পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১০ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে যুদ্ধবন্দী ও দালালদের বিচারের কথা তার ভাষণে বলেন আর এই খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে ১১ জানুয়ারি দৈনিক বাংলায়।পরে খুলনা সহ কোটালিপাড়া ও অন্যান্য জেলায় বিভিন্ন ভাষণে বলেছিলেন কেউ যদি কোন দালালদের জন্য সুপারিশ করে বা বাঁচানোর চেষ্টা করে তাহলে তাকেও বিচারের আওতায় আনা হবে।
বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযুদ্ধের সাধারণ ক্ষমার ব্যাপারে এখনো কোথাও কোথাও যে গুঞ্জন ওঠে যে তার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণায় দালালদের সবাই ছাড়া পায় এই কথার সত্যতা ওই সময়ের কোন পত্র পত্রিকায় পাওয়া যায়নি। ক্ষমা সংক্রান্ত যে প্রেসনোট টি ছিল সেখানে স্পষ্ট বলা ছিল যে, ‘‘খুন, খুনের চেষ্টা, ধর্ষণ, ঘরবাড়ি ও জাহাজে অগ্নিসংযোগ এসকল অভিযোগে অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে ক্ষমা প্রদর্শন প্রযোজ্য হইবে না।’’ খবরটি প্রকাশিত হয় পহেলা এপ্রিল, ১৯৭২ দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার কে সকল প্রকার বিবৃতি দেয়া আর সেই সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের আওয়ামী মুসলিম লীগের গণ পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের যোগ দেয়া ২৩ জন কে বহিষ্কারও করেছিলেন। এই খবরটিও প্রকাশিত হয় এপ্রিল ১০, ১৯৭২ দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায়। এ সময়কার আর পত্র পত্রিকা থেকে জানা যায় যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের জন্য এবং এই দালালদের বাঁচাতে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করেছিল ওই সময়কার ‘মুসলিম বাংলা আন্দোলন’ যারা ছিল ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পক্ষে এবং স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি। আর এদেরকে উস্কে দিয়েছিল এবং যারা এর নেপথ্যে ছিল সেই দল টি হল জামেয়েত ইসলামী । এই জামায়েত ইসলামীর সাথে আরও বিভিন্ন ধর্ম ভিত্তিক মৌলবাদী মুসলিম দল এর দোসর হিসেবে কাজ করে ।
ভীষণ ভাবে তোপের মুখে একেকজন রাজাকার দালাল গুলো ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পরে। নীরবে পরিকল্পনা করতে থাকে কিভাবে সবাই বিচার থেকে মুক্তি পাবে। সেই নিল নকশা আগে থেকেই একে যাচ্ছিল সবাই। সুযোগ বুঝে কোপ মারার ধান্দায় ছিল সবাই। কিন্তু বঙ্গুবন্ধুর সজাগ দৃষ্টি ও ক্ষমতা এই দালালদের প্রথম দিকে নাজেহাল করে দিয়েছিল।
একটি বিষয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য যে, আবুল কামাল ইউসুফ ’৭১ সালের মে মাসে ৯৬ জন জামায়েত কর্মী নিয়ে খুলনার খান জাহান আলী সড়কের একটি আনসার কাম্পে প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠন করে। ওই সময় দৈনিক সংগ্রাম সহ বিভিন্ন পত্রিকায় ঢালাও ভাবে এই সকল খবর প্রকাশিত হয়। একটি দেশ কে জানতে বুঝতে এবং পরিচালনা বর্গ, আভ্যন্তরীণ বিষয় গুলো জানতে সংবাদ পত্রের বিকল্প আর অন্য কিছু হতে পারে বলে মনে হয় না। তাই ‘৭১ সালের সংবাদ পত্র গুলো ঘাঁটলে অনেক অজানা তথ্য বের হয়ে আসে যা ওই সময়কার বাস্তব চিত্রগুলো বোঝার ব্যাপারে বেশ সহায়ক। সেই সাথে এই রাজাকার, দালাল দ্বারা সংঘটিত খবর গুলো রীতিমতো বীভৎস, ভীতিকর, অস্বাভাবিক ও অসস্থিকর।
