আমরা যে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে আমাদের নিজেদেরকে শিক্ষিত করছি সেই শিক্ষাব্যবস্থাটি আমাদের নিজেদের তৈরি করা নয়। এটা ব্রিটিশ আমলে তাদের নীতিনির্ধারকরা তৈরি করে দিয়ে গেছেন। আমরা ভৌগোলিক স্বাধীনতা পাওয়ার পর তাদের নির্মিত সেই ইমারতে দু একটা কামরা, দরজা জানালার রদবদল করেছি বলা যায়, কিন্তু মৌলিক কোনো পরিবর্তন আনি নি। যে শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছিল অন্য একটি জাতিকে উৎকৃষ্ট দাস বানানোর জন্য সেই শিক্ষা আমরা স্বাধীন হয়েও নিজেদের ও নিজেদের সন্তানদের জন্য বহাল রেখেছি। এর পরিণাম যা হওয়ার তা-ই হয়েছে, আজও আমরা মনে-মগজে এবং জীবনকাঠামোতে সেই পশ্চিমা প্রভুদের দাসত্বই করে যাচ্ছি। পার্থক্য এই যে, আগে তারা আমাদের জনগণকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করত, আর এখন আমাদের সরকাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে।
আমরা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে বাস করি। শিক্ষাব্যবস্থাতেও সেই দুর্নীতির প্রবল আধিপত্য। যদিও আমাদের ছেলেমেয়েরা প্রতি বছর বিপুল হারে পাশ করছে, তাদের বিজয়চিহ্নিত হাস্যোজ্জ্বল মুখ আমাদেরকে আনন্দিত করছে কিন্তু এই পাশের হারই শেষ কথা নয়। একটি গাছের ফল দেখেই আনন্দিত হওয়ার কিছু নেই, সেই ফল কতটুকু খাদ্যোপযোগী, সেটা বিষাক্ত না পুষ্টিকর সেটাই আসল বিবেচ্য হওয়া উচিত। দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রকাঠামোতে এই ভালো ফল করা ছেলে মেয়েরা যখন নিজেদের জায়গা খুঁজে নেয়, তখন তারাও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। একটি পাত্র যেমন পানির আকৃতিকে নিজের মতন করে নেয়, তেমনি এই ধ্বংসপ্রাপ্ত পচে যাওয়া সমাজ কাঠামো আমাদের চরিত্রকে ধ্বংস করে দেয়, মনুষ্যত্বকে গলিত শবে পরিণত করে। ফলে পাশের পরিসংখ্যানে আমাদের বিদ্যাশিক্ষার অহঙ্কার যতই বৃদ্ধি পাক জাতিগতভাবে আমরা দিন দিন আরো অপদস্থ হই, হীনতায় নিমজ্জিত হই। আমাদের শিক্ষিত মানুষগুলো হাজার হাজার কোটি ডলার বিদেশে পাচার করছে, আমাদের পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা থেকে শুরু করে প্রথম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। এই জাতিবিধ্বংসী কাজে জড়িত থাকছেন আমাদের শিক্ষকেরা। ছাত্ররা প্রায়ই আবার শিক্ষকদের ধরে পেটাচ্ছে। শিক্ষকরা আবার বেতনের জন্য অনশন করছেন। আমরণ অনশন অর্থাৎ তারা পন করেছেন যে মারা যাবেন। কতুটুকু বেদনার্ত হলে মানুষ শেষতক মরতে যায়!
