-চল আইজকা জলিলের বাড়ি ঘেরাও দিমু
-কি করছে জলিল?
-মিনুরে এসিড মারছে
-আইনে আছে এসিড মারার বিচার নব্বই দিনের মধ্যে শেষ হয়।
মনে আছে এই টিভি কমার্শিয়াল টির কথা? এসিড নিক্ষেপ একটা সময় আলোচনায় উঠে এসেছিল। পত্রিকা খুললেই এসিড নিক্ষেপের সংবাদ। কোন মেয়ে প্রেম প্রস্তাবে রাজি হয়নি? মারো এসিড। কোন মেয়ে ছ্যাকা দিছে? মারো এসিড। বউয়ের সাথে ঝগড়া? মারো এসিড। পত্রিকার পাতায় পাতায় এসিড নিক্ষেপের কাহিনী। একটা সময় এমন অবস্থা হোল যে প্রতিটা মেয়ের মনে ভয় ঢুকে গেলো, এই বুঝি পরবে এসিড সন্ত্রাসের হাতে! সে সময়ে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং জনগনের তোপের মুখে সরকার এসিড ক্রাইম নিয়ে হাতে নিলেন কিছু যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত।
এসিড নিক্ষেপের বিচার করা শুরু হোল দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে। সারাদেশে খোলা এসিড বিক্রি নিষিদ্ধ করা হোল। ভয়ে এসিড বিক্রেতারাও এই ব্যাবসা বন্ধ করে দিল। প্রতিদিন টিভি কমার্শিয়াল, পত্রিকা বিজ্ঞাপন। এভাবে বেশ কয়েক বছর। এরপর একটা সময় দেখা গেলো এসিড নিক্ষেপ তেমন একটা নেই আর! আশ্চর্যের বিষয়, আপনি খেয়াল করে দেখুন এখন মানুষ কতটা সচেতন এসিড ক্রাইম নিয়ে!
আরেকটা টিভি কমার্শিয়ালের কথা না বললেই নয়। যার স্লোগান ছিল, "বাঁচতে হলে জানতে হবে।"
হ্যা এটা এইডসের একটা বিজ্ঞাপন ছিল। মানুষ কে এইচ আই ভি এইডস রোগের সম্পর্কে সচেতন করতেই ঢালাও ভাবে এই বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়েছিল। পাঠ্য বইয়ে যোগ করা হয়েছিল একটি গল্প এইডস নিয়ে। চারিদিকে বিলবোর্ডে দেখা যেত এইডসের এই স্লোগান, "বাঁচতে হলে জানতে হবে।" আর এইডস থেকে রক্ষায় করনীয় কিছু জিনিস, তার সাথে থাকতো কি কি কারণে এইডস ছরায় তার কিছু টপিক। লক্ষ্য করুন, আজকের প্রজন্ম এইডস সম্পর্কে কতটা জানে? তাদের মুখস্ত হয়ে গেছে এইডস সম্পর্কিত সব তথ্য। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে সচেতনতার জন্যে। এবং আজকে আমরা সচেতন। বাংলাদেশ একটি এইডস ঝুকিপুর্ন দেশ ঘোষণা করা হলেও সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়াতে পাব্লিক এওয়ারনেস বেড়েছে, বাংলাদেশে এইডস সেভাবে ছড়ায়নি।
এভাবে বিজ্ঞাপন এবং সঠিক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আমাদের দেশ একের পর এক বড় সমস্যা থেকে উত্তরণ হয়ে আসছে, এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে,
১, পরিবার পরিকল্পনা, দুটি সন্তান ই যথেষ্ট
২, জন্ম নিয়ন্ত্রণ
৩, শিশুশ্রম বন্ধ (আমার নাম আবুল হোসেন, সেই টিভি এড সবার মন কেড়েছিল)
৪, টিকাদান (আপনার শিশুকে টিকাদিন, মারাত্নক কয়েকটি রোগ থেকে শিশুকে রক্ষা করুন)
৫, নারী শিক্ষা
৬, মেয়েদের ধনুষ্টংকারের টিকা দান
৭, গর্ভবতী নারীর সচেতনতা এবং করনীয় এছারাও অনেক।
এবারে চলুন দেখি উপরে বর্নিত সমস্যা ধারাবাহিকতায় চলে আসা আরেকটি ইস্যু। বর্তমানে বহুল আলোচিত এই ইস্যুটি হচ্ছে ধর্ষণ ।
প্রথমেই জেনে নেই ধর্ষণ কি?