স্বাধীনতা বিরোধী ও এই দালালদের সমর্থন পেতে ন্যাপ (ভাসানী) ,আতাউর রহমান (জাতীয় লীগ) , আওয়ামী লীগ বিরোধী পিকিং পন্থী জোট ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগেই দালালদের মুক্তি দাবি করে। ন্যাপ সহ ওই সময়ে ছয় দলীয় জোটের ৭ দফায় এই দালাল আইন বাতিলের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। ওই সময়কার পত্র পত্রিকা গুলো তে এই খবর গুলো আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় তলে স্বাধীন বাংলায়। তোপের মুখে যখন এই দালাল আইন বাতিল হয় তখন বড় বড় রাজাকার ও সাজাপ্রাপ্ত দালালরা মুক্তি পায়।
বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর। কিন্তু এই ক্ষমা ঘোষণার আগ পর্যন্ত দালাল বন্দী ছিল ৩৭ হাজার ৪৭১ জন। এদেরকে গ্রেফতার করার কাজ শুরু হয় ১৯৭২ এর জানুয়ারি মাসে।
বিচারের জন্য সরকার ওই সময়ে ৭৩ টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এপ্রিল মাসে বিচার শুরু করেন। আনুমানিক ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড আর বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড হয়েছিল আনুমানিক ৭৫২ জনের। বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন তখন ২৫ হাজার ৭১৯ জন আসামীকে ছেড়ে দেয়া হয় । কিন্তু আনুমানিক ১১ হাজার দালাল দের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের কারনে বন্দী করে রাখা হয় আর তাদের বিচারের কাজ চলমান রাখা হয়। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় থাকা কালিন সর্বমোট ২ হাজার ৮৮৪ টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। তোপের মুখে কালো টাকার মালিক এই রাজাকার আর দালালদের দল বিভিন্ন ভাবে এই বিচার কাজ বন্ধ করার আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যায়। প্রচুর অর্থ বিভিন্ন ভাবে উপরমহলের কাছে বিতরন করা হয়। তখনকার পত্র পত্রিকাতে খবরগুলো প্রকাশিত হয়।
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট এই জিয়াউর রাহমান ১৯৭৫ সালে ডিসেম্বরে ৩১ এ দালাল আইন বাতিল ঘোষণা করে। আর ৪ টি সুনির্দিষ্ট অপরাধে প্রায় ১১ হাজার দালালদের মুক্ত করে দেয়া হয়। দৈনিক আজাদ, পূর্বদেশ, দৈনিক বাংলা, বাংলার বানী, দৈনিক সংবাদ খবরের কাগজ গুলোতে এই খবর এর সত্যতা মেলে।
যেসকল দালালদের সাজা হয়েছিলো- দালাল আইন এর প্রথম ফাঁশির রায় হয়েছিলো কুষ্টিয়ার মিরপুর গ্রামের রাজাকার চিকন আলীর। ৭২ সালের জুনের ১১ তারিখে দৈনিক বাংলার প্রধান শিরোনাম হয় ‘দালালীর দায়ে মৃত্যুদণ্ড’। ৭১ এর ১৯ অক্টোবর সেই গ্রামের ইয়াজুদ্দিনকে গুলি করে মারার জন্য ফাঁশির আদেশ হয়। কিন্তু উচ্চ আদালতে সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাবাস দেয়। কিন্তু ৮ বছর ৪ মাস জেল খাটার পর দালাল আইন বাতিল হলে এই রাজাকার জেল থেকে ছাড়া পায়। ৮ বছর আগে চিকন আলির মৃত্যু হয়। দৈনিক বাংলায় ৭২ এর ৬ অক্টোবর প্রখ্যাত শিক্ষক অধ্যাপক ডঃ এ কে আজাদ কে ৭১ এর ১৫ ডিসেম্বর আজিমপুরের দায়রা শরিফের বাসা থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করার জন্য এক মামলায় ৩ দালালের মৃত্যুদণ্ড হয়। আইয়ুব আলী। মকবুল হোসেন ও জোবায়ের ছিল আলবদর বাহিনীর সদস্য। এদেরকে এখনও আর খুজে পাওয়া যায় নি। আরও ছিল-
রাজাকার/ দালাল- আব্দুল হাফিজ
জেলা/গ্রাম- দেবীদ্বার উপজলার জাফরগঞ্জ গ্রাম
অভিযোগ- হত্যা,লুট, দালালী মামলায় অন্যান্য ধারায় অপরাধ
সাজা - ৪১ বছর
প্রকাশিত সংবাদ পত্রিকা- বাংলার বাণী ’৭৩, ১২ এপ্রিল
রাজাকার/ দালাল-আইনজীবীঃ সা’দ আহমদ (শান্তি কমিটি)
জেলা/গ্রাম কুষ্টিয়া
অভিযোগ- অপহরন, নরহত্যা, পাক বাহিনিকে সহযোগিতা , কুষ্টিয়ার সাজানো উপনির্বাচন
সাজা -যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