এই যে অব্যবস্থা আর অস্থিরতাগুলোর মধ্যে দিয়ে আমাদের বছরগুলো কেটে যাচ্ছে, এই অবস্থাকে আমরা বিধির লিখন বলে মেনে নিয়েছি, এর পরিবর্তন করা আমাদের সাধ্যাতীত বলেই যেন ধরে নিয়েছি। এখন সবাই চাকরি করছে, সকাল বিকাল অফিস করছে, মাস শেষে বেতন পাচ্ছে। দেশ রসাতলে যাচ্ছে, প্রজন্ম ধ্বংস হচ্ছে হোক না, আমি তো আমার বেতনটা পাচ্ছি, ইনক্রিমেন্ট পাচ্ছি। সেটা অপর্যাপ্ত মনে হলে তার জন্য আন্দোলন করছি। আমরা ধরেই নিয়েছি যে সিস্টেমের এই জগদ্দল পাথর পরিবর্তন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, এটা আমাদের কাজ নয়, এটা নিয়ে চিন্তা করাটাও সময়ের অপচয়। আমার জীবনটা উপভোগ করা আর নিজেকে নিয়ে ভাবাটাই আমার আসল কাজ। যারা এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেন তারাও ঐ বলা পর্যন্তই। তাদের নাম বুদ্ধিজীবী। তারা বিপ্লব ঘটাতে পারেন না, ঘটাতে চানও না। কারণ প্রতিষ্ঠিত সমাজ কাঠামোতে তাদের অবস্থানটা পাকাপোক্ত রাখতে হবে। সমাজ পাল্টানোর চেষ্টা করলে সেটা তাদের ব্যক্তিগত জীবনে দুর্যোগ বয়ে আনতে পারে। আমলাতান্ত্রিকতার যে মাকড়সার জাল ব্রিটিশরা বিছিয়ে দিয়ে গেছে সেখানে আমাদের সমাজ যেন আটকে পড়া পতঙ্গের মতই অসহায়।
এই মাকড়সার জাল ছিড়তে হবে, সমাজটাকে নিজেদের জন্য উপকারী কাঠামোয় বিন্যস্ত করতে হবে। এই বৃহৎ চিন্তাটা হেযবুত তওহীদ করতে পারে কারণ আমাদের কাছে বিকল্প সেই ব্যবস্থা, যেটা দিয়ে নিশ্চিতরূপেই সার্টিফিকেট আর চারিত্রিক উৎকর্ষের মধ্যে, বস্তুগত উন্নতি ও সামাজিক শান্তির মধ্যে, প্রগতিশীল ভাবনা ও বিবেকের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা হবে। সেই পবির্তন সাধনের রূপরেখা আল্লাহর রহমে আমাদের কাছে আছে। কিন্তু সেটা গ্রহণের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন এই জাতির মধ্যে বোধের জাগরণ যা দিয়ে তারা বর্তমান পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে অনুভব করবে, ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো সুস্পষ্টভাবে দেখতে সক্ষম হবে এবং এর আমূল পরিবর্তনের জন্য সংকল্পবদ্ধ হবে। এই বোধের জাগরণের জন্য তাদেরকে জানতে হবে এই শিক্ষাব্যবস্থার গোড়ার কথা।
ব্রিটিশরা যখন ভারতবর্ষকে অধিকার করে নেয় তখন ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের থেকে অনেক উন্নত ছিল। এখানে মুসলিম বংশোদ্ভূতদের শাসন চলছিল যার শাসনব্যবস্থা পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর দেওয়া ব্যবস্থা না হলেও ইসলামের বহু মূলনীতি এখানে কার্যকর ছিল। যার পরিণামে এখানে রাজনৈতিক গোলোযোগ কম ছিল, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল, সামাজিক নিরাপত্তা ছিল। হাজার বছরের মুসলিম শাসনে একটিও দুর্ভিক্ষ হয় নি। গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছ এই বাগধারাগুলো সেই সময়ের বাংলাসহ সমগ্র ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হতো। সমস্যা ছিল শাসকদের বিলাসিতা, গা-ছাড়া ভাব আর প্রাসাদ ষড়যন্ত্র নিয়ে। এসবের ফাঁক ফোকর গলেই ব্যবসায়ীর বেশ নিয়ে ইংরেজরা এদেশে আসে এবং ধীরে ধীরে তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে। তারপর ষড়যন্ত্র ও সামরিক শক্তিবলে তারা মুসলিম শাসকগোষ্ঠীকে সিংহাসনচ্যুত করে ধীরে ধীরে নিজেরা এদেশের শাসনব্যবস্থাকে নিজেদের মতো করে ঢেলে সাজায়। বাদশাহ নবাবদের হাত থেকে প্রশাসনিক ক্ষমতা ও কর সংগ্রহ (নিজামত ও দেওয়ানী) ছাড়াও বিচারকার্য, শিক্ষাব্যবস্থা প্রভৃতি নিজেদের করায়ত্ব করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন যিনি তিনি আর কেউ নন- বড়লাট লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস। ভারতবর্ষের জমিতে ‘ইতিবাচক ভঙ্গিতে’ ব্রিটিশ শাসনের শেকড় বিস্তার সম্ভব হয়েছিল তাঁর মত কর্মকুশলী, কূটনীতিজ্ঞ আর ঝানু রাজনীতিকের বদৌলতে এ কথা ঐতিহাসিকগণ বিনা বাক্যব্যয়ে স্বীকার করবেন।
