দ্বিতীয়বার দার্জেলিং ভ্রমণে আমি বুকিং ডট কম থেকে একটা হোটেল বুক করি। দার্জেলিং মল রোডের সাথেই হোটেলের লোকেশন এটা ধারণা করেছি।কিন্তু ঠিক কোথায় তা বুঝতে পারি নাই সেটাই ভুল ছিল। দার্জেলিং পৌছাই সন্ধ্যা ৭টায়। আমি আর আমার বান্ধবী সংগত কারণে আলাদা হোটেল বুক করেছিলাম বলে জীপের বাকি ৪ জন তাদের গন্তব্যে নেমে যায় এবং জীপ আমাদেরকে নামায় মল রোডের শেষ মাথায়।
এখানে আমি মাত্র ৬ মাস আগেই এসেছি বিধায় কিচ্ছু অচেনা না আমার কাছে।আমরা অনেক ক্লান্ত ছিলাম সারারাতের বাস জার্নি এবং বর্ডার ক্রসিং এর বিভিন্ন ঝামেলার কারণে। বাকী সবাই এক হোটেলে আর আমি মাতবরী করে আরেক হোটেলে বুক করেছি বিধায় একটু ভয় পাচ্ছিলাম, সাথে ছেলে মানুষ কেউ নাই। তো অন্ধকার গলির সামনে আমাদের লাগেজ এবং বান্ধবীকে রেখে আমি চললাম বুক করা হোটেলের খোজেঁ। উদ্দেশ্য, হোটেলের কাউকে সাথে এনে লাগেজ বহন করানো কারণ, নিজে পাহাড় বেয়ে উঠতে পারলেও লাগেজসহ তো উঠা সম্ভব না। তো ও দাড়িয়ে থাকল আর আমি এক লাফে পাহাড়ের দুইটা উচু বাক পার করলাম, দেখি আরেক বাক। সেটাও উঠলাম। দেখি আরেকটা !! ইতিমধ্যে ঠান্ডাতেও ঘামতে শুরু করেছি। একজনকে হোটেলের নাম বলে জিজ্ঞেস করলাম কোথায়, বলে " ওউর উপার যাও, মিলেগা " !! আমি তো বিরক্ত । কি রে ভাই। এত উপরে লোকেশন কিভাবে হল, বুঝতে পারি নাই। তো যেখানে দাড়িয়ে এসব ভাবছিলাম, সেখানেই দেখি একটা হোটেল। ঢুকে গেলাম ভিতরে।
যখন বুকিং করা হোটেলটা খুজে পাইনি তখন আমার উচিত ছিল, বাকী সংগী সাথিদের হোটেলে চলে যাওয়া যা আমি করিনি কারণ, আমার মনে হয়েছে, আমি এডভান্স টাকা না দিলেও, বুকিং করেছি একজনকে, তারা আমাকে ওয়াটস এপে নাম্বার দিয়েছে, ম্যাসেজ দিয়েছে। হটাত করে কিভাবে তাদের না বলে অন্য হোটেলে উঠি। আমি আবার অতি লয়াল কি না এসব ব্যাপারে। মোবাইলে তখনো সিম থাকলেও রিচার্জ করা হয়নি বিধায় হোটেলে যোগাযোগ ও করতে পারছিলাম না। যাহোক, সামনের হোটেলে ঢুকে পড়লাম পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে। রিয়াজ নামে একটা বাঙ্গালী ছেলে আমাকে রুম দেখালো। আমার ভালোও লাগল। ১১০০ রুপি পার নাইটে বুক করে ফেললাম দুই দিনের জন্য এবং ওকে সাথে নিয়ে নিচে নামতে শুরু করলাম আমাদের লাগেজ এবং বান্ধবীর খোজেঁ !
