আজকে আমি ফ্রি। মোবাইল অপারেটরের ফ্রি অফারের মত ফ্রি না, আজকে আমার হাতে বিশেষ কোন কাজ নেই। কখনো যে থাকে তাও না ঠিক, যেহেতু হাটাহাটিও একটা কাজের মধ্যেই পরে। সকালে মেসে চোখ বন্ধ করে ময়ূরাক্ষীর সুশীতল বাতাস গায়ে লাগাচ্ছিলাম। অনেক দিন পরে ময়ূরাক্ষীতে গোসল সেরে হলুদ পাঞ্জাবিটা ধুয়ে রোদে শুকাতে দিলাম। তারপর লুঙ্গি পরিধানরত অবস্থায় ময়ূরাক্ষীর পাশে পাটি বিছায়ে শুয়ে পরলাম। যারা জানেন না, তাদের বলি, ময়ূরাক্ষী আমার নদির নাম, এটা আমার একান্ত নিজের নদী। হুমায়ুন আহমেদ অবশ্য ময়ূরাক্ষী নামে আমাকে নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন, সেখানে বিস্তারিত পাবেন। শুধু এতটুকই বলি, চোখ বন্ধ করে চেষ্টা করলেই আমি অদ্ভুত সুন্দর একটা নদী দেখতে পাই, আমার নদী, ময়ূরাক্ষী।
হঠাত করেই দমকা বাতাস শুরু হোল। আমার পরিধান করা লুঙ্গিটা উড়ে কাছেই একটা নারিকেল গাছের ডালে আটকে ছেঁড়া ঘুড়ির মত পতপত করে উড়তে লাগলো। আমি নগ্ন হয়েই শুয়ে রইলাম, কারণ আজকে আমি ফ্রি, কোন কাজ করব না। ঠিক সেই সময়েই মহাপুরুষ গড়ার কারিগর, মানে আমার বাবার আগমন। আমি দৌড়ে গিয়ে আধাশুকনো পাঞ্জাবিটা গায়ে গলিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বললাম, "বাবা, একটু টাইম মেন্টেইন করো, এইটা কোন সময় হোল!"
বাবা হাসতে হাসতে বললেন, "হিমু, কেউই জানে না তার ইজ্জত কখন উড়ে যাবে, বাস্তব চরিত্রবানের চরিত্রে কালি লাগে না, কালি লাগে ভান করা বেঈমানের। যাও, বেঈমানের খোঁজে।"
দরজায় করা নাড়ার শব্দে চোখ মেললাম, হোটেলের পিচ্চিটা চা নিয়ে এসেছে। চা খেতে খেতে চিন্তা করলাম বাবা বেঈমান বলছেন কাকে! চা শেষ করে পাঞ্জাবি পড়ে রাস্তায় নেমে এলাম। ততক্ষনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি কাশিমপুর কারাগারে যাব। যুদ্ধাপরাধী এবং জাতীয় বেঈমান রাজাকারদের লুঙ্গি উড়াব। কয়েকদিন যাবত চারিদিকে কানাঘুষা, কাশিমপুর কারাগারে যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরী নাকি কোন ছেলে নিয়মিত বলাৎকার করেছে। যা দিনকাল পরেছে, এখন আর পুরুষরাও নিরাপদ না।
হাটতে হাটতে গাবতলি বাস স্ট্যান্ডে চলে এলাম। এখানে বিশেষ ধরনের লোক পাওয়া যায়। কেউ বাড়ি যাওয়ার আনন্দে খুশি, কেউ বউ রেখে কাজে যাওয়ার দুঃখে কাতর। কোন কোন শিশু অভিমান করে, কারণ তার জন্যে বাসের টিকিট কাটা হয়নি, এবারেও ব্যাগের উপরে বসে যেতে হবে। কেউ কেউ আবার উকি ঝুকি দিয়ে দেখে কার মানিব্যাগ কত মোটা। আমি কাশিমপুরের বাসের দিকে হাঁটছিলাম। পেছন থেকে একজন হঠাত করে এসেই হাত ধরে বলল, "হিমু ভাই, কি সৌভাগ্য! আপনাকে আমার এলাকায় পেয়েছি। বলেন এই অধম কি সেবা করবে?"