প্রকাশিত সংবাদ পত্রিকা- দৈনিক পূর্বদেশ ’৭৩ । ১৪ মার্চ
রাজাকার/ দালাল-
তিন ভাই
জেলা/গ্রাম-বগুরা, সরুগ্রাম
১। মফিজুর রহমান/ চান মিয়া
সাজা - মৃত্যুদণ্ড
২। মখলেছুর রহমান /খোকা মিয়া
সাজা - যাবজ্জীবন
৩। মশিউর রহমান/লাল মিয়া
সাজা - যাবজ্জীবন
অভিযোগ- হত্যা
রাজাকার/ দালাল-মাতবর কেরামত আলী কাজি( শান্তি কমিটি)
মৃত্যু -১৯৯০
জেলা/গ্রাম- মুন্সিগঞ্জ ,চর শিল মন্দি( বর্তমানে পূর্ব শিল মন্দি )
সাজা - ৮ বছর কারাদণ্ড
অভিযোগ- লুট , পাক বাহিনিকে সহায়তা, নির্যাতন
রাজাকার/ দালাল-ইজহার (এখন জাপা নেতা)
জেলা/গ্রাম- নীলফামারী সৈয়দপুর
অভিযোগ- হত্যা, নির্যাতন,
রংপুরের নিসবেতগঞ্জের বধ্যভূমিতে তুলসীরামকে হত্যা
রাজাকার/ দালাল-আলবদর সিদ্দিকুর রহমান
রাজাকার/ দালাল-মোহাম্মদ গালিব
সাজা - যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
অভিযোগ- পূর্ব পাকিস্তান বিবিসির সংবাদদাতা নিজামউদ্দীনের অপহরণ
প্রকাশিত সংবাদ পত্রিকা- দৈনিক বাংলা ’৭২, ৪ এপ্রিল
রাজাকার/ দালাল- মুজিবুর রহমান
সাজা - যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
অভিযোগ- অপহরন, শ্রী কান্তি দাস হাওলাদারকে হত্যার অভিপ্রায়ে অপহরণ
প্রকাশিত সংবাদ পত্রিকা- দৈনিক বাংলা’৭৩ ,১২ জুলাই
রাজাকার/ দালাল- ডঃ মালিক
সাজা - যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
অভিযোগ- মন্ত্রিসভার পূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনকে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে যুদ্ধ পরিচালনায় সহায়তা
প্রকাশিত সংবাদ পত্রিকা- আজাদ পত্রিকা’৭৩ ,৯ জানুয়ারি
রাজাকার/ দালাল-মকবুল হোসেন,ময়মনসিংহ
রাজাকার/ দালাল- আইয়ুব আলী,ময়মনসিংহ
রাজাকার/ দালাল- আতিয়ার রহমান,ঢাকা
সাজা - যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
অভিযোগ- ’৭১, ১৫ ডিসেম্বর ঢাকার আজিমপুর থেকে ধরে নিয়ে মন্টুকে হত্যা করে
প্রকাশিত সংবাদ পত্রিকা- দৈনিক বাংলা ’৭৩, ৭ ডিসেম্বর
রাজাকার/ দালাল- দীরুল আজির আসিফ আলী
জেলা/গ্রাম- মৌলভীবাজার
সাজা - যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
অভিযোগ- পাক বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশ এবং তিন পল্লীবধুর শ্লীলতাহানির
প্রকাশিত সংবাদ পত্রিকা- দৈনিক পূর্বদেশ ’৭৩ ,১৪ এপ্রিল
রাজাকার/ দালাল- আব্দুল হামিদ
রাজাকার/ দালাল- আজিজ উল্লাহ্
জেলা/গ্রাম- কুমিল্লা
সাজা - যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
অভিযোগ- রফিক উদ্দিন নামের এক মুক্তিযোদ্ধাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেওয়া।
প্রকাশিত সংবাদ পত্রিকা- দৈনিক সংবাদ ’৭৩, ২০ এপ্রিল
শাস্তি হতো। বিচার হতো। সবকিছুই ঠিক মতই চলত। ’৭২ ’৭৩ এর পত্রিকা গুলো পর্যালোচনা করলে বা দেখলে অনেক খবর বেরিয়ে আসে। যা আমরা এ প্রজন্মের অনেকেই হয়ত জানি না। অনেক আশ্চর্য হই যখন ঠিক এরকম অনেক খবর চোখের সামনে পরে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এই আলবদর।, আলশামস, শান্তি কমিটি, ফ্রিডম পার্টি, জামায়েতি দালাল আর রাজাকার মিলে নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালায়। দেশ টাকে চিঁরে ফেড়ে একশেষ করে। বিচার এদের হবেই। সব রাজাকার নরপশুদের এই বাংলার মাটিতেই বিচার হবে। আর একটু ধৈর্য ধরতে হবে। বিচারের দাবির আন্দোলন থেমে নেই। আন্দোলনের নতুন নতুন জোয়ার এসেছে। নতুন অধ্যায় তৈরি হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি এখন উত্তাল। শাহাবাগের উত্তাল আন্দোলন চলছেই, চলবে। বিচার হবেই। হবেই বিচার।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০১৬ সকাল ৮:০৮