কথায় কথায় রিয়াজের সাথে পরিচয় হল। মুসলমান এবং কলকাতার ছেলে। হোটেলে ওয়াইফাই আছে কি না জিজ্ঞেস করতেই সোজা সাপ্টা উত্তর দিল, " ম্যাডাম, ২ দিন ধরে লাইনে প্রবলেম, কানেকশন পাবেন না " । ওয়াইফাই থাকাটা আমাদের জন্য খুব দরকার তখন কারণ বাসায় জানাতে হবে ঠিকভাবে এসেছি এবং প্রতিদিন যোগাযোগ করতেই হবে। রিয়াজকে এটা বলা মাত্রই সে বুঝল ব্যাপারটা এবং বলল ভালো ওয়াইফাই ওয়ালা হোটেলে নিয়ে যাবে আমাদের আপাতত। রাত ধীরে ধীরে বাড়ছে। আমরা মরার মত ক্লান্ত। সাথের সংগী সাথীদের থেকে আলাদা হয়ে গেছি আমরা মেয়ে দুজন। ওদের সাথে ঠিক ৮টায় আইনক্সের সামনে দেখা করবার কথা। সময় হয়ে এসেছে প্রায়, এখনো হোটেলেই চেক ইন করতে পারলাম না।ওদের জানাতেও পারলাম না। ওদের কাছে যে সিম ছিল ইন্ডিয়ান, সেটার নাম্বার নেওয়া হয়নি তাড়াহুরায়। আবার আমার কাছে যেটা আছে সেটা রিচার্জ করার সময় পাইনি হোটেল খোজার কারণে। একদম এলোমেলো অবস্থা। সর্বশেষ কথা, দুজন মেয়ে আলাদা হয়ে গেছি গ্রুপ থেকে, রাত হয়ে আসছে, আমরা ভয় পাচ্ছি। তবুও রিয়াজের কথায় রাজি হলাম। লাগেজের কাছে পৌছে, বান্ধবীকে জানালাম অবস্থা। তিনজন মিলে আবার একটা বাকে উঠলাম। সেখান থেকে সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে হবে। যারা দার্জিলিং এ গিয়েছেন তারা বুঝবেন কোন সিড়িগুলির কথা বলছি আমি। যারা যাননি তাদের জন্য বলছি, শহরটির শর্টকার্ট রাস্তাই হল সিড়ি রয়েছে শহরজুড়ে। সিড়ি বেয়ে উঠবেন, অথবা পাহাড়ের বাক বেয়ে উঠতে নামতে হবে এবং সময়ও যেমন বেশি লাগবে তেমনি রাস্তাও বেশি। তো এমন একটা অন্ধকার সিড়ির সামনে এসে রিয়াজ বলল, লাগেজ এখানে রেখে আগে আমাকে হোটেল দেখে আসতে । রাজী না হয়ে উপায় ছিল না। লাগেজ ও তো একা রাখা যায় না, তাই লাগেজের কাছে আবার ও বান্ধবীকে রেখে আমি চললাম, অন্ধকার সিড়ি বেয়ে রিয়াজের সাথে সাথে।
অনেকগুলো সিড়ি উঠানামা শেষে একটা হোটেলে পৌছালাম। আরেকবার দার্জিলিং এ এসে এইদিকটায় আমি আসিনি বিধায় চেনা পরিচিত না কিছু এবং রাত প্রায় ৮টা ছুইছুই। যে শহর সন্ধ্যা ৭-৮টার মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ে সেখানে ৮টা ভালই রাত বলা চলে। তো রিয়াজের সাথে ঢুকলাম হোটেলে। মধ্যম মানের হোটেল। ছোট রিসিপশন। দশাসই চেহারার দুইটি ছেলে বসা। ওদের বর্ণনাটা একটু দেওয়া দরকার এখানে তাই দিচ্ছি। একজনের চুল ছোট ছোট করে কাটা, কানে দুল। হাতে ট্যাটু আকা। ছোট ছোট চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। আমাদের দেখে একটু বিরক্তির ছাপ বুঝি ফুটে উঠল চেহারাতে। বাকীজনের চুল স্পাইক করে আকাশ ছুয়ে ফেলবে মনে হচ্ছে। আড় চোখে আমাদের দেখছে এবং মিটিমিটি হাসি দিচ্ছে যা এই পরিস্থিতিতে মোটেও সুখকর না আমার কাছে। প্রথমেই বলল রুম সব বুকড। আমরা অক্টোবরের ৮-৯ তারিখে গিয়েছি, যখন পূজার ছুটি শুরু হবে আর ৩-৪ দিন পরেই। তাই সবকিছুই মোটামুটি বুকড সব জায়গাতেই, এটা রিয়াজ বলেছিল আমাকে রাস্তায়। তো ছেলেটা না বলার পরে রিয়াজ তাকে অন্য ভাষায় কিছু বলার পরে যে প্রথমে হাসল এবং বলল দেখছে কি করা যায়। ওর বিদ্রুপ মার্কা হাসিতে আমি সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম, এক মূহূর্তে রিয়াজকেও বিশ্বাস করতে পারলাম না। হোটেলে কাউকে দেখছিলাম ও না আশেপাশে এবং হোটেলটি তুলনামূলক অন্ধকার জায়গাতে আমার মনে হচ্ছিল। একদম চুপ হয়ে থাকলাম। ছেলেটা ফোন করলো একজন মহিলাকে, যিনি হোটেলের মালিক, পরে জেনেছিলাম। দার্জেলিং এর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলল তারা পরিষ্কার বুঝলাম কিন্তু কি কথা হল তা বুঝলাম না। তারপরে বাংগালী শুনে সবার আগে পাসপোর্ট ওদের কাছে দিতে বলল এবং সাথে দুইদিনের টাকা পুরাটাই পরিশোধ করতে বলল। এক মুহুর্ত চিন্তা করে, না করতে পারলাম না, দিয়ে দিলাম দুইদিনের জন্য ১৮০০ টাকা। ছোট একটা রুম, কোনমতে দুইজন থাকতে পারব, তবে বাথরুমে গিজার আছে এটা বলল।