এই লোকটিকে আমি চিনি। এর নাম গাল কাটা মিজান। একবার আমার সঙ্গে জেলখানায় তিনদিন ছিল। সেই থেকে আমার বিশেষ ভক্ত। গাবতলি এলাকায় তার বিশেষ "পাওয়ার" আছে। আমি উদাস চেহারায় বললাম, "একটা বাসের টিকিট লাগবে, কাশিমপুর যাব।"
গাল কাটা মিজান উত্তেজিত হয়ে বলল, "বস টিকিট কেন! আপনের জন্যে একটা বাস যাবে। আপনি পায়ের উপর পা তুলে যাবেন, যখন যেই সিটে বসতে ইচ্ছা করবে বসে পরবেন। টাকা পয়সার জন্যে চিন্তা করবেন না, এইটা আমার এলাকা। প্রয়জনে আমিও যাব আপনার সাথে। জান দিয়ে দিব হিমু ভাই।"
গাল কাটা মিজান একটা বাস প্রাইভেটে নিতে চেয়েছিল। যাত্রীদের বাস বিলম্ব হবে ভেবে আমি অনুরোধ করায় সে থেমেছে। সামনের দুই সিটে দুজন বসে রওনা দিলাম কাশিমপুরের উদ্দেশ্যে। এই মুহূর্তে রূপাকে বার বার মনে পড়ছে। লং জার্নিতে পাশে থাকে রূপা, দুজন দুজনের হাত ধরে বসে থাকবো। রূপা বসবে জানালার পাশে। রূপার মেক-আপের ঘ্রাণ জানালার বাতাসে বিমোহিত করবে আমাকে। আমি আস্তে করে বলবো, "রূপা, বমি করবা?"
ভ্রমণে গাল কাটা মিজান কে বড্ড বেমানান লাগছে। আমি বললাম," মিজান সাহেব একটা ফোন করা যাবে?" মিজান স্বভাবসুলভ উত্তেজিত হয়ে বলল, "হিমু ভাই একটা কেন! আমার সিম পোস্টপেইড, ক্রেডিট শেষ হয়ার ঝামেলা নাই। যত্ত খুশি কল করবেন, কিন্তু একটা করবেন না।" আমি ধন্যবাদ দিয়ে রূপার বাসার নাম্বারে ফোন দিলাম। বরাবরের মত রূপার বাবা ফোন ধরল, আমিও বরাবরের মত 'তুই রাজাকার' বলে ফোন কেটে দিলাম। তারপর ফোন দিলাম মাজেদা খালার বাসায়। বাদল শাহবাগ আন্দোলন থেকে বাড়িতে এসেছে কি না জানতে হবে।
অপাশ থেকে কাজের মেয়ে ফোন ধরে বলল, "হ্যালো! কেডায় আপ্নে?" আমি গলা যথাসম্ভব ভারী করে বললাম, "র্যাব মহাপরিচালক! মাজেদা ম্যাডামকে দিন।" কাজের মেয়ে "খালাম্মা গো" বলে চিৎকার করে ফোন রেখে গেলো। মাজেদা খালা ফোন ধরেই বল্লেন,"হিমু তুই মানুষ হবি না?" আমি মাজেদা খালাকে জিজঙ্গেস করলাম, " ডিয়ার খালামনি, আমি যে হিমু তুমি বুঝলা কেমনে?" মাজেদা খালা রেগে যেয়ে বললেন, "একটা চড় মেরে তোর দাঁত ফেলে দিব ফাজিল। র্যাব আমার বাসায় ফোন করবে কেন! তোকে না বলছি বাদলকে শাহবাগ থেকে ভুজুং ভাজুং দিয়ে বাসায় নিয়ে আসতে? তোকে দেখলাম আমার ম্যানেজার আর সেক্রেটারির [হিমু শিবির ২ দ্রষ্টব্য] সাথে বাদলকে নিয়ে শাহবাগে মোমবাতি ধরাইতে। তরে পাইলে আমি পাতি লেবুর মত দুই টুকরা করে ফেলব।"
আমি জিজ্ঞেস করলাম,"খালা তুমি দেখলা কেমনে?"