বিশ্ববিখ্যাত তথ্যকোষ উইকিপেডিয়া-র মতে, Rape is a type of sexual assault usually involving sexual intercourse, which is initiated by one or more persons against another person without that person's consent.অর্থাৎ ধর্ষণ হচ্ছে এমন একটি যৌন প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর পূর্বক এক বা একাধিক মানুষ অন্য মানুষের উপর নির্যাতন করে থাকে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা হচ্ছে, "physically forced or otherwise coerced penetration – even if slight – of the vulva or anus, using a penis, other body parts or an object"অর্থাৎ, শারীরিক ভাবে জোর পুর্বক কারো যৌন অঙ্গে লিঙ্গ কিংবা অন্য কোন শারীরিক অঙ্গ দিয়ে নির্যাতন। খুব মজা লাগতেছে পড়তে? মজা পাবার মত কিছু নেই। একবার চিন্তা করুন আপনারও মা বোন কিংবা বউ গার্লফ্রেন্ড আছে।
এবারে জেনে নেই ধর্ষণের টার্গেট গ্রুপ কারা?
ধর্ষণের সূত্রপাত আজ কিংবা কাল হয়নি, এটি মানব জাতির ইতিহাসের শুরু থেকে চলে আসছে। ধর্ষণ আসলে সংঘঠিত হয় যার মাধ্যমে তাকে বলা হয় ধর্ষক আর যে ভিকটিম তাকে বলা হয় ধর্ষিত/ ধর্ষিতা। মার্কেটিং এ টার্গেট গ্রুপ ক্রেতা হলেও ধর্ষকের টার্গেট গ্রুপ নারী। কখনো এর ব্যাতিক্রম দেখা যায়। যেমন বছর কয়েক আগে তিন নারী মিলে পাকিস্তানে এক যুবককে টানা তিন দিন ধর্ষণ করেছিল।
যাক, এটা ব্যাতিক্রম, এবং খুব কম ক্ষেত্রেই ঘটে। মূল ব্যাপার হচ্ছে ধর্ষকের টার্গেট নারী, সেই নারী যে বয়সের হোক। পাঁচ বছরের শিশু থেকে শুরু করে সত্তর বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত ধর্ষণের স্বীকার হচ্ছে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় ধর্ষিতদের মধ্যে ৯১% নারী বাকি ৯% পুরুষ। আদিম কালের ইতিহাস এবং বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে দেখা যায় ধর্ষণের আসল স্বীকার নারীরা। মনে রাখবেন, ধর্ষক আমাদের মাঝেই আছে আর সেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত একজন।
ধর্ষক কে?
সোজা কথায় ধর্ষক হচ্ছে একটা মানসিক রোগী। আর এই রোগের জন্ম দেয় সিনেমা, চটি বই, পর্ন সাইট ও সিডি ডিভিডি আর এক্ষেত্রে আবার অনেকাংশে দায়ি চটকদার ধর্ষণের খবর খুব রস সহকারে লেখা সাংবাদিক। তারা এমন ভাবে রস মিশিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে যে ধর্ষক সেই কাহিনী শুনে আরও ইন্সপায়ারেশন পায়। অথচ সংবাদপত্র যতটা মজার করে ধর্ষণের কাহিনী লেখে ততটা কাহিনী করে ধর্ষণের শাস্তি এবং বিচার লেখে না। সব শালা কমার্শিয়াল কুত্তা। সিনেমার সেরা ডায়ালগ, " আজ তোমাকে কে বাঁচাবে সুন্দরী?"
ধর্ষিতের প্রতিক্রিয়াঃ
ধর্ষণের স্বীকার নারীদের অধিকাংশই লোকলজ্জার ভয়ে চুপ করে থাকেন। তারা থানায় ডায়েরী করেন না, মামলা করেন না। ডক্টরের কাছে সঠিক তথ্য দেন না। যা বললাম তা ঘটে ধর্ষণের পরে বেচে যাওয়া নারীদের ক্ষেত্রে। আর যেসব নারী বা মেয়ে মারা যায়, মৃত্যুর পরেও তাদের ধর্ষিত হতে হয়। হুজুর জানাজা পড়াতে চায় না অনেক্ষেত্রে দেখা যায়, লাশ বার বার ময়না তদন্তের জন্যে উঠানো হয় অর্থাৎ মৃত্যুর পরেও শান্তি নেই! কি দুনিয়া!
ধর্ষিত হওয়ার পরে বেঁচে যাওয়া অধিকাংশ নারীই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। অনেকে মানুষ দেখলেই ভয়ে আঁতকে উঠেন। প্রচুর রক্তক্ষরণে শারীরিকভাবে ক্ষতি হয়। আর আমাদের সমাজের কথা আর নাই বললাম, সে নিজেই অসুস্থ।
চলুন জেনে নেই ধর্ষণ এবং বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়?