এরপরে আমাকে হোটেলে থাকতে বলে রিয়াজ গেল আমার বান্ধবীকে আনতে। আবার ও ভয় পেলাম, না জানি কোন ফাঁদে পরি। কিন্তু কিছু করার নেই, ইতিমধ্যে পাসর্পোট ওদের হাতে দিয়ে দিয়েছি। হোটেলের ছেলে দুটি আমাকে আপাদপমস্তক দেখছে আর নিজেরা কিছু বলাবলি করছে। এবার ছোট চুলের ছেলেতা চেয়ার ছেড়ে উঠে আমার দিকে আসল। আমি সত্যি এবার ভয়ে বেশ কাত। আল্লাহর নাম নিচ্ছি। ছেলেটা একেবারে কাছে এসে রুমের চাবি আমার হাতে দিয়ে বলল, “ ম্যাডাম, ইয়ে রুম কা চাবি। আপ আন্দার যাকার আরাম কিজিয়ে, অর কুছ চাহিয়ে তো মুঝে বাতানা, মেরা নামে ড্যানি হ্যাঁয়”। মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ করতে করতেই চাবি হাতে নিয়ে বললাম যে, আপাতত এখানেই বসি। ওরা আসলে রুমে যাব একবারে। ড্যানি হেসে ওর চেয়ারে গিয়ে বসল এবং আবারো ছেলে দুটি কিছু বলে হাসাহাসি করতে লাগল। আমি জানি না, এই পরিস্থিতিতে অন্যরা কি করত, কিন্তু আমার অনুভূতি আমি কাউকে বুঝাতো পারব না। আমি অনেক ভয় পাচ্ছি , এবং ভেবে নিয়েছি আমি , আমরা ঝামেলাতে পরেছি। তবুও আল্লাহর উপরে ভরসা রেখে অপেক্ষা করতে লাগলাম বান্ধবীর জন্য। প্রায় ১৫ মিনিট পরে, রিয়াজ আমার বান্ধবী আর আমাদের লাগেজ নিয়ে এসে পৌছালো হোটেলে। ধড়ে পানি ফিরে পেলাম এমন মনে হল। ১৫ মিনিট মনে হল যেন ১৫ ঘণ্টা !!! আসলে এই দার্জেলিং ভ্রমণে একটা জিনিস খুব ভালোভাবে বুঝেছিলাম আর তা হল, বাংলাদেশ ছাড়া সব জায়গাতেই মেয়েরা নিরাপদে ভ্রমণ করতে পারে চাইলেই। চিন্তার কিছু নেই, শুধু একটু জানতে হবে কিভাবে ম্যাপ ব্যবহার করে।
হোটেলে চেকইন করে ফ্রেশ হয়ে বাকী সদস্যদের সাথে মিশে গেলাম। বাকী ২ দিনে ড্যানির সাথে পরিচয় হল ভালোই। রিয়াজ ও অনেক সাহায্য করেছিল আমাদের। কিন্তু ড্যানি অনেক বেশি। কম খরচে মিরিক আর শিলিগুড়ি যাবার ট্যাক্সি ঠিক করে দিল। নিজের প্রিয় চার্জারটা দিয়ে দিল যখন আমরা হোটেল পরিবর্তন করে অন্য হোটেলে গেলাম। আরো অনেক কিছু ড্যানি আমাদের জন্য করেছে যা প্রথম দর্শনে আমরা ভাবিনি ওর করবে আমাদের জন্য। আসলে ঘটনাটা হচ্ছে, কোন বাংলাদেশী একবার এই হোটেলে চেকইন করে, ৫ দিন থেকে, ৩ দিনের টাকা বাকী রেখে চলে গিয়েছিল। পাসপোর্টের ডিটেইলস না থাকায় ওরা ধরতে পারেনি। তাই, আমরা বাঙ্গালী শুনে ড্যানি এবং হোটেলের সবাই যথেষ্ট বিরক্ত ছিল। কিন্তু ৬ দিনে, ও আমাদের এত ভালোভাবে চিনেছিল যে তার আইফোনের চার্জারটি দিতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করেনি সে। তো করোনার মধ্যে, একদিন হঠাত দেখি হোয়াটসএপে ড্যানির ম্যাসেজ। ম্যাডাম ক্যায়সে হো ইস করোনা কে টাইম মে !! খুবই অবাক হয়েছিলাম যে, ২ বছর পরেও সে আমাদের মনে রেখেছে !!! উত্তর দিলাম। টুকটাক চ্যাটিং হল। ওর বাড়িতে মানে শিলং এ ছিল সে তখন। সেখানে যাবার জন্য অনুরোধ করল। আরো অনেক কথা। একজন অপরিচিত মানুষ থেকে হঠাত একজন পরিচিত মানুষ হয়ে যাবার এই গল্পটা জানি না আপনাদের কেমন লাগবে, কিন্তু আমি নিজে এই অভিজ্ঞতাটা নিয়েছি বিধায় আমার সবসময়ই ভালো লাগে। সেদিনের হোটেলেই মুহুর্তটা মাঝেমাঝে মনে পরলেই হাসি। ভেবেই নিয়েছিলাম ড্যানি আমাদের কোন ক্ষতি করবেই !!
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০২২ বিকাল ৫:৫৬