এক ছুটির দিনে হুট করেই মেনিলা চলে এলো আমার ফ্ল্যাটে। আমি তখন সমরেশ মজুমদারের বই ‘দায় বন্ধন’ পড়ছিলাম। দড়জা খুলে মেনিলাকে দেখে মনে হচ্ছিল উপন্যাসের নায়িকা স্বাতীলেখা দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। মেনিলা ছাই রঙয়ের শাড়ি পড়েছে। শাড়ি কুঁচি ঠিকভাবে দেয়া হয়নি। হাতে চুড়ি, কপালে টিপ। চোখে কাজল দিয়েছে খুব গাড় করে। দড়জায় দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষন। মেনিলা মিষ্টি করে হেসে বলল,”কেমন দেখাচ্ছে আমাকে?”
“তুমি এই অসময়ে? তাও আবার এই ড্রেসে!”
“বললে না তো, কেমন লাগছে?”
“খুব খুব সুন্দর। মনে হচ্ছে একটি এঞ্জেল নেমে এসে পাখা হারিয়ে ফেলেছে।“
“সত্যি বলছো নাকি দুস্টমি করছো রিক?”
“আমি সিরিয়াস, তোমাকে সত্যিই সুন্দর লাগছে”
“তুমি তৈরি হও ঝটপট, আজ তোমাকে নিয়ে বেড়াতে যাবো। যাস্ট টুয়েন্টি মোর মিনিটস অন ইউর হ্যান্ড। হ্যারি আপ।“
“কোথায় যাবে?”
“এখন বলা যাবে না, তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।“
আমি যথাসম্ভব দ্রুত তৈরি হয়ে নিলাম। বেড়িয়ে পরলাম মেনিলার সাথে। আমাকে অবাক করে দিয়ে মেনিলা গাড়িতে রবীন্দ্র সঙ্গীত ছেরে দিলো। আমি অবাক হয়ে মেনিলাকে দেখছিলাম আর মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম, "বধূ কোন আলো লাগলো চোখে"
প্রায় দু’ঘন্টার পথ পেরিয়ে মেনিলা আমাকে নিয়ে গেলো সি-বীচে। শিশুর মত দৌড়ে মেনিলা এগিয়ে গেলো সমুদ্রের ঢেউয়ের দিকে। ফিরে এসে হাত টেনে আমাকে নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো হাটু জলে।
মেনিলা আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “রিক, তোমাকে কিছু বলতে চাচ্ছি, সে জন্যেই এখানে আসা।”
“হুম বলো।”
“স্যোলমেট বলে যে কিছু আছে, তা কি তুমি বিলিভ করো?”
“থাকতেও পারে”
“তুমি কি জানো আমি ছোট বেলা থেকে তোমাকে স্বপ্নে দেখে আসছি।“
“তাই নাকি?”
“হ্যা, তারপরে যখন একটু বড় হলাম, আমি চোখ বন্ধ করলেই দেখতাম তোমাকে। প্রথম প্রথম ভয় করতো তুমি এশিয়ান বলে। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম তোমার জন্যেই আমি এসেছি”
“আমি তো কখনো দেখিনি তোমাকে”
“হতে পারে, আবার এমনো হতে পারে তুমি খেয়াল করোনি আমি এসেছিলাম তোমার স্বপ্নে। আমাদের অনেকেই স্বপ্ন ভুলে যায়। আমি কোন বিপদে চোখ বন্ধ করে তোমাকে ডাকতাম। তোমার কথায় কত বিপদ থেকে আমি উদ্ধার হয়েছি! তোমার মন খারাপ থাকলে বুঝতে পারতাম। আচ্ছা রিক, আজ থেকে পাঁচ বছর আগে কি তুমি কোন কারনে খুব বেশী ডিপ্রেসড ছিলে? আমার মন তখন বলছিল তুমি খুব প্রবলেমে আছো। আমার ইচ্ছে করতো ছুটে যেতে তোমার কাছে, কিন্তু আমি তোমার ঠিকানা জানতাম না। আমি চোখ বন্ধ করলে তোমাকে দেখতে পেতাম না তখন।“