তিনি তথা ব্রিটিশ নীতিনির্ধারকগণ এতদঅঞ্চলের পূর্বতন শাসক জাতি মুসলমানদেরকে মানসিক দাসে পরিণত করার জন্য একটি বিকৃত ইসলাম শিক্ষা দিতে চাইলেন যেন তারা ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে, মুসলিমরা যেন রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়েই মাথা ঘামানো ভুলে যায়। তারা যেন কেবল নামাজ রোজা করে পরকালের মুক্তিকেই ধর্মের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে নেয় আর ব্যক্তিগত জীবনের মাসলা-মাসায়েল নিয়ে ফেরকা-মাজহাব আর দলাদলিতে ব্যস্ত থাকে এটা ছিল তাদের চাওয়া। এই চাওয়া পূরণ করার জন্য তারা ১৭৮০ সনে কলকাতায় আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করল যেখানে তাদের দেশের খ্রিষ্টান প-িতদের তৈরি করা একটি ইসলামর সিলেবাস ও কারিকুলাম মোতাবেক মুসলিমদেরকে তারা শিক্ষা দিতে শুরু করল। মুসলিমরা ভাবলো খ্রিষ্টানরা তো বেশ, আমাদেরকে ইসলামও শেখাচ্ছে। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মুসলিমদের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। অতঃপর মুসলিমরা ১৪৬ বছর সেই খ্রিষ্টানদের কাছ থেকে ইসলাম শিখল যে ইসলাম আজ পর্যন্ত আমাদের মনে মগজে বসত করে। আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলাম কেমন ছিল সে আকিদা বা ধারণা আজ আমাদের কাছে সম্পূর্ণরূপে অপরিচিত।
পাশাপাশি বিরাট একটি উপনিবেশকে পরিচালনা করতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে আর্দালি, পেয়াদা, পুলিশ, কেরানি জাতীয় কাজগুলোতে নিয়োগ দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। এই আজ্ঞাবহ একটি গোষ্ঠী পয়দা করাও অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। এই গোষ্ঠীটির জন্য প্রভুর ভাষা ইংরেজিতে মোটামুটি দক্ষতা প্রয়োজন ছিল কারণ ভাষার দূরত্ব বড় দূরত্ব, এতে ভাবের আদান প্রদান প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এজন্য তারা চালু করল সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা যাকে আমরা ইংরেজি শিক্ষা বা আধুনিক শিক্ষা বলে জানি। এখানে প্রথমত শিক্ষা দেওয়া হলো যে, ইংরেজরা পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত জাতি, শ্রেষ্ঠ জাতি। তাদের সব ভালো, তাদের কালো বলে কিছু নেই। তাদের ভাষা ভালো, তাদের সংস্কৃতি ভালো, পোশাক ভালো, মূল্যবোধ ভালো, গায়ের রং ভালো, হাসিকান্না ভালো, সাহিত্য ভালো, আইন ভালো, ধর্ম ভালো, ইতিহাস ভালো, রাজারানীও ভালো। আর ভারতবর্ষের কিছুই উন্নত না, কিছুই আধুনিক না। তাদের সেগুলোর খোলনলচে সব পাল্টাতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থার এই অংশটিতে তারা এমন একটি শিক্ষানীতি প্রবর্তন করল যার মাধ্যমে এমন একটি জনগোষ্ঠী তৈরি হয় যারা মনে মগজে চিন্তায় রুচিতে মূল্যবোধে পুরোপুরি ব্রিটিশদের আজ্ঞাবহ ও তাদের অন্ধ অনুসারী-অনুকারী হয়ে ওঠে।
ব্রিটিশরা যখন চলে গেল তখন এই মানসিক দাসদের হাতেই সরকারী কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব ছেড়ে গেল। আজও সেই পরম্পরা চলছে। মাদ্রাসা শিক্ষিতরা রয়ে গেছে ধর্মব্যবসা করে জীবিকানির্বাহের কাজে। তারা মানুষকে মাসলা-মাসায়েলের ওয়াজ করে পরকালে জান্নাতে যাওয়ার পথ দেখাচ্ছে। জাতীয় অঙ্গনে তারা অচ্ছুৎ, অযোগ্য। আর জাতীয় জীবনের সবকিছু এবং বিশেষ করে গণমাধ্যম সেই ইংরেজি শিক্ষিত দাস শ্রেণিটির হাতে।
প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যে অপরাধীদেরকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হতো। অপরাধীরা আদালত প্রাঙ্গন থেকে নিজেদের ক্রুশ নিজেরাই বহন করে নিয়ে নগরের বাইরে ক্রুশবিদ্ধ করার নির্দিষ্ট জায়গায় যেতেন। আমরা যেন সেই অপরাধী যারা স্বেচ্ছায় নিজেদের কাঁধে এমন একটি ক্রুশতুল্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বহন করে যাচ্ছি যা আমাদেরই যন্ত্রণাদায়ক পরিণতি বয়ে আনছে। কেবল চিন্তার ঐক্য নেই বলে আমরা এই ক্রুশকে ঘাড় থেকে ছুঁড়ে ফেলতে পারছি না। বলতে পারছি না যে, ঢের হয়েছে আর না। এবার আমরা সত্যিকার অর্থে স্বাধীন হবো। জগৎবাসীকে দেখিয়ে দেব আমরা নিজেদের মত করে বাঁচতে জানি।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ২:১৬