মাজেদা খালা রেগে বললেন, "টিভিতে লাইভ দেখছি। তোরে আমি খুন করব হিমু। তুই বাদলের মাথা আর নস্ট করে দিয়ে আসছিস..." আমি ফোন কেটে দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। হাফেজ আজিজুদ্দিন শায়েখের কথা বেশ মনে পড়ছে।
আমরা এখন রাস্তায় হাঁটছি। কাশিমপুর আরও দুই কিলোমিটার। টিকিট চেকার মাঝপথে উঠে আমাদের কাছে টিকিট না পেয়ে নামিয়ে দিয়েছে। মিজান বলেছিল," অই বেটা, কার কাছে টিকিট চাস? জানস আমি কে, আমি গাল কাটা মিজান।" টিকিট চেকার গাল কাটা মিজান কে চিনতে না পেরে একটা থাপ্পর মেরে নামিয়ে দেয়। আমি বিলম্ব না করেই নেমে পরি। আজকে থাপ্পর খাওয়ার মুড নাই। মিজান এখন বেশ চুপচাপ। ঠান্ডা স্বরে বলল, "হিমু ভাই, ডোন্ট মাইন্ড। আমাদের ধান্দাটাই এমন, এলাকার বাইরে 'পাওরার' নাই।
আমরা কাশিমপুর কারাগারে প্রবেশ করলাম। আগেই বলেছি কাশিমপুর কারাগারের জেলার আমার বিশেষ পরিচিত। আজকে তাকে বিশেষ অনুরোধ করে ফাঁসির আদেশ হওয়া যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসাইন সাইদির সাথে দেখা করতে চাইলাম। তিনি আমাদের কনডেম সেলের কাছে সাদির কাছে নিয়ে গেলেন। আমি নম্র স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, "হুজুর ভাল আছেন?"
সাইদি কিছুটা বিমর্ষ ছিল। আমাকে দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। বললেন ইসলামী ছাত্রী সংস্থার ময়না পাখি, টিয়া পাখিরা আর উড়ে আসে না। হুলুদ পাঞ্জাবিতে আমাকে ছাত্র শিবিরের কেউ ভেবে জিজ্ঞেস করলেন,"আমাকে চাদে পাঠায়াছিলা কে? তুমি?"
আমি উদাস হয়ে বললাম, "কোন সমস্যা?"
সাইদি এবার বলল, "আজকাল বড় বেয়াদব হয়েছ বাছা। একবার বেরুতে পারলে শিবির গ্যাং দ্বারা তোমাকে সায়েস্তা করাইব।"
আমি ভাব এনে বললাম, "আমি হিমু শিবিরের প্রধান হিমালয় হিমু। আপনার মেশিন চলে?"
মেশিনের প্রশ্নে বিমর্ষ হয়ে পরলেন সাইদি। বললেন, "শুনলাম সাকা চৌধুরী আজকাল নির্বিচারে মেশিন চালাচ্ছে! হস্তিটার স্বভাব আর পাল্টাইল না। টেবিলের মজা কূপমন্ডক কি জানিবে!"
কথা গুরুতর অশ্লীলতার দিকে আগাচ্ছে দেখে সাইদিকে থামালাম। জিজ্ঞেস করলাম, "ফাঁসির আগে শেষ ইচ্ছা কি?"
সে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, "একবার ছাত্রী সংস্থায় যেতে চাই, নাতনীরা যে কি হালে দিন কাটাইতেছে কে জানে। আমি আমার মেশিন তাদের নামে ওয়াক্বফ করে যেতে চাই।"
যাওয়ার সময় হয়ে এলো। কি আর বলার, আমি আর গাল কাটা মিজান সাইদির দিকে তাক্যে বললাম, "তুই রাজাকার, তুই রাজাকার।"
সাইদি চিৎকার দিয়ে বলল, "মেশিন চিনস বদমাশ?"
আমি আর মিজান মিডল ফিঙ্গার দেখিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পরলাম। দারুন জ্যোৎস্না। আজকে হাটতে হাটতে জোনাকি ধরবো। হা করে চাদের আলো খাবো। আমি আর গাল কাটা মিজান দূরে জোনাকি পোকার খোঁজে হাটতে শুরু করলাম।