আমি আরও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ঠিক পাঁচ বছর আগে আমি সত্যিই ডিপ্রেসড ছিলাম। আমি তখন ভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। রাত্রির সাথে আমার সম্পর্ক খুব ভালোই চলছিলো। রাত্রি আমাকে এতটাই ভালোবাসতো যে ওকে ছারা আমি একটি মুহূর্ত কল্পনা করতে পারতাম না। আর রাত্রিও ছিল তেমনি পাগলী। সময় খুব ভালোই কাটছিলো আমাদের। হঠাত করেই একদিন জানতে পারলাম রাত্রি হসপিটালে ভর্তি। আমি ছুটে যেয়ে দেখলাম সাদা চাদর বিছানো একটি বেডে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে রাত্রি। মুখে অক্সিজেন মাস্ক। আমি নিথর হয়ে তাকিয়ে রইলাম। রাত্রির বড়ভাই যখন হাত রাখলো আমার কাঁধে, সম্ভিত ফিরে পেলাম। আমাকে ধরে শব্দ করে কেঁদে ফেললেন তিনি। আমি লক্ষ্য করলাম কাঁদতে পারছি না আমি। তাকে সান্তনা দেয়ার একটি বাক্যও আসছে না আমার মুখে। আমি শুধু তাকিয়ে ছিলাম গায়ে নীল চাদর টেনে দেয়া রাত্রির মুখের দিকে। ঠোঁটদুটো শুকিয়ে আছে। স্যালাইনের বোতল থেকে সরু একটি নল এসে রাত্রির হাতে থেমেছে।
রাত্রির বড়ভাই আমাকে বাইরে বারান্দায় নিয়ে গেলেন। খুলে বললেন সব। দু’দিন আগে রাত্রি হঠাত প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হয়। ভর্তি করা হয় হসপিটালে। টেস্ট করার পরে ধরা পরে রাত্রির দু’টো কিডনিই অকেজো হয়ে গেছে। এখন হাতেও তেমন সময় নেই কিছু করার। খুব বেশিদিন ও থাকবে না আমাদের মাঝে। আমি পাথরের মত শুনছিলাম সব। আমার চোখে জল আসেনি একফোঁটাও।
শেষদিনে ডক্টর এসে আমাকে নিয়ে গেলো রাত্রির কেবিনে। চোখ মুখ উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল রাত্রির। ছারা চুলে কতটা সুন্দর যে লাগছিল ওকে। মনে হচ্ছিল ওর চোখ জলে টলটল করছে। আমি ঢুকতেই ডান হাতটা উঁচু করে বাড়ালো আমার দিকে। আমি এসে ধরলাম ওর হাত। বেডে ওর পাশে বসে ওর হাতটা ছুঁইয়ে দিলাম গালে। ওর ছলছল চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো জল। আমি ওর চোখের জল মুছে চুমু খেলাম কপালে। শান্ত ছোট ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় রাত্রি বললো,”খেয়াল রেখো নিজের”
আমি মাথা নাড়লাম। বললাম, ”কিছু হবে না রাত্রি, দু’দিন পরেই তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে।“
“কেন মিথ্যে আশ্বাস দিচ্ছো? তুমি ভালো থেকো রিক। অনেক ভালোবাসি তোমাকে।“
“তুমি একটু ঘুমাও, খুব কি খারাপ লাগছে?”
“ঘুমিয়েই তো পড়বো। আর একটু জেগে থেকে দেখি তোমাকে। জানো, তোমাকে যতই দেখি আরও দেখতে ইচ্ছে করে। তুমি সত্যিই খুব ভালো।“
ঘুমিয়ে পরে রাত্রি। আমি বেরিয়ে যাই কেবিন থেকে। সন্ধ্যায় হসপিটালে ফিরে দেখি রাত্রি আর নেই। আমার সামনে দিয়েই তাকে এম্বুলেন্সে তোলা হলো। রাত্রি সেই রাত্রিই আছে, শুধু প্রান নেই নিথর দেহে। আমি তখনো কাঁদিনি। প্রথম যেদিন ফুল হাতে দাঁড়ালাম ওর কবরের পাশে, বুক ফেটে কান্না বেড়িয়ে এলো। আমি বুঝতে যে পৃথিবীর সেরা জিনিস আমি হারিয়ে ফেলেছি। আমি ওর কবরের মাটি হাতড়ে খুঁজতাম রাত্রির স্পর্শ।
প্রায় দু’বছর কেটে যায় এভাবে। আমি ভার্সিটি থেকে পাশ করে স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে চলে আসি। কিন্তু একটি মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারিনি রাত্রিকে। প্রায়ই আমার কল্পনায় দাঁড়ায় রাত্রি। খুব হেসে আমাকে বলে, “তুমি এখনো বোকাই রয়ে গেলে। তোমাকে খুব ভালোবাসি বোকাছেলে। তুমি সত্যিই খুব ভালো।“
মাঝে মাঝে রাত্রির স্মৃতি চিহ্ন বের করে দেখি। আমার বার্থডেতে ওর দেয়া রিষ্টওয়াচ, ওর হাতের একটি চুড়ি আর একটি খোপায় দেয়ার কাঁটা। খুব সাধারন, আবার পৃথিবীর সব থেকে অসাধারন।
“রিক, শুনতে পাচ্ছো?”
