ছে এখন।
দেখাসাক্ষাতহীন অবস্থায় আমরা বেশ কাছাকাছি এলাকায় বড়ো হয়েছি। আমার লেখাপড়া আর তার কাজকাম-ই আমাদের একে অপর থেকে দূরে রেখেছে। তবে খুব একটা দেখা করার আগ্রহ ছিলো না আমার, প্রয়োজনও নয়। একদিন দেখলাম সে বেশ রঙমলে শাড়ী পরিহিতা এক বালিকাবধূ নিয়ে হেটে যাচ্ছে। দেখামাত্র বললো, ভালো আছোস, দেখি না যে, বাসায় আসিস। ব্যাস, এটুকুই। মেয়েটা কে বা কারা, কিছুই বললো না, আমিও জিজ্ঞেস করিনি। ওরা চলে গেলে, দুচারদিন পর জানতে পারলাম, সেটা মুরাদের (রূপক নাম) বউ, নতুন বিয়ে করেছে। এলকায়ও শুনলাম টুকটাক রব, মুরাদ কী জিনিশ বাগাইলো, পসিবল? সেটা ২০০৩-এর কথা।
এ বছরের মার্চ মাসে একদিন মুরাদের সাথে দেখা, এপ্রিলের ১ম সপ্তাহেই বিদেশ চলে যাচ্ছে, শুনালো। মোবাইল নাম্বারও দিলো। দুচার মিনিট কথা বলেই বললো, যাই। বললাম, চলে তো যাবি, একটু দাড়া, কথা বলি। বললো, না। বউকে আনতে হবে শালির বাসায় গেছে। বললাম, ফোন করে চলে আসতে বল। চট করে বলে বসলো, নাহ, বউরে মোবাইল ব্যবহার করতে দিই না, এটা ভালো না। আচ্ছা যাই বন্ধু, ভালো থাকিস ...। ব্যাস, হাটা ধরলো, চলেও গেলো।
আবার সেই ঘোর, আবার সেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভেতরের সজীব ইচ্ছা। ভেসে উঠলো, ২০০৩-এ দেখা সেই বালিকাবধূর মুখাবয়ব, শরীর এবং রঙিন শাড়ী পরে ধীর প্রকম্পিত পদক্ষেপ। শালায় তো মোবাইল ব্যবহার করতে দেয় না। কী করি, মাইয়া মানুষ। আবার বন্ধুর বউ। বন্ধুটা আবার বিদেশ চলে যাচ্ছে ...। এইসব হাবিজাবি মাথার আশপাশে ভনভন করতে লাগলো। যাকগে, কিছু একটা হবেই (জেনেশুনেই বললাম কারণ, বালিকাদের বেলায় যা চাই, কোনোদিন হতাশ হইনি, নিরাশও হইনি কখনো)।
কেমন যেন ভুলতেই বসেছিলাম বিষয়টা। এপ্রিল গড়িয়ে চলে এলো মে মাস। যখন প্রসঙ্গটি মনে এলো, ততোদিনে মুরাদের বিদেশ চলে যাওয়ারই কথা। হয়তো গেছে, অথবা যায়নি। যদি যায়, তাইলে তো গুটিলাল। না গেলে ধৈর্যের পথ খোলা, সবসময়। মাথায় একটা ইনফো এলো, তার বউ মোবাইল চালায় না, সে চলে গেলে হয়তো নিজের মোবাইলটাই বউকে দিয়ে যেতে পারে... এ কথা চিন্তা করতে ভালোই লাগলো, শুনতেও ভাল্লাগে। তারপরই সেই ঐতিহাসিক ৩ মে, রাত ৩টার উপরোক্ত প্রসঙ্গ। মনে আছে, সেদিন ফোন রেখেছিলো বিরক্তিকর স্বরে এই কথা বলে- এতো রাতে মানুষকে বিরক্ত করেন ক্যান, রাখি। পরদিন সকালে বেহায়ার মতো আবার ফোন দিলাম, টুকটাক কথা বললো বিরক্তির স্বর নিয়েই কিন্তু বিরক্তির কথাটা উচ্চারণ করলো না। দুপুরের পর আবার দিলাম কল, খোজ নিলাম, খাওয়াদাওয়া হয়েছে, ইত্যাদি। সাথে বললাম, দুপুরে খেয়ে বিকেল পর্যন্ত রেস্ট নিলে ভালো লাগবে। এবার আর বিরক্তির স্বর নেই, বিরক্ত শব্দও নেই। সন্ধ্যায় আবার, রাত ১০টার দিকে আবার, আবার রাত ১টায়। এই কলটা দীর্ঘ হলো, অনেক কথা, অনেক কতো কথা। আড়াইটায় শেষ হলো। ১৫/২০ মিনিট পর বিছানায় যাবো, এমন সময় সেই ফোন দিলো, বললো, দেখলাম, ঘুমাইছেন কী না। ২ মিনিট কথা বলে রেখে দিলো। একটু পরই আবার ফোন দিলো, দুচারটা কথা জিজ্ঞেস করলো, তারপর বললো, কল দিতাছি দেইখা কি বিরক্ত হন (ঘড়িতে তখন ৩টা বাজে, কাকতালীয়)? ... ২৪ ঘন্টায় সবকিছু বদলে গেলো, পসিবল, আমার বেলায় এমন হয়েই থাকে।