সম্মতি ছাড়া যৌন মিলন ও কিন্তু ধর্ষণের সংজ্ঞার মধ্যে পরে। সেই হিসেবে বাংলাদেশের লাখ লাখ নারী নিজ স্বামীর হাতেই ধর্ষণের স্বীকার হচ্ছেন। আচ্ছা বাদ দেই স্বামী স্ত্রীর নিজেদের ব্যাপার, তারা নিজেরাই নিজেদের সামলে নিতে পারেন। বাংলাদেশে নাবালিকা থেকে শুরু করে সব শ্রেনির নারীই ধর্ষণের স্বীকার হতে পারেন। আর ধর্ষণের পরে অধিকাংশ সময়েই দেখা যায় ধর্ষক খুন করে ফেলে, যাতে প্রমাণ বেঁচে না থাকে।
বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ৩৭৫ এবং ৩৭৬ ধারা মোতাবেক ধর্ষণ একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি তারপরে আছে যাবজ্জীবন , যদিও সব সময় ফাঁসি প্রদান করা হয় না। পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে ধর্সনের আলাদা শাস্তি আছে, যেমন ইসরাইলে পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলা হয় আবার ইংল্যান্ডে ওষুধ প্রয়োগে নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হয়। আবার ধর্ষণের চেষ্টা প্রমানিত হলে অন্য শাস্তি বাংলাদেশে, সর্বোচ্চ দশ বছরের জেল আর সর্বনিন্ম পাঁচ বছর আর অর্থদণ্ড।
আরে ভাই, ধর্ষণের চেস্টা প্রমানিত হওয়া মানে কি? এটারে ফাঁসি দিবি না কেন? কিছুদিন আগে ধর্ষণের চেষ্টা করে এক বছর জেল খাটা এক খাটাশ জামিনে বের হয়ে ঠিকি মেয়েটাকে ধর্ষণ করে হত্যা করলো। এইটার দায় নিবে কে? ধর্ষণের চেষ্টা প্রমাণ হলে তাকেও যাবজ্জীবন কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে ফাঁসি দেয়া হোক।
ধর্ষণ শব্দটিকে ধর্ষণ করতে আমাদের করণীয়ঃ
সেদিন এক ছেলে বাংলাদেশে এক বন্ধুর সাথে কথা বলতেছে। দেশের বন্ধুটি তাকে বলতেছে দেশে খুব ধর্ষণ হচ্ছে, এপাশ থেকে শুনে সে খুব উত্তেজিত, কিভাবে কে কেমনে করতেছে। খুশিতে দেশের বন্ধুর কাছে জানতে চাচ্ছে। পাশ থেকে সব শুনছিলাম। ফোন রাখার পরে আমার স্বভাবসুলভ দিলাম খিচ্চা এক ঝারি। ব্যাটা ধর্ষণের খবরে খুশি হওয়ার কি আছে? ধর্ষণের শাস্তি জানস? ৩০ দিনের মধ্যে ফাঁসি। আমার কথা শোনার পরে সে চুপসে গেলো। আসলে ৩০ দিনে ফাঁসি হয় না। একটা সাইকো ঠিক করতে যদি মিথ্যা কথা বলতে লাগে তা বলা পাপ না আমার কাছে।
যাইহোক, আসলে রেইপ নিয়ে মিডিয়ার লাফালাফি এটাকে এখন খুব জনপ্রিয় একটা সিস্টেমে পরিণত করেছে। এখন মিডিয়ার উচিৎ ধর্ষণের শাস্তি আর শাস্তির উদাহরণ ঢালাও ভাবে প্রচার করা। কাকা কাকে ধর্ষণ করা হচ্ছে তা প্রচার না করে কাকে কাকে ধর্ষণের দায়ে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে তা হেডলাইনে তুলে আনা। সরকারের উচিৎ এক্ষেত্রে বিচার কাজ আরও দ্রুত করা।
এইডস, এসিড ক্রাইমের মত এই ব্যাপারে সচেতনতা এবং শাস্তি নিয়ে ক্যাম্পেইন করা। বিজ্ঞাপনে সয়লাব করে তোলা চারিদিক। অতীতেও বাংলাদেশ অনেক ক্রাইসিস থেকে উঠে এসেছে, এবারো আসবে বিশ্বাস করি। বাংলাদেশ মানেই প্রতিদিন যুদ্ধ করা একটি দেশ। এদেশে রাজাকারের যেমন ঠাই নেই, কিছুদিন পরে দেখা যাবে ধর্ষক কেও প্রশ্রয় দিবে না এ দেশ। সুতরাং ধর্ষণ বন্ধে প্রয়োজন, সচেতনতা এবং সচেতনতা। আপনি এই ব্যাপারে সচেতন হোন, আপনার পরিচিত ব্যাক্তিটিকে সচেতন করে তুলুন।