“হু, বলো” মেনিলার ডাকে চমকে উঠে সম্ভিত ফিরে পেলাম।
“আমি সেই ছোট বেলা থেকেই ভালবাসছি তোমাকে। আমি জানতাম একদিন তোমার দেখা পাবো। যেদিন বারে প্রথম তোমাকে দেখলাম, চমকে উঠেছিলাম। হয়ত সেদিনটির জন্যেই আমার জন্ম। সেই থেকেই তোমার পেছনে ছায়ার মত আছি। জানো যেদিন বাস্তবে তোমাকে দেখলাম, সেদিন থেকে চোখ বন্ধ করে তোমাকে আর দেখতে পেতাম না। সেদিন আমার মন বলছিল তুমি বরফে আটকে যাবে। আমি ছুটে এসে দেখি সত্যিই। রিক, সত্যিই তোমাকে আমি ভালোবাসি। তোমাকে ছারা বাকি জীবন আমি ইমাজিন কতে পারি না।“
“মেনিলা, আমি কেউ একজনের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছি। আমি পারবো না সেই স্মৃতির সাথে ঘাতকতা করতে। আমি প্রথম থেকেই জানতাম তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমি তাই পাশ কাটানোর জন্যে না বুঝার ভান করতাম। আমি কিছুদিন পরেই ফিরে যাব সেই মিইয়ে যাওয়া স্মৃতির কাছে।“
“ও আচ্ছা, তাহলে সত্যি করে বলবে কি তুমি আমাকে স্বপ্নে দেখতে পেতে কি না?”
“না, আমি কখনোই তোমাকে দেখিনি।“
ফেরার পথে একটিও কথা বলেনি মেনিলা। কিছুদিন পরে আমি ফিরে আসি দেশে। বাকিটুক জীবন আমি বেঁচে থাকতে চাই রাত্রির স্মৃতিতে ডুবে। মেনিলাকে সেদিন মিথ্যে বলেছিলাম। আমি ছোট বেলা থেকেই স্বপ্নে এক বিদেশিনীকে দেখতাম। ঠিক যেন মেনিলার মত। রাত্রির সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে আমি আর তাকে দেখিনি। জীবনে কিছু অপূর্ণতা থাকে। থাকনা আমার জীবনটাও অপূর্ণ, অগোছালো আর অতৃপ্ত।
The Ring Of Bright Water.
নির্মল স্বচ্ছ পানিতে যখন ঢিল ফেলা হয়, তখন কেন্দ্র থেকে একের পর এক গোলাকার চাকতির মত রিং নির্গত হয়। যাকে ‘স্বচ্ছ জলে বিন্দুর ঢেউ’ বলা যায়। আমি সেই বিন্দু থেকে যতদুরেই মিলিয়ে যাই না কেন, উৎপত্তি সেই বিন্দুতেই। আমি সেই বিন্দুকেই ঘিরে। কিন্তু বিন্দু থেকে যে ঢেউ ছড়িয়ে পরে, সে কখনো কোনদিনেও আর ফিরে আসে না বিন্দুর কাছে। সে ঢেউ কখনো ফিরবার নয়। ঢেউ তীরে এসে পৌঁছে, কিন্তু বিন্দু মিলিয়ে যায় স্বচ্ছ জলে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০১১ সকাল ৮:৩০