লেখাটায় আমি মেয়েটার নাম ধরছি রোদেলা (অরিজিন্যাল নাম এমন অসামসালা নয়)। এই দিনটার পর থেকে দিনে ৫/৬ বার দুচার মিনিট করে কথা বলতাম, আর রাতে বলতাম ১টা থেকে ৪টা পর্যন্ত। এভাবে সপ্তাহখানেক, তারপর ডেট, প্রথম দিনই ঢাকা রিজেন্সীর শীশা ওয়ার্ল্ড-এ। আমি বারবার তাকে বালিকাবধূ সম্বোধন করলেও সে আর বালিকা নেই, একদমই সম্পূর্ণা। দুনিয়াটা বুঝে, স্বামীর অনুপস্থিতি বুঝে, আমার আহ্লাদটাও বুঝে, ... নিজের শরীরমনইচ্ছার কথাটা তো বেশ করেই বুঝে। তার স্বামী মানে আমার বন্ধু মুরাদ কোনোদিন কৌতূহলবশতও সিগারেট খায় নাই কিন্তু রোদেলা প্রথম দিনই আমার হাত থেকে সিগারেট খেতে চাইলো, আমি দেইনি, বললাম শীশা খাও। বললাম সিগারেটের শেষ আছে, শীশার সহজে শেষ নেই। যার সহজ সমাপ্তি নেই, সেটাই তো আরাধ্য।
তারপর, ... তারপর, সেদিনের পর আমি বলে দিয়েছিলাম, সপ্তাহে একদিন চলে এসো, বললো চেষ্টা করবো। ... পরদিনই হাজির, বললো, ভাল্লাগে না, মুরাদ নেই, বাসায় প্রাণ নেই। তোমার কাছে যতোক্ষণ থাকি, মনে হয় মুরাদ কাছেই আছে, তুমি তো অনেক বেশি মুরাদ ...। সপ্তাহে ১দিন, অথচ সে ৫দিনই চলে এলো। নিয়ে গেলো অশেষ, কাঙ্ক্ষিত বিন্দু। ... ক্লান্তি, আবার নতুন নতুন সব উদ্বোধন। মুরাদ রোদেলাকে ছেড়ে সুদূর বিদেশ চলে গেলো অনায়াসেই। আর আমি, বিদেশ তো নয়ই, দুদিনের জন্য সিলেট গিয়েছিলাম, তার কতো মায়াকান্না। আমিও কান্না ধরে রাখতে পারিনি।
মুরাদের ভালবাসা অসাধারণ ছিলো্, গর্ব করার মতো ছেলে, রোদেলা খুশ ছিলো, এখনো তাই। বাট, আমারটাও ফেলনা নয়। অন্য অনেক বালিকাকে, বালিকাবধূকে, গৃহবধূকে যেভাবে কাছে ডেকেছিলাম, এখনও ডাকি, সেভাবেই ডেকেছিলাম রোদেলাকে, ভালবাসাটাও দিয়েছিলাম এবং এখনও দিচ্ছি সেরকমই। যে ভালোবাসা হৃদয়মনশরীরসিক্ত, সেই ভালোবাসায় প্রতারণা, ছলচাতুরি, কিছুই করা যায় না। নিরেট ভালবাসা অনেককে ছড়িয়ে দিলেও শেষ হয় না, এটা আমার বিশ্বাস।
২ বছর পর মুরাদ এলে আমার খেয়াল রাখতে পারবে না যথাযথ, ব্যাপারটি নিয়ে এখনই সে খুব চিন্তিত। বলে, তোমার কি তখন খুব কষ্ট হবে? আমি বলি, কিছুটা তো হবেই। তখন সে বলে, মুরাদ যখন এসে আবার চলে যাবে, তখন আমি তোমার সাময়িক সব কষ্ট ভুলিয়ে দেবো। রোদেলার কথা শুনে চোখের পানি ধরে রাখাটা সত্যিই মুশকিল- ঘুড়ি তুমি কার আকাশে ওড়ো!
রোদেলাকে নিয়ে লেখা আমার একটি সাম্প্রতিক কবিতা
বালিকাবধূবিষয়ক পরকীয়ার পরবর্তী পোস্ট
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ সকাল ৭:২০